আল হাসানাইন (আ.)

বাস্তবতার দর্পনে ওহাবি মতবাদ (১-১০)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

প্রথম পর্ব    আমরা যদি বিভিন্ন ধর্ম বা ধর্মীয় উৎসগুলো নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাবো বহু ধর্ম কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন মাযহাব বা ফের্কায় বিভক্ত হয়ে গেছে। মহান ঐশী ধর্মগুলোর ক্ষেত্রেও এ সত্য সমানভাবে প্রযোজ্য। ধর্মগুলোর প্রবর্তন করেছিলেন যাঁরা,তাদেঁর সাথে কালগত দূরত্ব সৃষ্টির কারণে এইসব মাযহাব আর ফের্কার জন্ম হয়েছে। এ ধরনেরই একটি ফের্কা হচ্ছে 'ওহাবি' ফের্কা।
 
নিঃসন্দেহে ঐশী ধর্মগুলোতে এতোসব ফের্কা আর মাযহাবগত মতপার্থক্য এসেছে মানুষের চিন্তা থেকে। কেননা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সকল নবী-রাসূলেরই লক্ষ্য বা মিশন ছিল এক আল্লাহর প্রার্থনা বা একত্ববাদের প্রতি মানুষকে আহ্বান করা। এক্ষেত্রে সকল নবীরই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল এক ও অভিন্ন এবং তাদেঁর সবাই মানব জাতিকে বিচ্ছিন্নতা পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সর্বশেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাব এবং জুলুম নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করাও সকল ঐশী ধর্মের অভিন্ন বিশ্বাস। একইভাবে সকল ঐশী ধর্ম এ ব্যাপারে অভিন্ন বিশ্বাস পোষণ করে যে, ওহী আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে-যা সকল মারেফাত বা আধ্যাত্মিকতার উৎস। তবে ইতিহাসের কাল পরিক্রমায় আমরা লক্ষ্য করবো,সামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতি, লোভ-লালসা এবং পার্থিব মুনাফার লোভে অথবা অন্য কোনো দুরভিসন্ধিমূলক চিন্তার কারণে কোনো কোনো ব্যক্তির মাঝে ধর্ম সম্পর্কে ভুল উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে।
 
চিন্তা ও উপলব্ধিগত এই পার্থক্য কালক্রমে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়ে ঐশী ধর্মের অনুসারীদের মাঝে বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিয়েছে। এভাবেই অসংখ্য ফের্কা এবং মাজহাব-চাই তা মানুষের চিন্তাগত ভ্রান্তির কারণেই হোক কিংবা কোনো ব্যক্তি,দল বা কারো রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির কারণেই হোক-গড়ে উঠেছে। একথা এখন অনস্বীকার্য বাস্তবতা যে এইসব ফের্কা এবং মাজহাব দ্বীন বা ঐশী ধর্মগুলোর ঐক্যকে টার্গেট করে বিচ্ছিন্নতার তীর নিক্ষেপ করেছে। ঐশী ধর্মগুলো হচ্ছে ঐক্যের মূল উৎস। ঐক্যের এই উৎসমূলে বিচ্ছিন্নতার বীজ রোপন করেছে ফের্কা বা মাজহাবগুলো-যেসব মাজহাব কখনো কখনো সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামিপূর্ণও বটে। 'ওহাবি' মতবাদও অপরাপর বহু ফের্কার মতো একটি ফের্কা।
অন্যান্য ফের্কার মতো এই ফের্কাটিরও শেকড় প্রোথিত রয়েছে এর প্রতিষ্ঠাতার ব্যক্তিগত চিন্তাধারার মধ্যে। ওহাবি মতবাদের মূল ভাবনাগুলো গৃহীত হয়েছে 'ইবনে তাইমিয়া'র চিন্তাধারা থেকে। তাই প্রথমেই ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিগুলো একবার পর্যালোচনা করে নেওয়া জরুরি। হিজরি সপ্তম শতাব্দিতে তথা ৬৬১ হিজরিতে 'তাকিউদ্দিন আহমাদ ইবনে আব্দুল হালিম' তৎকালীন তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় হাররান ( ইংরেজি ভাষায় Carrhae ) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইবনে তাইমিয়া নামেই বেশি পরিচিত। হাররান শহরটি সেই সময় ছিল হাম্বলি মাজহাব চর্চার প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলোর একটি। বর্তমানে অবশ্য শহরটির কোনো অস্তিত্ব অবশিষ্ট নেই। তবে প্রাচীনকালে হাররান ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ একটি শহর।

ইবনে তাইমিয়া এমন এক পরিবারে লালিত পালিত হন যেই পরিবারটি ছিল এক শতাব্দিরও বেশি সময় ধরে হাম্বলি মাজহাবের পতাকাবাহী। ধর্মীয় বহু বই-পুস্তক লেখালেখি হয়েছে এই পরিবারে। স্বয়ং ইবনে তাইমিয়ার পিতা ছিলেন হাররানের বিখ্যাত ফকিহ। তিনি 'শায়খুল বালাদ' নামে পরিচিত ছিলেন। হাররানের জনগণ তাকেঁ খতিব এবং ইসলামী জ্ঞান ও বিদ্যার শিক্ষক হিসেবেই জানতো। অপরদিকে ইবনে তাইমিয়ার জীবনকাল ছিল ইসলামী ভূখণ্ডে মোঙ্গলদের পাশবিক হামলার সমকালীন। সে সময় মোঙ্গলরা ব্যাপক সহিংস হামলা চালিয়ে মুসলিম ভূখণ্ডগুলো দখল করে নিয়েছিল এবং প্রতিদিনই প্রায় তাদের হুকুমাত বিস্তৃত হচ্ছিলো। এই যুগে মূল্যবান সব ইসলামী শিল্পকর্ম ও মুসলিম মনীষীদের বইপুস্তকগুলো মোঙ্গলদের হাতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো।
 
বিখ্যাত আরব ঐতিহাসিক ইবনে কাসির লিখেছেনঃ 'হিজরি ৬৬৭ সালে অর্থাৎ ১২৬৯ খ্রিষ্টাব্দে যখন ইবনে তাইমিয়ার বয়স ৬ বছরের বেশি ছিলো না,তখন হাররান শহরের ওপর মোঙ্গলদের চাপ এতো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিলো যে, তাদের হামলার ভয়ে হাররানবাসীরা শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। ইবনে তাইমিয়াও সে সময় তার পরিবারের সাথে হাররান থেকে দামেশকে চলে গিয়েছিলেন।' দামেশকে যাবার পর 'দারুল হাদিসে'র প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন ইবনে তাইমিয়ার পিতা। সেখানে ইবনে তাইমিয়া পড়ালেখা করেন। তিনি তাঁর যৌবনকাল কাটান দামেশকে। তাঁর পিতাসহ হাম্বলি মাজহাবের বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে তিনি ফিকাহ, হাদিস, উসূল, তাফসির, কালাম ইত্যাদি শেখেন। এক পর্যায়ে তিনি হাম্বলি মাজহাবে ইজতেহাদের পর্যায়ে পৌছেঁন এবং ফতোয়া দেওয়া ও শিক্ষকতা করার মতো যোগ্যতা অর্জন করেন। দামেশকে তার পিতার মৃত্যুর পর তিনি পিতার স্থলাভিষিক্ত হন এবং কোরআনের তাফসির পড়ানোর দায়িত্বে নিয়োজিত হন।
 
ইবনে তাইমিয়া অন্যান্য ধর্ম এবং মাজহাব নিয়েও পড়ালেখা করেন এবং এমন কিছু ফতোয়া দিতে থাকেন যেগুলোর সাথে আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবসহ শিয়া মাজহাবেরও কোনো মিল ছিলো না। ইবনে তাইমিয়া মুসলমানদের মাঝে প্রচলিত কিছু রীতিনীতিরও সমালোচনা করতে থাকেন এবং এমনকি কিছু কিছু সুন্নাতের অনুসরণকে শিরকের সাথে তুলনা করার পাশাপাশি আল্লাহর সাথে দূরত্ব সৃষ্টির কারণ বলেও উল্লেখ করেন। মুসলমানদের দৃঢ় বিশ্বাসগুলোর কোনো কোনোটির ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার কারণে এবং ব্যতিক্রমধর্মী ফতোয়া প্রদান করার কারণে ইবনে তাইমিয়ার জীবনে শুরু হয় ব্যাপক তোলপাড়। হিজরি ৬৯৮ সাল পর্যন্ত ইবনে তাইমিয়ার চিন্তাধারা সম্পর্কে তেমন কিছুই শোনা যায় নি, কিন্তু এখন আবার ধীরে ধীরে তার চিন্তাধারার উত্থান ঘটছে। উদাহরণত বলা যায় এ বছরই আশআরি মাজহাবের বিরুদ্ধে একটি বই লেখা হয়েছে যে বইটি দামেশকে ব্যাপক হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে।
ইবনে তাইমিয়া নিজেকে 'সালাফি' বলে মনে করতেন।সালাফি শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে অতীতচারিতা বা পূর্বপুরুষদের নিঃশর্ত অনুসরণ করা। তবে 'সালাফিয়া' একটি ফের্কার নাম যেই ফের্কায় নবীজী (সা), তাঁর সাহাবিবর্গ এবং তাবেয়িনদের অনুসরণের দাবী করা হয়। তাবেয়িন বলতে বোঝায় এমন শ্রেণীর লোকজনকে যাঁরা এক বা একাধিক সাহাবির সাহচর্য লাভে ধন্য হয়েছেন। সালাফিরা মনে করতেন ইসলামের সকল আকিদা-বিশ্বাস সাহাবি এবং তাবেয়িনদের আমল অনুযায়ী বাস্তবায়িত হওয়া উচিত। আর ইসলামী আকিদা কেবল কিতাব এবং সুন্নাত থেকেই গ্রহণ করতে হবে,আলেমদের উচিত হবে না কোরআনের বাইরের কোনো দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে কোনো কিছু আমল বা বাস্তবায়ন করা। সালাফিদের চিন্তায় বিবেক-বুদ্ধি বা যুক্তি তথা গবেষণার কোনো স্থান নেই,তাদের কাছে কেবল কোরআন-হাদিসের মূল টেক্সটই প্রমাণের জন্যে যথেষ্ট। তাদের যুক্তির বিরোধিতাকারীদের সাথে তারা কঠোর ব্যবহার করতো।
 
ইবনে তাইমিয়া সালাফি ইসলাম তথা প্রাচীন ইসলামে ফেরার অজুহাত দেখিয়ে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে এমন সব দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত দিতে থাকেন যার ভিত্তিতে মুসলমানদের বহু চিন্তা ও কাজকর্ম প্রশ্নের সম্মুখিন হয়ে যায়,এমনকি বহুসংখ্যক মুসলমান ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত অর্থাৎ কাফের হিসেবে পরিগণিত হয়।
ইবনে তাইমিয়া যখন তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনা প্রসূত বিভিন্ন মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন, তখন তার ঐসব বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে,বিশেষ করে তিনি যখন আল্লাহর গুণাবলি নিয়ে কথা বলতেন তখন। তিনি আল্লাহ সম্পর্কে বিশ্বাস করতেন যে আল্লাহ সশরীরী একটি সত্ত্বা এবং তিনি আকাশসমূহের উর্ধ্বে থাকেন। ইবনে তাইমিয়াই প্রথম কোনো মুসলিম যিনি আল্লাহর সশরীরী সত্ত্বার প্রবক্তা এবং এর পক্ষে লেখালেখিও করেছেন। তিনি মহানবী (সা) এর রওজা শরিফ যিয়ারত করা কিংবা তাঁর সম্পর্কে কোনো স্মরণসভা বা কোনো অনুষ্ঠান করাকে হারাম এবং শের্‌ক বলে মনে করতেন। এছাড়া তিনি কোনো ওলি আওলিয়া কিংবা নেককার বান্দাদের শরণাপন্ন হওয়া অথবা তাদের সহায়তা প্রার্থনা করাকেও হারাম বলে মনে করতেন কেননা তাঁর ধারণা এ ধরনের আমলের মানে হলো আল্লাহ বহির্ভুত সত্ত্বার শরণাপন্ন হওয়া।
 
