হুর ইবনে ইয়াযীদ

বাংলায় একটি প্রবাদ বাক্য আছে : ‘শেষ ভালো যার সব ভালো তার ।’ আমরা মা’সুমগণের নিকট থেকে বর্ণিত দোয়ায় পাঠ করি, ‘হে আল্লাহ! আমাদের কাজের পরিণাম শুভ করুন।’ কিন্তু সে সৌভাগ্য হয় ক’জনের? হলফ করে বলা যায়, এদের সংখ্যা নিতান্তই কম। এদের কারো কথা ইতিহাস মনে রাখে, আর কেউ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। যাদের কথা ইতিহাস কখনোই বিস্মৃত হতে পারে না নিঃসন্দেহে তাদের সাথে জড়িয়ে আছে কোনো অবিস্মরণীয় ঘটনা।

কারবালার বীরত্ব গাথায় আমরা যে ক’জন ত্যাগী বীরের কথা জানতে পারি তাদের মধ্যে হুর ইবনে ইয়াযীদের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।

হুর ইবনে ইয়াযীদ এক সম্ভান্ত্র গোত্রে গ্রহণ করেন। তার বীরত্ব ও উদারতা তার পূর্বপুরুষেরই উত্তরাধিকার। ইসলামপূর্ব ও পরবর্তীকালে তারা উদারতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন । হুর ইবনে ইয়াযীদ অত্যাচারীকে সাহায্য করা থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে এক সুন্দর-সৌভাগ্যময় পরিণতির মাধ্যমে ইহ ও পরকালীন কাল্যাণ লাভ করেছিলেন ।

হুর ছিলেন কুফার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অন্যতম। আর এ কারণে ইবনে যিয়াদ তাকে সহস্রাধিক অশ্বারোহী সৈন্যের প্রধান হিসাবে নিয়োগ করেছিল । সে কুফার উদ্দেশ্যে গমনরত ইমাম হোসাইন (আ.) -এর পথরোধ করার জন্য হুর ইবনে ইয়াযীদ কে আদেশ দিয়েছিল ।

হুর ইবনে ইয়াযীদ বলেন : ‘দারুল ইমারা থেকে যখন বাইরে আসছিলাম তখন তিনবার এ শব্দ শুনতে পেলাম যে,কেউ যেন বলছেন : ‘‘হে হুর! তোমাকে শাহাদাতের সংবাদ!’’ যতই এদিক ওদিক তাকালাম,কাউকে দেখতে পলাম না। আপন মনে বলতে লাগলাম : ‘‘তোমার মাতা শোকার্ত হোক;হোসাইনের বিরুদ্ধে, আর বেহেশতের সুসংবাদ শুনছো’’!’

কিন্তু আশুরার দিনে হুর যখন ইমাম হোসাইনের সঙ্গীদের সাথে মিলিত হলেন তখন সেই গায়েবী আওয়াজের অর্থ বুঝতে পারলেন।

হুর ‘যু হুসাম’ নামক স্থানে হযরত ইমাম হোসাইনের সাথে সাক্ষাৎ করেন যখন তিনি ও তার সঙ্গীরা তৃষ্ণার্ত ছিলো। ইমাম হোসাইন (আ.) তাদের ও তাদেরকে বহনকারী পশুগুলোকে তৃপ্তিসহকারে পানি পান করানোর আদেশ দেন। অতঃপর হুর ইমাম হোসাইনকে স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করলেন। ইমাম হুরকে বললেন যে, তিনি কুফাবাসীর আমন্ত্রণে কুফায় যাচ্ছেন। কিন্তু হুর তাকে কুফায় যেতে দিল না। অতঃপর ইমাম সেখানেই তাবু ফেললেন।

বর্ণিত আছে যে,হুর আশুরার রাতে দেখেন যে, তার পিতা তাকে বলছেন : ‘আজ তুমি কোথায় আছ?’ হুর জবাব দিলেন : ‘ইমাম হোসাইনের সম্মুখে, তাকে বাধা দেবো এবং ইবনে যিয়াদের বাহিনী আসা পর্যন্ত তাকে আটকে রাখব।’ তার পিতা তার ওপর রাগান্বিত হলেন এবং বললেন : ‘ধিক তোমাকে ! রাসূল (সা.) -এর সন্তানদের সাথে কী করছো? যদি নিজেকে অনন্তকাল দোযখের আগুনে দেখতে চাও তবেই ইমাম হোসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। তুমি কি কিয়ামত দিবসে মহানবী (সা.),আমীরুল মু’মিনীন (আ.) ও ফাতেমা যাহরার ক্রোধে পতিত হতে চাও এবং তাদের শাফা’আত থেকে বঞ্চিত হতে চাও ?’

আশুরার দিন হুর ওমর ইবনে সা’দের সাথে সাক্ষাৎ করে তার কাছে জানতে চাইলেন : ‘তুমি কি হোসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফলেছো?’ ওমর ইবনে সা’দ জবাবে বললো : ‘হ্যাঁ । এমনভাবে যুদ্ধ করবো যাতে কমসংখ্যকের মাথা ও হাত কাটতে হয়।’ হুর বললেন : ‘এটা কি ভালো ছিলোনা যে, তাকে তার ওপর ছেড়ে দেবে, আর তিনি তার পরিবার-পরিজন নিয়ে দূরে যেখানে ইচ্ছা চলে যাবেন?’ ওমর ইবনে সাদ বললো : ‘যদি ব্যাপারটা আমার হাতে থাকতো তাহলে এমনটিই করতাম । কিন্তু আমীর ওবায়দুল্লাহ এমনটি করার অনুমতি দেননি।’

হুর ওমর ইবনে সা’দ থেকে  দূরে সরে গিয়ে একাকী চিন্তায় মগ্ন হলেন। এমন সময় কোররাত ইবনে কাইস রিয়াহী কাছে এলে তাকে উদ্দেশ্য করে হুর বললেন : ‘নিজের ঘোড়াকে পানি পান করিয়েছো?’

কোররাত বলে :বুঝতে পারলাম যে, তিনি চাচ্ছিলেন যে, আমি তার নিকটে অবস্থান করি। আর তাই বললাম : ‘না,আমার ঘোড়াকে পানি দেইনি।’ আমি তাকে রেখে অন্যত্র চলে গেলাম। হঠাৎ দেখলাম হুর ধীরে ধীরে হোসাইনের দিকে যাচ্ছেন। মুহাজির ইবনে আউস তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল : ‘আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছো? ’হুর নীরব থাকলেন এবং কোনো জবাব দিলেন না। কিন্তু ভীষণ কাপছিলেন । হাজির ইবনে আউস হুরকে বলল : ‘ তোমার আচরণ তো সন্দেহ জনক; আমি তোমাকে কখনোই এমন দেখিনি। যদি আমাকে পূর্বে জিজ্ঞাসা করা হতো কুফার শ্রেষ্ঠ বীর কে ? তবে আমি তোমার নামটিই বলতাম। তাহলে তোমার মধ্যে যে উদ্বেগ আমি দেখতে পাচ্ছি তা কি জন্য ?’

হুর জবাবে বললেন : ‘আল্লাহর শপথ, আমি নিজেকে বেহেশত ও দোযখের মাঝে পরীক্ষা করছি। আল্লাহর শপথ,বেহেশত ব্যতীত অন্য কোনো পথ বেছে নেবো না, এমনকি টুকরা টুকরা হয়ে গেলেও ।’ অতঃপর তিনি নিজের ঘোড়াকে দ্রূত ইমাম হোসাইনের দিকে পরিচালনা করলেন। ইমামের নিকটবর্তী হলে নিজের ঢালকে আত্মসমর্পণের ইঙ্গিত হিসাবে উাল্টো করে ধরলেন এবং ইমাম হোসাইনের সামনে উপস্থিত হয়ে মুখমণ্ডল মাটিতে স্থাপন করলেন।

