আল হাসানাইন (আ.)

ইমাম হোসাইন (আ.) কপটতার স্বরূপ উম্মোচন করেছেন

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

‘নিফাক’ বা কপটতা সম্পর্কে কোনো কিছু লিখতে যাওয়ার আগে ইসলামের শরীয়তী নীতির আলোচনা করা প্রয়োজন। বিশেষ করে শরীয়তী মূলনীতির উৎস কোথায় এবং তা মানুষের মাঝে কী ধরনের গুণ সাঞ্চার করতে চায় তা আলোচনা হওয়া আবশ্যক যাতে মানবতার ওপর ‘নিফাক’ বা কপটতার মারাত্মক পরিণতি এবং তা দূরীকরণের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করা যায়।

মানুষের জন্য তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা’আলার নির্ধারিত জীবন বিধান মানুষের কাছে পৌছে দেয়া হয়েছে তার নবী-রাসূলদের মাধ্যমে। আর নবী-রাসূলদের তিনি সৃষ্টি করেছেন বিশেষ গুণ ও ক্ষমতা দিয়ে। তারা ছিলেন আল্লাহ তা’আলার ‘মনোনীত’ বা ‘বাছাইকৃত’ মানুষ এবং পরে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাদের অবস্থান,মর্যাদা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওপর এ শরীয়তী বিধানের চূড়ান্তরূপ নাযিল করার পর,কিয়ামত পর্যন্ত মানব সমাজের দিকনির্দেশনার জন্য তা মূল আকারে সংরক্ষণ করা আবশ্যক ছিল। প্রকাশ্য শত্রুতার মাধ্যমে এ বিধান ধ্বংস করার শত্রুও সব সময় ছিল। কিন্তু শত্রুদের এ আশা যখন ভঙ্গ হয়,তখন কপটতা বা ‘মুনাফেকি’র মাধ্যমে এর অঙ্গ হানির চেষ্টা শুরু হয়। দুশমনরা ইসলামের নিজস্ব সমাজে প্রবেশ করে তার সারবস্তু পরিবর্তনের চেষ্টা করে।

শরীয়তের এ বিধান সংরক্ষণের জন্য আবার ‘বাছাই করা’ বা মনোনীত মানুষ -ইমামদের সেবার প্রয়োজন ছিল,যারা এ উদ্দেশ্যে যে কোনো কিছু বা সব কিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন। আল্লাহ তা’আলা নবীদের মতোই বিশেষ গুণ দিয়ে ইমামদের সৃষ্টি করেন এবং পরীক্ষার মাধ্যমে মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শরীয়ত সংরক্ষণের দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। অতএব,এ পৃথিবী থেকে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) -এর বিদায় পরবর্তী মুনাফিকদের কমকাণ্ড ঐতিহাসিকভাবে চিহ্নিত করার আগে ঐসব মানুষের বিশেষ গুণাবলী খুজে বের করা দরকার যারা আল্লাহ তা’আলার বাণী বয়ে এনেছেন,তা মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছেন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সেই বিধান সংরক্ষণ করে গেছেন। আমরা এখানে ইসলামের প্রাথমিক যুগের সে সব ব্যক্তির ইতিহাসের ওপর সংক্ষেপে আলোকপাত করব যারা আনুগত্য,সাহস ও ত্যাগী চেতনার মাধ্যমে নিজেদেরকে শরীয়ত হেফাজতকারীর মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিলেন।

