পবিত্র কুরআনের আয়াতের আলোকে সাইয়্যেদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন (আ.)

আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন :

فَتَلَقَّىٰ آدَمُ مِن رَّبِّهِ كَلِمَاتٍ فَتَابَ عَلَيْهِ ۚ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ

‘অতঃপর আদমের নিকট রবের পক্ষ থেকে কয়েকটি শব্দ ওহী করা হলো, অতঃপর তিনি (আল্লাহ ) তার প্রতি প্রত্যাবর্তন করলেন (তাকে ক্ষমা করলেন) । নিঃসন্দেহে তিনি পুনঃপুনঃপ্রত্যাবর্তনকারী (তওবা কবুলকারী) পরম দয়ালু।’ (সূরা বাকারা: ৩৭)

উপরিউক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আদম (আ.) আল্লাহ তা’আলা র মহান আরশের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন এবং সেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও মা’সুম ইমামগণের নাম দেখতে পলেন। হযরত জিবরাইল (আ.) তাকে নামগুলো কাদের তা বুঝিয়ে দিলেন। অতঃপর আদম (আ.) বললেন : ‘হে পরম সাত্তা! আলীর উসিলায়,হে স্রষ্টা! ফাতেমার উসিলায় আমাদের ক্ষমা কর।’

এর পর হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে তার চোখে অশ্রু এসে গেল। তখন তিনি বললেন : ‘হে আমার ভাই জিবরাইল! এর কী কারণ যে, হোসাইনের নাম উচ্চারণে আমার চোখে অশ্রু এসে যাচ্ছে ?

’জিবরাইল বললেন : ‘আপনার বংশধরদের মধ্য থেকে আপনার এ সন্তান এমন মুসিবতের মুখোমুখি হবে যে,দুনিয়ার বুকে আসন্ন অন্য সমস্ত মুসিবত এর সামনো স্লান হয়ে যাবে।’ আদম (আ.) জিজ্ঞাসা করলেন : ‘তার ওপরে কী ধরনের মুসিবত আপতিত হবে ?’

জিবরাইল বললেন : ‘তিনি পিপাসার্ত অবস্থায় তার পূর্বে নিহত সঙ্গীদের লাশ সামনে নিয়ে নিহত হবেন। শত্রুরা তার মৃত্যু দেখার জন্য অপেক্ষা করবে।’ তখন আদম (আ.) ও জিবরাইল খুব ক্রন্দন করলেন।’ (আল আওয়ালিম :.পৃ.১০৪-১১৭)

‘হায়! আমি যদি তাদের সাথে থাকতাম’!

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের সাথে জিহাদে শরীক হতে পারেনি এক পর্যাযে তারা বলবে :

يَا لَيْتَنِي كُنتُ مَعَهُمْ فَأَفُوزَ فَوْزًا عَظِيمًا

‘হায়! আমিও যদি তাদের সাথে থাকতাম তাহলে বিরাট সাফল্যের অধিকারী হতাম!’ (সূরা নিসা : ৭৩)

হযরত ইমাম রেযা (আ.) উপরিউক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করার পর বলেন : ‘হে শহীদের! পুত্র তুমি যদি হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তার আহলে বাইতের সাথে বেহেশতে স্থান লাভ করতে চাও , তাহলে তোমাকে হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর হত্যাকারীদের প্রতি অভিসম্পাত করতে হবে । যারা তার সাথে শহীদ হয়েছিলেন তুমি যদি তাদের মতো পুরস্কৃত হতে চাও , তাহলে যখনই তুমি তার কথা স্মরণ করবে তখনই বলবে : হায়! আমি যদি তাদের সাথে থাকতাম, তাহলে এক মহাবিজয় লাভ করতে পারতাম!’ (বিহারুল আনওয়ার : ৪৪তম খণ্ডণ্ড, ২৯৯ )

‘অঙ্গীকার পূরণ কর’

আল্লাহ তা’আলা কুরআন মজীদে এরশাদ করেন :

مِّنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللَّـهَ عَلَيْهِ  فَمِنْهُم مَّن قَضَىٰ نَحْبَهُ وَمِنْهُم مَّن يَنتَظِرُ ۖ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلًا

‘ঈমানদারদের মধ্যে এমন অনেক লোক রয়েছে যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণ করেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ রণাঙ্গনে শহীদ হয়েছে ও কেউ কেউ (শাহাদাতের জন্য) প্রতীক্ষা করছে এবং তারা তাদের অঙ্গীকারে পরিবর্তন সাধন করে নি।’ (সূরা আহযাব : ২৩)

আশুরার দিনে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর সঙ্গী-সাথিগণ একজন একজন করে তার নিকট আসেন এবং তাকে অভিনন্দন জানান। তারা তাকে সম্বোধন করে বলেন : ‘হে আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর বংশধর!’ তখন তিনি তাদের অভিনন্দনের জবাবে বলেন : ‘তোমাদের পরে শাহাদাতের জন্য আমরা অপেক্ষা করব।’ এর পর তিনি উপরিউক্ত আয়াত পাঠ করলেন। এর পর ইমাম হোসাইন (আ.) -এর সঙ্গী-সাথিগণ (আল্লাহ তাদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হন) সকলেই শহীদ হলেন এবং তার সাথে কেবল তার পরিবারের সদস্যরা রইলেন। (আল-আওয়ালিম : ১৭তম খণ্ডণ্ড, পৃ. ২৭৫) এর পর তারা (শত্রুরা) তার ওপর ভয়ঙ্কর ভাবে ঝপিয়ে পড়ল।

