আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আ'রাফ;(২৭তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আ'রাফ; আয়াত ১২৮-১৩১

সূরা আ'রাফের ১২৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন-

قَالَ مُوسَى لِقَوْمِهِ اسْتَعِينُوا بِاللَّهِ وَاصْبِرُوا إِنَّ الْأَرْضَ لِلَّهِ يُورِثُهَا مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ

"মূসা (আ.) তাঁর জাতিকে বললেনঃ আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা কর এবং দৃঢ়তা অবলম্বন কর; নিশ্চয়ই রাজ্য বা জগতের মালিক আল্লাহ, আল্লাহ তাঁর দাসদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা উত্তরাধিকার দিয়ে থাকেন। সংযমী বা খোদাভীরুদের জন্যেই রয়েছে শুভ পরিণাম।" (৭:১২৮)

হযরত মূসা (আ.)'র মোজেজার কাছে জাদুকররা পরাজিত হওয়ার পর ফেরাউন মূসা (আ.)'র অনুসারীদের নির্যাতিত করার ও এমনকি তাদেরকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিল, যাতে তাদের সংখ্যা কমে যায় এবং যাতে নতুন করে আরো কোনো মানুষ হযরত মূসার (আ.) অনুসারী না হয়। ফেরাউন ইসরাইল বংশীয় যুবকদেরকে ও এ বংশের কন্যা ও মহিলাদের বন্দী করার নির্দেশ দিল।

এ অবস্থায় হযরত মূসা (আ.) তাঁর জাতিকে এসব কঠিন বিপদের মোকাবেলায় ধৈর্য ও দৃঢ়তা অবলম্বনের আহবান জানালেন এবং তাদেরকে বললেন, হে জনগণ, জগত বা রাজ্যের মালিক ও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের অধিকারী হলেন একমাত্র আল্লাহ। যদি তোমরা ফেরাউনের মোকাবেলায় রুখে দাঁড়াও এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম কর ও আল্লাহর সাহায্য কামনা কর, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে পৃথিবীর অধিপতি বা শাসক করবেন বলে ওয়াদা দিয়েছেন । তোমরা যদি আল্লাহর পথে সংগ্রাম কর, তাহলে তোমরাই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হবে এবং শুভ ফলাফল তোমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছে, তবে শর্ত হলো তোমাদেরকে খোদা-ভীরু হতে হবে।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকারঃ

এক. অত্যাচারী, খোদাদ্রোহী শক্তি ও জালেম সরকারগুলোর বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার জন্য তিনটি গুণ জরুরী। এগুলো হলো- ধৈর্য ও দৃঢ়তা, আল্লাহর ওপর ভরসা ও প্রতিরোধ এবং খোদা-ভীতি বা ধার্মিকতা।

দুই. খোদা-ভীরু মানুষেরা ইহকালে ও পরকালে উভয় জগতেই সৌভাগ্যের অধিকারী হয়।

সূরা আরাফের ১২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَالُوا أُوذِينَا مِنْ قَبْلِ أَنْ تَأْتِيَنَا وَمِنْ بَعْدِ مَا جِئْتَنَا قَالَ عَسَى رَبُّكُمْ أَنْ يُهْلِكَ عَدُوَّكُمْ وَيَسْتَخْلِفَكُمْ فِي الْأَرْضِ فَيَنْظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُونَ

"মূসার জাতি তাঁকে বললোঃ আপনি আমাদের কাছে আসার আগ থেকেই আমরা নির্যাতিত হচ্ছিলাম ও আপনি আসার পরও নির্যাতিত হচ্ছি । মূসা বললেনঃ অচিরেই তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের শত্রুকে ধ্বংস করবেন এবং তোমাদেরকে এ দেশে তাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। এরপর তোমরা কেমন কাজ কর তা তিনি লক্ষ্য করবেন।" (৭:১২৯)

বনি ইসরাইল বা ইসরাইল বংশীয়রা আশা করছিল, হযরত মূসা (আ.)'র অভ্যুত্থান বা প্রতিরোধ ও ফেরাউনের মাধ্যমে সংগঠিত জাদুকরদের ওপর তাঁর বিজয়ের ফলে ফেরাউন ক্ষমতা ছেড়ে দেবে এবং বনি ইসরাইলের লোকজন আরাম আয়াশে জীবন যাপন করতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে হলো তার উল্টো। অর্থাৎ, ফেরাউনের অত্যাচার এতো বেড়ে গেলো যে, ইসরাইল বংশীয়রা হযরত মূসাকে বললো: আপনার প্রতিরোধে কোনো লাভ হয়নি। আপনি এখানে আসার আগে ও আপনার প্রতিরোধ শুরু হবার পরও আমরা নিপীড়িত হচ্ছি। হযরত মূসা (আ.) তাদের কথার জবাবে বললেন, শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয় এক দিনে বা রাতেই অর্জিত হয় না এবং দুঃখ-বেদনা সহ্য করা ছাড়া বিজয় আসে না। তোমরা যদি প্রতিরোধ গড়ে তোলো ও সংগ্রাম চালিয়ে যাও, তাহলে মহান আল্লাহ তোমাদের শত্রুকে নির্মূল এবং তোমাদেরকে ফেরাউনের রাজত্বের স্থলাভিষিক্ত করবেন বলে আশা রয়েছে । অবশ্য তোমরা যদি ক্ষমতা পাও, তাহলেই যা খুশী তা করতে পারবে এমনটি ভেবো না, বরং আল্লাহ তোমাদের দেখবেন যে তোমরাও ক্ষমতা পেয়ে ফেরাউনের মত জনগণের ওপর জুলুম কর না ন্যয় বিচার অনুযায়ী আচরণ কর ।