ইবনে তাইমিয়া নবীজীসহ সকল অলিআওলিয়ার কবর মেরামত করা বা পবিত্র কোনো কবরের পাশে মসজিদ নির্মাণ করারও বিরোধী ছিলেন এবং এ ধরনের কাজকে তিনি শিরক বলে মনে করতেন। তাঁর এইসব বক্তব্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মাজহাবের আলেম ওলামাগণ তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তারা আল্লাহর সশরীরী সত্ত্বায় বিশ্বাসী এবং আল্লাহকে মানুষের মতোই চিন্তা করতে অভ্যস্থ এমন কোনো ব্যক্তির এ ধরনের কথাবার্তা গ্রহণ করতে পারছিলেন না। তাঁরা কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্যগুলোকে খণ্ডন করে বহু বই লিখেছেন। বিশেষ করে আল্লাহ যে অশরীরী বা দৈহিক কাঠামোর উর্ধ্বে এবং মানুষের উপলব্ধিরও উর্ধ্বে সে সম্পর্কে বিস্তারিত লেখালেখি করেছেন। সেইসাথে তাঁরা আদালতে আবেদন জানিয়েছেন ইবনে তাইমিয়ার বিপথগামী চিন্তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যে। ইবনে তাইমিয়া প্রতিবাদের এই ঝড়ের মুখেও তার বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটাতে থাকেন।
কেবল তাই নয় যারা তাঁর বিরোধিতা করছে তাদেরকে তিনি কাফের বলে অভিহিত করেন এমনকি কখনো কখনো তাঁর লেখায় তাদেঁরকে অভিহিত করার ক্ষেত্রে অশোভন শব্দও ব্যবহার করেছেন। ইতিহাসে এসেছে হিজরি ৭০৩ সালে ইবনে তাইমিয়া যখন বিখ্যাত আরব মুসলিম আরেফ 'মহিউিদ্দন আরাবি'র লেখা 'কুসুসুল হেকাম' নামক বইটি পড়েন,তখন তিনি এতে তাঁর নিজস্ব মত ও বিশ্বাসের বিরোধী বক্তব্য খুঁজে পান। সেজন্যে পাল্টা একটি বই লেখেন 'আন্নুসুসু আলাল ফুসুস' নামে। এ বইতে মহিউদ্দিন আরাবি'র চিন্তাধারাকে প্রত্যাখ্যান করে তাঁর অনুসারীদেরকে অভিশাপ দেওয়া হয়েছে। এভাবে মতবিরোধ ক্রমশ তীব্র আকার ধারণ করে।
মুসলমানদের মাঝে প্রচলিত বিখ্যাত ধ্যান-ধারণার সাথে ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্য সাংঘর্ষিক হবার ফলে ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। যার পরিণতিতে ৭০৫ হিজরিতে সিরিয়ার আদালত তাঁর বিরুদ্ধে মিশরে নির্বাসনের রায় দেয়। হিজরি ৭০৭ সালে তিনি কারামুক্ত হন এবং কয়েক বছর পর আবার সিরিয়ায় ফিরে আসেন এবং তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গির অনকূলে পুনরায় লেখালেখি করতে থাকেন। ৭২১ হিজরিতে আবারো তাঁকে কারাগারে আটক করা হয় এবং ৭২৮ হিজরির জিলকাদ মাসে শেষ পর্যন্ত দামেশকের কেল্লা কারাগারে মারা যান।
ইবনে তাইমিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর চিন্তাদর্শেরও প্রায় মৃত্যু ঘটে গিয়েছিল। খুব কম লোকই তাঁর চিন্তাদর্শের অনুসারী ছিল।কিন্তু পাঁচ শতাব্দি পর 'মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদি'নামের এক লোক ইবনে তাইমিয়ার আকায়েদের ভিত্তিতে নতুন করে একটি ফের্কার জন্ম দেন।তাঁর ওই ফের্কার নাম হচ্ছে 'ওহাবিয়্যাত'বা ওহাবি মতবাদ। এই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব হিজরি ১১১৫ সালে সৌদি অরবে জন্মগ্রহণ করেন। তরুণ বয়সে তিনি ইবনে তাইমিয়ার চিন্তাধারায় প্রভাবিত ছিলেন। এমন একটি মতবাদের প্রবর্তন করেন তিনি ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষাগুলোর সাথে যার ব্যাপক মতপার্থক্য ছিলো। তবে তিনি তাঁর আকিদা বিশ্বাসের বিস্তারের ক্ষেত্রে নজদের শাসক 'মুহাম্মাদ বিন সাউদে'র শক্তি ও ক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়েছেন। আব্দুল ওহাব পুনরায় সালাফি মতবাদের প্রচার ঘটান। তিনি মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্র কেন্দ্র অর্থাৎ মক্কা এবং মদিনায় তাঁর এই মতবাদ পেশ করেন এবং ভয়াবহ সংঘর্ষের মাধ্যমে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
 
দ্বিতীয় পর্ব
মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাবের পিতা সন্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার শৈশব থেকেই উদ্বিগ্ন ছিলেন, কেননা তার ছেলের কথাবার্তায় আচার আচরণে গোমরাহি বা বিচ্যুতির লক্ষণ ছিলো স্পষ্ট। আব্দুল ওহাব মুসলমানদের বেশিরভাগ আকিদা বিশ্বাসকেই ঠাট্টা মশকরা করে উড়িয়ে দিতো। মদিনায় পড়ালেখা করার সময় প্রায়ই এমন কিছু বিষয় তুলে ধরতো নির্দিষ্ট একটি আকিদার সাথে যা ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ। শিক্ষকরাও তার ভবিষ্যৎ বিচ্যুতির ব্যাপারে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাব মদিনাতেও ইসলামের নবির শরণাপন্ন হওয়া বা তাঁর রওজা যিয়ারত করতে আসা মানুষের সমালোচনা করতেন। জানা যায়, শৈশবে তিনি মিথ্যা নবুয়্যতের দাবিদার যেমন মুসাইলামাতুল কাজ্জাব কিংবা সাজ্জাদ, আসওয়াদ আনাসির মতো ব্যক্তিদের জীবনী পড়তেন এবং এ ব্যাপারে ভীষণ আকর্ষণ বোধ করতেন। তবে তাঁর আকিদা বিশ্বাসের ওপর সরাসরি ছাপ পড়েছে ইবনে তাইমিয়া এবং তাঁর ছাত্র ইবনে কাইয়্যেম জুযির মতো লোকদের।
মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব যখন তার আকিদার কারণে মদিনার লোকজনের বিরোধিতার সম্মুখিন হলেন তখন মদিনা ছেড়ে চলে গেলেন নাজদে। তারপর কিছুদিন ছিলেন বসরায়। বসরায় যখন ছিলেন তখন তিনি তাঁর আকিদা নিয়ে আবারো বাড়াবাড়ি করেন এবং বসরা থেকেও বিতাড়িত হন। ওহাব ধর্মের সরল সঠিক পথ থেকে এতো বেশি বিচ্যুত হন যে আপামর মুসলমানকে কাফের-মুশরিক বলে বেড়াতে শুরু করেন এমনকি মুসলমানদের হত্যা করাকে ওয়াজিব বলেও মন্তব্য করেন। আব্দুল ওহাব তার অসুস্থ চিন্তাধারার ভিত্তিতে এমনকি মক্কা-মদিনার মতো ইসলামের পবিত্রতম ভূখণ্ডগুলোকে পর্যন্ত 'দারুল কুফ্‌র' এবং 'দারুল হার্‌ব' বলে অভিহিত করেন। পবিত্র এই স্থাপনাগুলোকে দখল করা এবং ধ্বংস করাকে তার অনুসারীদের ওপর ওয়াজিব বলে ঘোষণা করেন। সহিংসতা ছিল আব্দুল ওহাব এবং তার অনুসারীদের আচরণগত প্রধান বৈশিষ্ট্য।

তৃতীয় পর্ব
আব্দুল ওহাবের ভ্রান্ত আকিদার বিরুদ্ধে মুসলিম জনগোষ্ঠি তো বটেই, এমনকি তার পিতা এবং আপন ভাইও ঐ মতবাদ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার ভাই শায়খ সোলাইমানের জীবনকথায় এসেছে আব্দুল ওহাবের পিতা জীবিতকালে ছেলের এ ধরনের আকিদা প্রচারের ব্যাপারে বাধা দিয়েছিলেন। তবে হিজরি ১১৫৩ সালে পিতার মৃত্যুর পর অনগ্রসর কিছু লোকের মাঝে তার আকিদা প্রচারের সুযোগ পায়। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাবের আকিদার বিষয়টি স্পষ্ট হবার পর তার বিরুদ্ধে বড়ো বড়ো বহু আলেম উঠে আসেন। স্বয়ং তার ভাই শায়খ সোলায়মান-যিনি ছিলেন একজন হাম্বলি আলেম-তিনিও ওহাবের আকিদা প্রত্যাখ্যান করে একটি বই লেখেন। ইমানী দায়িত্বের অংশ হিসেবে ওহাবকে কোরআন হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বহু চিঠিও লেখেন তিনি এবং ইসলামের ভেতর এসব বেদায়াত প্রবেশ করানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। একটি পত্রে তিনি সূরা নিসা'র ১১৫ নম্বর আয়াত উদ্ধৃত করেন যেখানে লেখা রয়েছেঃ 'সত্য সুস্পষ্ট হবার পর যে কেউ নবীজীর বিরোধিতা করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য কোনো পথের অনুসরণ করে, আমরা তাকে সেই বাতিল পথেই চলতে দেবো এবং দোযখে প্রবেশ করাবো,সেই স্থানটি খুবই বাজে।'
তারপরও আব্দুল ওহাব তার জাহেলি বিশ্বাসের ওপর স্থির থাকে এবং যে-ই তার দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে তাকেই কাফের বলে সাব্যস্ত করে। সোলায়মান এক জায়গায় আব্দুল ওহাবের মূর্খতার কথা উল্লেখ করে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেনঃ রাসূলে আকরাম (সা) বলেছেন 'কোনো বিষয়ে যার সঠিক জ্ঞান নেই সে বিষয়ে তার উচিত নয় মতামত ব্যক্ত করা,বরং তার উচিত হলো যেটা সে জানে না তা একজন জ্ঞানী লোকের কাছ থেকে জেনে নেওয়া'। সূরা আম্বিয়ার ৭ নম্বর আয়াতেও এসেছেঃ فاَسئلوا أهلَ الذکر ان کنتم لا تعلمون অর্থাৎ'যদি না জানো তাহলে যে জানে তার কাছে জিজ্ঞেস করো।'সেজন্যেই শায়খ সোলায়মান বলতেন-ওহাবের জ্ঞানের অভাব রয়েছে,তাই তার উচিত যারা জ্ঞানী ও ইসলামী চিন্তাবিদ তাদেরকে জিজ্ঞেস করা এবং তাদের অনুসরণ করা।
 
