সূরা আ'রাফ; (১৯তম পর্ব)

সূরা আ'রাফ; আয়াত ৮৭-৮৯

সূরা আ'রাফের ৮৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَإِنْ كَانَ طَائِفَةٌ مِنْكُمْ آَمَنُوا بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ وَطَائِفَةٌ لَمْ يُؤْمِنُوا فَاصْبِرُوا حَتَّى يَحْكُمَ اللَّهُ بَيْنَنَا وَهُوَ خَيْرُ الْحَاكِمِينَ (87(

"আমাকে যা প্রেরণ করা হয়েছে যদি তোমাদের মধ্যে কোন দল তাতে ঈমান আনে এবং কোন দল ঈমান না আনে, তবে ধৈর্য্য ধারণ কর যতক্ষণ না আল্লাহ্‌ আমাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেন। আর তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ মীমাংসাকারী।" (৭:৮৭)

আগের পর্বে আমরা হযরত শোয়েব (আ.) এর সম্প্রদায়ের প্রতি তার বিভিন্ন উপদেশ ও দিকনির্দেশনা নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি, মাদইয়ানের অধিবাসীরা জিনিসপত্র বিক্রির সময় ওজনে কম দিতো এবং একে অপরের সম্পদ আত্মসাৎ করত। সমাজে ব্যাপকভাবে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় হযরত শোয়েব (আ.) সবসময় সমাজের মানুষকে আল্লাহর পথে চলতে এবং মানুষের অধিকার নষ্ট না করতে আহ্বান জানাতেন। কিন্তু কাফেররা নবীর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে বরং উল্টো ঈমানদার ব্যক্তিদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করত এবং তাদেরকে নানাভাবে অপমান-অপদস্থ করত। কাফেররা বলত- তোমরা যা বলছ তা যদি সত্যি হয়, তাহলে আল্লাহ কেন আমাদেরকে শাস্তি দিচ্ছে না। তাদের এ ধরনের বক্তব্যের কারণে ঈমানদার ব্যাক্তিদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয় এবং এক সময় তারাও বলে, হে শোয়েব (আ.) আমাদের পথই যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ কেন বিপথগামীদের শাস্তি দিচ্ছে না?

মুমিন ও কাফের-উভয় দলের প্রশ্নের জবাবে এ আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করেন না। তিনি মানুষকে ভুল করার পরও তওবা করে সঠিক পথে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেন। এ কারণে পাপ কাজ সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শাস্তি নেমে আসে না।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. যেহেতু আল্লাহ পরম দয়ালু, সে কারণে পাপ কাজ করার সঙ্গে সঙ্গেই আল্লাহ মানুষকে শাস্তি দেন না। এটা আল্লাহর মহানুভবতা। কাজেই পাপীদের দ্রুত শাস্তি না হওয়ার কারণে ঈমানদারদের হতাশ হলে চলবে না। এ ছাড়া পাপীদেরও এ জন্য গর্ব করার কিছু নেই। বরং এর মাধ্যমে তারা সংশোধনের সুযোগও হাত ছাড়া করে।

দুই. ঈমানদারকে পুরস্কৃত এবং পাপীদের শাস্তি দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ। এ কারণে কেবল তিনিই মানুষের চিন্তা-বিশ্বাস ও কাজকর্ম সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন। কাজেই কারো ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার অধিকার আমাদের কারোরই নেই।

সূরা আরাফের ৮৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا مِنْ قَوْمِهِ لَنُخْرِجَنَّكَ يَا شُعَيْبُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا مَعَكَ مِنْ قَرْيَتِنَا أَوْ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَا قَالَ أَوَلَوْ كُنَّا كَارِهِينَ (88(

"নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে মত্ত গোত্রপতিরা তাকে বললো-হে শোয়েব আমরা তোমাকে ও তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আমাদের জনপদ থেকে বের করে দেবো। যদি না তোমরা আমাদের ধর্মে ফিরে আসো। শোয়েব জবাবে বললো-আমরা রাজি না হলেও কি আমাদের জোর করে ফিরিয়ে আনা হবে?" (৭:৮৮)

সত্যের পথে যারা অবিচল তাদের প্রতি হুমকি দেয়া, অত্যাচারী ও আধিপত্যকামীদের একটি কৌশল। একই কারণে মাদইয়ানের গোত্র-প্রধানরাও শোয়েব (আ.) ও তার অনুসারীদের ওই এলাকা থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিল। যেমনিভাবে হযরত লুত (আ.)এর সম্প্রদায়ের বর্ণনা দিতে যেয়ে পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে, অপবিত্ররা লুত (আ.) ও তার অনুসারীদের বলেছিল-'যেহেতু তোমরা পবিত্র তাই আমাদের শহর থেকে তোমরা বের হয়ে যাও।'

যেহেতু হযরত শোয়েব (আ.) মাদইয়ানবাসীদেরকে অন্যায় ও অবিচারের পথ থেকে সরে আসার আহ্বান জানাতেন, সে কারণে তার কথাবার্তা তাদের ভালো লাগতো না। এ অবস্থায় তারা শোয়েব (আ.) ও তার অনুসারীদের শহর থেকে বের করে দেয়ার পরিকল্পনা করে এবং তাদের বলে, আমাদের ধর্ম মেনে নাও, অন্যথায় তোমাদেরকে এই শহর থেকে বের করে দেয়া হবে। হযরত শোয়েব তাদের উত্তরে বলতেন, তোমাদের ধর্মের প্রতি আমাদের কোন আকর্ষণ নেই। তোমরা কি আমাদেরকে তোমাদের ধর্ম মেনে নিতে বাধ্য করতে চাও?

