বাস্তবতার দর্পনে ওহাবি মতবাদ (১১ - ২০)

১১তম পর্বআল হোসাইন (আ.) 
আমরা যদি বিভিন্ন ধর্ম বা ধর্মীয় উৎসগুলো নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাবো বহু ধর্ম কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন মাযহাব বা ফের্কায় বিভক্ত হয়ে গেছে। মহান ঐশী ধর্মগুলোর ক্ষেত্রেও এ সত্য সমানভাবে প্রযোজ্য। ধর্মগুলোর প্রবর্তন করেছিলেন যাঁরা,তাদেঁর সাথে কালগত দূরত্ব সৃষ্টির কারণে এইসব মাযহাব আর ফের্কার জন্ম হয়েছে। এ ধরনেরই একটি ফের্কা হচ্ছে 'ওহাবি' ফের্কা।
নিঃসন্দেহে ঐশী ধর্মগুলোতে এতোসব ফের্কা আর মাযহাবগত মতপার্থক্য এসেছে মানুষের চিন্তা থেকে। কেননা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সকল নবী-রাসূলেরই লক্ষ্য বা মিশন ছিল এক আল্লাহর প্রার্থনা বা একত্ববাদের প্রতি মানুষকে আহ্বান করা। এক্ষেত্রে সকল নবীরই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল এক ও অভিন্ন এবং তাদেঁর সবাই মানব জাতিকে বিচ্ছিন্নতা পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। সর্বশেষ ত্রাণকর্তার আবির্ভাব এবং জুলুম নির্যাতনের অবসান ঘটিয়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করাও সকল ঐশী ধর্মের অভিন্ন বিশ্বাস। একইভাবে সকল ঐশী ধর্ম এ ব্যাপারে অভিন্ন বিশ্বাস পোষণ করে যে, ওহী আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে-যা সকল মারেফাত বা আধ্যাত্মিকতার উৎস। তবে ইতিহাসের কাল পরিক্রমায় আমরা লক্ষ্য করবো,সামাজিক পরিবেশ-পরিস্থিতি, লোভ-লালসা এবং পার্থিব মুনাফার লোভে অথবা অন্য কোনো দুরভিসন্ধিমূলক চিন্তার কারণে কোনো কোনো ব্যক্তির মাঝে ধর্ম সম্পর্কে ভুল উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে।
চিন্তা ও উপলব্ধিগত এই পার্থক্য কালক্রমে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়ে ঐশী ধর্মের অনুসারীদের মাঝে বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিয়েছে। এভাবেই অসংখ্য ফের্কা এবং মাজহাব-চাই তা মানুষের চিন্তাগত ভ্রান্তির কারণেই হোক কিংবা কোনো ব্যক্তি,দল বা কারো রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির কারণেই হোক-গড়ে উঠেছে। একথা এখন অনস্বীকার্য বাস্তবতা যে এইসব ফের্কা এবং মাজহাব দ্বীন বা ঐশী ধর্মগুলোর ঐক্যকে টার্গেট করে বিচ্ছিন্নতার তীর নিক্ষেপ করেছে। ঐশী ধর্মগুলো হচ্ছে ঐক্যের মূল উৎস। ঐক্যের এই উৎসমূলে বিচ্ছিন্নতার বীজ রোপন করেছে ফের্কা বা মাজহাবগুলো-যেসব মাজহাব কখনো কখনো সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামিপূর্ণও বটে। 'ওহাবি' মতবাদও অপরাপর বহু ফের্কার মতো একটি ফের্কা।
অন্যান্য ফের্কার মতো এই ফের্কাটিরও শেকড় প্রোথিত রয়েছে এর প্রতিষ্ঠাতার ব্যক্তিগত চিন্তাধারার মধ্যে। ওহাবি মতবাদের মূল ভাবনাগুলো গৃহীত হয়েছে 'ইবনে তাইমিয়া'র চিন্তাধারা থেকে। তাই প্রথমেই ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিগুলো একবার পর্যালোচনা করে নেওয়া জরুরি। হিজরি সপ্তম শতাব্দিতে তথা ৬৬১ হিজরিতে 'তাকিউদ্দিন আহমাদ ইবনে আব্দুল হালিম' তৎকালীন তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় হাররান ( ইংরেজি ভাষায় Carrhae ) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইবনে তাইমিয়া নামেই বেশি পরিচিত। হাররান শহরটি সেই সময় ছিল হাম্বলি মাজহাব চর্চার প্রধান প্রধান কেন্দ্রগুলোর একটি। বর্তমানে অবশ্য শহরটির কোনো অস্তিত্ব অবশিষ্ট নেই। তবে প্রাচীনকালে হাররান ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ একটি শহর।

ইবনে তাইমিয়া এমন এক পরিবারে লালিত পালিত হন যেই পরিবারটি ছিল এক শতাব্দিরও বেশি সময় ধরে হাম্বলি মাজহাবের পতাকাবাহী। ধর্মীয় বহু বই-পুস্তক লেখালেখি হয়েছে এই পরিবারে। স্বয়ং ইবনে তাইমিয়ার পিতা ছিলেন হাররানের বিখ্যাত ফকিহ। তিনি 'শায়খুল বালাদ' নামে পরিচিত ছিলেন। হাররানের জনগণ তাকেঁ খতিব এবং ইসলামী জ্ঞান ও বিদ্যার শিক্ষক হিসেবেই জানতো। অপরদিকে ইবনে তাইমিয়ার জীবনকাল ছিল ইসলামী ভূখণ্ডে মোঙ্গলদের পাশবিক হামলার সমকালীন। সে সময় মোঙ্গলরা ব্যাপক সহিংস হামলা চালিয়ে মুসলিম ভূখণ্ডগুলো দখল করে নিয়েছিল এবং প্রতিদিনই প্রায় তাদের হুকুমাত বিস্তৃত হচ্ছিলো। এই যুগে মূল্যবান সব ইসলামী শিল্পকর্ম ও মুসলিম মনীষীদের বইপুস্তকগুলো মোঙ্গলদের হাতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো।
বিখ্যাত আরব ঐতিহাসিক ইবনে কাসির লিখেছেনঃ 'হিজরি ৬৬৭ সালে অর্থাৎ ১২৬৯ খ্রিষ্টাব্দে যখন ইবনে তাইমিয়ার বয়স ৬ বছরের বেশি ছিলো না,তখন হাররান শহরের ওপর মোঙ্গলদের চাপ এতো ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিলো যে, তাদের হামলার ভয়ে হাররানবাসীরা শহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। ইবনে তাইমিয়াও সে সময় তার পরিবারের সাথে হাররান থেকে দামেশকে চলে গিয়েছিলেন।' দামেশকে যাবার পর 'দারুল হাদিসে'র প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন ইবনে তাইমিয়ার পিতা। সেখানে ইবনে তাইমিয়া পড়ালেখা করেন। তিনি তাঁর যৌবনকাল কাটান দামেশকে। তাঁর পিতাসহ হাম্বলি মাজহাবের বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে তিনি ফিকাহ, হাদিস, উসূল, তাফসির, কালাম ইত্যাদি শেখেন। এক পর্যায়ে তিনি হাম্বলি মাজহাবে ইজতেহাদের পর্যায়ে পৌছেঁন এবং ফতোয়া দেওয়া ও শিক্ষকতা করার মতো যোগ্যতা অর্জন করেন। দামেশকে তার পিতার মৃত্যুর পর তিনি পিতার স্থলাভিষিক্ত হন এবং কোরআনের তাফসির পড়ানোর দায়িত্বে নিয়োজিত হন।
ইবনে তাইমিয়া অন্যান্য ধর্ম এবং মাজহাব নিয়েও পড়ালেখা করেন এবং এমন কিছু ফতোয়া দিতে থাকেন যেগুলোর সাথে আহলে সুন্নাতের চার মাজহাবসহ শিয়া মাজহাবেরও কোনো মিল ছিলো না। ইবনে তাইমিয়া মুসলমানদের মাঝে প্রচলিত কিছু রীতিনীতিরও সমালোচনা করতে থাকেন এবং এমনকি কিছু কিছু সুন্নাতের অনুসরণকে শিরকের সাথে তুলনা করার পাশাপাশি আল্লাহর সাথে দূরত্ব সৃষ্টির কারণ বলেও উল্লেখ করেন। মুসলমানদের দৃঢ় বিশ্বাসগুলোর কোনো কোনোটির ব্যাপারে প্রশ্ন তোলার কারণে এবং ব্যতিক্রমধর্মী ফতোয়া প্রদান করার কারণে ইবনে তাইমিয়ার জীবনে শুরু হয় ব্যাপক তোলপাড়। হিজরি ৬৯৮ সাল পর্যন্ত ইবনে তাইমিয়ার চিন্তাধারা সম্পর্কে তেমন কিছুই শোনা যায় নি, কিন্তু এখন আবার ধীরে ধীরে তার চিন্তাধারার উত্থান ঘটছে। উদাহরণত বলা যায় এ বছরই আশআরি মাজহাবের বিরুদ্ধে একটি বই লেখা হয়েছে যে বইটি দামেশকে ব্যাপক হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে।
ইবনে তাইমিয়া নিজেকে 'সালাফি' বলে মনে করতেন।সালাফি শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে অতীতচারিতা বা পূর্বপুরুষদের নিঃশর্ত অনুসরণ করা। তবে 'সালাফিয়া' একটি ফের্কার নাম যেই ফের্কায় নবীজী (সা), তাঁর সাহাবিবর্গ এবং তাবেয়িনদের অনুসরণের দাবী করা হয়। তাবেয়িন বলতে বোঝায় এমন শ্রেণীর লোকজনকে যাঁরা এক বা একাধিক সাহাবির সাহচর্য লাভে ধন্য হয়েছেন। সালাফিরা মনে করতেন ইসলামের সকল আকিদা-বিশ্বাস সাহাবি এবং তাবেয়িনদের আমল অনুযায়ী বাস্তবায়িত হওয়া উচিত। আর ইসলামী আকিদা কেবল কিতাব এবং সুন্নাত থেকেই গ্রহণ করতে হবে,আলেমদের উচিত হবে না কোরআনের বাইরের কোনো দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে কোনো কিছু আমল বা বাস্তবায়ন করা। সালাফিদের চিন্তায় বিবেক-বুদ্ধি বা যুক্তি তথা গবেষণার কোনো স্থান নেই,তাদের কাছে কেবল কোরআন-হাদিসের মূল টেক্সটই প্রমাণের জন্যে যথেষ্ট। তাদের যুক্তির বিরোধিতাকারীদের সাথে তারা কঠোর ব্যবহার করতো।
ইবনে তাইমিয়া সালাফি ইসলাম তথা প্রাচীন ইসলামে ফেরার অজুহাত দেখিয়ে ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ে এমন সব দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত দিতে থাকেন যার ভিত্তিতে মুসলমানদের বহু চিন্তা ও কাজকর্ম প্রশ্নের সম্মুখিন হয়ে যায়,এমনকি বহুসংখ্যক মুসলমান ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত অর্থাৎ কাফের হিসেবে পরিগণিত হয়।
ইবনে তাইমিয়া যখন তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনা প্রসূত বিভিন্ন মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন, তখন তার ঐসব বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে,বিশেষ করে তিনি যখন আল্লাহর গুণাবলি নিয়ে কথা বলতেন তখন। তিনি আল্লাহ সম্পর্কে বিশ্বাস করতেন যে আল্লাহ সশরীরী একটি সত্ত্বা এবং তিনি আকাশসমূহের উর্ধ্বে থাকেন। ইবনে তাইমিয়াই প্রথম কোনো মুসলিম যিনি আল্লাহর সশরীরী সত্ত্বার প্রবক্তা এবং এর পক্ষে লেখালেখিও করেছেন। তিনি মহানবী (সা) এর রওজা শরিফ যিয়ারত করা কিংবা তাঁর সম্পর্কে কোনো স্মরণসভা বা কোনো অনুষ্ঠান করাকে হারাম এবং শের্‌ক বলে মনে করতেন। এছাড়া তিনি কোনো ওলি আওলিয়া কিংবা নেককার বান্দাদের শরণাপন্ন হওয়া অথবা তাদের সহায়তা প্রার্থনা করাকেও হারাম বলে মনে করতেন কেননা তাঁর ধারণা এ ধরনের আমলের মানে হলো আল্লাহ বহির্ভুত সত্ত্বার শরণাপন্ন হওয়া।