ইমাম হোসাইন (আ.) তাকে বললেন : ‘মাথা ওপরে তোলো,তুমি কে ? ’হুর বললেন : ‘হে রাসূলের সন্তান! আমি সেই ব্যক্তি যে আপনার পথে বাধ সেধেছিল । আমি আপনাকে নিরাপদ স্থানে যেতে দেই নি। কিন্তু আল্লাহর কসম, আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি যে, আপনার সাথে এরূপ আচরণ করা হবে । আমার ধারণা ছিলো আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করা হবে । এখন অনুতাপে দগ্ধ হয়ে আপনার দিকে ফিরে এসেছি;আমার তাওবা কি কবুল হয়েছে ? ’ইমাম জবাব দিলেন : ‘হে , মহান আল্লাহ তোমার তাওবা কবুল করেছেন। ’হুর তৃপ্ত হৃদয়ে ইমাম হোসাইনের নিকট প্রার্থনা করলেন : ‘আমাকে অনুমতি দিন যাতে আমি আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত প্রথম ব্যক্তি হতে পারি।’

ইমাম হোসাইন (আ.) তার কাল্যাণার্থে দোয়া করলেন। অতঃপর হুর ইবনে যিয়াদের সৈন্যদের নিকট গিয়ে তাদেরকে উপদেশ দিলেন। কিন্তু তাতে তারা কর্ণপাত না করে তার দিকে তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। হুর তাদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে শাহাদাতের পেয়ালা পান করলেন। হযরত ইমাম হোসাইন (আ.) হুরের রক্তাক্ত নিথর দেহের পাশে গিয়ে বললেন : ‘তুমি সত্যিই হুর (মুক্ত) যেমনটি তোমার মাতা তোমার নামকরণ করেছেন। তুমি দুনিয়াতে, আর আখেরাতে সৌভাগ্যবান।’

এ মহান ত্যাগী বীরের সমাধিস্থল বর্তমান কারবালা থেকে পশ্চিমে সাত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তার সমাধির ওপর একটি স্থাপনা আছে যা সুন্দর কারুকার্য খচিত। কথিত আছে,হুরের আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে তামিম গোত্রের একদল ব্যক্তি আশুরার ঘটনার পর তার দেহ এ স্থানে এনে দাফন করেন।

শাহ ইসমাইল (আয়াতুল্লাহ হায়েরীর বর্ণনামতে শাহ আব্বাস) ইরাক দখল করার পর কারবালায় এসে ছিলেন । তিনি হুরের মর্যাদা ও মাযার সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন । সত্য উদঘাটনের জন্য তিনি হুরের কবর খননের নির্দেশ দেন। কবর খননের পর তিনি হুরের দেহকে রক্তাক্ত পোশাকসহ দেখতে পান । তারা তার জখমগুলোকে তাজা দেখতে পান । তার মাথায় তরবারির আঘাতে সৃষ্ট জখম দেখতে পান যা এক টুকরা কাপর দিয়ে বাধা ছিল । শাহ এ কাপড় খুলে অন্য কাপড দিয়ে জখমটি বাধার নির্দেশ দিলে তা খোলা মাত্র ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। ফলে পুনরায় তা বেধে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয় এবং তাবাররুক হিসাবে শাহ সে কাপড়ের টুকরা থেকে  কিঞ্চিৎ পরিমাণ কেটে নেন। অতঃপর শাহ হুরের সমাধিকে পুনরায় আকর্ষণীয় রূপে তৈরী করার নির্দেশ দেন। [সূত্র:দায়েরাতুল মা’য়ারেফে তাশাইয়্যূ, ৬ষ্ঠ খণ্ড]

সংকলনে : মোঃ মাঈন উদ্দিন