যাই হোক ওহাবের বিরুদ্ধে সে সময় এতোসব বিরোধিতা সত্ত্বেও সে তার ভ্রান্ত আকিদাকে নাজদ অঞ্চলের কিছু লোকের মাঝে প্রচার করতে সক্ষম হয়েছিল। সমাজ বিজ্ঞানীগণ এর কারণ হিসেবে বলেছেন ঐ এলাকাটি ছিল প্রত্যন্ত মরু,তাদের লেখাপড়া কিংবা দ্বীনী জ্ঞান ছিল একেবারেই নগণ্য। সেই এলাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৈন্যতার কারণেই সেখানকার কিছু লোকজন ওহাবের আকিদা গ্রহণ করেছিল। এই শ্রেণীর লোকজনকে যে-কেউ খুব সহজেই প্রতারিত করতে পারে। তাছাড়া ওহাবের কথাবার্তার ভঙ্গিটাও ছিল বেশ আকর্ষণীয় এবং মুগ্ধকর। সবোর্পরি মুহাম্মাদ ইবনে সাউদ এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শক্তির ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা ছিল তার পেছনে।
এমনিতেই পশ্চিমা উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো এ সময় চারদিক থেকে মুসলিম বিশ্বকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল। ব্রিটিশরা পূর্বদিক থেকে ভারতের বৃহৎ অংশ দখল করে পারস্য উপসাগর উপকূলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। তারা প্রতিটি মুহূর্তে ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। ফরাশিরাও নেপোলিয়নের নেতৃত্বে মিশর, সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন দখল করে ভারতের দিকে যাবার চিন্তা করছিলো। রুশরাও চেয়েছিলো ইরান এবং তুরস্কে বারবার হামলা চালিয়ে তাদের সাম্রাজ্য একদিক থেকে সেই ফিলিস্তিন পর্যন্ত অন্যদিকে সুদূর পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত করতে। সে সময়কার আমেরিকাও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর দিকে তাদের লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল। তারা লিবিয়া এবং আলজেরিয়ায় গুলিবর্ষণ করে মুসলিম বিশ্বে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা চালিয়েছিল। এরকম একটি কঠিন পরিস্থিতিতে যখন শত্রুদের মোকাবেলায় মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতামূলক হৃদ্যতার প্রয়োজন ছিলো,ঠিক সে সময় মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব ভ্রান্ত মতাদর্শ প্রচারের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে কাফের সাব্যস্ত করে মুসলিম ঐক্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছিলো।
 
এদের মাঝে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদই ছিলো সবচেয়ে অগ্রসর। তারা মুসলমানদের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করে তাদের সম্পদ লুট করার চেষ্টা চালিয়েছিল। এই ফাটল সৃষ্টি করার জন্যে মুসলিম বিশ্বে মাজহাবগত মতপার্থক্য সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। এ কারণেই কোনো কোনো ঐতিহাসিক ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের স্বার্থসিদ্ধির সাথে ওহাবি ফের্কার আবির্ভাবের যোগসূত্রের বিষয়টিকে উড়িয়ে দেন নি। ইতিহাসে ব্রিটিশ গোয়েন্দা মিস্টার হ্যাম্পারের সাথে আব্দুল ওহাবের যোগাযোগের কথা এসেছে। হ্যাম্পার মুসলিম দেশগুলোতে বৃটেনের পক্ষে গোয়েন্দাবৃত্তি করতো। সে ইসলামী বেশভুষায় মূলত মুসলমানদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির পথ খুজেঁ বেড়াতো। হ্যাম্পার তার ডায়েরিতে ব্যক্তিগত স্মৃতিকথায় লিখেছে ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলীয় বসরা শহরে আব্দুল ওহাবের সাথে তার দেখা হয়। ওহাব সম্পর্কে তার মূল্যায়ন এরকমঃ 'মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাবের মাঝে আমি আমার হারানো আমিকে খুজেঁ পেলাম। মাজহাব সংরক্ষণে তার নির্লিপ্তি, তার আত্মম্ভরি ও অহমিকাপূর্ণ আত্মা ও মানসিকতা, সমকালীন আলেমদের প্রতি তার ঘৃণা, স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি এমনকি চার খলিফা সম্পর্কে গুরুত্বহীনতা ইত্যাদি ছিল তার চিন্তাগত বৈশিষ্ট্য। কোরআন ও সুন্নাহর সামান্য জ্ঞানই ছিল মূল ভিত্তি। ওহাবের এইসব গুণাবলিই ছিল দুর্বল স্থান যার মধ্য দিয়ে তার ভেতরে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ ঘটে।'
 
হ্যাম্পারের বক্তব্য থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় তাহলো সে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাবকে ওহাবি ফের্কা প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছিলো এবং এ ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার তাকে ও মুহাম্মাদ ইবনে সাউদকে সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দেবে বলেও ঘোষণা করেছে। কিন্তু বাধ সেধেছে সে সময়কার আলেম সমাজ। ওহাবের ভাই,পিতাসহ সবাই তার ভ্রান্ত আকিদার বিরোধিতা করেছে। পিতার মৃত্যুর পর ওহাব যখন যেখানে গেছে কিছুদিন পরপর সেখান থেকে বিতাড়িত হয়েছে। সবশেষে এসে ভিড়েছে নজদের বিখ্যাত শহর দারিয়ার গভর্নর মুহাম্মাদ ইবনে সাউদের কাছে। ইনিই ছিলেন আলে সউদের পূর্বপুরুষ। তার সাথে ওহাবের চুক্তি হয় উগ্র ওহাবি চিন্তাধারা বিকাশের মধ্য দিয়ে ইবনে সাউদের সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটানো হবে। শাসক থাকবেন ইবনে সাউদ আর ধর্মীয় প্রচারণা চালাবে ওহাব। এই চুক্তিকে আরো মজবুত করার জন্যে দুই পরিবার বৈবাহিক সূত্রেও আবদ্ধ হয়।

চতুর্থ পর্ব
আলে সাউদের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আব্দুল ওহাব তার মতবাদের বিস্তার ঘটায়। বিশেষ করে তারা আশপাশের শহর এবং গোত্রগুলোতে দ্রুততার সাথে প্রচার কাজ শুরু করে। ওহাবি মতবাদ প্রচারের একেবারে শুরুতেই যে কাজটি করা হয় তাহলো উয়াইনা'য় সাহাবাদের এবং আওলিয়াদের মাযারগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। আব্দুল ওহাব আল্লাহর অলিদের শরণাপন্ন হওয়াকে শিরক এবং মূর্তিপূজার মতো অপরাধ বলে গণ্য করতো এবং যারা একাজ করতো তাদেরকে কাফের বলে সাব্যস্ত করতো। তাদেরকে হত্যা করা জায়েয এবং তাদের মালামালকে যুদ্ধে প্রাপ্ত গনিমত বলে ঘোষণা করেছিল। এই ফতোয়া পেয়ে ওহাবের অনুসারীরা হাজার হাজার নিরীহ মুসলমানের রক্ত ঝরিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো সে সময় দিরইয়ের লোকজন অভাবগ্রস্ত ছিল। এই রক্তপাতের পর তাদের ভাষায় প্রচুর গনিমত পাবার ফলে অভাব কেটে যায়। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ বুশ্‌র নজদি' লিখেছেনঃ আমি আমার কাজের শুরুতে দিরইয়া শহরের দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখেছি,কিন্তু পরবর্তীতে এই শহর সাউদের অর্থাৎ মুহাম্মাদ ইবনে সাউদের উত্তর পুরুষের সময়ে বেশ সম্পদশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু কীভাবে এতোটা সম্পদশালী হলো তার বর্ণনা প্রসঙ্গে ইবনে বুশর ইতিহাসের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেনঃ নজদের অন্যান্য শহরসহ বিভিন্ন গোত্রের মুসলমানদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের সম্পদ লুট করে এরকম সম্পদশালী হয়েছে। যারাই ওহাবি মতবাদ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। হামলা করে যেসব গনিমত পেত তার সবই শায়খ মুহাম্মাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতো আর মুহাম্মাদ ইবনে সাউদ, তার অনুমতিক্রমে একটা অংশ নিতো। আব্দুল ওহাব তার ইচ্ছামতো এই সম্পদ ব্যবহার করতো। অনেক সময় দেখা যেত ওহাব সকল সম্পদ মাত্র দু'তিন জনের মাঝে বিলি করে দিয়েছে। ওহাব বিভিন্ন শহরের লোকজনকে তার মতবাদের দিকে আমন্ত্রণ জানাতো। যারা গ্রহণ করতো তারা নিরাপদ ছিলো,আর যারা বিরোধিতা করতো তাদের জান-মালকে হালাল ঘোষণা করে আক্রমণ চালাতো। নজদ এবং নজদের বাইরে ওহাবিরা এরকম বহু যুদ্ধ করেছে। ইয়েমেন, হেজাজ, সিরিয়ার উপকণ্ঠ, ইরাকে ওহাবিরা যতো যুদ্ধ করেছে সবই তাদের মতবাদ গ্রহণে অস্বীকৃতির কারণেই করেছে। 'আহসা' শহরের 'ফুসুল' নামের একটি গ্রামের তিন শ' মুসলমানকে ওহাবিরা হত্যা করে তাদের সকল মালামাল লুট করেছে।
 
আব্দুল ওহাব নিজেকে হাম্বলি মাজহাবের অনুসারী বলে পরিচয় দিতেন। অথচ এই মাজহাবের মূল প্রবক্তা আহমাদ ইবনে হাম্বলকেও কাফের বলে ঘোষণা করেছিল। কেননা তিনি কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ) এর মাযার যিয়ারত সম্পর্কে বই লিখেছিলেন। ওহাবের দৃষ্টিতে পবিত্র কোনো স্থাপনা যেমন অলি-আওলিয়া, মাসুমিনদের মাযারের মতো মহান স্থাপনাগুলো যিয়ারত করা শির্‌ক, তাই এইসব স্থাপনা যিয়ারতকারীদের জানমাল হরণ করা মোবাহ অর্থাৎ সওয়াবের কাজ। তার এই চরমপন্থী মতবাদ শুরু থেকেই যে আলেমদের বিরোধিতার সম্মুখিন হয়েছিল সেকথা আমরা ইতোপূর্বেও বলেছি। সে সময়কার হেজাজের বিখ্যাত আলেমে দ্বীন এবং মক্কার মুফতি সাইয়্যেদ আহমাদ ইবনে যিনি দাহলান 'খুলাসাতুল কালাম' নামক গ্রন্থে লিখেছেন '১১৬৫ হিজরিতে আব্দুল ওহাবের জীবিতাবস্থায় নজদের একদল ওহাবি আলেম মক্কা শহরে গিয়েছিলেন সেখানকার আলেমদের সাথে বাহাস করার জন্যে। তারা তাদের আকিদার কথা বর্ণনা করতো আর মক্কার আলেমগণ তাদের বক্তব্য খণ্ডন করতেন। কোরান-হাদিস বিরোধী ওহাবি আকিদা মক্কী আলেমগণ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তাঁরা ওহাবি মতবাদকে ভিত্তিহীন এবং নষ্ট আকিদা বলে মনে করতেন। ঠিক সে সময় মক্কার কাজি ওহাবি আলেমদেরকে কারাবন্দী করার আদেশ দেন। ঐ আদেশের পর কিছু কিছু ওহাবি আলেম পালিয়ে গিয়েছিলো আর কিছু কিছু আলেমকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল।
 
ওহাবি আলেমদেরকে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা একটু ভিন্নভাবে ১১৯৫ হিজরি তথা ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দেও ঘটেছিলো। আলে সাউদ এবং ওহাবি ফের্কার মূল কেন্দ্র দিরইয়া শহরের ওহাবি আলেমরা মক্কায় গিয়েছিলো সেখানকার আলেমদের সাথে নতুন তৌহিদ নিয়ে কথা বলার জন্যে। মক্কার আলেমগণ তখনো ওহাবি আলেমদেরকে কাফের বলে তাদেরকে মক্কা থেকে বিতাড়িত করেছিল এবং তাদের ওপর হজ্ব করা বা আল্লাহর ঘর যিয়ারত করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলো। এখানে একটি প্রশ্ন এসে যায়,তাহলো ওহাবিরা কেন তাদের আকিদা নিয়ে মক্কায় যেত? জবাব হলো মক্কা শহর ছিলো ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থান ও প্রাণকেন্দ্র। তাই ওহাবিরা চেয়েছিল মক্কা দখল করে তাকে তাদের ধর্মীয় কেন্দ্র বানাতে যাতে মুসলমানরা ইসলামের পরিবর্তে ওহাবি আকিদায় দীক্ষিত হয়।
 