ইবনে তাইমিয়া নবীজীসহ সকল অলিআওলিয়ার কবর মেরামত করা বা পবিত্র কোনো কবরের পাশে মসজিদ নির্মাণ করারও বিরোধী ছিলেন এবং এ ধরনের কাজকে তিনি শিরক বলে মনে করতেন। তাঁর এইসব বক্তব্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মাজহাবের আলেম ওলামাগণ তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তারা আল্লাহর সশরীরী সত্ত্বায় বিশ্বাসী এবং আল্লাহকে মানুষের মতোই চিন্তা করতে অভ্যস্থ এমন কোনো ব্যক্তির এ ধরনের কথাবার্তা গ্রহণ করতে পারছিলেন না। তাঁরা কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্যগুলোকে খণ্ডন করে বহু বই লিখেছেন। বিশেষ করে আল্লাহ যে অশরীরী বা দৈহিক কাঠামোর উর্ধ্বে এবং মানুষের উপলব্ধিরও উর্ধ্বে সে সম্পর্কে বিস্তারিত লেখালেখি করেছেন। সেইসাথে তাঁরা আদালতে আবেদন জানিয়েছেন ইবনে তাইমিয়ার বিপথগামী চিন্তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্যে। ইবনে তাইমিয়া প্রতিবাদের এই ঝড়ের মুখেও তার বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটাতে থাকেন।
কেবল তাই নয় যারা তাঁর বিরোধিতা করছে তাদেরকে তিনি কাফের বলে অভিহিত করেন এমনকি কখনো কখনো তাঁর লেখায় তাদেঁরকে অভিহিত করার ক্ষেত্রে অশোভন শব্দও ব্যবহার করেছেন। ইতিহাসে এসেছে হিজরি ৭০৩ সালে ইবনে তাইমিয়া যখন বিখ্যাত আরব মুসলিম আরেফ 'মহিউিদ্দন আরাবি'র লেখা 'কুসুসুল হেকাম' নামক বইটি পড়েন,তখন তিনি এতে তাঁর নিজস্ব মত ও বিশ্বাসের বিরোধী বক্তব্য খুঁজে পান। সেজন্যে পাল্টা একটি বই লেখেন 'আন্নুসুসু আলাল ফুসুস' নামে। এ বইতে মহিউদ্দিন আরাবি'র চিন্তাধারাকে প্রত্যাখ্যান করে তাঁর অনুসারীদেরকে অভিশাপ দেওয়া হয়েছে। এভাবে মতবিরোধ ক্রমশ তীব্র আকার ধারণ করে।
মুসলমানদের মাঝে প্রচলিত বিখ্যাত ধ্যান-ধারণার সাথে ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্য সাংঘর্ষিক হবার ফলে ব্যাপক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। যার পরিণতিতে ৭০৫ হিজরিতে সিরিয়ার আদালত তাঁর বিরুদ্ধে মিশরে নির্বাসনের রায় দেয়। হিজরি ৭০৭ সালে তিনি কারামুক্ত হন এবং কয়েক বছর পর আবার সিরিয়ায় ফিরে আসেন এবং তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গির অনকূলে পুনরায় লেখালেখি করতে থাকেন। ৭২১ হিজরিতে আবারো তাঁকে কারাগারে আটক করা হয় এবং ৭২৮ হিজরির জিলকাদ মাসে শেষ পর্যন্ত দামেশকের কেল্লা কারাগারে মারা যান।
ইবনে তাইমিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর চিন্তাদর্শেরও প্রায় মৃত্যু ঘটে গিয়েছিল। খুব কম লোকই তাঁর চিন্তাদর্শের অনুসারী ছিল।কিন্তু পাঁচ শতাব্দি পর 'মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদি'নামের এক লোক ইবনে তাইমিয়ার আকায়েদের ভিত্তিতে নতুন করে একটি ফের্কার জন্ম দেন।তাঁর ওই ফের্কার নাম হচ্ছে 'ওহাবিয়্যাত'বা ওহাবি মতবাদ। এই মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব হিজরি ১১১৫ সালে সৌদি অরবে জন্মগ্রহণ করেন। তরুণ বয়সে তিনি ইবনে তাইমিয়ার চিন্তাধারায় প্রভাবিত ছিলেন। এমন একটি মতবাদের প্রবর্তন করেন তিনি ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষাগুলোর সাথে যার ব্যাপক মতপার্থক্য ছিলো। তবে তিনি তাঁর আকিদা বিশ্বাসের বিস্তারের ক্ষেত্রে নজদের শাসক 'মুহাম্মাদ বিন সাউদে'র শক্তি ও ক্ষমতাকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়েছেন। আব্দুল ওহাব পুনরায় সালাফি মতবাদের প্রচার ঘটান। তিনি মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্র কেন্দ্র অর্থাৎ মক্কা এবং মদিনায় তাঁর এই মতবাদ পেশ করেন এবং ভয়াবহ সংঘর্ষের মাধ্যমে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
১২তম পর্ব
মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাবের পিতা সন্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার শৈশব থেকেই উদ্বিগ্ন ছিলেন, কেননা তার ছেলের কথাবার্তায় আচার আচরণে গোমরাহি বা বিচ্যুতির লক্ষণ ছিলো স্পষ্ট। আব্দুল ওহাব মুসলমানদের বেশিরভাগ আকিদা বিশ্বাসকেই ঠাট্টা মশকরা করে উড়িয়ে দিতো। মদিনায় পড়ালেখা করার সময় প্রায়ই এমন কিছু বিষয় তুলে ধরতো নির্দিষ্ট একটি আকিদার সাথে যা ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ। শিক্ষকরাও তার ভবিষ্যৎ বিচ্যুতির ব্যাপারে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাব মদিনাতেও ইসলামের নবির শরণাপন্ন হওয়া বা তাঁর রওজা যিয়ারত করতে আসা মানুষের সমালোচনা করতেন। জানা যায়, শৈশবে তিনি মিথ্যা নবুয়্যতের দাবিদার যেমন মুসাইলামাতুল কাজ্জাব কিংবা সাজ্জাদ, আসওয়াদ আনাসির মতো ব্যক্তিদের জীবনী পড়তেন এবং এ ব্যাপারে ভীষণ আকর্ষণ বোধ করতেন। তবে তাঁর আকিদা বিশ্বাসের ওপর সরাসরি ছাপ পড়েছে ইবনে তাইমিয়া এবং তাঁর ছাত্র ইবনে কাইয়্যেম জুযির মতো লোকদের।
মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব যখন তার আকিদার কারণে মদিনার লোকজনের বিরোধিতার সম্মুখিন হলেন তখন মদিনা ছেড়ে চলে গেলেন নাজদে। তারপর কিছুদিন ছিলেন বসরায়। বসরায় যখন ছিলেন তখন তিনি তাঁর আকিদা নিয়ে আবারো বাড়াবাড়ি করেন এবং বসরা থেকেও বিতাড়িত হন। ওহাব ধর্মের সরল সঠিক পথ থেকে এতো বেশি বিচ্যুত হন যে আপামর মুসলমানকে কাফের-মুশরিক বলে বেড়াতে শুরু করেন এমনকি মুসলমানদের হত্যা করাকে ওয়াজিব বলেও মন্তব্য করেন। আব্দুল ওহাব তার অসুস্থ চিন্তাধারার ভিত্তিতে এমনকি মক্কা-মদিনার মতো ইসলামের পবিত্রতম ভূখণ্ডগুলোকে পর্যন্ত 'দারুল কুফ্‌র' এবং 'দারুল হার্‌ব' বলে অভিহিত করেন। পবিত্র এই স্থাপনাগুলোকে দখল করা এবং ধ্বংস করাকে তার অনুসারীদের ওপর ওয়াজিব বলে ঘোষণা করেন। সহিংসতা ছিল আব্দুল ওহাব এবং তার অনুসারীদের আচরণগত প্রধান বৈশিষ্ট্য।
১৩তম পর্ব
আব্দুল ওহাবের ভ্রান্ত আকিদার বিরুদ্ধে মুসলিম জনগোষ্ঠি তো বটেই, এমনকি তার পিতা এবং আপন ভাইও ঐ মতবাদ প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার ভাই শায়খ সোলাইমানের জীবনকথায় এসেছে আব্দুল ওহাবের পিতা জীবিতকালে ছেলের এ ধরনের আকিদা প্রচারের ব্যাপারে বাধা দিয়েছিলেন। তবে হিজরি ১১৫৩ সালে পিতার মৃত্যুর পর অনগ্রসর কিছু লোকের মাঝে তার আকিদা প্রচারের সুযোগ পায়। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাবের আকিদার বিষয়টি স্পষ্ট হবার পর তার বিরুদ্ধে বড়ো বড়ো বহু আলেম উঠে আসেন। স্বয়ং তার ভাই শায়খ সোলায়মান-যিনি ছিলেন একজন হাম্বলি আলেম-তিনিও ওহাবের আকিদা প্রত্যাখ্যান করে একটি বই লেখেন। ইমানী দায়িত্বের অংশ হিসেবে ওহাবকে কোরআন হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বহু চিঠিও লেখেন তিনি এবং ইসলামের ভেতর এসব বেদায়াত প্রবেশ করানো থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। একটি পত্রে তিনি সূরা নিসা'র ১১৫ নম্বর আয়াত উদ্ধৃত করেন যেখানে লেখা রয়েছেঃ 'সত্য সুস্পষ্ট হবার পর যে কেউ নবীজীর বিরোধিতা করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য কোনো পথের অনুসরণ করে, আমরা তাকে সেই বাতিল পথেই চলতে দেবো এবং দোযখে প্রবেশ করাবো,সেই স্থানটি খুবই বাজে।'
তারপরও আব্দুল ওহাব তার জাহেলি বিশ্বাসের ওপর স্থির থাকে এবং যে-ই তার দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে তাকেই কাফের বলে সাব্যস্ত করে। সোলায়মান এক জায়গায় আব্দুল ওহাবের মূর্খতার কথা উল্লেখ করে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেনঃ রাসূলে আকরাম (সা) বলেছেন 'কোনো বিষয়ে যার সঠিক জ্ঞান নেই সে বিষয়ে তার উচিত নয় মতামত ব্যক্ত করা,বরং তার উচিত হলো যেটা সে জানে না তা একজন জ্ঞানী লোকের কাছ থেকে জেনে নেওয়া'। সূরা আম্বিয়ার ৭ নম্বর আয়াতেও এসেছেঃ فاَسئلوا أهلَ الذکر ان کنتم لا تعلمون অর্থাৎ'যদি না জানো তাহলে যে জানে তার কাছে জিজ্ঞেস করো।'সেজন্যেই শায়খ সোলায়মান বলতেন-ওহাবের জ্ঞানের অভাব রয়েছে,তাই তার উচিত যারা জ্ঞানী ও ইসলামী চিন্তাবিদ তাদেরকে জিজ্ঞেস করা এবং তাদের অনুসরণ করা।
যাই হোক ওহাবের বিরুদ্ধে সে সময় এতোসব বিরোধিতা সত্ত্বেও সে তার ভ্রান্ত আকিদাকে নাজদ অঞ্চলের কিছু লোকের মাঝে প্রচার করতে সক্ষম হয়েছিল। সমাজ বিজ্ঞানীগণ এর কারণ হিসেবে বলেছেন ঐ এলাকাটি ছিল প্রত্যন্ত মরু,তাদের লেখাপড়া কিংবা দ্বীনী জ্ঞান ছিল একেবারেই নগণ্য। সেই এলাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৈন্যতার কারণেই সেখানকার কিছু লোকজন ওহাবের আকিদা গ্রহণ করেছিল। এই শ্রেণীর লোকজনকে যে-কেউ খুব সহজেই প্রতারিত করতে পারে। তাছাড়া ওহাবের কথাবার্তার ভঙ্গিটাও ছিল বেশ আকর্ষণীয় এবং মুগ্ধকর। সবোর্পরি মুহাম্মাদ ইবনে সাউদ এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শক্তির ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা ছিল তার পেছনে।
