সূরা আ'রাফ;(৩০তম পর্ব)

সূরা আ'রাফ; আয়াত ১৪১-১৪২

সূরা আ'রাফের ১৪১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَإِذْ أَنْجَيْنَاكُمْ مِنْ آَلِ فِرْعَوْنَ يَسُومُونَكُمْ سُوءَ الْعَذَابِ يُقَتِّلُونَ أَبْنَاءَكُمْ وَيَسْتَحْيُونَ نِسَاءَكُمْ وَفِي ذَلِكُمْ بَلَاءٌ مِنْ رَبِّكُمْ عَظِيمٌ

"হে বনি ইসরাইল! স্মরণ কর, যখন আমি তোমাদের ফেরাউন সম্প্রদায়ের হাত থেকে রক্ষা করেছিলাম, তারা তোমাদের কঠোর শাস্তি দিত, তোমাদের পুত্র সন্তানদের হত্যা করতো ও মেয়েদের দাসী বা সেবিকা হিসেবে জীবিত রাখতো এবং এসবে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদের জন্যে ছিল মহা পরীক্ষা। " (৭:১৪১)

আগের পর্বে আমরা জেনেছি, বনী ইসরাইল সম্প্রদায় নীল নদ পার হবার পর ফেরাউনের কর্তৃত্ব থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু এর পরই তারা মূর্তি পূজারী একটি জাতিকে দেখে তাদের জন্যেও সে ধরনের স্পর্শযোগ্য উপাস্য বানিয়ে দিতে হযরত মূসা (আ.)’র কাছে আবেদন জানায় ।

এ আয়াতে তাদের বলা হচ্ছে- তোমরা কি এতো দ্রুত মূসা (আ.)’র খোদাকে ভুলে গেলে? তোমরা কাঠ ও পাথরের কয়েকটা মূর্তি দেখে সে ধরনের খোদা পেতে চাচ্ছ? অথচ মূসা (আ.)’র খোদাই তোমাদেরকে ফেরাউনের অত্যাচারের নিগড় থেকে রক্ষা করেছেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমতা ও সম্মান দিয়েছেন। তোমরা কি ভুলে গেছ, ফেরাউন তোমাদের পুরুষ ও নারীদের সাথে কি আচরণ করতো? ফেরাউন বিভিন্ন অজুহাতে তোমাদের পুত্র সন্তান ও পুরুষকে হত্যা করতো, যাতে  কেউ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা আন্দোলন করতে না পারে  এবং তোমাদের নারীকে দাসী করে রাখতো। এ সবই কি তোমরা ভুলে গেছ?

এ আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ বলছেন, যদিও ফেরাউন তোমাদের ওপর এ ধরনের কঠোর নির্যাতন নিপীড়ন চালাতো, কিন্তু এর মাধ্যমে আল্লাহও পরীক্ষা করতেন যে, কারা এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতো এবং কারা এসবের কাছে নতি স্বীকার করতো।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা দরকারঃ

এক.  খোদায়ী নেয়ামতের ব্যাপারে উদাসীনতা মানুষ বা সমাজকে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে। আল্লাহর নবী-রাসূলগণ সব সময় মানুষকে আল্লাহর নেয়ামতগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদেরকে খোদাদ্রোহীতা ও অংশীবাদিতা বা শিরক থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছেন।

দুই.  মানুষের জীবনে দুঃখ ও বিপদ এবং প্রাচুর্য ও সুখ সমৃদ্ধি আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা মাত্র।

সূরা আরাফের ১৪২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَوَاعَدْنَا مُوسَى ثَلَاثِينَ لَيْلَةً وَأَتْمَمْنَاهَا بِعَشْرٍ فَتَمَّ مِيقَاتُ رَبِّهِ أَرْبَعِينَ لَيْلَةً وَقَالَ مُوسَى لِأَخِيهِ هَارُونَ اخْلُفْنِي فِي قَوْمِي وَأَصْلِحْ وَلَا تَتَّبِعْ سَبِيلَ الْمُفْسِدِينَ

"আমরা তাওরাত নাজেলের জন্যে ৩০ রাত মূসার সাথে অঙ্গীকার করেছিলাম যাতে সে তুর পাহাড়ে আসে এবং আরো দশ রাত বাড়িয়ে তা পরিপূর্ণ করেছিলাম। এভাবে তাঁর প্রতিপালকের নির্ধারিত সময় চল্লিশ রাতে পূর্ণ হয়। তুর পাহাড় ত্যাগের আগে মূসা তাঁর ভাই হারুনকে বললো, আমার উম্মতের মধ্যে তুমি আমার প্রতিনিধিত্ব করবে, তাদেরকে সংশোধন করবে এবং বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের অনুসরণ করবে না।" (৭:১৪২)

মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী, ফেরাউনের হাত থেকে বনী ইসরাইলকে মূক্ত করা ছিল হযরত মূসা (আ.)’র প্রথম  কর্মসূচি । অনেক সমস্যা ও বিপদ মোকাবেলা করে তিনি এ কাজে সফল হন। কিন্তু এরপরও ফেরাউনের মত অত্যাচারী শাসকের কর্তৃত্ব থেকে মূক্ত হওয়া একটি জাতির লোকদের ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনের জন্যে স্পষ্ট ও লিখিত বিধান থাকা জরুরী । তাই মহান আল্লাহ তাওরাত গ্রন্থ নাজেলের উদ্যোগ নেন এবং এ গ্রন্থ গ্রহণের জন্যে মূসা (আ.) কে তাঁর জাতি থেকে আলাদা হতে বলেন। আল্লাহ মূসা (আ.)কে ৪০ দিনের জন্যে তুর পাহাড়ে আসতে বলেন এবং এ সময়ে হারুন (আ.)কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করতে বলেন। পবিত্র কুরআনে এ সময়টিকে ৪০ রাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর আল্লাহর দরবারে মুনাজাতের জন্যে ও তাঁর  বিশেষ অনুগ্রহ পাবার জন্যে রাতই সবচেয়ে ভালো সময় বলে হয়তো এখানে রাতের কথা বলা হয়েছে ।  বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)ও চল্লিশ দিন তাঁর স্ত্রী ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন  থেকে হেরা গুহায় ধ্যানে মগ্ন ছিলেন এবং এভাবে তিনি আল্লাহর বিশেষ রহমত পেয়েছিলেন।

এখানে লক্ষ্য করার মত একটি বিষয় হলো, হযরত মূসা (আ.) মাত্র চল্লিশ দিনের জন্যে তাঁর জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হবার কারণে আল্লাহর নির্দেশে নিজ স্থলাভিষিক্ত মনোনয়ন করতে বাধ্য হয়েছিলেন; আর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর ওফাতের পরবর্তী বছরগুলোর জন্যে কোনো স্থলাভিষিক্ত নিয়োগ করবেন না, বা এ বিষয়ে কোনো চিন্তাও না করে বিষয়টি জনগণের মর্জির ওপর ছেড়ে দেবেন এটা কি  যৌক্তিক হতে পারে? এমনকি মহানবী (সা.) মদীনা থেকে অনেক দূরে অবস্থিত তাবুকের যুদ্ধে যাবার কারণে হযরত আলী (আ.)কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত বা প্রতিনিধি হিসেবে মদীনায় রেখে যান। এ সময় বিশ্বনবী (সা.) বলেনঃ  হে আলী! মূসার কাছে হারুন যে অবস্থানে ছিলেন, আমার কাছেও তুমি সেরূপ । মদীনা থেকে চলে যাবার পর তুমি আমার প্রতিনিধি বা স্থলাভিষিক্ত হবে, যতক্ষণ না আমি আবার মদীনায় ফিরে আসছি। হযরত মূসা (আ.) তুর পাহাড়ে যাবার সময় তাঁর ভাই হারুনকে এ কথা বলে সতর্ক করেছিলেন যে, সাবধান, বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীরা যেন তোমাদের নেতা না হয়ে বসে এবং তুমিও যেন তাদের পথ ও মতের অনুসারী না হও। কিন্তু হযরত মূসা (আ.)’র এতো সাবধান বাণী ও উপদেশ সত্ত্বেও ইতিহাস যা সাক্ষ্য দেয় তা হলো, জনগণ হারুনকে ত্যাগ করেছিল এবং তারা সামেরী নামের এক ব্যক্তির অনুসারী হয়ে পড়ে। মূর্তি নির্মাতা এ ব্যক্তি হযরত মূসা (আ.)’র অনুপস্থিতির সূযোগ নিয়ে স্বর্ণ দিয়ে একটি বাছুর তৈরির মাধ্যমে মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করে ।

এ আয়াত থেকে আমাদের মনে রাখা জরুরী যে-

এক.  বড় ধরনের দায়িত্ব পাবার পেছনে থাকে রাতের একাগ্র ইবাদত ও মুনাজাত । সমাজে আমাদের উপস্থিতি যেন ব্যক্তির আধ্যাত্মিক নির্জনতায় বাধা সৃষ্টি না করে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত ।

দুই. প্রত্যেক জাতি বা সমাজের জন্যে খোদায়ী বা ধর্মীয় নেতা থাকা জরুরী। মূসা নবীর মতো কাউকে তুর পাহাড়ে যেতে হলে হারুনের মতো কাউকে স্থলাভিষিক্ত করে যেতে হবে ।

তিন.  নবী-রাসূল ও আল্লাহর পথের পথিকদের প্রধান দায়িত্ব হলো সমাজকে সংশোধন করা এবং সমাজ থেকে অন্যায় ও দুর্নীতি দূর করা।