ইতোমধ্যে মুহাম্মাদ ইবনে সাউদ ১১৭৯ হিজরি তথা ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর স্থলাভিষিক্ত হন তাঁরই পুত্র আব্দুল আযিয। বাবার মতো আব্দুল আযিযও ওহাবের সাথে মৈত্রীতে আব্দ্ধ হন। বাবা বেঁচে থাকতে আব্দুল আযিয পিতার সেনাবাহিনীর একাংশের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন,আব্দুল ওহাবের পৃষ্ঠপোষকতায় সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তাই সৌদি আরবের বিরাট একটি অংশ দখল করতে সক্ষম হন তিনি। ওহাবি মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব শেষ পর্যন্ত ১২০৭ হিজরিতে অর্থাৎ ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ৯৬ বছর বয়সে মারা যান। তার মৃত্যুর পর তার সন্তানেরা ওহাবি মতবাদ প্রচারের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। তারই উত্তরপুরুষ আব্দুল লতিফ ওহাবি মতবাদের ওপর বহু বই লিখেছেন। এভাবে ওহাবের ছেলেরা, পৌত্রেরা ভ্রান্ত ওই মতবাদ ব্যাখ্যা করে বহু বই লিখেছেন।
 
ওহাবিদের চরমপন্থার ভয়াবহ একটি নিদর্শন হলো ইরাকের পবিত্র কারবালা শহরে হামলা চালিয়ে হাজার হাজার যিয়ারতকারীকে হত্যা করা এবং সেখানে অবস্থিত ইমাম হোসাইন (আ) এর মাযারে হামলা চালানো। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে সাউদ বিন আব্দুল আযিয,নজদের জঙ্গি আরব সেনাদের মধ্য থেকে বিশ হাজারের একটি বাহিনীকে কারবালা শহরে হামলার উদ্দেশ্যে পাঠান। ঐ সেনারা প্রতমে কারবালা শহর অবরোধ করে এভং পরে জোর করে শহরে প্রবেশ করে। সে সময় কারবালা ছিলো ব্যাপক খাতিমান ও সম্মানীয়। ইরান, তুরস্ক এভং আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যিয়ারতকারীগণ কারবালায় যেতেন ইমাম হোসাইন (আ) এর মাযার যিয়ারত করার জন্যে। সাউদ এই যিয়ারতকারী এবং তাদেরকে আশ্রয় প্রদানকারীকে কাফের বলে ঘোষণা করে সবাইকে মর্মান্তিকভাবে হত্যা করে। আত্মগোপনকারী কিংবা পলায়নকারীরা ছাড়া কেউ তাদের হাত থেকে রক্ষা পায় নি।
 
ইতিহাসে এসেছে ওহাবিরা কারবালা শহরের অন্তত ৫ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল। সাউদের এই নৃশংস সেনারা নবীজীর সন্তান হোসাইন ইবনে আলি (আ) এর মাযারের মর্যাদাটুকুও রাখে নি,মাযারটিকে তারা ধ্বংস করে দিয়ে সোনা-রূপাসহ সকল সম্পদ লুট করে নিয়ে গিয়েছিলো। ভয়াবহ সেই ঘটনার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো সে সময়।

পঞ্চম পর্ব
কারবালায় হামলার এই বিপর্যয়কর ঘটনায় মুসলিম বিশ্বে ওহাবিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিলো। সমকালীন কবিগণ এই হত্যাকাণ্ড এবং ইমাম হোসাইন (আ) এর মাযারের সম্মান ও পবিত্রতা বিনষ্ট করার ঘটনা নিয়ে বহু মর্সিয়া রচনা করেছিলেন। ওহাবিরা বারো বছর ধরে মাঝে মাঝেই কারবালা শহর এবং তার আশেপাশে হামলা চালিয়েছিল। নাজাফ শহরেও তারা হামলা চালায়। হামলা চালিয়ে তারা সেখানকার অর্থসম্পদ লুট করে নেয়। ইরাকের সমকালীন বিশিষ্ট আলেম আল্লামা সাইয়্যেদ জাওয়াদ আমেলি কারবালায় ওহাবিদের আক্রমণ সম্পর্কে লিখেছেনঃ '....(সাউদ) ১২১৬ হিজরিতে হোসাইন (আ) এর মাযারে হামলা চালায়। শিশুসহ বহু মানুষকে সে হত্যা করে। তাদের মালামাল লুট করে নেয় এবং হারাম শরিফের ওপর এমন অত্যাচার চালায় যে আল্লাহই ভালো জানেন।' কারবালায় ওহাবিদের আক্রমণের ফলে তাদের বিরুদ্ধে জনগণের ঘৃণা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌছেঁ যে ১২১৮ হিজরির গ্রীষ্মে সাউদের পিতা আব্দুল আযিযকে ৮৩ বছর বয়সে হত্যা করা হয়। হত্যাকারী ছিলো একজন শিয়া। সাউদের সেনারা ১২২০ হিজরিতেও পবিত্র নাজাফে ইমাম আলী (আ) এর পবিত্র মাযার স্থাপনায় আক্রমণ করে। কিন্তু নাজাফের লোকজনের নজিরবিহীন প্রতিরোধের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

লেখকদের বর্ণনায় এসেছে একদল মানুষ এবং দ্বীনী এলেম শিক্ষার্থী নাজাফের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন কাশেফ আলগাত্তার সাথে দিবারাত্রি এই শহর রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর ঘর ছিলো অস্ত্রের গুদাম। এই মুজাহিদ আলেম নাজাফের প্রতিটি প্রবেশদ্বারে এবং সকল টাওয়ারে লোকজনের সাথে তাঁর কজন ছাত্রকে প্রতিরক্ষার দায়িত্বে মোতায়েন করেছিলেন। নজদের ইতিহাসবিদ ইবনে বুশরা নাজাফে ওহাবিদের হামলা সম্পর্কে লিখেছেনঃ ১২২০ হিজরিতে বিশাল একটি সেনাদল ইরাকের নাজাফ শহরের দিকে পাঠায়। শহরের পাশে পৌঁছতেই ওহাবি সেনারা বেশ গভীর খন্দকের মুখোমুখি হয়। ওহাবি সেনারা কিছুতেই ওই পরিখা অতিক্রম করতে সক্ষম হলো না। নাজাফ শহরের উঁচু প্রাচীর বা স্থান থেকে তীর নিক্ষেপের ঘটনায় বহু ওহাবি সেনা মারা যায়,বাকিদের কেউ কেউ ফিরে যায় এবং আশেপাশের গ্রামে লুটপাট চালায়। ওহাবিরা এভাবেই মূল ইসলামে ফেরার প্রতারণাপূর্ণ শ্লোগান দিয়ে নিরীহ মুসলমানদের হত্যা করে। অথচ কোরআনের শিক্ষা হলো মুসলমানদেরকে ঐক্য, সংহতি, ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির দিকে আহ্বান জানানো। ইতিহাস সবসময় ভালো এবং মন্দের চিত্র মানুষের সামনে তুলে ধরে যাতে চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ সত্য এবং বাতিলকে সুস্পষ্টভাবে দেখতে পায়।
 
তো ওহাবি মতবাদের ইতিহাস হচ্ছে এমন একটি ক্যানভাসের মতো যেখানে উগ্র সহিংসতার বিচিত্র দৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। আব্দুল ওহাবের মৃত্যুর পর তার দুই ছেলে বাবার সেই সহিংস ধারা অব্যাহত রাখে। মুহাম্মাদ বিন সাউদের সন্তানও ওহাবি মতবাদ প্রচারে নামে এবং তার অধীনস্থ ভূখণ্ডে ওহাবি ফের্কার বিস্তার ঘটায়। এক্ষেত্রে আব্দুল আযিযের ভূমিকাটা ছিল উল্লেখযোগ্য। সে ওহাবি ফের্কা বিস্তারে গণহত্যা চালিয়ে ব্যাপক ত্রাস সৃষ্টি করেছিলো। আব্দুল আযিয তার ছেলে সাউদসহ পবিত্র শহরগুলোতে রক্তপাত ঘটিয়েছে এবং পবিত্র সব মাযারসহ সকল ধর্মীয় নিদর্শন ধ্বংস করে দিয়েছে। পবিত্র কারবালা শহর এবং ইমাম হোসাইন (আ) এর মাযার শরিফ ধ্বংস করার পর তারা ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র মক্কা শহর দখল করতে চেয়েছিলো।
 
পবিত্র কারবালা ও নাজাফ শহরে হামলা চালানোর পর ওহাবিরা ১২১৭ হিজরিতে হেজাজের গুরুত্বপূর্ণ শহর তায়েফে হামলা চালায়। আব্দুল আযিযের সময় তার ছেলে সাউদ ছিল ওহাবিদের সেনা অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে পরিচালিত এই হামলা ছিল নৃশংসতম একটি হামলা। এ সম্পর্কে ইরাকের বিখ্যাত মনীষী কবি জামিল যাহাভি লিখেছেনঃ "ওহাবিদের নোংরাতম কাজগুলোর একটি ছিল তায়েফের গণহত্যা। ছোটোবড়ো কারো পরেই কোনোরকম দয়া করে নি তারা। এমনকি দুধের শিশুকেও তারা মায়ের কোলে মাথা কেটে হত্যা করেছে। ঘরে ঘরে যখন আর কেউ বাকি ছিলো না তখন তারা মসজিদে,বাজারের দোকানে দোকানে গিয়ে লোকজনকে হত্যা করেছে। কোরান পড়া অবস্থায় এমনকি নামায আদায়কালেও তারা হত্যা করেছে। গুরুত্বপূর্ণ বইপুস্তক, কোরান, হাদিস, বোখারি মুসলিম শরিফসহ হাদিস-ফেকাহর অন্যান্য কিতাবও তারা বাজারের গলিতে ফেলে দিয়ে পদদলিত করেছে।
 
তায়েফে এই গণহত্যা চালানোর পর ওহাবিরা মক্কার আলেমদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখে ওহাবি মতবাদের প্রতি আমন্ত্রণ জানায়। 'হিন্দি' নামে পরিচিত শাহ ফজলে রাসুল কাদেরি "সাইফুল জাব্বার" গ্রন্থে লিখেছেনঃ মক্কার আলেমগণ কাবার পাশে সমবেত হয়েছিলেন ওহাবিদের পত্রের জবাব দেওয়ার জন্যে। এরিমাঝে গণহত্যা-দুর্গত তায়েফের একদল লোক মাসজিদুল হারামে এসে সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানালো। মক্কার জনগণের মাঝে তখন শোরগোল পড়ে গেল যে ওহাবিরা খুব শীঘ্রই মক্কায় হামলা চালাবে। তাদের মাঝে ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হলো। এদিকে হজ্ব পালনের জন্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা আলেমগণ, সুন্নিদের চার মাজহাবের মুফতিগণ ঘোষণা করেন যে ওহাবিরা কাফের এবং অমুসলিম,তাদের সাথে জেহাদ করা ওয়াজিব। তাঁরা মক্কার আমিরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ওহাবিদের মোকাবলায় লড়বার জন্যে।" কিন্তু ওহাবিদের সাথে যুদ্ধ করতে আলেম সমাজ সম্মত হলেও মক্কাবাসীরা তাদের সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিলো না। এদিকে সাউদও মক্কায় একটি চিঠি লিখে হুমকি দিয়েছিল-তিন দিনের মধ্যে কাবা যিয়ারতকারীদের সবাইকে কাবা ত্যাগ করতে হবে।
 