এমনিতেই পশ্চিমা উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো এ সময় চারদিক থেকে মুসলিম বিশ্বকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল। ব্রিটিশরা পূর্বদিক থেকে ভারতের বৃহৎ অংশ দখল করে পারস্য উপসাগর উপকূলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। তারা প্রতিটি মুহূর্তে ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো। ফরাশিরাও নেপোলিয়নের নেতৃত্বে মিশর, সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন দখল করে ভারতের দিকে যাবার চিন্তা করছিলো। রুশরাও চেয়েছিলো ইরান এবং তুরস্কে বারবার হামলা চালিয়ে তাদের সাম্রাজ্য একদিক থেকে সেই ফিলিস্তিন পর্যন্ত অন্যদিকে সুদূর পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত করতে। সে সময়কার আমেরিকাও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর দিকে তাদের লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল। তারা লিবিয়া এবং আলজেরিয়ায় গুলিবর্ষণ করে মুসলিম বিশ্বে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা চালিয়েছিল। এরকম একটি কঠিন পরিস্থিতিতে যখন শত্রুদের মোকাবেলায় মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতামূলক হৃদ্যতার প্রয়োজন ছিলো,ঠিক সে সময় মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব ভ্রান্ত মতাদর্শ প্রচারের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে কাফের সাব্যস্ত করে মুসলিম ঐক্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছিলো।
এদের মাঝে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদই ছিলো সবচেয়ে অগ্রসর। তারা মুসলমানদের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করে তাদের সম্পদ লুট করার চেষ্টা চালিয়েছিল। এই ফাটল সৃষ্টি করার জন্যে মুসলিম বিশ্বে মাজহাবগত মতপার্থক্য সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। এ কারণেই কোনো কোনো ঐতিহাসিক ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের স্বার্থসিদ্ধির সাথে ওহাবি ফের্কার আবির্ভাবের যোগসূত্রের বিষয়টিকে উড়িয়ে দেন নি। ইতিহাসে ব্রিটিশ গোয়েন্দা মিস্টার হ্যাম্পারের সাথে আব্দুল ওহাবের যোগাযোগের কথা এসেছে। হ্যাম্পার মুসলিম দেশগুলোতে বৃটেনের পক্ষে গোয়েন্দাবৃত্তি করতো। সে ইসলামী বেশভুষায় মূলত মুসলমানদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির পথ খুজেঁ বেড়াতো। হ্যাম্পার তার ডায়েরিতে ব্যক্তিগত স্মৃতিকথায় লিখেছে ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলীয় বসরা শহরে আব্দুল ওহাবের সাথে তার দেখা হয়। ওহাব সম্পর্কে তার মূল্যায়ন এরকমঃ 'মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাবের মাঝে আমি আমার হারানো আমিকে খুজেঁ পেলাম। মাজহাব সংরক্ষণে তার নির্লিপ্তি, তার আত্মম্ভরি ও অহমিকাপূর্ণ আত্মা ও মানসিকতা, সমকালীন আলেমদের প্রতি তার ঘৃণা, স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি এমনকি চার খলিফা সম্পর্কে গুরুত্বহীনতা ইত্যাদি ছিল তার চিন্তাগত বৈশিষ্ট্য। কোরআন ও সুন্নাহর সামান্য জ্ঞানই ছিল মূল ভিত্তি। ওহাবের এইসব গুণাবলিই ছিল দুর্বল স্থান যার মধ্য দিয়ে তার ভেতরে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ ঘটে।'
হ্যাম্পারের বক্তব্য থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় তাহলো সে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাবকে ওহাবি ফের্কা প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছিলো এবং এ ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার তাকে ও মুহাম্মাদ ইবনে সাউদকে সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দেবে বলেও ঘোষণা করেছে। কিন্তু বাধ সেধেছে সে সময়কার আলেম সমাজ। ওহাবের ভাই,পিতাসহ সবাই তার ভ্রান্ত আকিদার বিরোধিতা করেছে। পিতার মৃত্যুর পর ওহাব যখন যেখানে গেছে কিছুদিন পরপর সেখান থেকে বিতাড়িত হয়েছে। সবশেষে এসে ভিড়েছে নজদের বিখ্যাত শহর দারিয়ার গভর্নর মুহাম্মাদ ইবনে সাউদের কাছে। ইনিই ছিলেন আলে সউদের পূর্বপুরুষ। তার সাথে ওহাবের চুক্তি হয় উগ্র ওহাবি চিন্তাধারা বিকাশের মধ্য দিয়ে ইবনে সাউদের সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটানো হবে। শাসক থাকবেন ইবনে সাউদ আর ধর্মীয় প্রচারণা চালাবে ওহাব। এই চুক্তিকে আরো মজবুত করার জন্যে দুই পরিবার বৈবাহিক সূত্রেও আবদ্ধ হয়।
১৪তম পর্ব
আলে সাউদের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আব্দুল ওহাব তার মতবাদের বিস্তার ঘটায়। বিশেষ করে তারা আশপাশের শহর এবং গোত্রগুলোতে দ্রুততার সাথে প্রচার কাজ শুরু করে। ওহাবি মতবাদ প্রচারের একেবারে শুরুতেই যে কাজটি করা হয় তাহলো উয়াইনা'য় সাহাবাদের এবং আওলিয়াদের মাযারগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। আব্দুল ওহাব আল্লাহর অলিদের শরণাপন্ন হওয়াকে শিরক এবং মূর্তিপূজার মতো অপরাধ বলে গণ্য করতো এবং যারা একাজ করতো তাদেরকে কাফের বলে সাব্যস্ত করতো। তাদেরকে হত্যা করা জায়েয এবং তাদের মালামালকে যুদ্ধে প্রাপ্ত গনিমত বলে ঘোষণা করেছিল। এই ফতোয়া পেয়ে ওহাবের অনুসারীরা হাজার হাজার নিরীহ মুসলমানের রক্ত ঝরিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো সে সময় দিরইয়ের লোকজন অভাবগ্রস্ত ছিল। এই রক্তপাতের পর তাদের ভাষায় প্রচুর গনিমত পাবার ফলে অভাব কেটে যায়। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ বুশ্‌র নজদি' লিখেছেনঃ আমি আমার কাজের শুরুতে দিরইয়া শহরের দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখেছি,কিন্তু পরবর্তীতে এই শহর সাউদের অর্থাৎ মুহাম্মাদ ইবনে সাউদের উত্তর পুরুষের সময়ে বেশ সম্পদশালী হয়ে ওঠে। কিন্তু কীভাবে এতোটা সম্পদশালী হলো তার বর্ণনা প্রসঙ্গে ইবনে বুশর ইতিহাসের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেনঃ নজদের অন্যান্য শহরসহ বিভিন্ন গোত্রের মুসলমানদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের সম্পদ লুট করে এরকম সম্পদশালী হয়েছে। যারাই ওহাবি মতবাদ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে তাদের ওপর হামলা করা হয়েছে। হামলা করে যেসব গনিমত পেত তার সবই শায়খ মুহাম্মাদের নিয়ন্ত্রণে থাকতো আর মুহাম্মাদ ইবনে সাউদ, তার অনুমতিক্রমে একটা অংশ নিতো। আব্দুল ওহাব তার ইচ্ছামতো এই সম্পদ ব্যবহার করতো। অনেক সময় দেখা যেত ওহাব সকল সম্পদ মাত্র দু'তিন জনের মাঝে বিলি করে দিয়েছে। ওহাব বিভিন্ন শহরের লোকজনকে তার মতবাদের দিকে আমন্ত্রণ জানাতো। যারা গ্রহণ করতো তারা নিরাপদ ছিলো,আর যারা বিরোধিতা করতো তাদের জান-মালকে হালাল ঘোষণা করে আক্রমণ চালাতো। নজদ এবং নজদের বাইরে ওহাবিরা এরকম বহু যুদ্ধ করেছে। ইয়েমেন, হেজাজ, সিরিয়ার উপকণ্ঠ, ইরাকে ওহাবিরা যতো যুদ্ধ করেছে সবই তাদের মতবাদ গ্রহণে অস্বীকৃতির কারণেই করেছে। 'আহসা' শহরের 'ফুসুল' নামের একটি গ্রামের তিন শ' মুসলমানকে ওহাবিরা হত্যা করে তাদের সকল মালামাল লুট করেছে।
আব্দুল ওহাব নিজেকে হাম্বলি মাজহাবের অনুসারী বলে পরিচয় দিতেন। অথচ এই মাজহাবের মূল প্রবক্তা আহমাদ ইবনে হাম্বলকেও কাফের বলে ঘোষণা করেছিল। কেননা তিনি কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ) এর মাযার যিয়ারত সম্পর্কে বই লিখেছিলেন। ওহাবের দৃষ্টিতে পবিত্র কোনো স্থাপনা যেমন অলি-আওলিয়া, মাসুমিনদের মাযারের মতো মহান স্থাপনাগুলো যিয়ারত করা শির্‌ক, তাই এইসব স্থাপনা যিয়ারতকারীদের জানমাল হরণ করা মোবাহ অর্থাৎ সওয়াবের কাজ। তার এই চরমপন্থী মতবাদ শুরু থেকেই যে আলেমদের বিরোধিতার সম্মুখিন হয়েছিল সেকথা আমরা ইতোপূর্বেও বলেছি। সে সময়কার হেজাজের বিখ্যাত আলেমে দ্বীন এবং মক্কার মুফতি সাইয়্যেদ আহমাদ ইবনে যিনি দাহলান 'খুলাসাতুল কালাম' নামক গ্রন্থে লিখেছেন '১১৬৫ হিজরিতে আব্দুল ওহাবের জীবিতাবস্থায় নজদের একদল ওহাবি আলেম মক্কা শহরে গিয়েছিলেন সেখানকার আলেমদের সাথে বাহাস করার জন্যে। তারা তাদের আকিদার কথা বর্ণনা করতো আর মক্কার আলেমগণ তাদের বক্তব্য খণ্ডন করতেন। কোরান-হাদিস বিরোধী ওহাবি আকিদা মক্কী আলেমগণ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তাঁরা ওহাবি মতবাদকে ভিত্তিহীন এবং নষ্ট আকিদা বলে মনে করতেন। ঠিক সে সময় মক্কার কাজি ওহাবি আলেমদেরকে কারাবন্দী করার আদেশ দেন। ঐ আদেশের পর কিছু কিছু ওহাবি আলেম পালিয়ে গিয়েছিলো আর কিছু কিছু আলেমকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল।
ওহাবি আলেমদেরকে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা একটু ভিন্নভাবে ১১৯৫ হিজরি তথা ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দেও ঘটেছিলো। আলে সাউদ এবং ওহাবি ফের্কার মূল কেন্দ্র দিরইয়া শহরের ওহাবি আলেমরা মক্কায় গিয়েছিলো সেখানকার আলেমদের সাথে নতুন তৌহিদ নিয়ে কথা বলার জন্যে। মক্কার আলেমগণ তখনো ওহাবি আলেমদেরকে কাফের বলে তাদেরকে মক্কা থেকে বিতাড়িত করেছিল এবং তাদের ওপর হজ্ব করা বা আল্লাহর ঘর যিয়ারত করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলো। এখানে একটি প্রশ্ন এসে যায়,তাহলো ওহাবিরা কেন তাদের আকিদা নিয়ে মক্কায় যেত? জবাব হলো মক্কা শহর ছিলো ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থান ও প্রাণকেন্দ্র। তাই ওহাবিরা চেয়েছিল মক্কা দখল করে তাকে তাদের ধর্মীয় কেন্দ্র বানাতে যাতে মুসলমানরা ইসলামের পরিবর্তে ওহাবি আকিদায় দীক্ষিত হয়।
ইতোমধ্যে মুহাম্মাদ ইবনে সাউদ ১১৭৯ হিজরি তথা ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর স্থলাভিষিক্ত হন তাঁরই পুত্র আব্দুল আযিয। বাবার মতো আব্দুল আযিযও ওহাবের সাথে মৈত্রীতে আব্দ্ধ হন। বাবা বেঁচে থাকতে আব্দুল আযিয পিতার সেনাবাহিনীর একাংশের পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন,আব্দুল ওহাবের পৃষ্ঠপোষকতায় সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তাই সৌদি আরবের বিরাট একটি অংশ দখল করতে সক্ষম হন তিনি। ওহাবি মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব শেষ পর্যন্ত ১২০৭ হিজরিতে অর্থাৎ ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ৯৬ বছর বয়সে মারা যান। তার মৃত্যুর পর তার সন্তানেরা ওহাবি মতবাদ প্রচারের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। তারই উত্তরপুরুষ আব্দুল লতিফ ওহাবি মতবাদের ওপর বহু বই লিখেছেন। এভাবে ওহাবের ছেলেরা, পৌত্রেরা ভ্রান্ত ওই মতবাদ ব্যাখ্যা করে বহু বই লিখেছেন।
ওহাবিদের চরমপন্থার ভয়াবহ একটি নিদর্শন হলো ইরাকের পবিত্র কারবালা শহরে হামলা চালিয়ে হাজার হাজার যিয়ারতকারীকে হত্যা করা এবং সেখানে অবস্থিত ইমাম হোসাইন (আ) এর মাযারে হামলা চালানো। ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে সাউদ বিন আব্দুল আযিয,নজদের জঙ্গি আরব সেনাদের মধ্য থেকে বিশ হাজারের একটি বাহিনীকে কারবালা শহরে হামলার উদ্দেশ্যে পাঠান। ঐ সেনারা প্রতমে কারবালা শহর অবরোধ করে এভং পরে জোর করে শহরে প্রবেশ করে। সে সময় কারবালা ছিলো ব্যাপক খাতিমান ও সম্মানীয়। ইরান, তুরস্ক এভং আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যিয়ারতকারীগণ কারবালায় যেতেন ইমাম হোসাইন (আ) এর মাযার যিয়ারত করার জন্যে। সাউদ এই যিয়ারতকারী এবং তাদেরকে আশ্রয় প্রদানকারীকে কাফের বলে ঘোষণা করে সবাইকে মর্মান্তিকভাবে হত্যা করে। আত্মগোপনকারী কিংবা পলায়নকারীরা ছাড়া কেউ তাদের হাত থেকে রক্ষা পায় নি।
ইতিহাসে এসেছে ওহাবিরা কারবালা শহরের অন্তত ৫ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিল। সাউদের এই নৃশংস সেনারা নবীজীর সন্তান হোসাইন ইবনে আলি (আ) এর মাযারের মর্যাদাটুকুও রাখে নি,মাযারটিকে তারা ধ্বংস করে দিয়ে সোনা-রূপাসহ সকল সম্পদ লুট করে নিয়ে গিয়েছিলো। ভয়াবহ সেই ঘটনার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো সে সময়।
১৫তম পর্ব
আল্লাহ সম্পর্কে নাহজুল বালাগায় ইমাম আলী (আ) এর গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য এসেছে এভাবেঃ "..কোরআনে তৌহিদ সম্পর্কে এসেছে: 'কোনো কিছুই তাঁর মতো নয়'। ফলে তাঁর সাথে কোনো কিছুর তুলনা দেওয়াটা ভুল এবং আল্লাহর বাইরে চিন্তার শামিল। যে-ই আল্লাহকে কোনো কিছুর মতো ভাবে সে লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারলো না। যদি একান্ত প্রয়োজনে তুলনা দিতে হয় সেটা তো আল্লাহর বান্দার দেওয়া বর্ণনা হলো,আল্লাহর নিজের নয়। কেননা তিনি কোনো কিছুর সাথেই তুলনীয় নন। তাই যারা আল্লাহকে কোনো কিছুর সাথে তুলনা করলো তারা তো আল্লাহকে চেনার পথে অগ্রসর না হয়ে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে গেল এবং আল্লাহকে উপলব্ধি করতে পারলো না।"
বিশিষ্ট মনীষী ও ইসলামী চিন্তাবিদ ইমাম গাযযালি (রহ) বলেছেনঃ 'কেউ যদি মনে মনে ভাবে আল্লাহর একটি দৈহিক অবয়ব রয়েছে যা বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে গঠিত,তাহলে সে মূর্তি পূজক হয়ে যাবে কেননা প্রতিটি দেহই সৃষ্টি করা হয়েছে বা বানানো হয়েছে। আর সর্বকালের সর্বযুগের সকল আলেম ওলামা বা ধর্মীয় মনীষীই এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন যে সৃষ্টির পূজা করা কুফুরি এবং মূর্তি পূজার শামিল।' কুরতাবি আরেকজন বিখ্যাত আলেমে দ্বীন। যারা আল্লাহর দৈহিক সত্ত্বায় বিশ্বাস করে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেনঃ 'প্রকৃত সত্য কথাটি হলো আল্লাহ তায়ালার দৈহিক সত্ত্বার প্রবক্তা বা এই মতে বিশ্বাসীদের সবাই কাফের। কেননা মূর্তি পূজক আর ব্যক্তি পূজারিদের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।'
ইসলামের ইতিহাসবিদ এবং বহু আলেম মনে করেন ইবনে তাইমিয়াসহ কোনো কোনো মুসলমানের চিন্তায় আল্লাহর দেহতত্ত্বটা প্রবেশ করেছে ইহুদি ধর্ম থেকে। শাহরেস্তানি তাঁর 'মেলাল ও নাহল' গ্রন্থে লিখেছেনঃ "যেসব ইহুদি দৃশ্যত মুসলমান হয়েছিল তারা আল্লাহ তায়ালার দৈহিক সত্ত্বা সংক্রান্ত অসংখ্য হাদিস তৈরি করেছিল এবং সেগুলোকে ইসলামী শরিয়তে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিল। এ সংক্রান্ত সকল হাদিসেরই উৎস হলো তৌরাত।" ইবনে খালদুন আরেকজন বিখ্যাত মুসলমান ইতিহাসবিদ। তিনিও বলেছেনঃ ইসলামের আবির্ভাবস্থল আরব বই-পুস্তক কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিল না। তারা সৃষ্টি রহস্য এবং বিশ্বের সৃষ্টিকূল সংক্রান্ত রহস্য উদঘাটনের জন্যে ইহুদি আলেম ওলামা, আহলে তৌরাত এবং নাসারাদের কাছে জিজ্ঞেস করতেন।" অনেক নির্ভরযোগ্য হাদিস গ্রন্থেও তৌরাত এবং ইহুদি উৎস থেকে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। যাই হোক, আসরের এ পর্যায়ে আমরা ওহাবিদের আরেকটি বিশ্বাস নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করবো। এই আকিদাটির নাম হচ্ছে 'শাফায়াত'। ইবনে তাইমিয়া এই আকিদার প্রবক্তা, আর তাঁর অনুসারী মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব এ সম্পর্কে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন।
'শাফায়াত' শব্দটির সাথে আমাদের সবারই কমবেশি পরিচয় রয়েছে। যখনই কারো অপরাধ, গুনাহ কিংবা শাস্তির প্রসঙ্গ ওঠে এবং কেউ মাঝখানে এসে তাকে শাস্তি থেকে মুক্তি দেয়,তখনই বলা হয় অমুক তার পক্ষে 'শাফায়াত' করেছে। শাফায়াতের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কোনো মানুষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে মধ্যস্থতাকারী হওয়া কিংবা কোনো মানুষের কল্যাণে কাজ করা। শরিয়তের পরিভাষায় শাফায়াত হচ্ছে আল্লাহর কোনো অলি-আওলিয়া আল্লাহর কাছে অন্য কোনো মানুষের জন্যে মুক্তি বা ক্ষমাপ্রার্থী হওয়া। তিনি আল্লাহর কাছে ঐ ব্যক্তির গুনাহগুলো ক্ষমা করার জন্যে কিংবা তার শাস্তি হ্রাস করার জন্যে আবেদন জানাবেন। ওহাবিদের সাথে ইসলামের অন্যান্য মাযহাবের মতপার্থক্যের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো এই 'শাফায়াত'। ওহাবিরা অবশ্য এক ধরনের শাফায়াতকে ইসলামের একটি মূলনীতি হিসেবে মেনে নিয়েছে, তবে তারা বলে ঐ শাফায়াত একান্তই কিয়ামতের দিনের জন্যে নির্দিষ্ট। সেদিন গুনাহগার উম্মাতের জন্যে শাফায়াতকারীগণ আল্লাহর কাছে শাফায়াত করবেন। শাফায়াতের ক্ষেত্রে ইসলামের নবীর অংশ অনেক বেশি থাকবে। কিন্তু তাদের মূল যে বক্তব্য তাহলো মুসলমানদের কোনোরকম অধিকার নেই এই পৃথিবীতে কোনো নবী কিংবা আল্লাহর কোনো অলি-আওলিয়ার কাছে শাফায়াত প্রার্থনা করা। যদিও নবীজীর কাছ থেকে কিংবা আল্লাহর অন্যান্য আওলিয়ার কাছে শাফায়াত চাওয়ার প্রচলন সেই নবীজীর জীবিত থাকাকালেই মুসলমানদের মাঝে চলে আসছে। মুসলিম কোনো জ্ঞানী-গুণী মনীষীই উপযুক্ত বান্দাদের কাছে শাফায়াতের আবেদন করাকে প্রত্যাখ্যান করে নি। তবে হিজরী অষ্টম শতাব্দির শুরু থেকে ইবনে তাইমিয়া এবং পরবর্তীকালে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাব নজদি আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে শাফায়াত চাওয়াকে নিষেধ এবং হারাম ঘোষণা করেন এবং যথারীতি তাদের ঐ দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতাকারীদেরকে কাফের ও নাস্তিক বলে অভিহিত করেন।
এই দুইজন বিশ্বাস করেনঃ যে শাফায়াত নবীগণ, ফেরেশতাগণ এবং আল্লাহর অলিগণ করবেন তা একান্তই আখেরাতের সাথে সম্পৃক্ত, পৃথিবীর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণে কোনো বান্দা যদি নিজের লক্ষ্য অর্জন করা অর্থাৎ নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্যে আল্লাহ এবং তার মাঝে তৃতীয় কোনো মাধ্যমকে শাফায়াতের জন্যে অবলম্বন করে,তা শির্‌ক হিসেবে গণ্য হবে এবং তা হবে আল্লাহর বাইরে অন্য কারো বন্দেগি করার শামিল। অথচ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সকল বান্দারই উচিত কেবল সরাসরি আল্লাহর কাছেই তার চাওয়া পাওয়ার কথা এভাবে বলাঃ "হে আল্লাহ! আমাকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করো, যাদেরকে তুমি মুহাম্মাদ (সা) এর শাফায়াত ধন্য করেছো!" এভাবে বলা ঠিক নয়ঃ "হে মুহাম্মাদ! আমার জন্যে তোমার খোদার কাছে শাফায়াত করো!"
