সূরা আ'রাফ; (৩৮তম পর্ব)

সূরা আ'রাফ; আয়াত ১৬৭-১৬৯

সূরা আ'রাফের ১৬৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন বলেছেন-

وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكَ لَيَبْعَثَنَّ عَلَيْهِمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَنْ يَسُومُهُمْ سُوءَ الْعَذَابِ إِنَّ رَبَّكَ لَسَرِيعُ الْعِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُورٌ رَحِيمٌ

"দেখ! তোমার রব তো ঘোষণা করেছেন যে কিয়ামত পর্যন্ত তিনি সব সময় তাদের কাছে [এমন] লোকদের পাঠাবেন, যারা তাদেরকে দেবে কঠিনতম শাস্তি। নিঃসন্দেহে তোমাদের রব দ্রুত শাস্তিদানকারী। তিনি আবার ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালুও।" (৭:১৬৭)

আগের পর্বে বলা হয়েছে, বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে একটা দল কর্মবিরতি দিবসের বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছিল। সে সময় আল্লাহর নির্দেশে কর্মবিরতির দিন অর্থাত শনিবারে সব ধরনের কাজ নিষিদ্ধ ছিল। কেবলমাত্র ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত কিছু কাজ করার অনুমতি ছিল। অন্যান্য কাজের মতো সেদিন মাছ শিকার করাও নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ওই দলটি প্রতারণা ও ধূর্তামির আশ্রয় নিয়ে মাছ শিকার করেছে। এর ফলে আল্লাহ ক্ষুব্ধ হন এবং তাদের উপর আল্লাহ কঠিন শাস্তি নেমে আসে। তারা বানরে পরিণত হয়। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, যারা আল্লাহর নির্দেশকে অবহেলা করে এবং তা নিয়ে ঠাট্টা করে আল্লাহতায়ালা তাদেরকে এই দুনিয়াতেই কঠিন শাস্তি দিয়ে থাকেন। শুধু তাই নয়, তারা পৃথিবীতে সবসময় কঠিন শাস্তি ও সমস্যার মধ্যে থাকবে। অবশ্য এমন পাপীরাও যদি আল্লাহর কাছে তওবা করে, তাহলেও আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. অত্যাচারী ইহুদি সম্প্রদায় কিয়ামতের আগ পর্যন্ত কঠিন সমস্যা-সংকুলের মধ্যে থাকবে। কোন অবস্থাতেই তারা শান্তি পাবে না।

দুই. আল্লাহর দয়া ও রহমতের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়ার পাশাপাশি তার কঠোর শাস্তির বিধানের কথাও মনে রাখতে হবে। এর মধ্যদিয়ে মানব সমাজে উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিশ্চিত হয়।

সূরা আ'রাফের ১৬৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 وَقَطَّعْنَاهُمْ فِي الْأَرْضِ أُمَمًا مِنْهُمُ الصَّالِحُونَ وَمِنْهُمْ دُونَ ذَلِكَ وَبَلَوْنَاهُمْ بِالْحَسَنَاتِ وَالسَّيِّئَاتِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ

"এই পৃথিবীতে আমি তাদের খণ্ড-বিখণ্ড করে বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত করে দিয়েছি। তাদের মধ্যে কিছু লোক সৎ এবং কিছু লোক তার বিপরীত। ভালো ও খারাপ অবস্থায় ফেলে দিয়ে আমি তাদের পরীক্ষা করি। হয়তো তারা ফিরে আসবে।" (৭:১৬৮)

আগের আয়াতে ইহুদি সম্প্রদায়ের উপর আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও এর শাস্তি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে বলা হয়েছে, তারা কোন ঐক্যবদ্ধ জাতি নয় এবং তারা খণ্ড-বিখণ্ড ও বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত। তাদের কোন দেশ এবং স্বাধীন সরকার নেই।

তবে ইহুদি সম্প্রদায়ের সবাই অসৎ ও খারাপ নয়, তাদের মধ্যে সৎ ও ভালো মানুষও আছে। কিন্তু অধিকাংশই যেহেতু একগুঁয়ে ও জেদি ছিল তাই তারা ব্যাপক ভোগান্তিতে পরে। ইতিহাসে সব সময় ইহুদি সম্প্রদায় অপমান ও লাঞ্ছনা ভোগ করেছে।

এই আয়াতে আরো বলা হয়েছে, আল্লাহ মানুষকে নানাভাবে পরীক্ষা করে থাকেন। আল্লাহ ইহুদি সম্প্রদায়কেও ভালো ও খারাপ অবস্থায় ফেলে পরীক্ষা করেছেন, যাতে তারা সচেতন ও সতর্ক হয় এবং অতীতের ভুল বুঝে সঠিক পথে ফিরে আসে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক.  বিরোধী বা ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিষয়েও সুবিচার করতে হবে  এবং খারাপ দিকগুলোর পাশাপাশি তাদের ভালো দিকগুলোও তুলে ধরতে হবে।