মক্কার গভর্নরসহ আরো অনেক আলেম সাউদের কাছে গিয়ে মক্কাবাসীদের নিরাপত্তা চাইলো। সাউদও একটি চিঠিতে সবাইকে নিরাপত্তা দিয়েছিলো। ১২১৮ হিজরিতে সাউদ বিনাযুদ্ধে মক্কায় প্রবেশ করে। কাবা যিয়ারত করে লোকজনকে সমবেত করে তাদেরকে ওহাবি ফের্কার দাওয়াত দিয়ে বাইয়াত গ্রহণ করতে চাইলো। সেইসাথে সবাইকে বললো ওহাবি সেপাহীদের সাথে মক্কা শহরে যেতে এবং ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক মূল্যবান সব নিদর্শন ধ্বংস করে দিতে। মক্কা দখল করার পর ওহাবিরা ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের নিদর্শনগুলো ধ্বংস করে দেয়। নবীজী (সা) এর জন্মস্থানের গম্বুজ, হযরত আলী (আ) এর জন্মস্থানের গম্বুজ, হযরত খাদিজা (সা), আবু বকর (রা) এর স্মৃতিময় নিদর্শনগুলো ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলো। ওহাবিরা এইসব পবিত্র স্থাপনা ধ্বংস করার সময় তবলা বাজিয়ে গান গেয়ে নেচে নেচে উল্লাস করতো। ওহাবিদের এই জঘন্য কর্মকাণ্ডের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো। অনেকেই এ বিষয়ে বহু বইপুস্তক লিখেছেন।
 
৬ষ্ঠ পর্ব
কুয়েতের আহলে সুন্নাতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ডক্টর রেফায়ি "ওহাবি ভাইয়ের প্রতি পরামর্শ" নামক গ্রন্থে ওহাবি আলেমদের উদ্দেশ্যে লিখেছেনঃ তোমরা নবীজীর প্রথম হাবিবা বা সহধর্মিনী উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজাতুল কোবরা (সা) এর ঘর ধ্বংস করার অনুমতি দিয়েছো এবং কোনোরকম প্রতিক্রিয়া দেখাও নি। অথচ ঐ ঘরটি ছিলো কোরআন তথা ওহি অবতীর্ণ হবার পবিত্র স্থান....কেন তোমরা আল্লাহকে ভয় করছো না এবং পয়গাম্বরে কারিমের ব্যাপারে লজ্জা করছে না। ..তোমরা নবীজীর জন্মস্থানটিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে তাকে পশু বেচাকেনার স্থানে পরিণত করেছো যাকে কিছু নেককার ও ভালো মানুষ ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে তোমাদের ওহাবিদের ছোবল থেকে মুক্ত করায় গ্রন্থালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে....."
ওহাবিদের ভয়াবহতম এবং ন্যক্কারজনক আরেকটি কাজ-যে কাজের ক্ষতি সবসময়ের জন্যেই বহমান থাকবে-তা হচ্ছে মক্কার "আলমাকতাবুল আরাবিয়া" নামের বিশাল লাইব্রেরিতে আগুন দেওয়া। এই কুতুবখানায় দুর্লভ ও মূল্যবান ষাট হাজার কিতাব ছিল এবং চল্লিশ হাজারেরও বেশি হাতে লেখা অনন্য পাণ্ডুলিপি ছিলো। এগুলোর মাঝে সেই জাহেলি যুগের, ইহুদিদের, কুরাইশ কাফেরদেরও হাতে লেখা বহু নিদর্শন মজুদ ছিল। বিশাল এই গ্রন্থাগারে আরো ছিল প্রাচীন কোরআন, আলী (আ), আবু বকর, ওমর, খালেদ বিন ওলিদ, তারেক বিন যিয়াদসহ নবীজীর আরো বহু সম্মানিত সাহাবির হাতে লেখা অনন্য সব নিদর্শন। আলমাকতাবুল আরাবিয়া লাইব্রেরিতে আরো যেসব মূল্যবান নিদর্শন মজুদ ছিলো তার মধ্যে ছিলো রাসূলে খোদা (সা) এর অস্ত্রশস্ত্র, ইসলাম আবির্ভাবকালে যেসব মূর্তির পূজা করা হতো-যেমন লাত, উযযা, মানাত, হুবাল। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের বর্ণনায় এসেছে, ওহাবিরা কাফেরদের সাথে সংশ্লিষ্ট নিদর্শনগুলো এই গ্রন্থাগারে মজুদ থাকার অজুহাত দেখিয়ে তাতে আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করে দিয়েছে।
 
পূর্বপুরুষদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করা এবং প্রাচীনদের ইতিহাস সংরক্ষণ করা একটি সমাজের সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে পরিগণিত হয়। কেননা এইসব নিদর্শন শিক্ষা নেওয়া, ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত থেকে করণীয় ঠিক করা ইত্যাদির জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই বিভিন্ন দেশ ও সরকার এ ধরনের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোকে সংরক্ষণ করার জণ্যে বিশেষ বিশেষ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে এবং কাউকে সেখানকার ছোট্ট একটি মৃৎপাত্রও কিংবা সামান্য একটি প্রস্তর লিখনও নিয়ে যেতে দেয়া হয় না। নিঃসন্দেহে ইসলামী সভ্যতা বিশ্বের উন্নত সভ্যতাগুলোর একটি এবং মুসলমানরা ইসলামী শিক্ষার আলোকেই এই সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছিলেন। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর সঙ্গীসাথীদের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নিদর্শন সমৃদ্ধ এই সভ্যতার উত্তরাধিকার ও অংশ। তাই এইসব নিদর্শন সংরক্ষণ করা এবং সেগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করা ঐতিহ্যবাহী এই সংস্কৃতির গোড়াপত্তনকারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনেরই প্রতীক। পক্ষান্তরে এগুলোকে ধ্বংস করা মূর্খতা ও জাহেলি কুসংস্কার তথা গোঁড়ামির শামিল। ভ্রমণকাহিনী আর ইতিহাসের বহু গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে ইসলামী দেশগুলোসহ ওহির দেশে পূণ্যবানদের শত শত মাযার ছিল,যেগুলোর অধিকাংশই ওহাবিরা শেরেক আর কুফুরির অজুহাতে বিনষ্ট করে ধূলিস্মাৎ করে দিয়েছে।
 
সাউদ বিন আব্দুল আযিয মক্কা মুকাররমা দখল করার সময় আহলে সুন্নাতের বহু আলেম ওলামাকে বিনা কারণে শহীদ করেছে এবং মক্কার বহু সম্ভ্রান্ত লোককে কোনোরকম অভিযোগ ছাড়াই ফাঁসি দিয়েছে। মুসলমানদের যে-কেউই নিজেদের আকিদা-বিশ্বাসের ওপর স্থির থাকতো তাদের বিভিন্নভাবে শাস্তির হুমকি দিয়েছিলো। সে সময় হাটে-বাজারে, অলিতে গলিতে সাউদের ঘোষকেরা হাঁক মেরে ঘোষণা করে দিতোঃ "হে লোকজন! সাউদের দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত হও এবং তার বিস্তৃত ছায়ার নীচে আশ্রয় নাও!" ওসমানী সরকারে নৌ-বাহিনীর উচ্চতরো প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পরিচালক রিয়ার এডমিরাল আইয়ুব সাবুরি লিখেছেনঃ আব্দুল আযিয বিন সাউদ বিভিন্ন গোত্রের শেখদের সমাবেশে দেওয়া তার প্রথম বক্তৃতায় বলেছেন, আমাদের উচিত সকল শহর নগরকে আমাদের অধীনে নিয়ে আসা। আমরা আমাদের আকিদা বিশ্বাসগুলো তাদেরকে শিক্ষা দেবো। আমাদের এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে নিরুপায় হয়ে নবীজীর সুন্নাত তথা মুহাম্মাদি শরিয়াতের অনুসরণের দাবিদার আহলে সুন্নাতের আলেমদেরকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে...বিশেষ করে নামকরা আলেমদেরকে; কেননা এরা যতোদিন বেঁচে থাকবে ততোদিন আমাদের আকিদা বিশ্বাস হাসির মুখ দেখবে না। তাই যারাই নিজেদেরকে আলেম বলে মনে করে প্রথমে তাদেরকে নির্মূল করতে হবে।"
 
সাউদ বিন আব্দুল আযিয মক্কা দখল করার পর আরব্য উপদ্বীপের অন্যান্য শহরও দখল করার চিন্তাভাবনা করে। এবার তাই হামলা চালায় বন্দর নগরী জেদ্দার ওপর। ওহাবি লেখক ইবনে বুশর তাঁর "নজদির ইতিহাস" নামক গ্রন্থে লিখেছেন, সাউদ মক্কায় বিশ দিনেরও বেশি ছিলেন,তারপর জেদ্দা দখল করার জন্যে মক্কা ত্যাগ করে। সাউদ জেদ্দা অবরোধ করে ঠিকই, কিন্তু জেদ্দার শাসক গোলা নিক্ষেপ করে বহু সংখ্যক ওহাবিকে হত্যা করে এবং তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়। ওহাবিরা এভাবে পরাজিত হবার পর মক্কায় ফিরে না গিয়ে বরং তাদের মূল ভূখণ্ড নজদে চলে যায়, কেননা তারা শুনতে পেয়েছিল ইরান থেকে একদল সেনা নজদে হামলা করেছে। এই পরিস্থিতির কারণে সুবর্ণ একটি সুযোগ এসে যায় ওহাবিদের হাত থেকে মক্কা শহরকে পুনরায় উদ্ধার করার। মক্কার গভর্নর শারিফ গালিব ওহাবিদের হামলার পর জেদ্দায় লুকিয়েছিলেন,তিনি এখন জেদ্দার শাসকের সহযোগিতায় প্রচুর সেনা নিয়ে মক্কা অভিমুখে রওনা হলেন। তাদের সেনাদের কাছে কামান-গোলার মতো অস্ত্রশস্ত্র ছিল যার ফলে তারা ওহাবি সেনাদের ওপর হামলা চালিয়ে পুনরায় মক্কা বিজয় করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু ওহাবিরা এরপরেও বিশ্বমুসলমানের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান মক্কাকে পুনরায় দখল করার পাঁয়তারা করে। শেষ পর্যন্ত ১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দে ওহাবিদের সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক হিসেবে পরিচিত সাউদের আদেশে পবিত্র মক্কা শহরটিকে আবারো অবরোধ করা হয়। দখল করার পর সাউদ মক্কার জনগণের ওপর এতো কঠোর আচরণ করতে থাকে যে শহরের বহু লোক ক্ষুধা তৃষ্ণায় মারা যায়। সাউদের আদেশে মক্কা শহরের প্রবেশদ্বার এবং বের হবার পথ সবই বন্ধ করে দেওয়া হয়। যে-ই মক্কা থেকে পালাতে চেয়েছিল তাকেই হত্যা করা হয়েছিল। তাদের হাত থেকে শিশুরা পর্যন্ত রেহাই পায় নি। অবস্থা ভীষণ বেগতিক দেখে শেষ পর্যন্ত মক্কার গভর্নর শারিফ গালিব ওহাবিদের সাথে হাত না মিলিয়ে পারলো না।
 
ওহাবিরা মক্কা অবরোধ করার সময় সে তাদের সাথে ভালো আচরণ করেছিল এমনকি ওহাবি আলেমদেরকে মূল্যবান সব উপঢৌকনও দিয়েছিল প্রাণে বেঁচে থাকার জন্যে। মক্কা দখল করে এবার ওহাবিরা ইরাকি হজ্বযাত্রীদের জন্যে চার বছর,সিরিয়াবাসীদের জন্যে তিন বছর এবং মিশরীয়দের জন্যে দুই বছর হজ্বের মতো আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ ইবাদাতের সকল আনুষ্ঠানিকতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
 