ইমামের রক্ত কপটদের মুখোশ উম্মোচন করে

মহান আল্লাহ আমাদেরকে দিকনির্দেশনা দান ও সঠিক পথপ্রদর্শনের জন্য তার বাণী বাহক নবী ও ইমামগণকে প্রেরণ করেছেন এবং এ সংবাদ দিয়েছেন যে,‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক মুত্তাকী।’ (সূরা আল-হুজুরাত : ১৩) এজন্য আল্লাহ তা’আলার কাছে শুকরিয়া আদায় করার কোনো ভাষা খুজে পাওয়া যাবে না। এসব মানুষের ন্যায়পরায়ণতা এবং আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা ও নিষ্ঠা পরীক্ষিত। আল্লাহ তা’আলার প্রতি সংশয়হীন ঈমান এবং তার ইচ্ছার প্রতি তাদের আনুগত্য তার দৃষ্টিতে তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়। ‘যখন ইবরাহীমকে তার রব কয়েকটি কথা দ্বারা পরীক্ষা করেছিলেন এবং সেগুলো সে পূর্ণ করেছিল; আল্লাহ বললেন,‘আমি তোমাকে মানব জাতির নেতা করছি।’ সে বলল,‘আমার বংশধরগণের মধ্য থেকেও ?’ আল্লাহ বললেন,‘আমার প্রতিশ্রুতি জালেমদের প্রতি প্রযোজ্য নয়’।’ (সূরা আল-বাকারা: ১২৪)

এ মর্যাদা থেকে পাপকর্মকারীদের বাদ দিয়ে নবী ইবরাহীম (আ.) -এর পথপ্রদর্শন প্রার্থনা মঞ্জুর করা হয়েছে : ‘এবং তাকে দান করেছিলাম ইসহাক ও ইয়াকুব ও এদের প্রত্যেককে সৎপথে পরিচালিত করেছিলাম; তার পূর্বেও নূহকে পথ প্রদর্শন করেছিলাম এবং তার বংশধর দাউদ,সুলায়মান,আইয়ুব,ইউসুফ,মূসা ও হারুনকেও ; আর এভাবেই আমি সৎ কর্মপরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করি।’ (সূরা আল-আন’আম : ৮৪)

কুরআন মজীদে সুস্পষ্টভাবে আরো ঘোষণা করা হয়েছে যে,আল্লাহ তা’আলা ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে কাউকে কাউকে প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে থাকেন : ‘আল্লাহ আদম,নূহ ও ইবরাহীমের বংশধর এবং ইমরানের বংশধরদের বিশ্ববাসীর ওপর মনোনীত করেছেন। এরা একে অপরের বংশধর। আল্লাহ সর্ব শ্রোতা,সর্বজ্ঞ।’ (সূরা আলে ইমরান : ৩৩-৩৪)

উপরিউক্ত আয়াতগুলো থেকে আমরা নিম্নোক্ত কয়েকটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি :

১. আল্লাহ তা’আলা সবকিছু শুনছেন। তিনি জানেন,মানুষের অন্তরে কী আছে বা তার জন্য মানুষের অন্তরে কতখানি ভালোবাসা ও বিশ্বাস আছে।

২. পরে তিনি তার ঈমানদার বান্দাদেরকে বর্ধিত আনুকূল্য বা মর্যাদা প্রাপ্তির যোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য তাদের আরো পরীক্ষার সম্মুখীন করেন।

৩. আল্লাহর মনোনীত বা বাছাইকৃত বান্দা জাতিসমূহের ওপর মর্যাদা লাভ করেন।

৪. নবীদের প্রার্থনা কবুল করা হয়েছে এবং মানুষের কাছে প্রায়শই তাদের নিকটাত্মীয় ও সন্তান-সন্তুতি বা বংশধরদের দ্বারা আল্লাহর বাণী প্রচারে তাদেরকে শক্তি দান করা হয়েছে।

শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এবং তার চাচাত ভাই ইমাম আলী (আ.) ও তার বংশধরদের ক্ষেত্রেও আল্লাহ তা’আলার এ অগ্রাধিকারের কোনো তারতম্য ঘটেনি।