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. ইতিহাসের সব পর্যায়েই সমাজের আধিপত্যকামী নেতারা নবী-রাসূলদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অন্যদিকে, নবী-রাসূলগণ কখনোই কোন অত্যাচারি রাজা বা শাসককে সমর্থন দেননি।

দুই. নবী-রাসূলগণ সব সময় যুক্তি দিয়ে কথা বলতেন। কিন্তু শত্রুরা হুমকির ভাষায় কথা বলতো।

তিন. কাফেররা তাদের চিন্তা-বিশ্বাস অন্যদের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। কিন্তু ঈমানদারেরা তাদের ধর্ম নিতে কাউকে বাধ্য করে না।

সূরা আরাফের ৮৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَدِ افْتَرَيْنَا عَلَى اللَّهِ كَذِبًا إِنْ عُدْنَا فِي مِلَّتِكُمْ بَعْدَ إِذْ نَجَّانَا اللَّهُ مِنْهَا وَمَا يَكُونُ لَنَا أَنْ نَعُودَ فِيهَا إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّنَا وَسِعَ رَبُّنَا كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا عَلَى اللَّهِ تَوَكَّلْنَا رَبَّنَا افْتَحْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ قَوْمِنَا بِالْحَقِّ وَأَنْتَ خَيْرُ الْفَاتِحِينَ (89(

"তোমাদের ধর্ম থেকে আল্লাহ‌ আমাদের উদ্ধার করার পর আবার যদি আমরা তাতে ফিরে আসি তাহলে আমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপকারী বিবেচিত হবো। আমাদের প্রভু আল্লাহ‌ যদি না চান, তাহলে আমাদের পক্ষে সে দিকে ফিরে যাওয়া আর কোনক্রমেই সম্ভব নয়। আমাদের প্রভুর জ্ঞান সমস্ত জিনিসকে ঘিরে আছে। আমরা তাঁরই ওপর নির্ভর করি।" হে আমাদের প্রভু! আমাদের ও আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে যথাযথভাবে ফায়সালা করে দাও এবং তুমি সবচেয়ে ভাল ফায়সালাকারী। (৭:৮৯)

কাফেরদের অবমাননা ও হুমকির পর হযরত শোয়েব (আ.) নম্রতা ও ভদ্রতা বজায় রেখে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, তোমরা চাও আমরা যেন তোমাদের ধর্মে ফিরে আসি। অথচ আল্লাহ এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভ্রান্ত পথ থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন এবং আমাদের সঠিক পথ দেখিয়েছেন। যদি আমরা আবার তোমাদের পথে ফিরে যাই তাহলে আল্লাহর নির্দেশকে অবমাননা করা হবে। আল্লাহর ধর্ম থেকে মুখ ফিরিয়ে তোমাদের পথে ফিরে আসার কোন অধিকার আমাদের নেই। তবে আল্লাহ যদি এ ধরনের কোন নির্দেশ আমাদের দেন, তাহলে অবশ্যই আমরা তা মেনে চলবো। তবে আমরা জানি যে, আল্লাহ এ ধরনের কোন অনুমতিই আমাদের দেবেন না ।

আমরা নিজেদের ঈমানদার হিসেবে দাবি করবো, আর কাজে-কর্মে তোমাদের পথ অনুসরণ করবো, এটা সম্ভব নয়। কারণ আল্লাহ সব জানেন এবং কোন কিছুই তার কাছে গোপন করা যায়না। তাই তোমাদের হুমকি সত্ত্বেও আমরা আল্লাহর উপরই বিশ্বাস-আস্থা রাখি এবং তারই ওপর নির্ভর করি। পাশাপাশি তার কাছে দোয়া করি, তিনি যেন তোমাদের এবং আমাদের বিষয়ে সর্বোত্তম মীমাংসা দেন এবং আমরা যেন চূড়ান্তভাবে মুক্তিলাভ করি।

এ আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. ঐশী ধর্ম ও সৎ পথ থেকে সরে আসার অর্থ হলো, আল্লাহর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা। ঈমানদার ব্যক্তিরা কখনোই কারো সঙ্গে ধর্ম নিয়ে আপোষ করে না।

দুই. ঈমানদার ব্যক্তিরা শত্রুদের চাপ ও হুমকিতে হতাশ না হয়ে নিজেদের দায়িত্ব পালনে অবিচল থাকে এবং সব সময় আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলে।