সূরা আ'রাফ; (৩৯তম পর্ব)

সূরা আ'রাফ; আয়াত ১৭০-১৭৪

সূরা আ'রাফের ১৭০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَالَّذِينَ يُمَسِّكُونَ بِالْكِتَابِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ إِنَّا لَا نُضِيعُ أَجْرَ الْمُصْلِحِينَ

"যারা ঐশী গ্রন্থের বিধান যথাযথভাবে মেনে চলে এবং নামাজ কায়েম করে, নিঃসন্দেহে এ ধরনের সতকর্মশীল লোকদের কর্মফল আমি নষ্ট করি না।" (৭:১৭০)

ঐশী গ্রন্থ পাওয়ার পরও যারা তা প্রত্যাখ্যান করে এবং ঐশী গ্রন্থের বিধান অমান্য করে, তাদের সমালোচনা করা হয়েছে পবিত্র কুরআনে। তবে যারা ঐশী গ্রন্থের বিধান মেনে চলে এবং সে অনুযায়ী নামাজসহ বিভিন্ন এবাদত করে, পবিত্র কুরআনে তাদের প্রশংসা করা হয়েছে। এ আয়াতে নামাজ কায়েম করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইসলাম ধর্ম আবির্ভাবের আগেও সব ঐশী ধর্মে নামাজকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, নামাজ হলো ধর্মের প্রতিচ্ছবি।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. শুধুমাত্র কোরআন তেলাওয়াত ও মুখস্ত করাটাই যথেস্ট নয়। কুরআনের বিধান ও দিকনির্দেশনা অনুযায়ী চলতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। তাহলেই কেবল আমরা আল্লাহর শাস্তি থেকে মুক্তি পাব এবং ইহকাল ও পরকালে সুখি হতে পারবো।

দুই. ধর্মভিত্তিক সংস্কারই হচ্ছে প্রকৃত সংস্কার। যারা মুখে সমাজ সংস্কারের কথা বলে কিন্তু আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন করে না,তারা সমাজের জন্য প্রকৃত কল্যাণ বয়ে আনে না।

সূরা আরাফের ১৭১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذْ نَتَقْنَا الْجَبَلَ فَوْقَهُمْ كَأَنَّهُ ظُلَّةٌ وَظَنُّوا أَنَّهُ وَاقِعٌ بِهِمْ خُذُوا مَا آَتَيْنَاكُمْ بِقُوَّةٍ وَاذْكُرُوا مَا فِيهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

"যখন আমি পর্বতকে চাঁদোয়ার মত তাদের উর্ধ্বে স্থাপন করেছিলাম এবং তারা ধারণা করেছিলো যে, তা তাদের উপর পড়ে যাবে। [আমি বলেছিলাম] আমি তোমাদের যা দিলাম তা দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং তাতে যা আছে, তা স্মরণ কর যেনো তোমরা আল্লাহ্‌কে ভয় করতে পার।" (৭:১৭১)

এটি হচ্ছে সূরা আ'রাফের বনি ইসরাইল সম্পর্কিত সর্বশেষ আয়াত। এ আয়াতে হযরত মুসা (আ.) এর সময় সংঘটিত আরেকটি মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। হযরত মুসা (আ.) বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের কাছে খোদিত শিলালিপি আকারে তাওরাত নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বনি ইসরাইলিরা তা মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল এবং আল্লাহর নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করেছিল। এ অবস্থায় আল্লাহতায়ালা শাস্তির ভয় দেখানোর জন্য তুর পর্বতকে উঠিয়ে নিয়ে ওই সম্প্রদায়ের মানুষের মাথার উপর স্থাপন করেছিলেন। অর্থাত ওই সম্প্রদায়ের লোকজন দেখতে পেলো, তুর পাহাড় তাদের মাথার উপর অবস্থান করছে। তা দেখে তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো এবং সিজদাবনত হলো। তারা তখন থেকে আল্লাহকে মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিলো। তারা বললো, আমরা তাওরাতের বিধান মেনে চলবো এবং আল্লাহর অবাধ্য হবো না। যদিও পরবর্তীতে বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের এক দল লোক ধর্ম থেকে সরে এসে পাপ কাজে লিপ্ত হয়েছিল।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো :

এক. আল্লাহ মানুষকে সজাগ ও সচেতন করার জন্যে কখনো কখনো নিজের অসীম ক্ষমতার কিয়দাংশ প্রদর্শন করেন।

দুই. মানুষের কল্যাণেই ঐশী গ্রন্থ পাঠানো হয়েছে এবং এ বিষয়ে উদাসীনতা আল্লাহ মেনে নেন না।

তিন. আল্লাহর নির্দেশাবলী শুধু জানা থাকলেই চলবে না,তা সঠিকভাবে মানতে হবে। এ ছাড়া, মানুষকে আল্লাহর বিধান স্মরণ করিয়ে দিতে হবে,যাতে তারা সে ব্যাপারে উদাসীন হয়ে না পড়ে।