আল্লাহর দ্বীন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) -এর মাধ্যমে চূড়ান্ত রূপ নেয়। তার পরে আর কোনো নবী আসবেন না। অতঃপর তার সন্তান-সন্তুতি বা বংশধরদের দায়িত্ব হয়ে দাড়ায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিকনির্দেশনা দানের জন্য কিয়ামত দিবস পর্যন্ত অবিকলভাবে আল্লাহর বাণী পৌছে দেয়ার কাজ অব্যাহত রাখা। শেষ নবী (সা.) -এর জন্য তার পূর্ববর্তী নবীদের তুলনায় আরো অধিক সমর্থন ও সহায়তার প্রয়োজন ছিল। এ কারনেই তিনি আল্লাহ কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়ে তার বাণী প্রচার এবং উম্মাহকে পরিচালনার জন্য নিজের জীবদ্দশায় একটি পরিকল্পনা প্রপ্রণয়ন করে যান যা পৃথিবী থেকে তার বিদায় নেয়ার পরেও দিকনির্দেশনা দানের জন্য পালাক্রমে চলতে থাকে।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে,শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) কিয়ামত পর্যন্ত অবিকৃতভাবে ইসলাম পৌছে দেয়ার পরিকল্পনা য় কর্তব্যবদ্ধ ছিলেন। তাই তার পর মাত্র একজনকে তিনি উত্তরাধিকারী নিয়োগ করেননি,বরং একের পর এক দায়িত্ব পালনের জন্য কয়েকজন উত্তরাধিকারী নিয়োগ করেন। তিনি তার উত্তরাধিকারী হিসাবে কেবল ইমাম আলী (আ.) -এর নাম উল্লেখ করেননি,বরং তিনি বুঝাতে চেয়েছেন যে,‘আহলুল বাইত’- যারা কখনই কুরআন মজীদ থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন না- তারাই উম্মাহকে নেতৃত্ব দেবেন। কেবল একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র সৃষ্টি ইসলামের লক্ষ নয়। এর লক্ষ একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ সৃষ্টি করা,যা জীবনের প্রতিটি দিকে আল্লাহর আদেশের আনুগত্য করবে। এ ধরনের দিকনির্দেশনা কেবল তাদের কাছ থেকেই পাওয়া যেতে পারে যারা কখনই কুরআন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারেন না। অতএব,এটি একটি সন্দেহাতীত বিষয় যে,অন্য কেউ নয়,বরং আহলে বাইতের সদস্যগণই পারেন মহানবী (সা.)-এর উত্তরাধিকারী হতে এবং তার মিশন পরিচালনা করতে।

মহানবী (সা.) -এর কন্যা হযরত ফাতেমা (আ.)-এর মর্যাদা উপলদ্ধি করার জন্য ইসলামের প্রতি তার সেবার বিস্তারিত অনুসন্ধানের প্রয়োজন পড়ে না। তার সম্পর্কে মহানবী (সা.) -এর মন্তব্য এবং তার প্রতি তিনি যে শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন,তা-ই আল্লাহ তা’আলার প্রতি হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) -এর নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘ফাতেমা আমার একটি অংশ;যে তাকে ক্রোধান্বিত করে সে আমাকেই ক্রোধান্বিত করে।’ (সহীহ বুখারী : ‘নবীদের আত্মীয়-স্বজনের সৎগুণ ও ফাতেমার সৎগুণ’ অধ্যায়; আল-হাকিম : আল-মুসতাদরাক,দ্বিতীয় খণ্ড,পৃ.১৫৬; মাদারাজুন নাবুওয়াত,দ্বিতীয় খণ্ড,পৃ.৪৬০; সাওয়াইকু মুহরিকা,পৃ. ১৭৩)

এ থেকে বোঝা যায়,মহানবী (সা.) নিশ্চিত ছিলেন যে,তার কন্যার ক্রোধ কেবল ভুল ও অন্যায়ের বিরুদ্ধেই হতে পারে,অন্য কিছুতে নয়।

মহানবী (সা.) আরো বলেছেন,‘ফাতেমা জান্নাতে নারীদের নেত্রী বা ঈমানদার নারীদের নেত্রী।’ (সহীহ বুখারী,‘নবুওয়াতের প্রমাণ’ অধ্যায়,পঞ্চম খণ্ড,পৃ. ২৫) অতএব,আমরা এ মর্মে একমত যে,তিনি ছিলেন একজন নায়পরায়ণ ব্যক্তিত্বের মূর্ত প্রকাশ।

আরো বর্ণিত আছে যে,‘হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) যখনই মহানবী (সা.) -এর কাছে আসতেন তখন তিনি তাকে স্বাগত জানাতেন,তার জন্য দাড়িয়ে থাকতেন,তাকে চুমু দিতে ন,তার হাত ধরতেন এবং নিজের জায়গায় তাকে বসাতেন।’ (আল-হাকিম : আল-মুসতাদরাক,তৃতীয় খণ্ড,পৃ. ১৫৪)

