বুদ্ধিবৃত্তির দৃষ্টিতে ইমামের নিষ্পাপতা

শিয়া-সুন্নী উভয় মাজহাবের দৃষ্টিভঙ্গি হলো: মহানবী (সা.) এর ওফাতের পর ১২ জন ইমাম আগমন করবেন। তবে ঐসব ইমামের পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে দুই মাজহাবের মধ্যে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। এ লেখায় ইমামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা হবে। আর সেটি হলো ইমামের নিষ্পাপতা। শিয়া মাজহাবের মতে, ইমামকে অবশ্যই মাসুম বা নিষ্পাপ হতে হবে। কিন্তু সুন্নী মাজহাবের মতে ইমামের জন্য মাসুম বা নিষ্পাপ হওয়া আবশ্যক নয়।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে বুদ্ধিবৃত্তি নামক একটি বড় নেয়ামত দান করেছেন যা মানুষকে সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ে সহায়তা করে। এখন আমরা দেখতে চাই, বুদ্ধিবৃত্তি ইমামের নিষ্পাপতা সম্পর্কে কি বলে। বুদ্ধিবৃত্তির দৃষ্টিতে ইমামের জন্য নিষ্পাপ হওয়া জরুরী কিনা তা নিয়ে আলোচনার নিমিত্তে এ লেখার আয়োজন।

নিষ্পাপতার সংজ্ঞা

প্রথমেই আমরা নিষ্পাপতার সংজ্ঞা নিয়ে আলোচনা করব।

নিষ্পাপতার আরবী হলো ইসমাত যা আসামা শব্দ থেকে এসেছে। এর শাব্দিক অর্থ হলো রক্ষনাবেক্ষণ করা, সংরক্ষণ করা, বিরত থাকা ইত্যাদি।

আর ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ইসমাত বা নিষ্পাপত্ব এমন একটি অনুগ্রহ যা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে তার বিশেষ কিছু বান্দাকে দান করা হয়, যার মাধ্যমে ঐ সকল বান্দা যাবতীয় গুনাহ থেকে বিরত থাকে। আর গুনাহ থেকে বিরত থাকার অন্যতম একটি কারণ হলো গুনাহের প্রতি তাদের চরম ঘৃণা।

উল্লেখ্য যে, মাসুম বা নিষ্পাপ ব্যক্তিদের গুনাহের প্রতি চরম ঘৃণাবোধ থাকার প্রধান কারণ হলো গুনাহের অপূরণীয় ক্ষতি সম্পর্কে তাদের অবগতি থাকা, যা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের মধ্যে বিদ্যমান যোগ্যতার কারণে তাদেরকে দান করেছেন। তবে নিষ্পাপ হওয়ার অর্থ এ নয় যে তারা গুনাহ করতে অক্ষম। বরং তারা গুনাহ করতে সক্ষম কিন্তু গুনাহের অপূরণীয় ক্ষতির দিকে লক্ষ করে তা করতে অগ্রসর হন না। আমরা যদি একজন বুদ্ধিমান মানুষের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই যে, সেও নির্দিষ্ট কতগুলো গুনাহের ক্ষেত্রে মাসুম বা নিষ্পাপ। আর সেগুলো আঞ্জাম দেয়া তো দূরের কথা বরং এক মুহুর্তের জন্যেও ঐগুলো আঞ্জাম দেয়ার কথা চিন্তা করে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, মল-মূত্র খাওয়া হারাম এবং কবীরা গুনাহ। পৃথিবীতে এমন কোন বুদ্ধিমান মানুষ কি খুঁজে পাওয়া যাবে যে মল-মূত্র খাওয়া তো দূরে থাক খাওয়ার চিন্তা পর্যন্ত করতে পারে? এটা করা তার জন্য অসম্ভব! এ রকম মানুষ কোনদিনই খুঁজে পাওয়া যাবে না। তদ্রূপ মাসুম ব্যক্তিগণ গুনাহের কাজ করা কে মল-মূত্র খাওয়ার থেকেও নিকৃষ্ট বলে মনে করেন। তাই তাদের ক্ষেত্রে গুনাহের কাজ করা অসম্ভব।

ইসমাত বা নিষ্পাপতার বিভিন্ন দিক

ইসমাত বা নিষ্পাপতার তিনটি দিক রয়েছে :

১. ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নিষ্পাপতা :

এর অর্থ হলো মাসুম ব্যক্তিগণ যাবতীয় ওয়াজিব ও মুস্তাহাব কাজগুলো পালন করে থাকেন আর হারাম ও মাকরূহ কাজ থেকে বিরত থাকেন। আর মুবাহ বা বৈধ কাজগুলো শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য করেন।

২. জ্ঞানের ক্ষেত্রে নিষ্পাপতা :

এর অর্থ হলো মাসুম ব্যক্তিগণ ইসলামী শরীয়তের যাবতীয় বিধি-বিধান এবং ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের যাবতীয় কল্যাণ ও অকল্যাণ সম্পর্কে অবহিত।

৩. দৈহিক ও আত্মিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে নিষ্পাপতা :

এর অর্থ হলো মাসুম ব্যক্তিগণ যাবতীয় দৈহিক ত্রুটি থেকে মুক্ত। আর আখলাক বা চরিত্রের ক্ষেত্রে তারা হলেন আদর্শ চরিত্রের মূর্ত প্রতীক। এমন কোন খারাপ গুণ নাই যা থেকে তারা মুক্ত নন। অপরদিকে এমন কোন ভাল গুণ নাই যা তাদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ইমামগণের নিষ্পাপতার দলীলসমূহ

ইসমাত বা নিষ্পাপতার যে বর্ণণা উপরে দেয়া হলো, তা কেবলমাত্র নবী ও ইমামদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। নবী ও ইমাম ছাড়া অন্য কেউ এ রকম নিষ্পাপতার অধিকারী নয়। শিয়া-সুন্নী নির্বিশেষে সকলের মতে নবীগণ মাসুম বা নিষ্পাপ। কিন্তু ইমামগণের নিষ্পাপতার ব্যপারে মতানৈক্য রয়েছে। এখন আমরা ইমামগণের নিষ্পাপতা প্রমাণ করার জন্য আকলী বা বুদ্ধিবৃত্তিক দলীল উপস্থাপন করতে চাই :

১. ইমামগণের অন্যতম দায়িত্ব হলো কুরআন শরীফের তাফসীর করা। অতএব ইমামগণ যদি নিষ্পাপ না হন তাহলে কোনক্রমেই তাদের তাফসীরের উপর নিশ্চিত হওয়া যায় না।

২. নবীদের পর ইমামগণ হলেন পৃথিবীতে আল্লাহর হুজ্জাত বা দলীল। পৃথিবী কোন সময় আল্লাহর হুজ্জাত থেকে মুক্ত থাকবে না। কারণ আল্লাহর হুজ্জাত না থাকলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এজন্য কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সবসময়ই একজন ইমাম পৃথিবীর বুকে থাকবেন এবং মানুষকে সঠিক পথের দিশা দিবেন। হুকুম-আহকাম বর্ণণার ক্ষেত্রে তাদের ফয়সালাই হবে চুড়ান্ত। অতএব তারা যদি নিষ্পাপ না হন, তাহলে আহকাম বর্ণনার ক্ষেত্রে ভুল-ত্রুটির সম্মুখীন হবেন। আর ইমামগণ ভুল আহকাম বর্ণনা করলে ও নির্দেশনা দিলে মানুষ পথভ্রষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক। অতএব ইমামকে অবশ্যই মাসুম হতে হবে।

৩. ইমামদেরকে প্রেরণ করার পিছনে আল্লাহর উদ্দেশ্য হলো মানুষকে হেদায়েত করা। অতএব স্বয়ং ইমামগণ যদি গুনাহে লিপ্ত হন তাহলে মানুষ কিভাবে গুনাহ থেকে মুক্ত থাকবে? সেক্ষেত্রে তাঁর মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। অতএব ইমামদের জন্য গুনাহ থেকে মুক্ত হওয়া আবশ্যক।