সালাফিয়ারা এবং মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাবের অনুসারীরা শাফায়াত নিয়ে মহা ঝামেলা সৃষ্টি করেছে। এখনো ওহাবিরা শাফায়াত সম্পর্কে ব্যাপক হৈ চৈ করছে এবং শাফায়াতের প্রবক্তাদের উদ্দেশ্যে বিশ্রী শব্দ এবং ভাষা ব্যবহার করছে। অলি আওলিয়াদের কাছ থেকে শাফায়াত প্রার্থনা করতে নিষেধ করেছে তারা। এর পেছনে কিছু কারণ অবশ্য তারা তুলে ধরেছে।

১৬তম পর্ব
আল্লাহর অলিদের কাছে শাফায়াত কামনা করতে নিষেধ করার পেছনে সর্বপ্রথম কারণটি হলো এটা শির্‌ক বা অংশীবাদের পর্যায়ভুক্ত। কেননা তাদের বিশ্বাস শাফায়াতের আবেদন আসলে শাফায়াতকারীর পূজা করার মতো বিষয়। অর্থাৎ শাফায়াতের আবেদন করার মধ্য দিয়ে বান্দা আসলে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে এবং এভাবে আল্লাহর একত্ববাদী সত্ত্বার সাথে শরিক করা হয়। ওহাবি মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব 'কাশফুশ শাব্‌হাত' নামক গ্রন্থে দাবি করেছেন, 'শাফায়াত' এবং 'তাওয়াসসুল' শির্‌কের প্রকারভেদ। এ কারণে বহু মুসলমানকে মুশরিক বলে অভিহিত করেছে।এই ফের্কার দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের অপরাপর ফের্কার সাথে সম্পূর্ণ পৃথক। মূলত ওহাবিরা শাফায়াতের বিষয়টিকে ভুল বুঝেছে। এদের দৃষ্টিভঙ্গির জবাবে বলা উচিতঃ শাফায়াতের যে কোনো প্রকার আবেদনকে তখনই শির্‌ক বলে পরিগণিত করা যায় যখন শাফি বা শাফায়াতকারীকে 'ইলাহ', 'খোদা', 'সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক' ইত্যাদি বলে মনে করা হয়। কিন্তু আল্লাহর দরবারে প্রকৃত শাফায়াতকারীদের কাছে শাফায়াতের আবেদন করা শির্‌ক নয়; কেননা শাফায়াতের আবেদনকারী শাফায়াতকারীদেরকে আল্লাহর মনোনীত এবং ঘনিষ্ট বলেই মনে করে, কখনোই তাদেঁরকে খোদা বলে মনে করে না। বরং আল্লাহর নৈকট্য লাভের কারণেই তাদেঁরকে শাফায়াতের উপযুক্ত বলে মনে করে। অপরদিকে ইসলামের শিক্ষায় এসেছে, শাফায়াতকারীগণ কেবল আল্লাহর সম্মতিতেই অমুশরিক গুনাহগারদের জন্যে শাফায়াত করতে পারবেন এবং তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ করার এবং মাগফেরাতের আবেদন করতে পারবেন। পবিত্র কোরআনের আয়াতে আমরা দেখবো পয়গাম্বর (সা) এবং অন্যান্য সঠিক শাফায়াতকারীগণের কাছে শাফায়াতের আবেদন মূলত ঐশী মাগফেরাতের জন্যে এক ধরনের দোয়া। আল্লাহর কাছে অলি-আওলিয়া এবং নবীদের অবস্থান ও মর্যাদা যেহেতু নৈকট্যপূর্ণ, সেজন্যে মুসলমানরা তাদেঁর কাছে আবেদন জানায় তাদের জন্যে যেন একটু দোয়া করেন। কেননা তারা বিশ্বাস করে আল্লাহ পাক নবী আকরাম এবং তাঁর আওলিয়াদের দোয়া কবুল করেন এবং তাদের মাধ্যমে গুনাহগারদের গুনাহ দূর করেন।
কোরআনের আয়াত প্রমাণ করছে যে, মানুষের পক্ষে নবীজীর ক্ষমা প্রার্থনা করা পুরোপুরি প্রভাবশালী এবং উত্তম। সূরা মুহাম্মাদের উনিশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ ‘ওয়াসতাগফির লিজাম্বিকা ওয়ালিল মু'মিনিন'
অর্থাৎ'তোমার এবং ইমানদার নরনারীর ত্রুটির জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করো!' একইভাবে সূরা তওবার ১০৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ 'ওয়াসাল্লি আলাইহিম ইন্না সালাতাকা সাকানুল লাহুম'
অর্থাৎ 'আর তাদের জন্যে তুমি দোয়া করো! নিঃসন্দেহে তোমার দোয়া হচ্ছে তাদের জন্যে শান্তির কারণ।'
তো যেখানে নবীজীর দোয়া মানুষের জন্যে এতো উপকারী সেখানে তাঁর কাছে মানুষের দোয়া প্রার্থনায় কীসের বাধা! আর দোয়ার আবেদনে শাফায়াতের আবেদন ছাড়া কি অন্য কিছু রয়েছে?
হাদিসের কেতাবগুলোতেও শাফায়াত শব্দটি 'দোয়া' অর্থেই বেশিরভাগ ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি সহিহ বোখারির লেখক ইমাম মোঃ বোখারি তাঁর গ্রন্থেও 'শাফায়াত' শব্দটিকে দোয়া হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন 'যখনই লোকজন ইমামের কাছে আবেদন জানিয়েছে তাদের জন্যে বৃষ্টি কামনা করতে,তাদের আবেদন তো প্রত্যাখ্যান করা ঠিক নয়।' এ কারণে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে শাফায়াত বা দোয়া কামনা করা অবৈধ নয়।
শাফায়াত মানে যে দোয়া তার পক্ষে আরো সুস্পষ্ট অনেক তথ্য প্রমাণ রয়েছে। একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। হাদিসটি ইবনে আব্বাস রাসূলে খোদা (সা) এর কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন। বলা হয়েছেঃ 'যখনই কোনো মুসলমান মৃত্যুবরণ করে এবং তার জানাযার নামাযে এমন চল্লিশজন মুসল্লি অংশ নেয় যারা আল্লাহর সাথে কাউকে কখনো শরিক করে নি, আল্লাহ ঐ মৃত ব্যক্তির জন্যে তাদের শাফায়াত গ্রহণ করেন।'
সহিহ মুসলিম শরিফের হাদিস এটি। মৃত ব্যক্তির জন্যে অমুশরিক চল্লিশ জনের শাফায়াত মানে আল্লাহর দরবারে ঐ ব্যক্তির জন্যে রহমত এবং মাগফেরাত কামনা করা ছাড়া অন্য কিছু নয়। অতএব শাফায়াতের স্বরূপ যদি হয় দোয়া করা, তাহলে এই দোয়ার আবেদন করাটা কেন শেরেক হিসেবে পরিগণিত হবে?