এ আয়াত থেকে মনে রাখা দরকার :

এক. শুধু আরাম-আয়েশের পেছনে ছোটা এমন এক রোগ, যা খোদায়ী ধর্মের অনুসারীদেরকেও তাদের কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছা থেকে বিরত রাখে । ধর্ম ও ঈমান রক্ষা করে চলতে হলে অনেক কষ্ট বা বিপদ সহ্য করতে হবে । যারা শুধু আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসের পেছনে ছুটছে ধর্মের বিধি-বিধান মেনে চলা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।

দুই. ক্ষমতা ও শক্তি হলো খোদায়ী পরীক্ষার মাধ্যম, ব্যক্তি বা দলের লক্ষ্য পূরণের জন্যে শাসকদের ক্ষমতা জাহির করার মাধ্যম নয়।

সূরা আ'রাফের ১৩০ ও ১৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَقَدْ أَخَذْنَا آَلَ فِرْعَوْنَ بِالسِّنِينَ وَنَقْصٍ مِنَ الثَّمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ (130) فَإِذَا جَاءَتْهُمُ الْحَسَنَةُ قَالُوا لَنَا هَذِهِ وَإِنْ تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ يَطَّيَّرُوا بِمُوسَى وَمَنْ مَعَهُ أَلَا إِنَّمَا طَائِرُهُمْ عِنْدَ اللَّهِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ ((131

"নিশ্চয়ই আমি ফেরাউন-অনুসারীদেরকে দুর্ভিক্ষ, ক্ষরা ও ফসল-শস্যহানিতে আক্রান্ত করেছি, যেন তারা সাবধান হয় (এবং তাদের ভুল পথ পরিত্যাগ করে)।" (৭:১৩০)

"যখনই ভালো ও আনন্দদায়ক কিছু তারা পেত, তারা বলতোঃ এতো আমাদেরই প্রাপ্য, কিন্তু যখনই কোনো তিক্ততা বা খারাপ কিছু হতো, তারা তার জন্যে মূসা ও তাঁর অনুসারীদেরকে দায়ী করতো। জেনে রাখ, তাদের অকল্যাণ আল্লাহরই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে (তাদের মন্দ কাজের জন্য আল্লাহই তাদের শাস্তি দেন), কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা জানে না।" (৭:১৩১)

এ দুই আয়াতের ব্যাখ্যা:

মহান আল্লাহ বলছেনঃ এমনটি ভেব না যে, শুধু ইসরাইল বংশীয়রাই সব সময় বিপদ ও কষ্টের মধ্যে ছিল এবং ফেরাউন ও তার অনুসারীরা সব সময় আরাম-আয়েশের মধ্যে ছিল। ফেরাউন-অনুসারীদেরকেও আমরা দুর্ভিক্ষ ও ক্ষরার মতো কঠিন অবস্থায় ফেলেছি, যাতে তারা এটা বোঝে যে, সবকিছু তাদের হাতে নেই এবং তারা পৃথিবীর খোদা বা অধিপতি নয় । কিন্তু তারা এটা বোঝার পরিবর্তে হযরত মূসা (আ.) ও তাঁর অনুসারীদেরকেই এসব সংকটের জন্যে দায়ী করতো । তাদের মতে, মুসা ও তার অনুসারীরাই এসব সংকটের মূল উতস এবং তাদের এ বিশ্বাস এতোটা দৃঢ় হয়েছিল যে, তারা যে কোনো দুর্ঘটনার পরই বনি ইসরাইলকে অপয়া বা অলক্ষুণে বলে অভিযুক্ত করে বলতোঃ বনি ইসরাইল হলো অলক্ষুণে জাতি এবং এ জাতি যেখানেই যায় সেখানে দুর্ভাগ্য বা অলক্ষণও সাথে নিয়ে আসে! অন্যদিকে তারা নিজেদেরকে সব ভাল কিছুর উতস বলে ভাবত। তারা বলত, আমাদের যোগ্যতার কারণেই সব ভাল কিছু আমাদের পেছে চলে আসে। কিন্তু আল্লাহ বলছেন, না, ব্যাপারটা এমন নয়, ফেরাউনরা সব ভাল কিছুর উতস নয়, আবার বনি ইসরাইলও সব মন্দের উতস নয়, বরং আল্লাহই সব ভাল ও মন্দ নিয়ন্ত্রণ করেন, সবই তাঁরই হাতে, কিন্তু বনি ইসরাইল ও ফেরাউনের জাতি তা বোঝে না।

এ দুই আয়াতের শিক্ষা হল:

এক. নবী, ইমাম ও আওলিয়াগণকে ওসিলা করে দূর্যোগ ও আযাব থেকে মূক্তি চাওয়া হলে তা কার্যকরী হয়। কাফেররা মূসা (আ.)'র কাছে এ অনুরোধ জানিয়েছিল যে তিনি যেন তাদের রক্ষার জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন।

দুই.মানুষের জীবনে আনন্দ ও কষ্টের ঘটনা কোনো ব্যতিক্রমধর্মী বিষয় বা নিছক ঘটনাক্রমিক ব্যাপার নয়, বরং সেগুলো খোদায়ী নীতির আওতাধীন, যা পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে ।

তিন. খোদাদ্রোহী শাসকদের হাত থেকে মানুষকে মূক্তি দেয়া ছিল নবী-রাসূলগণের অন্যতম লক্ষ্য।

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)