আল্লাহ তা’আলা যখন ফেরেশতাদের সামনে ঘোষণা করেন যে,তিনি ‘কিসা’র (চাদরের) নিচের পাঁচজনকে ভালোবাসার জন্য সমগ্র বিশ্ব চরাচরকে সৃষ্টি করেছেন,তা থেকেই ফাতেমা (আ.) -এর মর্যাদা যে সকল দিক থেকে উচ্চতর ও বিশিষ্ট তা অনুধাবন করা যায়। ‘কিসা’র ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। আল্লাহ তা’আলা ফেরেশতাদের সামনে তাদের কে পরিচয় করিয়ে দেন : ‘তারা নবীর পরিবারের লোক এবং আমার নবুওয়াতের সম্পদ। তারা হলো :ফাতেমা,তার পিতা,তার স্বামী ও তার দুই পুত্র (হাসান ও হোসাইন)।’

আল্লাহ তা’আলা এক ওহীর মাধ্যমে তার শুভেচ্ছাসহ নবী (সা.) -এর এক প্রর্থনার জবাব দিয়েছেন,‘আল্লাহ তো কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে সম্পূর্ণ রূপে পবিত্র করতে।’ (সূরা আহযাব : ৩৩)

ইমাম আলী (আ.) যখন ‘কিসা’র নিচে তাদের সমবেত হওয়ার গুরুত্ব সম্পর্কে মহানবী (সা.) -কে জিজ্ঞাসা করলেন,তখন মহানবী (সা.) অত্যন্ত জোর দিয়ে ঘোষণা করলেন : ‘হে আলী! আল্লাহর কসম,যিনি আমাকে তার বাণী বাহক হওয়ার জন্য নির্বাচন করেছেন এবং আমাকে তার নবী বানিয়েছেন,পৃথিবীতে মানুষের যে কোনো সমাবেশ,যাতে আমাদের অনুসারী ও নিবেদিত লোকেরা যোগদান করবে,সেখানে যে-ই এ ঘটনা বর্ণনা করবে,আল্লাহ তাদের প্রতি করুণা বর্ষণ করবেন এবং ফেরেশতারা অবতীর্ণ হয়ে ঐ সমাবেশ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করতে থাকবে।’ এতে প্রতীয়মান হয় যে,মহানবী (সা.) -এর এ ঘোষণার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে,মুসলমানদের মাঝে এ বাণী স্থায়ীভাবে বিস্তৃত হতে থাকবে যাতে প্রজন্মসমূহ দিকনির্দেশনার জন্য আহলে বাইতের সদস্যদের সাথে সম্পৃক্ত থাকে।

মহানবী (সা.) -এর নাতীদেরকে এক সময় নামাযের সেজদাকালে তার পিঠের ওপর দেখা যায়। তারা নিজে নেমে না আসা পর্যন্ত তিনি তার সেজদা দীর্ঘায়িত করেন এবং তাদেরকে নামিয়ে আনারা পারে তার সাহাবীদের চেষ্টাকে নিরুৎসাহিত করে তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেন।

ইমাম আলী (আ.) -এর পর তার দুই পুত্র ইসলামকে রক্ষা করেন। হযরত ইমাম হাসান (আ.) -এর পর তাদের পবিত্র সংগ্রামের দায়িত্ব এসে বর্তায় তৃতীয় ইমাম হোসাইন (আ.) -এর ওপর। ইমাম হোসাইন ইসলামের নীতি ও বিধান অনুযায়ী কপটতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের উদ্দেশ্যে তার কৌশল নির্ধারণ করেন। তিনি এ বিষয়কে আরও বৈশিষ্টমণ্ডিত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেন,যাতে উমাইয়্যা মুনাফিকরা তাকে শহীদ করার জন্য কোনো অলীক অজুহাত সৃষ্টি করতে না পারে। তিনি প্রয়োজনীয় সাবধানতা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এমনভাবে যে,তার জিহাদ হবে মুনাফিকীর ওপর এক সুস্পষ্ট আঘাত।