শাফায়াতের বিষয়টিকে প্রত্যাখ্যান করার পেছনে ওহাবিদের আরেকটি কারণ বা দলিল হলো তারা বিশ্বাস করে মুশরিকরা যে আল্লাহর একত্ববাদী সত্ত্বার সাথে অন্যদেরকে শরিক করেছিল অর্থাৎ শির্‌ক করেছিলো, তাদের ঐ শিরকের কারণ ছিল মূর্তিগুলোর কাছে শাফায়াত কামনা। পবিত্র কোরআনেও এই বিষয়টির উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা ইউনূসের ১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ "আর তারা অর্থাৎ মূর্তিপূজকরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন কিছু বস্তুর পূজা করে যেগুলো না তাদের কোনো ক্ষতিসাধন করতে পারে, আর না পারে তাদের কোনো উপকার করতে; আর তারা বলেঃ এরা তো আল্লাহর কাছে আমাদের জন্যে সুপারিশকারী....।"
এই আয়াতকে সামনে রেখে ওহাবি মতবাদে বিশ্বাসীরা বলেনঃ একারণেই নবী করিম (সা) এবং আল্লাহর অলি-আওলিয়াদের কাছে যে-কোনো ধরনের শাফায়াত কামনা করা মূর্তির কাছে মুশরিকদের শাফায়াত কামনা করার শামিল।
সালাফিয়াদের এই আকিদা বিশ্বাসের জবাবে বলতে হয় নবী-রাসূলগণের কাছে শাফায়াত কামনা করা আর মূর্তিগুলোর কাছে শাফায়াতের আবেদন জানানো-এই দুয়ের মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। পার্থক্যটি হলো মুশরিকরা মূর্তিগুলোকে তাদের খোদা বলে মনে করতো। খোদা মনে করার কারণেই তারা মূর্তিগুলোর কাছে শাফায়াত কামনা করতো। কিন্তু যিনি একজন মুসলমান তিনি আল্লাহর অলি আওলিয়াকে কোনোভাবেই খোদা বলে মনে করেন না। মনে করেন আল্লাহর কাছে মর্যাদার অধিকারী এবং তাঁর খুব নিকটবর্তী একজন বান্দা হিসেবে। আর সে জন্যেই তাদেঁর কাছে শাফায়াত বা দোয়ার আবেদন জানান একজন মুসলমান। কেননা মুসলমানরা বিশ্বাস করেন নবী করিম (সা), উপযুক্ত মুমিন ব্যক্তিগণ, শাহাদাত লাভকারীগণ এবং ফেরেশতাগণ আল্লাহর দরবারে শাফায়াত করার অধিকারের মর্যাদাপ্রাপ্ত। সেজন্যেই মুসলমানগণ দুনিয়া এবং আখেরাত উভয় জগতেই আল্লাহর দরবারে শাফায়াতকারী হিসেবে তাঁদের কাছে দোয়ার আবেদন জানায়।
১৭তম পর্ব
ইসলামী দ্বীন অনুযায়ী শাফায়াত হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্যে অসামান্য এক নিয়ামত।যেসব ব্যক্তি আল্লাহর বন্দেগি ত্যাগ করেনি এবং কুফুরি বা শির্‌ক করে নি, আল্লাহর আওলিয়াদের শাফায়াত তাদের জন্যে আশার আলোর মতো। শাফায়াত তাদের অন্তর থেকে হতাশা দূর করে দেয় আর আল্লাহর রহমতের প্রতি তাদের আগ্রহ উদ্দীপনা বাড়ায়। কিন্তু শাফায়াত সম্পর্কে বাহ্যত কিছু ইসলামী ফের্কা যেসব বোধ-বিশ্বাস বা মতাদর্শের কথা বলে সেগুলো একটু পর্যালোচনার বিষয়। সালাফিয়া বা ওহাবিরা বিশ্বাস করে কোরআনের সুস্পষ্ট হুকুম অনুযায়ী দোয়া করার সময় আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ডাকা ঠিক নয় কেননা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে শাফায়াতের আবেদন জানানোর মানে হলো এক আল্লাহর বাইরে কারো কাছে নিজের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা।
তাঁরা সূরা জ্বিনের ১৮ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি তুলে ধরেন যেখানে বলা হয়েছেঃ 'তোমরা আল্লাহ তায়ালার সাথে কাউকে ডেকো না।' একইসাথে সূরা মুমিনের ৬০ নম্বর আয়াতে এসেছেঃ 'তোমরা আমাকে ডাকো,আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো'। উদ্ধৃত আয়াত দুটির প্রথমটিতে-যেখানে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে তারা যেন আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে না ডাকে-তা থেকে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো প্রার্থনা করাকে হারাম বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। কেননা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর উদ্দেশ্যে রুকু সিজদা করা, ইবাদাত করা শির্‌ক হিসেবে পরিগণিত,যারা তা করবে তারা মুশরিক হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহর অলিদের কাছে শাফায়াত কামনা করার মানে তাদের ইবাদাত করা নয় বরং যারা শাফায়াত কামনা করে তারা জানে শাফায়াত কেবল আল্লাহর সম্মতিতেই সংঘটিত হয়। এধরনের ব্যক্তি মুমিন এবং আল্লাহর ওলিদেরকে 'মাধ্যম' হিসেবে গ্রহণ করে যাতে তাঁরা ঐ ব্যক্তির জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করে, কেননা আল্লাহ পাক পয়গাম্বর এবং পুণ্যবানদের দোয়া ভালোভাবে কবুল করেন।
সুতরাং কেউ যদি তার গুনাহগুলো ক্ষমার জন্যে কিংবা তার প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্যে দোয়া চাইতে নবীজীর শরণাপন্ন হয় সেটা কক্ষণো নবীজীকে আল্লাহর মতো চিন্তা করা হয় না বরং তাকেঁ কেবল 'মাধ্যম' হিসেবে গ্রহণ করা হয়। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও মুফাস্‌সির আল্লামা তাবাতাবায়ি এ সম্পর্কে বলেছেন ইমামের কাছে প্রয়োজনীয়তা মেটানোর প্রত্যাশা করাটা তখনি শের্‌ক বলে পরিগণিত হবে যখন প্রত্যাশাকারী ইমামকে পরোয়ারদেগারের মতো প্রভাবশালী এবং চিরন্তন শক্তির অধিকারী বলে চিন্তা করবে। কিন্তু শক্তিমত্তার অধিকারী যদি আল্লাহকেই ভাবা হয় আর ইমামকে যদি মাধ্যম হিসেবে মনে করা হয় তাহলে শির্‌ক হবে না।
মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব ইসলামের নামে যে ভ্রান্ত আকিদা-বিশ্বাসের প্রসার ঘটিয়েছেন ইসলামের মৌলিক এবং নির্ভরযোগ্য বর্ণনা অনুযায়ী সেগুলোর অসারতা প্রমাণিত হবার ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়। প্রকৃত ব্যাপারটা হলো ইবনে তাইমিয়ার মতো আব্দুল ওহাবরাও ইবাদাত বা প্রার্থনার গভীর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে নি। এজন্যেই তারা ভেবেছে নেককার শাফায়াতকারীগণের কাছে শাফায়াতের প্রত্যাশা করা মানে তাদের ইবাদাত করা। তারা জানতো না যে প্রকৃত ইবাদাত হলো আল্লাহর দরবারে পরিপূর্ণ বিনয়ের প্রকাশ, কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তিকে সম্মান করা বা তার প্রতি বিনয় প্রদর্শন করা ইবাদাত নয়। এমনকি সেই গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ববর্গ যদি নবী কারিম (সা) কিংবা তাঁর আহলে বাইতের মহান ইমামদের মতোও হন-যাঁরা নিজেরাই আল্লাহর বন্দেগি এবং আনুগত্য করার ক্ষেত্রে আদর্শস্থানীয়।

শাফায়াতকে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষেত্রে ওহাবিদের আরেকটি দলিল হলো এই যে, তারা মনে করে শাফায়াতের অধিকার কেবল আল্লাহরই রয়েছে,তাঁর বাইরে আর কারো ঐ অধিকার নেই। তারা তাদের বক্তব্যের পক্ষে পবিত্র কোরআনের সূরা যুমারের ৪৩ এবং ৪৪ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়েছেন যেখানে বলা হয়েছেঃ 'তারা কি আল্লাহ ব্যতীত সুপারিশকারী গ্রহণ করেছে? বলুন! তাদের কোনো এখতিয়ার না থাকলেও এবং তারা না বুঝলেও? বলুন সমস্ত সুপারিশ আল্লাহরই ক্ষমতাধীন! আসমান ও যমিনে তাঁরই সাম্রাজ্য, অতপর তাঁরই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।' কিন্তু এ আয়াতে এ কথা বলা উদ্দেশ্য নয় যে, 'কেবল আল্লাহই শাফায়াত করবেন,ব্যাস..অন্য কারো আর শাফায়াত করার অধিকার নেই।' কেননা এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আল্লাহ কখনোই কারো জন্যে কারো কাছে শাফায়াত করবেন না এবং আল্লাহ এসব কাজের অনেক উর্ধ্বে। বিবেকও এটা সমর্থন করে না যে বলি কোনো বান্দার গুনাহ মাফের জন্যে খোদা 'মাধ্যম' হয়েছেন। কারণটা হলো এই, একথা বলার সাথে সাথে যে প্রশ্নটি সামনে এসে দাঁড়ায় তাহলো আল্লাহ মাধ্যম হয়ে কার কাছে শাফায়াত করবেন? তাই আয়াতের কেন্দ্রীয় বক্তব্য হচ্ছে আল্লাহ হলেন শাফায়াত গ্রহণ করার মালিক। তিনি যাকেই উপযুক্ত মনে করবেন তাকেঁই বান্দার ব্যাপারে শাফায়াত করার অনুমতি দেবেন। এই বিশ্লেষণ অনুযায়ী ওহাবিদের দাবির সাথে এই আয়াতের কোনো সম্পর্কই নেই। রাসূলে খোদার সময় থেকে আজ পর্যন্ত মুসলমানরা কেবল বিশ্ব স্রষ্টাকেই শাফায়াতের মালিক এবং শাফায়াত গ্রহণকারী হিসেবে মনে করে আসছে,তাঁর কোনো আওলিয়াকে নয়। সেইসাথে মুসলমানরা এ-ও বিশ্বাস করে যে কেবল তিনি বা তাঁরাই শাফায়াত করার যোগ্য যাদেঁরকে আল্লাহ শাফায়াত করার অনুমতি দিয়েছেন। কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী রাসূলে খোদা (সা)কে আল্লাহ শাফায়াতের অনুমতি দিয়েছেন। সুতরাং শাফায়াত করার অনুমতিপ্রাপ্ত হিসেবে তাঁর কাছে শাফায়াতের আবেদন জানানোটাই স্বাভাবিক এবং যুক্তিযুক্ত।
বোখারি এবং মুসলিমের মতো বিখ্যাত হাদিসবেত্তাদের মতো আলেমগণও তাঁদের সংকলিত হাদিস গ্রন্থে কক্ষণো শাফায়াতকে শির্‌ক বলে উল্লেখ করেন নি। মুহাম্মাদ তিরমিযির সুনানে তিরমিযি সহিহ হাদিস গ্রন্থ 'সিহহা সিত্তা'র অন্তর্ভুক্ত অন্যতম প্রধান একটি গ্রন্থ। তিরমিযি তাঁর গ্রন্থে শাফায়াত সম্পর্কে আনাস ইবনে মালিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। আনাস ইবনে মালিক বলেনঃ নবীজীর কাছে আবেদন জানিয়েছি কিয়ামতের দিন তিনি যেন আমার জন্যে শাফায়াত করেন। তিনি আমার আবেদন গ্রহণ করে বললেনঃ 'আমি এ কাজটি আঞ্জাম দেবো।' নবীজীকে বললামঃ 'আপনাকে কোথায় খুজেঁ পাবো?' নবীজী বললেনঃ 'পুলসিরাতের কাছে।' যাই হোক, আনাসের কাছে মোটেও মনে হয় নি যে শাফায়াতের আবেদন করা এক ধরনের শির্‌ক।
১৮তম পর্ব
ওহাবি মতবাদে বিশ্বাসীগণ শাফায়াতের আবেদন করাটাকে শির্‌ক বলে মনে করেন। কিন্তু বিখ্যাত হাদিসবিদ বোখারি এবং তিরমিযি তাঁদের সংকলিত হাদিস গ্রন্থে শাফায়াত সম্পর্কে যেসব হাদিস বর্ণনা করেছেন সেখানে শাফায়াতের পক্ষে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। যেমন তিরমিযি আনাস ইবনে মালিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন। আনাস ইবনে মালিক বলেনঃ নবীজীর কাছে আবেদন জানিয়েছি কিয়ামতের দিন তিনি যেন আমার জন্যে শাফায়াত করেন। তিনি আমার আবেদন গ্রহণ করে বললেনঃ 'আমি এ কাজটি আঞ্জাম দেবো।' নবীজীকে বললামঃ 'আপনাকে কোথায় খুজেঁ পাবো?' নবীজী বললেনঃ 'পুলসিরাতের কাছে।' এ বর্ণনা থেকে শাফায়াতের আবেদন করাটাকে শির্‌ক ভাববার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। কেননা আনাস দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে নবীজীর (সা) এর কাছে শাফায়াতের আবেদন জানিয়েছেন এবং নবীজীও তাকে কথা দিয়েছেন। অন্তত আনাসের কাছে কোনোভাবেই মনে হয় নি যে শাফায়াতের দরখাস্ত করাটা শির্‌ক।
সাওয়াদ ইবনে আযেব নবী আকরাম (সা) এর আরেকজন সঙ্গী ছিলেন যিনি নবীজীর কাছে শাফায়াত প্রার্থনা করেছেন। নবী কারিম (সা) সম্পর্কে সাওয়াদ ইবনে আযেব একটি কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন যেই কবিতার মধ্যে নবীজীর কাছে সুস্পষ্টভাবে শাফায়াত প্রার্থনা করা হয়েছে। কবিতার একটি পংক্তি এ রকমঃ

অকুল্ লি শাফিআন ইয়াওমা লা..জু শাফাআতিন
বিমুগ্‌নি ফাতিলান আন সাওয়াদ ইবনে আযিবিন
অর্থাৎ
হে নবীকূল শিরোমণি!