৭ম পর্ব
সাউদ কেবল হজ্বের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেই ক্ষান্ত হয় নি, এবার সে নজর দিয়েছে মদিনাতুন্নাবির দিকে। মদীনা শহরও সে অবরোধ করে ফেলে। কিন্তু মদিনাবাসীগণ যেহেতু ওহাবি আকিদা এবং তাদের সহিংসতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন সেহেতু তাঁরা ওহাবিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। প্রায় বছর খানেক এই প্রতিরোধ সংগ্রামের পর অবশেষে ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দে সাউদ ঐ শহরটিকেও দখল করে। ওহাবিরা নবীজী (সা) এর হেরেমের মূল্যবান সকল জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। তবে মুসলমানদের গণ বিরোধিতার ভয়ে রাসূলে আকরাম (সা) এর পবিত্র রওজা ধ্বংস করে নি ওহাবিরা। সাউদ বিন আব্দুল আযিয মদিনা মুনাওয়ারা দখল করার পর ঐ শহরবাসীদেরকে মাসজিদুন নববীতে সমবেত করেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তব্য শুরু করেন এভাবেঃ "হে মদিনার জনগণ! আল কোরআনের পবিত্র আয়াত আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দীনাকুম অর্থাৎ আজ তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্যে পরিপূর্ণ করে দিলাম এর ভিত্তিতে তোমাদের ধর্ম ও বিধিবিধান আজ পূর্ণতায় পৌঁছেছে, ইসলামের নিয়ামতে তোমরা মর্যাদাবান হয়েছো,একক অদ্বিতীয় সত্ত্বা আল্লাহ তোমাদের ওপর সন্তুষ্ট ও খুশি হয়েছেন। তোমাদের পূর্বপুরুষদের বাতিল ধর্মগুলো ছেড়ে দাও এবং কক্ষণো তাদেরকে ভালো মানুষ হিসেবে মনে করো না। তাদের ওপর দরুদ বা রহমত প্রেরণ করা কঠোরভাবে পরিহার করবে কেননা তাদের সবাই শেরেকি নীতির মধ্যেই মারা গেছে।"
 
সাউদ তার সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে বহু গণহত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে। সে সময়ে তার এবং তার অনুসৃত ওহাবি ফের্কার ভয়াবহ সহিংসতা আরবের বাদশা এবং জনগণকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে মৃত্যুর ভয়ে হজ্ব এবং যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করতেও সাহস করতো না। মক্কার শাসক নিজের জীবনের ভয়ে সাউদের ইচ্ছায় আদেশ দিতে বাধ্য হয়েছিল মক্কা ও মদিনায় ইমামদের যতো মাযার আছে এবং এ ছাড়াও আরো যতো পবিত্র স্থাপনা আছে,সকল স্থাপনা ভেঙ্গে গুড়িয়েঁ মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে। ওহাবি মাযহাবকে হেজাজে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল এবং ওহাবিরা চাওয়া অনুযায়ী আযান থেকে ইসলামের মহান নবী (সা) এর ওপর দরুদ পাঠানো সংক্রান্ত অংশটিও বাদ দেওয়া হয়েছিল। হেজাজের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ববর্গ এবং আরবের আমির ওমরাগণ ওহাবিদের এই বলদর্পী, বিচ্যুত আকিদা বিশ্বাসপূর্ণ ফের্কাকে আর সহ্য করতে না পেরে সর্বোচ্চ মহলে অর্থাৎ ওসমানী বাদশার কাছে প্রচুর চিঠি লেখেন এবং ওহাবিদের ক্রমবর্ধমান শক্তির ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে তাকেঁ অবহিত করেন। তাঁরা আরো গুরুত্বের সাথে বলেন যে ওহাবি ফের্কা কেবল সৌদি আরবের মধ্যেই সীমিত থাকবে না,তারা সমগ্র ওসমানী সাম্রাজ্যজুড়ে সকল মুসলমানের ওপর ওহাবি মতবাদের প্রসার ঘটাতে চায়।


ওসমানী সাম্রাজ্য সে সময় হেজাজ, ইয়েমেন, মিশর, ফিলিস্তিন, সিরিয়া এবং ইরাকের মতো মুসলিম ভূখণ্ডজুড়ে বিস্তৃত ছিল। ওসমানী বাদশা তাই মিশরের গভর্নরকে আদেশ দিয়েছিলেন ওহাবিদের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে। ঠিক সে সময় সাউদের বয়স ছিল ছেষট্টি বছর এবং অন্ত্রের ক্যান্সারে সে তখন মারা যায়। সাউদের মৃত্যুর পর তার ছেলে আব্দুল্লাহ তার স্থলাভিষিক্ত হয়। যাই হোক, মিশরের গভর্নর মুহাম্মাদ আলি পাশা ওসমানী সরকারের পক্ষ থেকে ওহাবিদের বিরুদ্ধে বেশ কটি সশস্ত্র যুদ্ধ করে ওহাবিদেরকে পরাজিত করে মক্কা, মদিনা এবং তায়েফকে মুক্ত করতে সমর্থ হয়। এই যুদ্ধে মিশরের গভর্নর ওহাবিদের বেশ কজন কমান্ডারকে আটক করে ওসমানী সাম্রাজ্যের তৎকালীন রাজধানী ইস্তাম্বুলে পাঠিয়ে দেয়। এই বিজয়কে ঘিরে মিশরে বেশ আনন্দ উৎসবের আয়োজন করা হয়। কিন্তু ওহাবিদের কাজ তখনো শেষ হয়ে যায় নি। মিশরের গভর্নর মুহাম্মাদ আলি পাশা সেজন্যে জলপথে আরেকটি বাহিনী হেজাজের উদ্দেশ্যে পাঠায়। পাশা তখন মক্কা শহরকে তাদের ঘাটিঁ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে সেখানকার আমির এবং তার ছেলেকে নির্বাসনে পাঠায়,আর তার মালামাল বাজেয়াপ্ত করে। এরপর মিশরে ফিরে গিয়ে তাদের কওমের ইব্রাহিম পাশা নামের একজনের নেতৃত্বে একটি বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে নজদের দিকে পাঠায়।
 
ইব্রাহিম পাশা নজদের দিরইয়া শহরটিকে অবরুদ্ধ করে। দিরইয়া ছিল ওহাবিদের তৎকালীন মূল কেন্দ্র। ওহাবিদের প্রতিরক্ষা বাহিনী ইব্রাহিম পাশার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু ইব্রাহিম পাশার বাহিনী ছিল কামানের মতো আরো অনেক ভারি অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত। ফলে ওহাবিরা সুবিধা করতে পারে নি এবং ইব্রাহিম পাশার কাছে পরাজিত হয়। ওহাবিদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ইব্রাহিম পাশা দিরইয়া শহর জয় করে এবং আব্দুল...ইবনে সাউদকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর আব্দুল...ইবনে সাউদসহ তার আরো বহু নিকটজনকে ওসমানী বাদশার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওসমানী সম্রাট আব্দুল... এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদেরকে বাজারঘাট শহর নগর প্রদক্ষিণ করানোর পর ফাসিতেঁ ঝুলিয়ে হত্যা করে। আব্দুল...ইবনে সাউদের মৃত্যুর পর আলসাউদের সমকালীন শাসকসহ তার সহযোগীরা মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন শহরে আনন্দ উৎসবের আয়োজন করে।
 
ইব্রাহিম পাশা ৯ মাসের মতো দিরইয়া শহরে অবস্থান করেন এবং তারপর শহরটিকে সকল অধিবাসীশূন্য করার নির্দেশ দেন। অবশেষে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেন দিরইয়া শহরটি। ইব্রাহিম পাশা মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব এবং আলে সাউদের বহু বংশ ও উত্তর প্রজন্মকেও নির্মূল করেন অথবা নির্বাসনে পাঠান যাতে ভয়াবহ বিপজ্জনক ঐ ফের্কাটির নামও আর অবশিষ্ট না থাকে। এই বিজয়ের পর ওসমানী সম্রাট নজদ এবং হেজাজ ভূখণ্ডের শাসনের ভার মিশরের গভর্নর মুহাম্মাদ আলী পাশার ওপর অর্পন করেন। এভাবেই ১২১৩ হিজরিতে অর্থাৎ ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে ওহাবি মতবাদের বিলুপ্তি ঘটে। এরপর অন্তত এক শতাব্দি সময়কাল পর্যন্ত ওহাবি মতবাদের নামটিরও আর কোনো অস্তিত্ব ছিল না কিংবা বলা ভালো এই ফের্কাটি নিয়ে আর কেউ কখনো কোনোরকম চিন্তাভাবনা করেনি।
 
মিশরের গভর্নর মুহাম্মাদ আলী পাশা ইব্রাহিম পাশার নেতৃত্বে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত বিশাল সেনাবাহিনী পাঠিয়ে নজদ ভূখণ্ডে যেরকম সফল অভিযান চালিয়েছিল, সৌদিআরব ভূখণ্ডে সেই অভিযানের প্রতিক্রিয়া ছিল সুস্পষ্ট এবং চোখে পড়ার মতো। নজদ বিজয়ের পর আব্দুল আযিয এবং তার ছেলে সাউদের বিশাল বিস্তৃত দেশটি ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং বহু সংখ্যক ওহাবি প্রাণ হারায়। ওহাবি ফের্কার দাওয়াত দেওয়ার ধারা এবং বিচ্যুত এই আকিদা-বিশ্বাস জনগণের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার ধারা বন্ধ হয়ে যায়। আপামর জনগণ ওহাবিপন্থীদের ভয়ে যেভাবে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল সেই ভয় মানুষের মন থেকে ধীরে ধীরে কেটে যায়।
 
৮ম পর্ব
প্রকৃতপক্ষে আলসাউদ তেষট্টি বছরে ব্যাপক স্থবির হয়ে পড়ে। আব্দুল আযিয বিন আব্দুর রহমানের আগমন পর্যন্ত এই স্থবিরতার ধারা অব্যাহত থাকে। আব্দুল আযিযের আগমনে সাউদ বংশের শক্তি যেমন ফিরে আসে তেমনি বিচ্যুত ঐ ওহাবি মতবাদের চর্চাও পুনরায় বৃদ্ধি পায়। আব্দুল আযিয বিন আব্দুর রহমান 'ইবনে সাউদ' নামেই বেশি পরিচিত। ওহাবিদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার লক্ষ্যে ইবনে সাউদ 'এখওয়ানুত তাওহিদ' নামে একটি সংগঠন গঠন করে। এই সংগঠনভুক্তদের আবাসনের জন্যে ব্যাপক তৎপরতাও চালায়। আসলে 'এখওয়ানুত তাওহিদ' ছিল ওহাবিদের সামরিক ও ধর্মীয় শাখা যার দায়িত্ব ছিল সমগ্র আরব ভূখণ্ডে এই মতবাদের বিস্তার ঘটানো।ইতিহাসে এসেছে আব্দুল আযিয বৃটিশদের সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতাসীন হয়েছে। অবশ্য গেল কয়েক শতাব্দির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বিভিন্ন ঘটনায় আধিপত্যবাদীদের পরিকল্পনার সুস্পষ্ট ছাপ লক্ষ্য করা যাবে। উপনিবেশবাদীরা ক্ষমতালিপ্সু অভ্যন্তরীণ শক্তিকে কাজে লাগিয়েই তাদের রাজনৈতিক পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করেছে এবং বলাবাহুল্য ক্ষমতালিপ্সুরাই উপনিবেশবাদীদেরকে নিজেদের দেশে ঢোকার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে। আব্দুল আযিয বিন সাউদও তাদের একজন।
 
ব্রিটিশদের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলে ক্ষমতায় গিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর জয়ী হবার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ঐ সময়টা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কাল। ব্রিটিশরা তখন চেয়েছিল ওসমানী সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করার মাধ্যমে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে তা দখল করে নিতে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ব্রিটিশ সরকার নজদে তাদের বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন দুটি বংশের সাথে মৈত্রী গড়ে তোলে। এই দুই খান্দানের একটি হলো হাশেমি; মক্কা এবং মদিনার ওপর যাদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। অপর বংশটি হলো আলেসাউদ যারা রিয়াদ এবং নজদের ওপর শাসন করছিল। ব্রিটিশরা আরবের আরব গোত্রগুলোকে খুশি করার জন্যে এবং ওসমানী সেনাদের বিরুদ্ধে হামলার ক্ষেত্রে তাদেরকে ব্যবহার করার জন্যে এই দুই খান্দানকে-যারা পরস্পরের বিরোধী ছিল-টার্গেট করে। ব্রিটিশরা উভয় খান্দানের কাছে দুত পাঠায়। 'টমাস এডওয়ার্ড লরেন্স'-যিনি আরবের লরেন্স নামেই বেশি পরিচিত-তাকে পাঠানো হয় শরিফ হোসাইনের শিবিরে। আর 'হ্যারি সেন্ট জন ব্রিজার ফিলবি'-যে কিনা ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং নিজেকে আব্দুল্...নাম ধারণ করেছিল-তাকে পাঠানো হলো আলেসাউদের কাছে।
 