 সূরা আরাফের ১৭২ থেকে ১৭৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِي آَدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَى شَهِدْنَا أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ (172) أَوْ تَقُولُوا إِنَّمَا أَشْرَكَ آَبَاؤُنَا مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا ذُرِّيَّةً مِنْ بَعْدِهِمْ أَفَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ الْمُبْطِلُونَ (173) وَكَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآَيَاتِ وَلَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ (174)

"আর যখন তোমার পালনকর্তা বনি আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করলেন তাদের সন্তানদেরকে এবং নিজের উপর তাদেরকে প্রতিজ্ঞা করালেন, আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই? তারা বলল, অবশ্যই, আমরা অঙ্গীকার করছি। আবার না কেয়ামতের দিন বলতে শুরু কর যে, এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না।" (৭:১৭২)

"অথবা বলতে শুরু কর যে, অংশীদারিত্বের প্রথা তো আমাদের বাপ-দাদারা উদ্ভাবন করেছিল আমাদের পূর্বেই। আর আমরা হলাম তাদের পরবর্তী বংশধর। তাহলে কি সে কর্মের জন্য আমাদেরকে ধ্বংস করবেন, যা পথভ্রষ্টরা করেছে?" (৭:১৭৩)

"এভাবে আমি বিষয়সমূহ সবিস্তারে বর্ণনা করি, যাতে তারা ফিরে আসে।" (৭:১৭৪)

মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই একজন পালনকর্তার অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। কারণ প্রতিটি মানুষের মনেই ঐশী প্রেম ও মহত্বের অস্তিত্ব দেয়া হয়েছে। আল্লাহকে রব হিসেবে মেনে চলার বিষয়ে মানব জাতি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এ আয়াতে সে প্রসঙ্গেই আলোচনা করা হয়েছে। আর এ আয়াতে বনি আদম বলতে বিশ্বের সব মানুষকেই বুঝানো হয়েছে। মানবজাতি আল্লাহর বিধান মেনে চলার বিষয়ে প্রতিশ্রুতবদ্ধ। তবে ঠিক কীভাবে এ প্রতিশ্রুতি নেয়া হয়েছে,তা কুরআনে উল্লেখ নেই। এ বিষয়ে তফসীরকারকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেক তাফসিরকারক মনে করেন, সমস্ত আদম সন্তানের কাছ থেকে দুনিয়ায় আসার আগেই সৃষ্টি লগ্নে আল্লাহকে মেনে চলার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি নেয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে এই অঙ্গীকার প্রত্যেক মানুষের মনে আল্লাহ পরিচিতির বীজ বপন করে দিয়েছে, যা ক্রমান্বয়ে লালিত হচ্ছে, সে ব্যাপারে কারও জানা থাক কিংবা না থাক।

মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে স্বতন্ত্র, কারণ আল্লাহ্‌ তাকে বিশেষ মানসিক ক্ষমতায় ভূষিত করেছেন। এই বিশেষ ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করার জন্য সে আল্লাহ্‌ সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ। বিশেষকরে আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য সে অঙ্গীকারবদ্ধ। সৃষ্টির প্রথমে প্রতিটি আত্মা থাকে পূত ও পবিত্র। কিন্তু কালের আবর্তে পৃথিবীর মোহে, শয়তানের কুমন্ত্রণার কাছে মানুষ হয় পরাজিত। আর এভাবেই মানুষ তার আত্মার পবিত্রতা হারায়। তখন সে বিবেকের আহ্বানও শুনতে পায় না।

বিবেক হচ্ছে, মানুষের প্রতি আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ। বিবেকের মাধ্যমে মানুষ ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্য ও ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। বিবেক সর্ব অবস্থায় তাকে সুপথে পরিচালিত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু পাপের মাধ্যমে আত্মাকে কলুষিত করে ফেলার কারণে অনেক মানুষই তার বিবেকের আহ্বান শুনতে পায় না। কিন্তু পূত ও পবিত্র আত্মা বিবেকের আহ্বানে সাড়া দেয়। সত্যকে অনুধাবন করতে ও সনাক্ত করতে সক্ষম। কাজেই প্রতিটি মানুষই অন্যায় পথ থেকে নিজেকে দূরে রাখার ক্ষমতা রাখে। আল্লাহ তাকে এ ক্ষমতা দিয়েছেন। এ কারণে কেউ কিয়ামতের দিন তার বাপ-দাদাদের পথভ্রষ্টতার কথা তুলে ধরে নিজের পথভ্রষ্ট হওয়াকে যৌক্তিক ও বৈধ হিসেবে প্রমাণ করতে পারবে না। প্রতিটি মানুষকে তার কৃতকর্মের দায় বহন করতে হবে। কেউ কারো পাপের ভার বহন করবে না।

সূরা আ'রাফের ১৭২,১৭৩ ও ১৭৪ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

এক. প্রতিটি মানুষের ভেতরেই ঐশী প্রেমের অস্তিত্ব রয়েছে। মানুষ তার নিজের লোভ-লালসার কারণে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে।

দুই. বাপ-দাদারা ভুল পথ অনুসরণ করে থাকলে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। ধর্ম মানাসহ সব ক্ষেত্রেই ঐশী গ্রন্থ এবং ঐশী ব্যক্তিত্বদের পথ অনুসরণ করতে হবে।