দুই. আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে পরীক্ষা করার একটি উদ্দেশ্য হলো, মানুষকে সচেতন ও ভুল বোঝার সুযোগ দেয়া,যাতে তারা সত পথে ফিরে আসে।

সূরা আ'রাফের ১৬৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَخَلَفَ مِنْ بَعْدِهِمْ خَلْفٌ وَرِثُوا الْكِتَابَ يَأْخُذُونَ عَرَضَ هَذَا الْأَدْنَى وَيَقُولُونَ سَيُغْفَرُ لَنَا وَإِنْ يَأْتِهِمْ عَرَضٌ مِثْلُهُ يَأْخُذُوهُ أَلَمْ يُؤْخَذْ عَلَيْهِمْ مِيثَاقُ الْكِتَابِ أَنْ لَا يَقُولُوا عَلَى اللَّهِ إِلَّا الْحَقَّ وَدَرَسُوا مَا فِيهِ وَالدَّارُ الْآَخِرَةُ خَيْرٌ لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ

"তাদের পরে এক [অসৎ] প্রজন্ম তাদের স্থলাভিষিক্ত হলো। তারা ঐশী গ্রন্থের (তাওরাত) উত্তরাধিকারী হয়েছিলো। কিন্তু তারা নিজেদের জন্য এই পৃথিবীর অসার [আনন্দ] সামগ্রী পছন্দ করেছিল। [এবং কৈফিয়ৎ হিসেবে] বলতো, "খুব শিগগিরই আমাদের [সকল কিছু] ক্ষমা করা হবে। কিন্তু এ ধরনের উপকরণ যদি আবারো তাদের সামনে উপস্থিত হয়, তবে তাও তারা তুলে নেবে [এবং আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করবে]। তাদের কাছ থেকে কি কিতাবে এ অঙ্গীকার নেয়া হয়নি যে তারা আল্লাহ সম্পর্কে সত্য ছাড়া অন্য কিছু বলবে না? এবং তারা ওই কিতাবের (ঐ প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে) বিষয়গুলো বারবার পড়েছে। তাকওয়া অবলম্বনকারীদের জন্য পরকালের আবাসই সর্বশ্রেষ্ঠ। তোমরা কি তা অনুধাবন করবে না ?" (৭:১৬৯)

ইহুদি সম্প্রদায়ের ইতিহাস বর্ণনা করে কুরআননের এই আয়াতে বলা হয়েছে, তারা হযরত মূসা (আ.)সহ বনি ইসরাইলের অন্য নবীদেরকে দেখেছে এবং সরাসরি তাদের বক্তব্য শুনেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তারা তাদের জেদ এবং একগুঁয়েমির কারণে আল্লাহর নবী ও ঐশী গ্রন্থের মর্যাদা রক্ষা করেনি। এ কারণে তাদেরকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে।

এরপর তাদের পরবর্তী প্রজন্মও ঐশী গ্রন্থ পাওয়ার পরও সেটাকে গুরুত্ব দেয়নি এবং পরকালীন কল্যাণের চেয়ে পার্থিব স্বার্থকেই  প্রাধান্য দিয়েছে এবং দুনিয়ার ধন-সম্পদ ও পদমর্যাদা তাদেরকে অন্ধ করে দিয়েছিল। অহংকার ও গরিমা তাদেরকে এতটাই আচ্ছন্ন করেছিল যে, তারা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে দাবি করে বসলো এবং বলতে লাগলো, আমরা আখিরাতের চিন্তা বাদ দিয়ে কেবল পার্থিব স্বার্থকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়ার পরও কিয়ামতের দিন আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করে দেবেন এবং আমরা বেহেশতবাসী হবো ।

এই আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ সম্পর্কে এসব বক্তব্য মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। ইহুদি সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বলা হচ্ছে, তোমরা তো তাওরাত পড়েছো এবং এটা জানো যে, এ ধরনের কোন কথা সেখানে নেই। তারপরও তোমরা কেন আল্লাহকে ভয় করছো না এবং নিজেদের কাজের পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা করছো না?

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. দুনিয়াপ্রীতি এবং অর্থপূজা মানুষের ঈমান দূর্বল করে দেয় এবং মানুষকে আখিরাতের চিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে

দুই. ভালো কাজ না করে আল্লাহর ক্ষমা পাওয়ার আশা করাটা একেবারেই অযৌক্তিক এবং এ ধরনের আশা কখনোই পূর্ণ হবে না।