লরেন্স শরিফ হোসাইনকে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে সুসংবাদ দেয় যে, ওসমানীদের পরাজয়ের পর বৃহত্তম আরবের শাসনভার তার ওপর অর্পন করা হবে। ব্রিটিশ এই একই প্রতিশ্রুতি আব্দুল আযিয সাউদিকেও দেয়। তারা নজদ, এহসা, কাসিম এবং জুবাইলের ওপর আব্দুল আযিযের শাসনকেও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুল আযিয এবং বৃটেনের মধ্যে সংঘটিত চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশরা আলেসাউদকে বার্ষিক ষাট হাজার লিরা প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং বাইরের যে কোনো হামলায় আব্দুল আযিয ও তার সন্তানদেরকে সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেয়। পক্ষান্তরে ইবনে সাউদও প্রতিশ্রুতি দেয় যে,সৌদি আরবের ব্রিটিশ সমর্থনপুষ্ট ভূখণ্ডের ওপর হামলা করা হবে না এবং ব্রিটিশদের শত্রুদেরকে কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর হাশেমি বংশীয় এবং মক্কার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হোসাইন ইবনে আলি নিজেকে আরবের বাদশা দাবি করে এবং আলেসাউদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু আব্দুল আযিয ব্রিটিশ সহযোগিতায় হোসাইন শরিফকে পরাস্ত করে। এর কবছর পর সাউদিরা তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা চালায়,কিন্তু বৃটেন নিজেদের স্বার্থচিন্তা করে আব্দুল আযিয সাউদিকে সমগ্র আরবের ওপর তার আধিপত্য বিস্তারকে সমীচীন মনে করে নি। ইতোমধ্যে ইবনে সাউদ হেজাজের ওপর তার আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশে তার সেনাদেরকে মক্কা মুকাররমার দিকে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয়।


ওহাবি সেনারা ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে মক্কায় যাবার আগে হেজাযের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর তায়েফে গিয়ে পৌঁছে। তায়েফের আমির ওহাবি সেনাদের আগমনের কথা শুনে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আগেভাগেই পালিয়ে যায়। এরপর তায়েফের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ওহাবিদের সাথে আলোচনায় বসে রক্তপাতহীনভাবেই তাদের হাতে তায়েফ শহর সমর্পন করে। কিন্তু ওহাবিরা তায়েফে প্রবেশ করার পর কথা রাখেনি। চুক্তি ভঙ্গ করে তারা নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরায়। এতোটা নির্দয় নিষ্ঠুরভাবে তারা হত্যাকাণ্ড চালায় যে তাদের হাত থেকে নারী-শিশু-পুরুষ কেউই রক্ষা পায় নি। অন্তত দুই হাজার মানুষকে তারা হত্যা করে যাদের মাঝে বহু আলেম ওলামাও ছিলেন। ওহাবিরা তায়েফ বাজার লুট করে বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। তায়েফে আব্দুল আযিযের সেনাদের এই নোংরামি আর নিষ্ঠুরতা ইতোপূর্বে এই তায়েফেই তাদের পূর্বসূরি ওহাবিদের বর্বর হামলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাদের হামলা থেকে শাফেয়িদের বিখ্যাত মুফতি শায়খ আব্দুল্ল.. যেভরিও রক্ষা পান নি। ওহাবিরা তাকেঁ মসজিদ থেকে টেনে বের করে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে।
 
কিছুদিন পর আব্দুল আযিয ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মক্কাও দখল করে। চুক্তি ভঙ্গ করে আব্দুল আযিয যে হেজাজে হামলা করলো বৃটেন প্রথমে তার বিরোধিতা করলেও শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিল। কেননা মধ্যপ্রাচ্যে বৃটেনের প্রয়োজন ছিল তাদের সাথে সম্পৃক্ত কোনো শাসকের। অপরদিকে সৌদি আরবের তেল সম্ভারের দিকে তাদের নজর ছিল। সেজন্যেই বৃটেন হাশেমি বংশকে সরিয়ে দিয়ে ইবনে সাউদকে সমগ্র আরব্য উপদ্বীপ দখলে সাহায্য করেছিল। তারি পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে ওহাবি আকিদার ভিত্তিতের সৌদি বাদশাহীর ভিত রচিত হয়। এরফলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ঐ গোঁড়া ওহাবি ফের্কা তাদের আকিদা প্রচার-প্রসারের শক্তিশালী ঘাটিঁ পেয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই ওহাবি মতবাদ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ডগুলোতে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে এবং আব্দুল আযিযও নিজেকে ওহাবি ফের্কার নেতা এবং হারামাইন শরিফাইনের খাদেম হিসেবে দাবী করে। সৌদিরা সেই শুরু থেকেই নিরীহ মুসলমানদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে,তাদের ধনসম্পদ লুট করে নিজেদের প্রয়োজনীয় আর্থিক বাজেট নিশ্চিত করতো,আর এখন তেল বিক্রি করে, বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাচ্ছে।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুল আযিযের মৃত্যুর পর তার ওসিয়্যত অনুযায়ী তার সন্তানদের হাতে থাকবে হুকুমাতের দায়িত্ব। আব্দুল আযিযের রেখে যাওয়া ৩৯ জন পুত্রসন্তান তাই ওসিয়্যত অনুসারে বয়সানুক্রমিক ধারায় সৌদি আরবের হুকুমাতের মসনদে আসীন হয়েছে।
 
৯ম পর্ব
গত আসরে আমরা বলেছিলাম ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুল আযিযের মৃত্যুর পর তার ওসিয়্যত অনুযায়ী তার সন্তানদের হাতে হুকুমাতের দায়িত্ব অর্পিত হয়। আব্দুল আযিযের রেখে যাওয়া ৩৯ জন পুত্রসন্তান সেই ওসিয়্যত অনুযায়ী বয়সানুক্রমিক ধারায় সৌদি আরবের হুকুমাতের মসনদে আসীন হয়। এর পরবর্তী ইতিহাসের দিকে আজ আমরা নজর দেওয়ার চেষ্টা করবো।
আব্দুল আযিযের সন্তানদের মধ্যে সর্বপ্রথম ক্ষমতায় আসীন হয়েছিল তার নাম ছিল সাউদ। তার পরের বাদশা ছিল ফয়সাল বিন আব্দুল আযিয। কিন্তু ফয়সালের বাদশাহীর সময় সাউদি পরিবারে অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় এবং এক পর্যায়ে ফয়সাল বিন আব্দুল আযিযকে হত্যা করা হয়। ফয়সালের বাদশাহীর সময় অপর যে ঘটনাটি সংঘটিত হয় তা হলো ইবনে আব্দুল ওহাবের সন্তানেরা ইতোপূর্বে যে সৌদি আরবের ওহাবি মাযহাবের নেতৃত্ব দিতো সেই নেতৃত্ব বা ওহাবি মাযহাবের প্রধানের দায়িত্ব থেকে তাদেরকে অব্যাহতি দেয়। ইবনে আব্দুল ওহাবের সন্তানদেরকে ওহাবি মাযহাবের প্রধানের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ফলে আলে-সাউদের কাছে ওহাবি মতবাদ একটি রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহে পরিণত হয় এবং আলে সাউদ ও ইবনে আব্দুল ওহাব খান্দানের মধ্যকার প্রায় দুইশ' বছরের সহযোগিতামূলক সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটে।
 
বাদশা ফয়সালের পর খালেদ বিন আব্দুল আযিয ক্ষমতার মসনদে আসীন হন। বাদশা খালেদের শাসনকালে সংঘটিত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি ছিল ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়।মহান এই বিপ্লবের ঘটনা ওহাবিদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলে। কারণটা হলো ইরানের বিপ্লব ছিল মার্কিন বিরোধী এবং স্বৈরাচারী শাসন বিরোধী প্রকৃত ইসলামী আদর্শ ভিত্তিক একটি বিপ্লব। ওহাবি মতবাদসহ গোঁড়া এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন সকল আকিদা-বিশ্বাস ও মতবাদের বিরোধী এই বিপ্লব। বাদশা খালেদের মৃত্যুর পর ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে ফাহাদ বিন আব্দুল আযিয বাদশাহী মসনদে আসীন হন এবং তিনি নিজেকে খাদেমুল হারামাইন আশশারিফাইন ঘোষণা করেন। পবিত্র এবং মহান এই ইসলামী দায়িত্ব সম্পন্ন উপাধি ধারণ করে নেপথ্যে তিনি তার অন্যায় কাজকর্মগুলোর ব্যাখ্যা দিতেন। ইহুদিবাদী ইসরাইলের কাছে আরব এবং মুসলিম জনশক্তি ফিলিস্তিনীদেরকে নতজানু করে তাদের সাথে সমঝোতা করার প্ররোচনা দেন। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদেশে চার শ ইরানী হজ্বযাত্রীকে হত্যা করা হয়েছিল এই ফাহাদ বিন আব্দুল আযিযের সময়ে।
 
২০০৫ সালে ফাহাদের মৃত্যুর পর ফাহাদের সৎ ভাই মালেক আব্দুল.. তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনিও লেবাননের প্রতিরোধ যুদ্ধে ইহুদিবাদী ইসরাইলকে সহযোগিতা করেন এবং একইভাবে ইয়েমেন ও বাহরাইনের জনগণের ওপর দমন নিপীড়ন চালানোর ক্ষেত্রে সেইসব দেশের শাসকদেরকে সার্বিক সাহায্য ও সহযোগিতা করার কর্মসূচি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। সবোর্পরি ওহাবিরা সৌদি হুকুমাতের ছত্রচ্ছায়ায় এবং সৌদি আরবের তেল বিক্রি থেকে অর্জিত অঢেল পয়সায় ভালো একটি সুযোগ লাভ করেছে তাদের ঐ ওহাবি মতবাদ প্রচার করার এবং তার প্রসার ঘটানোর। প্রচুর পয়সার অধিকারী হওয়ায় তারা আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ঐ বাতিল আকিদা প্রচার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে তারা গরীব অসহায় মানুষের মাঝে বিপুল অর্থ বিলিয়ে, ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে ইত্যাদি বিচিত্র পদক্ষেপ নিয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে নিজেদের ভ্রান্ত আকিদা বিশ্বাসকে সম্ভাব্য সকল পন্থায় মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে।
 
মানুষ যেহেতু ইন্দ্রিয় দিয়ে সৃষ্টিকূলকে অনুভব করে এবং মানুষের জন্যে যেহেতু স্থান এবং কালের বিষয়টি প্রযোজ্য সেজন্যে মানুষ চায় সবকিছুকেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হিসেবে বিবেচনা করতে। এইরকম বোধ ও বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা এমনকি আল্লাহকেও পঞ্চেন্দ্রিয় নির্ভর মানুষের মতো চামড়া, গোশত, রক্ত, হাড্ডিসহ মানবীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পন্ন বলে মনে করে। আল্লাহকে এরকম দৈহিক অবয়ব সম্পন্ন বলে যারা ভাবে তাদেরকে অভিহিত করা হয় 'মুশাব্বাহে' বলে। মুশাব্বাহে ছাড়াও কিন্তু আরেকটি দল আছে যারা আল্লাহর ঠিক মানবীয় অবয়ব কাঠামো থাকার কথা না বললেও তাঁর একটা অবয়ব থাকার কথা অস্বীকার করে না। এর কারণ হলো এরা কেবল কোরআন এবং রাসূলের বর্ণনার বাহ্যিক দিকটাই দেখে কোনোরকম চিন্তা-গবেষণা করাকে প্রত্যাখ্যান করে। তাদের বিশ্বাস, কোরআন কেবল তেলাওয়াৎ করার জন্যেই নাযিল হয়েছে,গবেষণার জন্যে নয়। এই চিন্তাটা একেবারেই ভ্রান্ত কেননা স্বয়ং কোরআনেরই বহু আয়াতে মানুষকে চিন্তা-গবেষণা করার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
 