তথ্য প্রমাণাদি থেকে জানা যায় যে,পরিস্থিতি সম্পর্কে ইমাম হোসাইন (আ.) –এর সুস্পষ্ট ধারণা ছিল এবং সে অনুযায়ী তিনি একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে আত্মীয়-স্বজন ও নিষ্ঠাবান বন্ধুদের সাথে আলোচনা করেন,আন্তরিকতা ও ভালোবাসার ভিত্তিতে দেয়া তাদের পরামর্শ ও উপদেশসমূহ বিবেচনা করেন এবং সবশেষে একটি সিদ্ধান্ত মূলক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। তিনি তার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু বান্ধবকে ঐ পরিকল্পনার সাথে একমত করেন। ইমাম হোসাইন (আ.) -এর যে সব আন্তরিক ও নিষ্ঠাবান আত্মীয়-স্বজন মদীনায় থেকে যান,মূলত তিনিই তাদেরকে মদীনায় রেখে যান সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুসারে।

মহানবী (সা.) -এর পত্নী উম্মে সালমা,যিনি নবী কন্যা হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) -এর পরিবারের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল ছিলেন,যাকে মহানবী (সা.) কারবালার বালি সংরক্ষণের জন্য দিয়ে ছিলেন এবং যে বালি ইমাম হোসাইন (আ.) -এর শাহাদাতের দিন লাল হয়ে যাবে বলে বর্ণিত আছে,তিনিও মদীনায় থেকে গিয়েছিলেন। ইমাম হোসাইন (আ.) নিজের অসুস্ত কন্যাকে তার হফাজতে রেখে এসেছিলেন।

ইমাম হোসাইন -এই বোন হযরত যায়নাব (আ.) তার সাথেই ছিলেন। তবে তার স্বামী আবদুল্লাহ ইবনে জাফর তাইয়্যার মদীনায় থেকে যান। কারণ,তিনি ছিলেন অসুস্থ। তবে কথিত আছে যে,ইমাম হোসাইন (আ.) যখন ইরাকের উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগ করেন,তখন তাহিমে তার যাত্রাবিরতিকালে আবদুল্লাহ তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে তিনি তার দুই পুত্রকে ইমাম হোসাইন –এর কাছে ন্যস্ত করেন,তার সাথে দীর্ঘ আলোচনা করেন এবং মদীনায় ফিরে যান।

ইমাম হোসাইন (আ.) -এর এক ভাই মুহাম্মাদ হানাফিয়া মদীনায় ছিলেন। ইমাম খুব সতর্কতার সাথে ও ধৈর্যসহকারে তার পরামর্শ শুনতেন। পরে তিনি তাকে বলেন যে,তিনি মহানবী (সা.) -কে স্বেপ্নে দেখেছেন এবং তিনি তাকে বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্রুত এগিয়ে যেতে বলেছেন।

এ আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে,উপরিউক্ত ব্যক্তি বর্গের মদীনায় থেকে যাওয়ার পিছনে সুস্পষ্ট কারণ ছিল। ইমাম হোসাইন ২৮ রজব মদীনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ইয়াযীদের ক্ষমতাসীন হওয়ায় মিল্লাতের,বিশেষ করে নিষ্ঠাবান ও ন্যায়পরায়ণ লোকদের অসন্তোষের কথা তিনি জানতেন। এ ধরনের অসন্তোষ ও অস্থিরতার মধ্যে জনসাধারণ আহলে বাইত -এর কাছে সাহায্যের জন্য আসে। তিনি ইরাকের জনসাধারণের কাছ থেকে চিঠিপত্র পাওয়া শুরু করেন। চিঠিতে তারা সাহায্য ও দিকনির্দেশনার আবেদন জানায় এবং তার প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে। এ ছাড়া তাকে,তার পরিবারবর্গ ও বন্ধুদেরকে নিজেদের পরিবারবর্গের অনুরূপ প্রতিরক্ষা প্রতিশ্রুতি দেয়। ১৪ রামাযান ইমাম হোসাইন (আ.) মুসলিম ইবনে আকীলকে তার দূত হিসাবে ইরাকে পাঠান। তার মাধ্যমে ইরাকীজনগণকে তিনি আশ্বাস দেন যে,মুসলিম ইবনে আকীলের রিপোর্ট প্রাপ্তির পরই তিনি যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