ওপরে উদ্ধৃত আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম রেযা (আ.) বলেন : ‘আল্লাহ তা’আলা যখন হযরত ইবরাহীম (আ.) -এর নিকট হযরত ইসমাইল (আ.) -এর পরিবর্তে একটি দুম্বা পাঠালেন ও তা-ই কুরবানি করার নির্দেশ দিলেন,তখন ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন যাতে তার মধ্যে সেই পিতার বিয়োগ-ব্যথা অনুভূত হয় যিনি তার সন্তানকে কুরবানি করছেন এবং এভাবে যাতে তিনি সর্বোত্তম পুরস্কারের উপযুক্ত হতে পারেন। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তার নিকট ওহী হয় : ‘হে ইবরাহীম! আমার সৃষ্ট সকল মানুষের মধ্যে তোমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় কে?’ ইবরাহীম (আ.) জবাব দিলেন : ‘আমি মুহাম্মাদকে সকলের চেয়ে বেশি ভালোবাসি।’ আল্লাহ পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন : ‘তুমি কাকে বেশি ভালোবাস, মুহাম্মাদকে, নাকি তোমার আত্মাকে?’ তিনি বললেন : ‘মুহাম্মাদকে।’ আল্লাহ পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন : ‘তার সন্তান কি তোমার নিকট তোমার নিজের সন্তানের চেয়ে প্রিয়তর ?’তিনি জবাব দিলেন : ‘অবশ্যই ।’ আল্লাহ বললেন : ‘কঠিন মুসিবতে নিপতি হয়ে মুহাম্মাদের সন্তানের মৃত্যুকেই কি তুমি বেশি কষ্ট পাবে,নাকি আমার প্রতি তোমার আনুগত্য প্রকাশের জন্য নিজের হাতে তোমার পুত্রের কুরবানিতে বেশি কষ্ট পাবে?’ তিনি বললেন : ‘ মুহাম্মাদের সন্তানের মৃত্যুতে।’ তখন আল্লাহ বললেন : ‘ইবরাহীম! একদল লোক যারা নিজেদেরকে মুহাম্মাদের অনুসারী বলে মনে করবে-তার সন্তানের রক্তে নিজেদের হাত রঞ্জিত করবে এবং এভাবে তারা আমার ক্রোধের শিকার হবে ।’ একথা শুনে ইবরাহীম (আ.) ক্রন্দন করতে লাগলেন। তখন সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা’আলা তার নিকট ওহী প্রেরণ করলেন : ‘হে ইবরাহীম! হোসাইনের মৃত্যু তোমার জন্য এক বিরাট মুসিবত স্বরূপ হতো। এ কারণে মহামুসিবতে নিপতিত হওয়ায় আমি যাদেরকে পুরস্কৃত করব তোমাকেও তদ্রূপ পুরস্কৃত করব।’ (বিহারুল আনওয়ার : ৪৪তম খণ্ডণ্ড,.পৃ. ২২৫-২৬৬) আল্লাহ তা’আলা সূরা আল-ফাজরে এরশাদ করেন :

يَا أَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ ﴿٢٧﴾ ارْجِعِي إِلَىٰ رَبِّكِ رَاضِيَةً مَّرْضِيَّةً

‘হে নিশ্চিন্ত নাফস! তুমি তোমার রবের দিকে প্রত্যাবর্তন কর এমন অবস্থায় যে,তুমি (তার প্রতি) সন্তুষ্ট ও (তার পক্ষ থেকে) সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত।’ (সূরা আল-ফাজরে-২৭-২৮)

হযরত ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেন : ‘তোমরা তোমাদের নামাযে সূরা আল-ফাজর পড়বে। হোসাইন বিন আলী (আ.) প্রসঙ্গে এটি নাযিল হয়েছে।’ তখন সেখানে উপস্থিত আবু আসসামা তাকে এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলেন। জবাবে ইমাম বললেন : ‘এখানে ‘হে নিশ্চিন্ত নাফস’ বলতে ইমাম হোসাইন (আ.) -এর নামকে বোঝানো হয়েছে। তিনি আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট, এ কারনে আল্লাহও তার ওপর সন্তুষ্ট। আর হযরত মুহাম্মাদ (সা.) -এর আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত তার সঙ্গী-সাথিগণ শেষ বিচাই দিনের ব্যাপারে আল্লাহর ওপর সনন্তুষ্ট। যারা সব সময় এ আয়াত পড়বে তারা বেহেশতে ইমাম হোসাইন (আ.) -এর সাথে থাকবে।’ (বিহারুল আনওয়ার : ৪৪তম খণ্ড, পৃ.২১৮-২১৯)

‘আমি কোনো ধন-সম্পদ বা ক্ষমতার লোভে কিংবা গালযোগ সৃষ্টির জন্য বিদ্রোহ করছিনা, আমি আমার নানাজানের উম্মতের মধ্যে সংস্কার করতে চাই, আমি ‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ’ করতে চাই এবং আমার নানাজান যে পথে চলেছেন আমি ও সে পথে চলতে চাই।’

ইমাম হোসাইন (আ.) [মাকতালু খারাযমী : ১/১৮৮]