পুনরুত্থান দিবসে তুমি হয়ো আমার শাফায়াতকারী
যে দিন অন্য কারো শাফায়াতে সাওয়াদ ইবনে আযেবের
অবস্থার বিন্দুমাত্রও হবে না উন্নয়ন,
হবে না কোনো লাভ এমনকি
খুরমা বিচির শাঁসের সমান।
সালাফি মতবাদে বিশ্বাসী চিন্তাবিদরা বা তাদের নেতৃবৃন্দ এ ধরনের হাদিসগুলোর উদ্ধৃতি দেয় না কিংবা ইঙ্গিতও করে না। আলকোরআনের সূরা নিসা'র ৬৪ নম্বর আয়াতের কথাও তারা উল্লেখ করে না,কেননা ঐ আয়াতে সুস্পষ্টভাবে শাফায়াতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই আয়াতে বলা হয়েছেঃ '...আর তারা যখন নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি সাধন করেছিলো (এবং আল্লাহর আদেশ নিষেধকে পদতলে পিষ্ট করেছিলো) তখন যদি আপনার কাছে আসতো এবং পরোয়ারদেগারের দরবারে ক্ষমার আবেদন জানাতো, আর নবীজীও যদি তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, তাহলে অবশ্যই আল্লাহকে তারা তওবা কবুলকারী এবং মেহেরবানরূপে পেতো।' এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট ভাষায় তাঁর রাসূল (সা) কে বান্দার গুনাহ মাফ করার জন্যে আল্লাহর দরবারে আবেদনকারী 'মাধ্যম' হিসেবে অর্থাৎ শাফায়াতকারী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।
বিখ্যাত মুসলিম মনীষী ও মুফাসসিরে কোরআন ফাখরে রাযি এই আয়াতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে বলেছেনঃ 'রাসূলে খোদা (সা) তাদের জন্যে ক্ষমার আবেদন জানিয়েছিলেন (এ আয়াতে যাদের কথা এসেছে)।'...যা নবীজীর উচ্চ মর্যাদারই পরিচয় বহন করে। এর অর্থ দাঁড়ায় তারা এমন এক মহান ব্যক্তিত্বের কাছে এসেছে...যিনি ঐশী রেসালাতের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং সুমহান মর্যাদার অধিকারী। অদৃশ্য এবং অজানা বাস্তব সত্য সম্পর্কে তাঁর ওপর ওহি অবতীর্ণ হয় এবং তিনি আল্লাহর বান্দাদের মাঝে আল্লাহরই প্রতিনিধি। নবীজী যেহেতু আল্লাহর কাছে এরকম এক উচ্চ মর্যাদার আসনে অবস্থান করেন,সেজন্যে তাঁর শাফায়াত গ্রহণ না হয়ে পারে না।'
এখন কথা হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেহেতু সুস্পষ্টভাবেই রাসূলে খোদা (সা) কে বান্দাদের গুনাহ মাফের জন্যে শাফায়াত করার অধিকার দিয়ে ধন্য করেছেন, সেহেতু প্রশ্ন জাগে সালাফিরা কেন এই সত্যটাকে অস্বীকার করছে? প্রসঙ্গক্রমে ইবনে তাইমিয়ার একটি বক্তব্যও এখানে উল্লেখ করাটা মনে হয় অসমীচীন হবে না। ইবনে তাইমিয়া বলেছেনঃ 'আল্লাহ তায়ালা তাঁর আওলিয়াকে শাফায়াত করার অধিকার দিয়েছেন, তবে আমাদেরকে তার আবেদন করা থেকে বিরত রেখেছেন।' তার এই বক্তব্যটাই শাফায়াত সংক্রান্ত বিতর্কের ব্যাপারে সালাফিয়াদের মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গির অসারতার পরিচয় বহন করে। কেননা পবিত্র কোরআনের সূরায়ে নিসা'র ৬৪ নম্বর আয়াতেই বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তাঁর বান্দাদেরকে বলেছেন তারা যেন তাদের নবীজীর কাছে শাফায়াত করার আবেদন জানায়।
আচ্ছা এ রকম কি কখনো হতে পারে যে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কাউকে কোনো কিছুর অধিকার দেবেন অথচ সেই অধিকারকে কাজে লাগাতে নিষেধ করবেন? এই কথাটাই তো বৈপরীত্যপূর্ণ। তাহলে আল্লাহ যেহেতু তাঁর আওলিয়াকে এ ধরনের অধিকার দিয়ে থাকেন তা অবশ্যই যাতে অন্যরা উপকৃত হতে পারে সেজন্যে, সেই অধিকারকে কাজে না লাগানোর জন্যে নয়। সালাফিয়াদের চিন্তাধারায় সবসময়ই এ ধরনের বিচিত্র বৈপরীত্য লক্ষ্য করা গেছে। তাদের বিচ্যুত চিন্তাধারার ক্ষেত্রে যুক্তি প্রমাণের দুর্বলতার এটা আরেকটি দলিল। শাফায়াতকে নাকচ করার পেছনে ওহাবিদের সর্বশেষ যুক্তি হলো পৃথিবীর বুকে আল্লাহর ওলিদের কাছে শাফায়াতের আবেদন জানানোটা মৃতের কাছে প্রয়োজন মেটানোর আবেদন করার মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
তাদের মতে এ রকম কাজ একেবারেই অবিবেচনা প্রসূত এবং অর্থহীন। তারা তাদের মতের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে সূরা নামলের ৮০ নম্বর আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে, যেখানে বলা হয়েছেঃ "আপনি আহবান শোনাতে পারবেন না মৃতদেরকে এবং বধিরকেও নয়, যখন তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে চলে যায়।" কোরআন এ আয়াতে মুশরিকদেরকে মৃতের সাথে তুলনা দিয়ে বলেছে, মৃতের যেমন উপলব্ধি শক্তি নেই, তেমনি সত্যের আহ্বান অর্থাৎ ইসলাম বোঝার শক্তিও মুশরিকদের নেই। মৃতেরা যদি কথা বলতে পারতো কিংবা তাদের যদি শোনার অনুভূতি থাকতো, তাহলে মৃত অন্তরের অধিকারী মুশরিকরাও হেদায়েতের উপযুক্ত হতো।

সালাফিয়ারা সূরা ফাতেরের ২২ নম্বর আয়াতেরও উল্লেখ করে থাকে শাফায়াতের বিষয়টিকে প্রত্যাখ্যান করার জন্যে। এ আয়াতে বলা হয়েছেঃ "অবশ্যই সমান নয় জীবিত ও মৃত। আল্লাহ্ শ্রবণ করান যাকে ইচছা। আপনি কবরে শায়িতদেরকে শুনাতে সক্ষম নন।"
আগের আয়াতের মতো এ আয়াতেরও ভুল ব্যাখ্যা করেছে ওহাবিরা। এ আয়াতের প্রকৃত অর্থ হলো 'যেসব মৃতদেহ কবরে শায়িত হয় তাদের উপলব্ধি ক্ষমতা থাকে না এবং রুহ বা আত্মা যে দেহ থেকে আলাদা হয়ে যায় ঐ দেহের আর বোধশক্তি থাকে না।' এখন কথা হলো আল্লাহর যেসব মহান বান্দা বা মনোনীত ব্যক্তির কাছে শাফায়াতের আবেদন জানানো হয়, তাঁদের আত্মা তো মৃত নয়। কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী বারযাখ বিশ্বে তাঁদের আত্মা জীবন্ত। তাদেঁর কাছেই শাফায়াতের আবেদন জানানো হয়, কবরে শায়িত নিষ্প্রাণ কোনো সাধারণ লাশের কাছে নয়।
১৯তম পর্ব

ওহাবিদের যুক্তি হলো কোরআনে বলা হয়েছেঃ 'যেসব মৃতদেহ কবরে শায়িত হয় তাদের উপলব্ধি ক্ষমতা থাকে না এবং রুহ বা আত্মা যে দেহ থেকে আলাদা হয়ে যায় ঐ দেহের আর বোধশক্তি থাকে না।' আবার কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী আল্লাহর মনোনীত নবী রাসূল, অলি আওলিয়াদের আত্মা মৃত নয়,বারযাখ বিশ্বে তাঁদের আত্মা জীবন্ত। তাদেঁর কাছেই শাফায়াতের আবেদন জানানো হয়, কবরে শায়িত নিষ্প্রাণ কোনো সাধারণ লাশের কাছে নয়। কোরআনের বক্তব্য অনুযায়ী পবিত্র আত্মাগুলো অন্য জগতে জীবন্ত থাকে এবং বেহেশতি সুযোগ সুবিধা ভোগ করে,ফলে সাধারণ আত্মার মতো সেইসব আত্মারও যে উপলব্ধি শক্তি থাকবে না এ যুক্তি ঠিক নয়।
সহিহ বোখারিতে বদর যুদ্ধের গল্প প্রসঙ্গে এসেছেঃ ঐ যুদ্ধে কাফেরদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ শেষ হবার পর নবী করিম (সা) তাঁর একদল সাহাবিকে নিয়ে একটি পুকুরের পাড়ে এলেন যেখানে মৃত মুশরিকদের লাশগুলোকে ফেলা হয়েছিল। নবীজী মৃতদের নাম ধরে ধরে ডাকলেন এবং বললেনঃ 'আল্লাহ এবং তার রাসুলের আনুগত্য করাটাই কি তোমাদের জন্যে উত্তম ছিল না? আমরা খোদার দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো যথাযথভাবে পেয়েছি, তোমরা কি তোমাদের খোদার অর্থাৎ মূর্তিদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবে পেয়েছো?' নবীজীর কথার এ পর্যায়ে ওমর বললেনঃ 'হে রাসূলে খোদা (সা)! আপনি এক কারো সাথে কথা বলছেন যাদের প্রাণ নেই।' নবীজী উত্তরে বললেনঃ যাঁর হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ সমর্পিত তাঁর শপথ! আমি যা বলছি তাদের চেয়ে তুমি তা বেশি শ্রবণকারী নও।'
একইভাবে নির্ভরযোগ্য আরো বহু বর্ণনায় এসেছে যে,নবীজীকে গোসল করানো এবং কাফন পরানোর কাজ শেষ করে হযরত আলী(আ) নবীজীর চেহারা মুবারককে খুলে তাঁকে সম্বোধন করে বলেছিলেনঃ হে রাসূলে খোদা (সা)! আমার বাবা-মা আপনার জন্যে উৎসর্গিত! আপনি জীবিত এবং মৃত উভয় অবস্থাতেই পূত-পবিত্র! আপনার পরোয়ারদেগারের কাছে আমাদের কথা স্মরণ করুন! আরবি সাহিত্যে উজকুর্নি ইন্দা রাব্বিক বলতে শাফায়াত করা অর্থ বোঝায়। হযরত ইউসূফ (আ) কারাগারে কাটানোর সময় তাঁর সাথে থাকা একদল বন্দির কারামুক্তির পর তারা যখন বাদশার দরবারে ফিরে যাচ্ছিল তখন বলেছিলেনঃ উজকুর্নি ইন্দা রাব্বাক অর্থাৎ বাদশার কাছে আমার কথা স্মরণ করো!হযরত আবু বকর সম্পর্কেও শাফায়াত কামনা সংক্রান্ত একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়ঃ রাসূলে খোদা (সা) এর রেহলাতের পর তিনি নবীজীর চেহারা মুবারক উন্মোচন করে হযরত আলী (আ) এর মতোই বলেছিলেনঃ হে রাসূলে খোদা (সা)! আমার বাবা-মা আপনার জন্যে উৎসর্গিত!আপনি জীবিত এবং মৃত উভয় অবস্থাতেই ছিলেন পূত-পবিত্র! আপনার পরোয়ারদেগারের কাছে আমাদের কথা স্মরণ করুন!
