আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আ'রাফ; (২২তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আ'রাফ; আয়াত ৯৭-১০২

সূরা আল আ'রাফের ৯৭, ৯৮ ও ৯৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

أَفَأَمِنَ أَهْلُ الْقُرَى أَنْ يَأْتِيَهُمْ بَأْسُنَا بَيَاتًا وَهُمْ نَائِمُونَ (৯৭) أَوَأَمِنَ أَهْلُ الْقُرَى أَنْ يَأْتِيَهُمْ بَأْسُنَا ضُحًى وَهُمْ يَلْعَبُونَ (৯৮) أَفَأَمِنُوا مَكْرَ اللَّهِ فَلَا يَأْمَنُ مَكْرَ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْخَاسِرُونَ ((৯৯

"জনপদের অধিবাসীরা কি নিরাপদ বোধ করে আমার ক্রোধ ও শাস্তি থেকে, যা রাতের বেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় তাদের ওপর নেমে আসবে? (৭:৯৭)

"অথবা, তারা কি নিরাপদ বোধ করে আমার ক্রোধ ও শাস্তি থেকে, যা আসবে প্রকাশ্য দিবালোকে তাদের ক্রীড়ারত [তথা কেবল দুনিয়াবি বিষয়ে মত্ততার মত অসাবধান] অবস্থায়?" (৭:৯৮)

"তারা কি আল্লাহ্‌র অদৃশ্য পরিকল্পনার বিরুদ্ধে নিরাপদ বোধ করে ? কিন্তু ধ্বংস হয়ে যাবে এমন লোক [দণ্ডপ্রাপ্ত] ছাড়া অন্য কেউ আল্লাহ্‌র কৌশল থেকে নিরাপদ মনে করে না।" (৭:৯৯)

গত পর্বের আলোচনায় আমরা বলেছিলাম, আল্লাহ কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাফির ও জালিমদেরকে এই দুনিয়াতেই শাস্তি দিয়ে থাকেন। এই তিন আয়াতে আল্লাহ বলছেন, আল্লাহর শাস্তি থেকে কেউই নিরাপদ নয়। কোনো পাপীরই এটা ভাবা উচিত নয় যে সে আল্লাহর শাস্তি থেকে নিরাপদ থাকবে। আল্লাহর শাস্তি কোনো আভাস বা ইঙ্গিত না দিয়েই হঠাত করে দিনে বা রাতে, নিদ্রিত বা জাগ্রত, কিংবা বিশ্রামরত বা কর্মরত অবস্থায় যে কোনো সময়ে চলে আসতে পারে।

এখানে খোদায়ী শাস্তিকে খোদায়ী কৌশল বা ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এর উদ্দেশ্য প্রতারণা নয়। কারণ, আরবীতে ‘মাকার’ শব্দটি প্রতিপক্ষকে তার লক্ষ্যে উপনীত হওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য পথ নির্নয় বা ব্যবস্থা নেয়াকে বোঝায়। তাই আল্লাহর ষড়যন্ত্র বলতে এমন ব্যবস্থাকে বোঝায় যা কাফেরদেরকে অন্যায় লক্ষ্য অর্জন থেকে বিরত রাখে।

যারা আল্লাহর ব্যাপারে উদাসীন তারা সহজেই নানা পাপাচারে জড়িয়ে পড়ে। আর এভাবে তারা আল্লাহর শাস্তির যোগ্য হয়ে পড়ে। মানুষের জীবন ও সত্যিকারের পুঁজির জন্য এটাই সবচেয়ে বড় ক্ষতি।

এ আয়াতের দু’টি শিক্ষা হল:

এক. দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য সবাইকেই খোদায়ী শাস্তি ভোগ করতে হবে। কোনো বিশেষ জাতি বা কোনো বিশেষ নবীর উম্মতই এই শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে না। বিশেষ কোনো সময়ে পাপ করলে সে জন্য শাস্তি ভোগ করতে হবে না, এমন ধারণারও কোনো ভিত্তি নেই।

দুই. মানুষ তার জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শক্তিমত্তার জন্য যেন অহংকারী না হয়। কারণ, খোদায়ী শক্তি ও ব্যবস্থাপনার কাছে সব কিছুই শক্তিহীন।

সূরা আরাফের ১০০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

أَوَلَمْ يَهْدِ لِلَّذِينَ يَرِثُونَ الْأَرْضَ مِنْ بَعْدِ أَهْلِهَا أَنْ لَوْ نَشَاءُ أَصَبْنَاهُمْ بِذُنُوبِهِمْ وَنَطْبَعُ عَلَى قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَسْمَعُونَ ((১০০

"যারা [পূর্ববর্তী] অধিকারীর পরে পৃথিবীর উত্তরাধিকারী হয়, এটা কি তাদের জন্য শিক্ষামূলক [পাঠ] নয় যে, আমি যদি ইচ্ছা করি, আমি তাদের পাপের জন্য তাদেরও শাস্তি দিতে পারি, এবং তাদের হৃদয়কে মোহর করে দিতে পারি যেনো তারা (সত্যের বাণী) শুনতে না পারে?" (৭:১০০)

এ আয়াতে মহান আল্লাহ ভূপৃষ্ঠের বর্তমান অধিবাসীদের সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, অতীতের জাতিগুলোর ইতিহাস থেকে কেন তারা শিক্ষা নিচ্ছে না, কেন তারা তাদের জীবন-অবসানের ব্যাপারে সাবধান হচ্ছে না? যারা পাপ করেছে তাদেরকে যে আমরা শাস্তি দিয়েছি তা কি তারা জানে না? পাপের ব্যাপারে ভয়ডরহীন হওয়ায় তাদের মন ও আত্মায় আমরা এমন মোহর মেরেছিলাম যে তারা সত্য দেখার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হয়েছিল।

ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী, মানুষের আত্মা প্রথমে সাদা কাগজের মত স্বচ্ছ ও পরিস্কার থাকে। কিন্তু প্রতিটি গোনাহর জন্য এ কাগজে কালো দাগ পড়তে থাকে। কেউ যদি তওবা করে বা অনুতপ্ত হয় তাহলে ওই কালো দাগ মুছে যায়। আর যারা পাপাচার অব্যাহত রাখে তাদের আত্মায় কালো দাগগুলো বড় হতে থাকে এবং এক সময় পুরো আত্মাই কালো হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তারা কোনো সত্যকেই বুঝতে পারে না এবং সৌভাগ্যের বা মুক্তির পথও খুঁজে পায় না।

এ আয়াতের দু'টি শিক্ষা হল:

এক. মানুষকে সব সময়ই সতর্ক ও ভর্তসনা করা জরুরি যাতে তারা উদাসীন হয়ে না পড়ে।

দুই. গোনাহ মানুষের আত্মাকে অকেজো করে দেয় এবং ধীরে ধীরে মানুষকে নির্ভিক খোদাদ্রোহী করে তোলে।

সূরা আরাফের ১০১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

تِلْكَ الْقُرَى نَقُصُّ عَلَيْكَ مِنْ أَنْبَائِهَا وَلَقَدْ جَاءَتْهُمْ رُسُلُهُمْ بِالْبَيِّنَاتِ فَمَا كَانُوا لِيُؤْمِنُوا بِمَا كَذَّبُوا مِنْ قَبْلُ كَذَلِكَ يَطْبَعُ اللَّهُ عَلَى قُلُوبِ الْكَافِرِينَ ((১০১

"এসব জনপদের ঘটনাগুলোর একটা অংশ আমি তোমার কাছে বিবৃত করছি। তাদের কাছে মোজেজা ও স্পষ্ট [প্রমাণসহ] তাদের রাসূলগণ অবশ্যই এসেছিলো কিন্তু তারা এমন লোক ছিল না যে, পূর্বে যা প্রত্যাখ্যান করেছিলো, তাতে বিশ্বাস স্থাপন করবে। এভাবেই আল্লাহ্‌ কাফিরদের হৃদয়ে মোহর মেরে দেন।" (৭:১০১)

এ আয়াতে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে আল্লাহ বলছেন, জনপদগুলো সম্পর্কে যা বলা হল, সেগুলোয় পাঠানো হয়েছিল নবী-রাসূল। তাঁরা মানুষকে মোজেজাসহ আল্লাহর বিভিন্ন স্পষ্ট নিদর্শন দেখিয়ে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই সত্যকে মেনে নিতে ও ঈমান আনতে প্রস্তুত ছিল না। এর কারণ, পাপ তাদেরকে এতটা ঘিরে ফেলেছিল যে, তাদের অন্তর সত্যকে উপলব্ধি করতে ও তা মেনে নিতে পারেনি।

এ আয়াতের দু’টি শিক্ষা হল:

এক. মানুষের বিভ্রান্ত চিন্তাধারা যেন ধর্ম প্রচারকদের মনোবলকে দুর্বল না করে। কারণ, সব যুগেই বিপুল সংখ্যক মানুষ বিভ্রান্ত ছিল।

দুই. নবী-রাসূলদের বক্তব্য ছিল অতি স্পষ্ট যুক্তি ও দলিলভিত্তিক, কিন্তু কাফিরদের অন্ধকারাচ্ছন্ন হৃদয় সেই সহজ্য সত্যও বোঝার ক্ষমতা রাখে না।

সূরা আরাফের ১০২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 وَمَا وَجَدْنَا لِأَكْثَرِهِمْ مِنْ عَهْدٍ وَإِنْ وَجَدْنَا أَكْثَرَهُمْ لَفَاسِقِينَ ((১০২

"তাদের বেশিরভাগকেই আমি অঙ্গীকার পালনে [বিশ্বস্ত] পাইনি। বরং তাদের অধিকাংশই ছিল বিদ্রোহী ও অপরাধী।" (৭:১০২)

আগের আয়াতে কাফিরদের অবাধ্যতার কারণ তুলে ধরার পর এ আয়াতে আল্লাহ বলছেন, মানুষ হিসেবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যেসব মানবীয় নীতিমালা ও প্রকৃতিগত স্বভাব দেয়া হয়েছে বেশিরভাগ কাফেরই তার প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ নয়। কারণ, প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ ভাল ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ কাফিরই পাপের পর পাপে জড়িত হয়ে ভাল ও মন্দকে বোঝার প্রাকৃতিক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ ধরনের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই এটা চায় না যে, তারা যেসব পাপাচারে আনন্দ উপভোগ করছে ধর্ম মানতে গিয়ে সেইসব কলুষিত আনন্দ ও অবৈধ স্বার্থ থেকে তারা বঞ্চিত হোক।

এ আয়াতের দু'টি শিক্ষা হল:

এক' বিচার বিবেচনার সময় শত্রুর ব্যাপারেও সুবিচার করতে হবে। তাদের সবাইকে ঢালাওভাবে মন্দ বলে চিত্রিত না করে বেশিরভাগের মধ্যে যে মন্দ স্বভাব রয়েছে কেবল তাই বলতে হবে।

দুই. মানবীয় নীতিমালা ও মানুষের স্বভাবগত মূল্যবোধগুলো মেনে চললেও আমরা অনেক পাপ এড়াতে পারব।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)