কাবা শরীফকে অপবিত্রকরণ থেকে রক্ষার জন্য ইমাম হোসাইন (আ.) পবিত্র হজ্জের একদিন আগেই ইরাকের উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। মক্কা ত্যাগের একদিন আগে তিনি জনসাধারণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন :

‘হে জনগণ! নবী আদম (আ.) -এর বংশধর বা সন্তান-সন্তুতির জন্য মৃত্যু এক সুন্দরী বালিকার গলার হারের মতো। নবী ইয়াকুব (আ.) যেমন নবী ইউসুফ (আ.) -এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আকুলভাবে প্রতীক্ষায় ছিলেন,আমিও তেমনি আমার পূর্ব পুরুষদের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করছি। আমার শাহাদাতের স্থান নির্ধারিত হয়ে গেছে; আমি অচিরেই সেখানে পৌছে যাবো। আমি দেখতে পাচ্ছি,নেকড়েরা নাওয়াদিস ও কারবালার মাঝখানে আমার দেহ টুকরা টুকরা করে কাটছে। তারা আমার দেহ নিয়ে শূন্য উদর পূরণ করছে। মৃত্যুর নির্ধারিত দিন কোনোভাবেই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। আল্লাহর ইচ্ছাই আমাদের ইচ্ছা; আহলে বাইত -এর ইচ্ছা তার ইচ্ছা থেকে আলাদা হবে না। হে জনগণ! যে আমাদের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করতে চায় এবং তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করতে চায় সে আমাদের সঙ্গী হতে পারে। ইনশাআল্লাহ,আগামীকাল সকালে আমি রওয়ানা হচ্ছি।

কবি ফারাযদাক ইমাম হোসাইনকে পরবর্তী যাত্রা বিরতিতে বলেন যে,‘ইরাকীদের অন্তর আপনার সাথে,কিন্তু তাদের তরবারি আপনার বিরুদ্ধে। (বিহারুল আনওয়ার : ১০ম খণ্ড,পৃ. ১৯৪)

জিহাদে শরীক হওয়ার আশায় বিপুল সংখ্যক আরব ইমাম হোসাইন (আ.) -এর কাফেলার চারদিকে সমবেত হয়। জাবালায় যাত্রা বিরতিকালে ইমাম হোসাইন (আ.) খবর পেলেন যে,মুসলিম ইবনে আকীল শহীদ হয়েছেন। তিনি এ খবর লোকজনকে জানিয়ে বার বার একই লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করে বললেন : ‘ যারা জিহাদে অংশ নিতে চায় ও যাদের ধৈর্য আছে তাদেরই আমার সাথী হওয়া উচিত এবং বাকিরা ফিরে যেতে পারে।’ (বিহারুল আনওয়ার : ১০ম খণ্ড,পৃ.-১৮৪)

এর পর নতুন করে সমবেত হওয়া লোকজন বিদায় নিল এবং কেবল ইমাম (আ.) -এর বাছাই করা ব্যক্তিগণই ইমামের সাথে থেকে গেলেন।

ইমাম হোসাইন তখন তার সনাদলের উদ্দেশ্যে তার পরবর্তী তাৎপর্যময় ভাষণ প্রদান করেন যার অংশবিশেষ নিম্নরূপ :