সালাফিয়ারা যেহেতু মানুষের আত্মার দেহবিচ্ছিন্ন স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না কিংবা মৃত্যুর পর আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করে না, সেহেতু তারা মনে করে নবী-রাসূলগণ কিংবা আল্লাহর অলি আওলিয়া আর পুণ্যবান বান্দাদের আত্মাও মৃত্যুর পর নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। সেজন্যে তাদের ধারণা যে বস্তুর কোনো অস্তিত্বই নেই তার কাছে শাফায়াতের আবেদন করার কোনো মানেই হয় না, তাই তাদের কাছে শাফায়াতের আবেদন করাটা বিবেক-বুদ্ধির পরিপন্থী কাজ। পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে মৃত্যু পরবর্তী আত্মা বা রূহের বেঁচে থাকা সম্পর্কে বর্ণনা থাকা সত্ত্বেও সালাফিয়া মতবাদে বিশ্বাসীরা এ ধরনের চিন্তাভাবনা নিজেদের মাঝে লালন করছে।
আলেম ওলামাগণ শাফায়াতের ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন এবং তাঁরা ইবনে তাইমিয়া কিংবা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাবের বক্তব্যকে ইসলামী দ্বীনের বিরোধী বলে মনে করেন। এ বক্তব্যের পক্ষে আমরা কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরার চেষ্টা করবো। খলিল আহমাদ সাহারানপুরি হানাফি ( জন্ম:১৩৪৬ হিঃ) বলেছেনঃ "দোয়ার সময় নবী-রাসূলগণ, নেককার সালেহিনগণ, অলি আওলিয়াগণ, শহিদগণ কিংবা সিদ্দিকীনদের শরণাপন্ন হওয়া বা শাফায়াতের জন্যে তাদেঁর সহায়তা নেওয়া আমাদের এবং আমাদের আলেম সমাজের দৃষ্টিতে জায়েয, চাই তাঁরা জীবিতই থাকুন কিংবা মৃত-তাতে কোনো পার্থক্য নেই। মানুষ যে দোয়ার মাঝে বা মুনাজাতে বলে: হে খোদা! অমুকের ওসিলায় তুমি আমার দোয়াটুকু কবুল করে নাও! আমার চাহিদা পূরণ করো-তাতে দোষের কিছু নেই।"
আরেকজন বিখ্যাত মনীষী হলেন বায়হাকি। তিনি বর্ণনা করেন: দ্বিতীয় খলিফার খেলাফতের সময় এক বছর খুব খরা গিয়েছিল। সে সময় হযরত বেলাল কয়েকজন সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে রাসূলে খোদা (সা) এর রওজা মোবারকে গিয়ে বললেনঃ "হে রাসূলে খোদা (সা)! তোমার রবের কাছে তোমার উম্মাতের জন্যে বৃষ্টি চাও...নৈলে ধ্বংসের আশঙ্কা রয়েছে।" নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্ট ইসলামী মনীষী আলী ইবনে আহমাদ সামহুদি তাঁর লেখা ভাফাউল ভাফা গ্রন্থে লিখেছেনঃ "আল্লাহর দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করা বা শাফায়াতের আবেদন করার জন্যে রাসূলে খোদার শরণাপন্ন হওয়া,তাঁর সুমহান ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার আশ্রয় নেওয়া তাঁর জন্ম-পূর্ববর্তীকাল, জন্ম-পরবর্তীকাল,তাঁর মৃত্যুর পর, আলমে বারজাখের সময় এবং পুনরুত্থান দিন-সবসময়ই জায়েয।"
এরপর হযরত আদম (আ) এর তাওয়াসসুল বা ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর শরণাপন্ন হবার বিখ্যাত বর্ণনাটিও উল্লেখযোগ্য। ঐতিহাসিক ঐ বর্ণনাটি এসেছে হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) থেকে। হযরত ওমর (রা) বলেছেনঃ হযরত আদম (আ) অবহিত হয়েছিলেন যে ভবিষ্যতে ইসলামের নবী (সা) পৃথিবীতে আসবেন, তিনি তাই আল্লাহর দরবারে আরজি পেশ করলেন এভাবেঃ "হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ (সা) এর ওসিলায় তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।" ইসলামে শাফায়াতের বিষয়টি আল্লাহর সাথেই সম্পর্কিত তবে আল্লাহর অনুমতিক্রমে অন্যান্যরাও শাফায়াতের আবেদন করতে পারেন। সূরা মারিয়ামের ৮৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ "যে দয়াময় আল্লাহ্র কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করেছে, সে ব্যতীত আর কেউ সুপারিশ করার অধিকারী হবে না।" একইভাবে সূরা ত্বা-হা'র ১০৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ "দয়াময় আল্লাহ্ যাকে অনুমতি দেবেন এবং যার কথায় সন্তূষ্ট হবেন সে ছাড়া কারও সুপারিশ সেদিন কোন উপকারে আসবে না।"
এখন প্রশ্ন হলো আল্লাহ কেন তাঁর কোনো কোনো আওলিয়াকে শাফায়াতের অনুমতি দিলেন? এর উত্তর হলো মানুষের মাঝে তাদেঁরকে মর্যাদাবান হিসেবে তুলে ধরা। নবীজী বলেছেনঃ "তিনিটি দল আল্লাহর কাছে শাফায়াত করবে। নবীগণ, আলেমগণ এবং শহীদগণ।" তবে সেইসব পাপীই আওলিয়াদের শাফায়াতের আশা করতে পারে যারা নিজেদের গুনাহর কারণে অনুতপ্ত হয়ে যথার্থই তওবা করে এবং তারপর নবী-রাসূলদের প্রদর্শিত পথে ঠিকঠাকমতো চলে।
 
২০ তম পর্ব
 
তাওয়াসসুল একটি বহুল পরিচিত শব্দ। তাওয়াসসুল একটি দোয়ার উপায়। তাওয়াসসুল আল্লাহর প্রতি মনোযোগী হবার একটি দরোজা। পারিভাষিক অর্থে বান্দার হাজত পূর্ণ করার জন্যে আল্লাহর কাছে কোনো বস্তু কিংবা ব্যক্তিত্বকে মাধ্যম হিসেবে দাঁড় করানোই হচ্ছে তাওয়াসসুল। ইসলামে এসেছে মানুষ তিনটি উপায়ে আল্লাহর কাছে তাওয়াসসুল অন্বেষণ করতে পারে।
এক, নিজের ব্যক্তিগত নেক আমলের সাহায্যে। অর্থাৎ বান্দা তার নেক আমলগুলোকেই আল্লাহ এবং তার মাঝে সেতুবন্ধন সৃষ্টিকারী মাধ্যম হিসেবে দাঁড় করাতে পারে এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে পারে ঐ আমলগুলোর ওসিলায় যেন আল্লাহ তার হাজত পূর্ণ করে দেন।
তাওয়াসসুলের দ্বিতীয় উপায়টি হলো আল্লাহর মনোনীত এবং প্রিয় বান্দাদের দোয়াকে তাওয়াসসুল বা মাধ্যম হিসেবে দাঁড় করানো। তার মানে হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী বান্দাদের কাছে তার জন্যে দোয়া চাওয়ার আবেদন করা। যেমনটি পবিত্র কোরআনে হযরত ইউসুফ (আ) এর গল্পে আমরা লক্ষ্য করবোঃ

ইউসুফ (আ) এর ভাইয়েরা যখন তাদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত হলো তখন তারা গেল তাদের পিতা হযরত ইয়াকুব (আ) এর কাছে। পবিত্র কোরআনে সূরা ইউসুফে এই ঘটনার বিবরণ রয়েছে। ইউসুফের ভাইয়েরা তাদের পিতাকে বললোঃ "হে পিতা! মহান আল্লাহর কাছে আমাদের পাপের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করো। বলো যে আমরা ভুল করে ফেলেছি।" ইয়াকুব (আ) জবাবে বললেনঃ "আমি শীঘ্রই আমার পরোয়ারদেগারের দরবারে তোমাদের জন্যে ক্ষমার আবেদন জানাবো। আল্লাহ অনেক ক্ষমাশীল এবং মেহেরবান।" এই আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায় হযরত ইয়াকুব (আ) এর সন্তানেরা দোয়া এবং এস্তেগফারের জন্যে তাদের পিতার শরণাপন্ন হয় এবং তাকেঁ তাদের ক্ষমার ওসিলা হিসেবে সাব্যস্ত করে।

তাওয়াসসুলের তৃতীয় উপায়টি হলো আল্লাহর কাছে যাদের বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে সেইসব ব্যক্তিত্বদের শরণাপন্ন হওয়া বা তাদেরকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা। নবীজীর সাহাবায়ে কেরামের মাঝেও এ ধরনের তাওয়াসসুলের উদাহরণ লক্ষ্য করা যায়।
কোনো মুসলমানই নেক আমলের সাহায্যে আল্লাহ তায়ালার সাথে তাওয়াসসুলের বৈধতার ব্যাপারে সন্দেহ করে না।
অথচ ওহাবিদের বিশ্বাস তাওয়াসসুল প্রার্থীর উচিত নয় কোনো ব্যক্তির শরণাপন্ন হওয়া এবং এরকম বলাঃ 'হে খোদা! আমি তোমার পয়গাম্বরের ওসিলায় তোমার আশ্রয় গ্রহণ করছি।' ওহাবি মতবাদের দৃষ্টিতে এ ধরনের তাওয়াসসুল করা ভুল এবং এ ধরনের আমল যারা করে তাদেরকে তারা মুশরিক বলে মনে করে। অথচ আহলে সুন্নাতের অনেক বড়ো বড়ো আলেমের বক্তব্য এবং লেখালেখিতেও রাসুলে খোদা (সা) এর প্রতি তাওয়াসসুল করার ব্যাপারে বহু বর্ণনা রয়েছে। তাদেঁর লেখায় কখনোই এ ধরনের তাওয়াসসুলকে শিরক বলে উল্লেখ করা হয় নি।#