আত্মগঠনের মাস : রমযান

রমযান মাস হলো সকল পাপ-পঙ্কিলতাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাইভস্ম করে ফেলার মাস। রমযান মাস শেষে একজন রোযাদার সম্পূর্ণ নিষ্পাপ শিশুর মতো নতুন জীবনের অধিকারী হয়ে উঠবেন-এটাই এ মাসের দাবী। রমযান শব্দটির মূল ধাতু বিশ্লেষণ করলেও তাই দাঁড়াবে। রমযান একটি আরবি শব্দ। এর শব্দমূল হলো রা-মিম-দোয়াদ বা রাময।আরবি ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত গরম,কঠোর সূর্যতাপ,দহন,জ্বলন,তৃষ্ণা এবং গলে যাওয়া।রমযান মাসে যেহেতু নেক আমলের কারণে বিগত গুনাহ বা পাপগুলো বিমোচিত হয়ে যায় কিংবা গলে গলে নিঃশেষ হয়ে যায় সেজন্যেই এ মাসের নাম হলো রমযান।

এ-ও বলা হয় যে রোযা রাখার কারণে ক্ষুধা-পিপাসার তীব্রতায় রোযাদারের পেট জ্বলতে থাকে। এ অবস্থা বোঝাবার জন্যেও আরবি ভাষায় বলা হয় আসসায়েমু ইউরমাযু অর্থাৎ রোযাদার দগ্ধ হয়।রমযান তার শব্দমূলের দাবী অনুযায়ী আমাদের জীবনের সকল গুনাহ-খাতা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে-গলিয়ে নিঃশেষ করে দিক, নিষ্পাপ এক নতুন জীবনের সতেজতা নিয়ে আসুক প্রতিটি রোযাদারের জন্যে-এই প্রত্যাশায় শুরু করছি আজকের আলোচনা।

রহমতের মাস রমযান আসলে আল্লাহর বান্দাদের জন্যে বিশেষ একটি কর্মশালার মাস। একমাস ব্যাপী এই কর্মশালায় রোযাদারকে বহু বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সারা বছর জুড়ে বাস্তব জীবনের ব্যবহারিক কার্যক্রমগুলো কীভাবে করতে হবে,কীভাবে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও ঈমান রাখতে হবে,কীভাবে নিজেকে সংশোধন করতে হবে,ঘুষ খাওয়া,অপরের হক নষ্ট না করা,ব্যক্তিগত অসৎ গুণাবলী থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা এবং সৎ গুণাবলী অর্জন বিশেষ করে কীভাবে চরিত্র গঠন করতে হবে হবে-সেসব শিক্ষা এ মাসে পাওয়া যায়।তাই রমযান মাস হলো আত্মগঠনের মাস ব্যাপী কর্মশালা।

জীবনের লক্ষ্য স্থির করার মাসও রমযান। সারা বছর ধরে আপনি হয়তো শরীয়ত পরিপন্থী অনেক কাজ করেছেন। এখন এই রমযান মাসে এসে চিন্তা করছেন আপনি কি আপনার আগের ভূমিকাতেই অটল থাকবেন,নাকি আল্লাহর দরবারে তওবা করে তাঁর সাথে অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবেন যে কখনো আর শরীয়ত পরিপন্থী কাজে নিজেকে লিপ্ত করবেন না। যদি আপনি আপনার ভুল স্বীকার করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নতুন জীবনের লক্ষ্যে আত্মশুদ্ধির পথ বেছে নেন,তাহলে আল্লাহও আপনাকে সাহায্য করবে,আত্মোন্নয়নে সহযোগিতা করবে। এই মাসে আপনাকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আত্মশুদ্ধির পথ বেছে নেওয়াই হলো ভবিষ্যত জীবনের লক্ষ্য স্থির করে নেওয়া। আপনি যদি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেন তাহলে আপনাকে আরো বেশি তৎপর হতে হবে। আল্লাহকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রমযান মাস চলে যাবার পর পুনরায় পূর্বের কর্মকাণ্ডে ফিরে যাওয়াটা হবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা। আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা ঈমানের পরিচায়ক নয়।

আপনি যদি মুমিন হয়ে থাকেন তাহলে আল্লাহকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনার্থে আপনাকে অনেক বেশি কর্মতৎপর হতে হবে। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেছেন ইন্নাল্লাহা লা ইউগায়্যিরু মা বি কাউমিন হাত্তা ইউগায়্যিরু মা বিআংফুসিহিম অর্থাৎ আল্লাহ নিশ্চয়ই ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো জাতির পরিবর্তন করেন না,যতোক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদেরকে পরিবর্তন করে নেয়।তার মানে হলো আত্মসংশোধনের ঘোষণা দিলেই চলবে না,বরং আত্মসংশোধনের জন্যে সকল প্রকার চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এই চেষ্টা চালানোর প্রক্রিয়াটির কোনো সময়সীমা নেই। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তা চালিয়ে যেতে হবে। কেননা আল্লাহ নিজেই বলেছেন ওয়াবুদ রাব্বাকা হাত্তা ইয়া'তিকাল ইয়াকীন অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত তোমার রবের ইবাদাত করো। এ প্রসঙ্গে নবী করীম ( সা ) বলেছেন কুল আ-মানতু বিল্লাহি ছুম্মাসতাকাম অর্থাৎ বলো,ঈমান আনলাম আল্লাহর ওপর,তারপর অবিচল থাকো। অতএব রমযান মাস হলো আল্লাহর ওপর অবিচল থাকা এবং ব্যক্তিজীবনের লক্ষ্য নির্ধারণের মাস।

রমযান মাসের শুরুতেই তাই আপনাকে পুরো মাসের একটা কর্মসূচি তৈরী করে ফেলতে হবে। এই কর্মসূচিতে দিনের এবং রাতের ইবাদাতের সময় ঠিক করে নিতে হবে। কর্মসূচিগুলোর মধ্যে যা যা থাকা জরুরী তার একটা সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা দেওয়া যাক। প্রথমেই আপনাকে সাহরি এবং ইফতারের সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে নিতে হবে। অর্থসহ বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করতে হবে। সেইসাথে ইসলামী সাহিত্য বেশি বেশি পড়তে হবে।বেশি বেশি ইবাদাতের স্বার্থে কম খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে এবং কম ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে।

রাত জেগে ইবাদাত করার চেষ্টা করতে হবে।গরীব-দুখি-অসহায়দের খোজ-খবর নিতে হবে এবং তাদের প্রতি যথাসম্ভব উদার-সহানুভূতিশীল ও দয়াবান হতে হবে। দুনিয়াবি ব্যস্ততা কমিয়ে আখেরাতের চিন্তা বেশি করতে হবে। রোযাদারকে ইফতার করানোর চেষ্টা করতে হবে। দোয়া-দরুদ,জিকির-আজকার বেশি বেশি করে আল্লাহর দরবারে তওবা-ইস্তেগফার করতে হবে। আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ চেয়ে বেশি বেশি মোনাজাত দিতে হবে।দৈনন্দিন এই কর্মসূচিগুলো যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।