‘হে লোকসকল! আল্লাহর নবী বলেছেন,যে ব্যক্তি এমন একজন বাদশাহকে দেখেছে,যে বাদশাহ নিষ্ঠুর আচরণ করে,আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করে,নবী (সা.) -এর সুন্নাতের বিরোধিতা করে এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে পাপাচারী ও স্বেচ্ছাচারীভাবে শাসন করে,অথচ (সে ব্যক্তি) কথা ও কর্মের দ্বারা তার বিরোধিতা করে নি,আল্লাহ সেই ব্যক্তিকেও সেখানে প্রেরণ করবেন,যেখানে ঐ বাদশাহকে পেরণ করা হবে (জাহান্নামে)। শোন,এ সব লোক (উমাইয়্যারা) শয়তানের অনুসরণ করে এবং আল্লাহর আনুগত্য করতে অস্বীকার করে। তারা ঝগড়া-বিবাদ ও গালযোগ বিস্তার করে,আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে নীতিভ্রষ্ট ও জাহেল হয়ে যাচ্ছে,তারা রাষ্ট্রের অর্থ কুক্ষিগত করছে,হারামকে হালাল এবং আল্লাহ কর্তৃক বৈধ ঘোষিত বিষয়কে অবৈধ ঘোষণা করছে। মহানবী (সা.) -এর নিকটজন হিসাবে আমার ওপর তোমাদেরকে ভালো কাজ করা এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলার এক বিরাট দায়িত্ব রয়েছে ...। আমি তোমাদের দিকনির্দেশনা দানের আন্ত্রমণ জানিয়ে তোমাদের প্রেরিত বার্তা বাহক ও অসংখ্য চিঠি পেয়েছি,যাতে তোমাদের এ প্রতিশ্রুতিও রয়েছে যে,তোমরা আমাকে অরক্ষিত রেখে ছেড়ে যাবে না এবং আমার প্রতি অবিশ্বস্ত ও বিশ্বাসভঙ্গকারী হবে না।’ (আবু মাখনাফ,পৃ. ৪৩)

তার ভাষণে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর উল্লেখ রয়েছে :

১. ইমাম হোসাইন (আ.) সুস্পষ্টভাবে শাসকদের সম্পর্কে আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামী বিধি- বিধান বর্ণনা করেছেন;

২. তিনি পরিস্কারভাবে মত প্রকাশ করেছেন যে,উমাইয়্যাদের আচরণ ছিল ইসলামী বিধানের বিপরীত;

৩. তিনি মহানবী (সা.) -এর বাণী উল্লেখ করে বলেছেন,যে শাসক আল্লাহপ্রদত্ত বিধানের বিরুদ্ধে কাজ করে,কথা ও কাজের মাধ্যমে তার বিরোধিতা করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য;

৪. তিনি নিজের থেকে অগ্রসর হননি,বরং লোকেরা তাকে যেতে এবং দিকনির্দেশনা দানে অনুরোধ করেছিল এবং

৫. তিনি তার শাহাদাত ঘনিয়ে আসার কথা উল্লেখ করেন এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণের কথাও ব্যক্ত করেন।

পরে ইমাম হোসাইন তার সহযোগীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন এবং তাতে জোর দিয়ে বলেন,সত্য অনুশীলন করা হচ্ছে না এবং মিথ্যা পরিহার করা হচ্ছে না। এমতাবস্থায় ঈমানদারকে অবশ্যই তার রবের সাথে সাক্ষাৎ করা উচিত। বর্তমান অবস্থায় মৃত্যু একটি আশীর্বাদ এবং জীবন হচ্ছে নির্যাতন। ইমাম হোসাইন (আ.) -এর এ ভাষণ তার সঙ্গী ও সাথীদের ঈমানের শক্তি আরো বৃদ্ধি করে।

হযরত যায়নাব জনসাধারণের মাঝে ইমাম হোসাইন –এর রক্ষ প্রদর্শন করায় তা প্রত্যাশিত ফল দিতে থাকে। ইবনে যিয়াদ বন্দি কাফেলা দ্রুত দামেস্কে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়। তাড়াহুড়া করে এবং তুলনা মূলকভাবে স্বল্প পরিচিতি রাস্তা দিয়ে গিয়েও উমাইয়্যা বাহিনীকে দামেস্কের পথে উপহাস,বিরোধিতা,এমনকি খোদ কুফায় বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হয়। এসবের কিছু এখানে উল্লেখ করা হলো :