যেমন সূরা মুহাম্মাদের ২৪ নম্বর আয়াতে এসেছেঃ 'তারা কি কোরআন সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?'একইভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা সোয়াদের ২৯ নম্বর আয়াতে বলেছেনঃ 'এটি একটি বরকতময় কিতাব,যা আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি যাতে মানুষেরা এর আয়াত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে এবং বুদ্ধিমানেরা তা অনুধাবন করেন'। সালাফিয়া ফের্কার প্রতিষ্ঠাতা ইবনে তাইমিয়া এমন এক ব্যক্তি যে কিনা আল্লাহর দৈহিক অবয়বের কথা বলেছেন কোরআনের আয়াতের বাহ্যিক অর্থের ওপর নির্ভর করে। হাত পায়ের মতো অঙ্গ প্রত্যঙ্গ রয়েছে আল্লাহর-এ ধরনের বিশ্বাস তার বর্ণিত আকিদায় লক্ষ্য করা যায়। যদিও সেইসব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ঠিক মানুষের মতো নয়, ভিন্নতর। এইসব কিংকর্তব্যবিমূঢ় কথাবার্তা বলার উদ্দেশ্য আসলে শ্রোতাদের চিন্তাশক্তি নষ্ট করে দেওয়ার কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ইবনে তাইমিয়া বলেছেনঃ আল্লাহর হাত আছে কিন্তু হাত বলতে আমরা যেই অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গকে চিনি সেইরকম হাত নয়,বরং আল্লাহর উপযোগী হাত। অতএব বলা উচিত এই অঙ্গের নাম হাত নয় কেননা হাত বলতে আমরা এমন একটি অঙ্গকে বুঝি যাকে সবাই একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও বাহ্যিক গঠন সহকারে চেনে। দৈহিক অবয়বের সাথে আল্লাহর তুলনা ইবনে তাইমিয়ার 'আরশুর রাহমান অমা ওরাদা ফিহে.....' বইতেও লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ সূরা যুমারের ৬৭ নম্বর আয়াতে এসেছেঃ 'কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতের মুঠোয় এবং আসমানসমূহ ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে.......'।
 
এখানে মুঠো শব্দটির অর্থ হচ্ছে পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকা; যেমন আমরা কথাপ্রসঙ্গে প্রায়ই বলে থাকিঃ ওটাতো আমার হাতে,অর্থাৎ ঐ ব্যাপারটা পুরোপুরি আমার নিয়ন্ত্রণে। কোরআনের উল্লেখিত আয়াতে বর্ণিত হাতের মুঠোও তেমনি একটি রূপকমাত্র যার অর্থ হচ্ছে মৃত্যুপরবর্তী বিশ্বের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ও অধিকার থাকবে আল্লাহর।#
১০ম পর্ব
সূরা যুমারের ৬৭ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে আমরা বলেছিলাম এখানে 'মুঠো' বলতে সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণের কথা বোঝানো হয়েছে। কিন্তু ইবনে তাইমিয়া তার বইতে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় কেবল আক্ষরিক অনুবাদ করে বলেছেনঃ কিয়ামতের দিন যমিন আল্লাহর হাতে ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে এবং তিনি তা ছুঁড়ে মারবেন যেভাবে বাচ্চারা বল ছুঁড়ে মারে। কোরআনের এরকম ভুল ব্যাখ্যা সালাফিদের বক্তব্যে প্রচুর দেখা যায়। তারা আল্লাহর দৈহিক গঠনের কথা বলে আল্লাহর উচ্চ মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে এবং তাঁর শ্রেষ্ঠত্বকে নিয়ে খেলেছে ছিনিমিনি খেলা। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে ইবনে তাইমিয়া মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব এবং এই মতবাদের অন্যান্য অনুসারীদের দৃষ্টিশক্তি একেবারেই অগভীর,তারা কেবল শব্দের বাহ্যিক বা আক্ষরিক দিকটার দিকেই তাকিয়েছে, শব্দের ভাবার্থ এবং প্রতীমানার্থ নিয়ে না ভাববার কারণে একত্ববাদের সূক্ষ্ম প্রাণ বা আত্মা থেকে রয়ে গেছে অনেক দূরে। এদের লেখালেখি আর কথাবার্তাতেও এই গোঁড়ামি আর অগভীর বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়।
রাসূলে খোদা (সা) এবং তাঁর নেককার সাহাবি ও তাবেয়িনগণ তৌহিদের যে মর্মাথের কথা বলে গেছেন, ওহাবিরা তা থেকে মুক্ত। কেননা তৌহিদ এমন একটি সত্য, এমন এক বাস্তবতা যা কেবল যথাযথ তথ্যপ্রমাণ আর মেধা শক্তির মাধ্যমেই অর্জন করা যায়। তৌহিদ এমন একটি বিষয় যা অন্তরে ঈমান এবং বিশ্বাসের গভীরতা সৃষ্টি করে এবং জীবনটাকে আল্লাহর ওপর ঈমান কেন্দ্রিক করে তোলে। মজার ব্যাপার হলো ওহাবিরা কোনো কোনো আয়াতের বাহ্যিক অর্থকে ধারণ করে নিজেদেরকে তৌহিদের যথার্থ রক্ষক এবং কোরআনের আয়াতের যথাযথ বাস্তবায়নকারী বলে মনে করে আর তাদের বাইরের সবাইকে কাফের বলে মনে করে। ইবনে তাইমিয়া তার বিরোধীদের জবাবে বলেছেন আল্লাহর কিতাব,রাসূলে আকরাম (সা)'র সুন্নাত এবং তাঁর সাহাবি ও তাবেয়িনদের বক্তব্যে যদিও আল্লাহর দৈহিক সত্ত্বার কথা দেখা যায় না কিন্তু এ ব্যাপারটিকে তো অস্বীকারও করা হয় নি। তাই আল্লাহর দৈহিক সত্ত্বা রয়েছে বলে মনে করা যায়।
 
ইবনে তাইমিয়া আল্লাহর দৈহিক সত্ত্বা সংক্রান্ত তার বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় বলেন, আল্লাহ আকাশ সমূহের উপরে বসে রয়েছেন। তিনি হাসেঁন, পথ চলেন, দৌড়েন ইত্যাদি। তিনি তার "আকিদাতুল হামাভিয়া' নামক পুস্তিকায় লিখেছেনঃ আল্লাহ তায়ালা হাঁসেন। কিয়ামতের দিন তিনি হাঁসিমুখে বান্দাদের সামনে প্রকাশিত হবেন।" অথচ কোরআনে কারিম সূরা আনআমের ১০৩ নম্বর আয়াতে সবার উদ্দেশ্যে বলেছে যে, আল্লাহ এমন এক সত্ত্বা,পৃথিবীর কারো পক্ষেই তাঁকে দেখা সম্ভব নয়। বলা হয়েছেঃ "দৃষ্টিসমূহ তাঁকে দেখতে পায় না, অবশ্য তিনি সকল দৃষ্টি বা চোখগুলোকে দেখেন; তিনি অত্যন্ত দয়ালু, সূক্ষ্মদর্শী ও সুবিজ্ঞ।" ইমাম আলী (আ) আল্লাহ সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেনঃ "আল্লাহ মানে হলো এমন একজন মাবুদ যাঁর সম্পর্কে সৃষ্টিকূল দিশেহারা,কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং সৃষ্টিকূল তাঁকে ভালোবাসে। আল্লাহ তো তিনিই, যাঁকে চোখ দিয়ে অনুভব করা যায় না এবং যিনি মানুষের চিন্তা, বুদ্ধি-বিবেচনার অনেক উর্ধ্বে।"
 
কোরআনের একটি প্রাণবন্ত আয়াতে আল্লাহর 'দৈহিকতা'কে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এ বিষয়ে 'সূরা এখলাস' অবতীর্ণ হয়েছিল বলে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। বিশিষ্ট দার্শনিক নিশাবুরি হিজরি চতুর্থ এবং পঞ্চম শতাব্দির একজন বিখ্যাত হাদিস শাস্ত্রবিদও ছিলেন। তাঁকে 'ইমামুল মুহাদ্দেসিন' এবং 'মুহাদ্দেস আলখোরাসান' নামে অভিহিত করা হতো। নিশাবুরি রাসূলে আকরাম (সা) এর বিশিষ্ট সাহাবি আবি ইবনে কাব থেকে বর্ণিত একটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। বর্ণনাটি হলোঃ মুশরিকরা একদিন রাসূলে খোদার কাছে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বংশ পরিচয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল। ঠিক সে সময় মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সা) এর ওপর সূরায়ে এখলাস নাযিল করেন। যেখানে বলা হয়েছেঃ 'হে পয়গাম্বর! মুশরিকদের বলুন! তিনি আল্লাহ,এক এবং অমুখাপেক্ষী, তাঁর কোনো সন্তানাদি নেই এবং তিনিও কোনো বাবা-মায়ের সন্তান নন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অদ্বিতীয়,তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।' বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ জনাব জাহাবিও এই বর্ণনার সত্যতা অনুমোদন করেছেন। আসলে কোরআন এইসব আয়াতের মাধ্যমে মুশরিকদের এই জবাবই দিচ্ছে যে, আল্লাহর দৈহিক কোনো অস্তিত্ব নেই যে তাঁর বংশ বা সন্তানাদি থাকবে। তারপরও দুঃখজনকভাবে ইবনে তাইমিয়ার মতেো লোকেরা আল্লাহর দৈহিক সত্ত্বার অস্তিত্ব প্রমাণে ব্যস্ত।
 
আরো একজন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন বায়হাকি। তিনিও আল্লাহর দৈহিক অস্তিত্বের বিষয়টিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। আল্লাহর দৈহিকতা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সপক্ষে তিনি হাম্বলি মাযহাবের ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেনঃ ' অভিধান বিশারদগণ 'দেহ' শব্দটির ব্যাখ্যায় বলেছেন এটি এমন এক বস্তু যার দৈর্ঘ আছে, প্রস্থ আছে, উচ্চতা আছে, গঠন এবং আকৃতি আছে। আর আল্লাহ তায়ালা এই সকল অবস্থা বা বৈশিষ্ট্য থেকে পবিত্র। তাই তাঁর দৈহিক অস্তিত্বের কথা বলা একেবারেই অনুচিত কেননা 'দেহের' যতো প্রকার আভিধানিক কিংবা পারিভাষিক অর্থ হয় সর্বপ্রকার অর্থ থেকে আল্লাহ পাক মুক্ত। শরীয়তেও এই শব্দটির প্রয়োগ নেই। অতএব, আল্লাহর দৈহিকতা সংক্রান্ত বিশ্বাস একান্তই ভ্রান্ত।'
মজার ব্যাপারটি হলো, ইবনে তাইমিয়া নিজেকে হাম্বলি মাযহাবের একজন অনুসারী বলে দাবী করে। আর হাম্বলি মাযহাবটির প্রতিষ্ঠাতা বা প্রধান হলেন ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল। স্বয়ং আহমাদ ইবনে হাম্বল যেখানে আল্লাহর দৈহিক সত্ত্বা সংক্রান্ত বিশ্বাসকে বাতিল বলে মনে করেন সেখানে ইবনে তাইমিয়া কীভাবে আল্লাহর দৈহিক গঠন কাঠামো রয়েছে বলে বিশ্বাস করেন! এভাবেই তৌহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়ার এই বিচ্যুত ও ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি ওহাবি চিন্তা বা মতবাদের মূল ভিত্তি রচনা করেছে। পরবর্তী আসরে আল্লাহর দৈহিকতা সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়ার অপর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার চেষ্টা করবো। আজকের আসরের সময় শেষ হয়ে আসায় আজ আর এ সম্পর্কে কথা বলার সুযোগ নেই।(রেডিও তেহরান)

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)