৪. ইমামগণ যেহেতু আল্লাহর হুজ্জাত সেহেতু তাদের আনুগত্য করা মানুষের উপর ওয়াজিব। অতএব তারা যদি গুনাহে লিপ্ত হন তাহলে অন্যান্যদের কর্তব্য হবে সে গুনাহের ক্ষেত্রেও ইমামদের আনুগত্য করা। অপরদিকে, ইসলাম মানুষকে গুনাহ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়। অতএব এক্ষেত্রে মানুষ এমন একটি আমলের সম্মুখীন হয়ে পড়ে, যা পালন করা একদিক থেকে ওয়াজিব আবার অন্যদিক থেকে হারাম। আর ইসলামে এমন কোন বিধান নেই যা করা একই সময়ে ওয়াজিব ও হারাম হতে পারে। অতএব ইমামদেরকে অবশ্যই গুনাহের কাজ থেকে মুক্ত হতে হবে।

৫. ইমামদের দায়িত্ব হলো, ইসলামী শরীয়তের রক্ষাণাবেক্ষণ করা। অতএব তারা যদি নিষ্পাপ না হন তাহলে ইসলামকে সঠিকভাবে হেফাজত করতে পারবেন না। কারণ ইসলামের মধ্যে বিচ্যুতি বা বিদআতের অনুপ্রবেশ ঘটলে মাসুম ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে প্রকৃত ইসলামের স্বরূপ যথাযথভাবে তুলে ধরা সম্ভব নয়। এজন্য ইমামকে যাবতীয় গুনাহের ঊর্ধে থাকতে হবে।

৬. ইমাম যদি নিষ্পাপ না হন তাহলে তাকে দিক-নির্দেশনা দান করার জন্য অন্য একজন ইমামের দরকার হবে। আর এভাবে, ইমামত যতক্ষণ পর্যন্ত একজন মাসুম ব্যক্তির কাছে না পৌঁছবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ ধারা চলতে অব্যাহত থাকতে হবে, আর যদি শেষ পর্যন্ত মাসুম ব্যক্তিতে না পৌঁছায় তবে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক দিক-নির্দেশনা পাওয়াও সম্ভব হবে না। অতএব ইমামকে অবশ্যই নিষ্পাপতার অধিকারী হতে হবে।

৭. মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হাকিম ও বিজ্ঞ। আর হাকিম তাকে বলা হয়, যিনি কোন অনর্থক কাজ করেন না। অতএব আল্লাহ যদি এমন এক ব্যক্তিকে ইমাম হিসেবে বাছাই করেন যিনি নিজেই গুনাহে লিপ্ত থাকেন তাহলে তার দ্বারা ইমাম প্রেরণের উদ্দেশ্য (অর্থাৎ মানুষকে হেদায়েত করা) সফল হবে না। আর ঐ সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে ইমাম প্রেরণ করা অনর্থক বলে বিবেচিত হবে। আর আল্লাহ যেহেতু অনর্থক কাজ করেন না সেহেতু তিনি কোন ক্রমেই এমন কোন ব্যক্তিকে ইমাম হিসেবে প্রেরণ করবেন না যিনি মাসুম নন।

৮. ইমাম যদি মাসুম না হন তাহলে তিনি দাওয়াতী কাজে সফল হবেন না। কারণ তিনি যখন মানুষকে তাকওয়া অবলম্বন করার কথা বলবেন, তখন মানুষ তার ব্যাপারে আপত্তি উত্থাপন করে বলবে : তিনি নিজেই তো তাকওয়া অবলম্বন করে চলেন না, তাহলে কিভাবে আমাদেরকে তাকওয়ার কথা বলেন! আর এভাবে ইমামের দাওয়াতী কার্যক্রম পুরো ভেস্তে যাবে।

অবশ্য আমরা যদি ইমাম (আ.)-দের জীবনী পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই যে, প্রত্যেক যুগে ইমামদের অনুসারীদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। এর অর্থ এ নয় যে, আহলে বাইতের ইমামদের মধ্যে কোন ত্রুটি ছিল বরং সবসময় শয়তান বিভিন্ন উপায়ে মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল যার ফলে গুটিকতক খাঁটি মুসলমান ছাড়া কেউই ইমামদের পক্ষাবলম্বন করে নি।

উপসংহার

উপরের আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, ইমামকে অবশ্যই নিষ্পাপ হতে হবে। আর শুধু গুনাহ নয় বরং যাবতীয় ভুলত্রুটি থেকে তাকে মুক্ত থাকতে হবে যাতে করে মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য সফল হয়। (লিখেছেন:মো. আব্দুল্লাহ,রাযীন, ১ম বর্ষ, সংখ্যা ১)