জনৈক অন্ধ অফিফ আজদী তার কান্যার সহায়তায় কুফায় বিদ্রোহ করেন। ইয়াযীদের যেসব লোক বন্দিদের এবং শহীদদের মাথা বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল তাকরিতের লোকজন তাদেরকে শহরে প্রবেশ করতে দেয়নি। লাবিনাবাসী চিৎকার দিয়ে বলে : ‘হে নবীর বংশধরদের খুনীরা! আমাদের শহর থেকে বরিয়ে যাও।’ মসূলবাসী ইয়াযিদী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয় এবং যথাযথ মর্যাদায় দাফনের উদ্দেশ্যে তাদের কাছ থেকে শহীদদের মাথাগুলো ছিনিয়ে নেয়। এ খবর শুনে ইয়াযিদী বাহিনী তাদের রাস্তা পরিবর্তন করে। তাব্ দূর্গের লোকেরা তাদের পানি সরবরাহে অস্বীকার করে এবং সংঘর্ষে ৬০০ ইয়াযিদীকে হত্যা করে। সেবুর শহরের লোকেরাও তাদের বিরোধিতা করে। হামার লোকেরা তাদের নগরের দ্বার বন্ধ করে দেয়। হাইমবাসীও ইয়াযিদী বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করে এবং শহীদদের মাথাগুলো ছিনিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌছে যে,দামেস্কে বন্দিদের পরিচয় প্রকাশ করার ও সাহস হচ্ছিলনা ইয়াযীদের। তবে হযরত যায়নাব ও উম্মে কুলসুম দামেস্কের বাজারে গিয়ে তাদের পরিচয় প্রকাশ করেন এবং ইয়াযীদের দরবারে গিয়ে কারবালার গণহত্যার বর্ণনা দিয়ে ঐ তথাকথিত মুসলিম শাসকের অনৈসলামী কাজের স্বরূপ উম্মোচন করেন।

তাদের মদীনায় ফিরে আসার ব্যবস্থা করা হয়। তবে তাদেরকে পথ বাছাইয়ের ইখতিয়ার দেয়া হয়। প্রথমে তারা কারবালায় যান। তাদের উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণকে বুঝানো যে,জুলুমের বিরুদ্ধে সত্যের জয় হয়েছে। পরে তারা মদীনার দিকে অগ্রসর হন।

ইমাম হোসাইন (আ.) -এর রক্ত এতই কার্যকর প্রমাণিত হয় যে,মুনাফিকরা নিজেরাই তাদের নিফাকের কথা ঘোষণা করে। কুফায় ইবনে যিয়াদ বলে : ‘আমরা বদরের প্রতিশোধ নিয়েছি।’ মদীনার গভর্নর ইমাম হোসাইন (আ.) -এর শাহাদাতের সংবাদ সংক্রান্ত চিঠি মহানবী (সা.) -এর রওজার ওপর ছুড়ে দিয়ে বলে : ‘আমরা বদরের প্রতিশোধ নিলাম।’ দামেস্কে ইয়াযীদ বলে : ‘আমি আশা করি,বদরে নিহত আমার পূর্বপুষরা দেখবেন,কীভাবে আমি প্রতিশোধ নিলাম!’

মুনাফিকরা নিজেরাই তাদের পূর্ব পুরুষদের সাথে তাদের সম্পর্কের কথা ঘোষণা করে,যারা ছিল কাফের এবং মহানবী (সা.) -এর সাথে তথা ইসলামের সাথে যাদের সংশ্রব ছিল না। ইমাম হোসাইন (আ.) -এর রক্ত মুনাফিকদেরকে দিয়ে ইসলামের সাথে তাদের কপটতার কথা ঘোষণা করিয়েছে এবং সে সম্পর্কে হযরত যায়নাব (আ.) -এর প্রচার চিরকালের জন্য কুফর ও নিফাক এবং ইসলামী মূল্যবোধের মধ্যকার পার্থক্য তুলে ধরেছে।#আল হাসানাইন

সূত্র :মাহজুবা,মে ২০০৩,

অনুবাদ :খলিফা সাইফুল ইসলাম

‘শহীদরা হচ্ছেন সমাজে মোম বাতি। তারা নিজেদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সমাজকে আলোকিত করেন। তারা যদি আলো না ছড়ান তাহলে কোনো প্রতিষ্ঠানই আলোকিত হবে না।’ –

শহীদ আয়াতুল্লাহ মুর্তাযা মোতাহহারী

 

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)