হোসাইনী বিপ্লবের তাৎপর্য ও এর প্রভাব

ইয়াহুদী,খ্রিষ্টান ও মুসলিম-সেমেটিক ঐতিহবাহী এ তিন জাতির পিতা হযারত ইবরাহীম (আ.) যে কারণে নমরুদের বিশাল রাজশক্তির বিরুদ্ধে একাই বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, যে কারণে হযারত মুসা (আ.) তার একমাত্র সহোদর ভ্রাতা হারুনকে সাথে নিয়ে ফেরাউনের রাজাপ্রাসাদে দাড়িয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, যে কারণে মহানবী হযারত মুহাম্মাদ (সা.) মক্কার আবু জেহেল,আবু লাহাব ও আবু সুফিয়ানদের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে ছিলেন,সে একই আদর্শিক কারণে রাসূলের নয়নমনি হযারত ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াযীদের রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন ।

কেনো এ বিপ্লব?

সমাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ আর খোদাদ্রোহিতাকে সমূলে উৎপাটন করাই ছিল এসব কালজয়ী মহাপুরুষদের মূল উদ্দেশ্য খোদাদ্রোহিতার বিরুদ্ধে লড়তে হলে বস্তুগত সাজ-সরঞ্জাম না হলেও চলে। কারণ, স্বয়ং আল্লাহই তাদের সহায়। ইমাম হোসাইনও তাই ইয়াযীদের খোদাদ্রোহী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন । চরম অসহায় অবস্থার মাঝেও তিনি আপস করেননি। প্রকৃতপক্ষে তার এরূপ পদক্ষেপ ছিল পূর্ববর্তী সকল নবী - রাসূলের পদাঙ্ক অনুসরণ। বুদ্ধিজীবীদের মতে, বিদ্রোহ তখনই মানায় যখন বিদ্রোহীদের হাতে পর্যাপ্ত সাজ-সরঞ্জাম এবং শক্তি থাকে। কিন্তু নবী এবং আল্লাহর ওলীদের বেলায় আমরা এ যুক্তির কোনো প্রতিফলন দেখিনা। বরং তারা প্রায় সকলেই তাদের চেয়ে তুলনামূলক বিচারে অনেক বেশি শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন। ইমাম হোসাইন (আ.) এ নিয়মের ব্যতিক্রম নন।

ইরানের বিখ্যাত ইসলামী চিন্তানায়ক শহীদ আয়াতুল্লাহ মুর্তাযা মোতাহহারী (রহ.) বলেন : মানব সমাজে সংঘটিত অজস্র বিপ্লবের মধ্যে ঐশী বিপ্লবকে পৃথক করার দু’টি মাপকাঠি রয়েছে । প্রথমত এ বিপ্লবের লক্ষ্য ও উল্লেখ্য বিচার করলে দেখা যায়- এ সব বিপ্লব মনুষ্যত্বকে উন্নত ও উত্তম করতে, মানবতাকে মুক্তি দিতে, জুলুম ও স্বৈরাচারের মুলোৎপাটন করে মজলুমের অধিকার ফিরিয়ে দেবার জন্য পরিচালিত হয়। ব্যক্তি কিংবা ক্ষুদ্র গোষ্ঠিস্বার্থ কিংবা জাতিগত বিদ্বেষের কারণে এ বিপ্লব নয়। দ্বিতীয়ত এসব বিপ্লবের গতি-প্রকৃতি বিচার করলে দেখা যায়- এসব বিপ্লবের উদ্ভব হয় অনেকটা অলৌকিকভাবে। চার দিক যখন জুলুম-নিপীড়ন এবং অত্যাচার ও স্বৈরাচারের ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত,ঠিক সেই মূহূর্তে অন্ধকারের বুক চিরে বারুদের মতো জ্বলে ওঠে এসব বিপ্লব । চরম দুর্দশায় নিমজ্জিত হয়ে মানুষ যখন দিশেহারা হয়ে পড়ে তখন উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো মানুষের ভাগ্যাকাশে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয় এ সমস্ত ঐশী বিপ্লব । এ চরম দুর্দিনে মানবতাকে মুক্তি দেয়ার মতো দূরদর্শিতা একমাত্র ঐশী পুরুষদেরই থাকে। কিন্তু সাধারণ মানুষ ঐ পরিস্থিতিতে একেবারে হাল ছেড়ে দেয়। এমনকি কেউ প্রতিকারের উদ্যোগী হলেও তারা তাকে ভয়ে সমর্থন করতে চায় না। এ ঘটনা আমরা ইমাম হোসাইনের বিপ্লবের মধ্যেও প্রত্যক্ষ করি। তিনি যখন ইয়াযীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন তখন সমসাময়িক কালের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা এটাকে অবাস্থব ব্যাপার বলে মনে করলেন। এ কারণে তাদের অনেকেই ইমাম হোসাইনের সাথে একাত্মতা প্রকাশে বিরত থাকেন। কিন্তু ইমাম হোসাইনের ভূমিকা ছিল তখন আমাদের এক কবির ভাষায়- ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে’- অবস্থার মতো।

তাই অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অন্য কারও সহযোগিতা থাকবে কি থাকবেনা, সে দিকে ভ্রূক্ষেপ না করেই তিনি নবী -রাসূলদের মতো নিজেই আগুনের ফুল্কির ন্যায় জ্বলে উঠলেন।

বস্তুত কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (আ.) -এর এ আত্মমুক্তির বিষয়টি ছিল, ইতিহাসের একটি জ্বলন্ত অধ্যায় যা থেকে অনাদিকালের মুক্তিকামী মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে উপকৃত হবে ।

হোসাইনী বিপ্লবের মূল লক্ষ্য

হোসাইনী বিপ্লবের মূল লক্ষ্য উপলদ্ধি করতে হলে পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতের তাৎপর্য উপলদ্ধি করতে হবে । উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে :

وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ ۚ وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

অর্থাৎ ‘তোমাদের সেই উম্মত হওয়া চাই যারা সৎকাজের আদেশ করে এবং অসৎকাজে বাধা দেবে। যে উম্মতের মধ্যে এ গুণ আছে তারাই তো সফলকাম।’ (সূরা আলে-ইমরান : ১০৪)

এ আয়াতের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপের জন্য পবিত্র কুরআনে পুনরায় এরশাদ হচ্ছে :

كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ

অর্থাৎ ‘তোমরই মানব জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠ উম্মত,

কিন্তু কেনো এবং কিসের জন্য তোমাদের এ শ্রেষ্ঠত্ব ? এর জবাবে বলা হচ্ছে:

تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ

অর্থাৎ- ‘কেননা,তোমরা সৎ কাজের আদেশ কর এবং অসৎ কাজে বাধা দাও ।’ সূরা আলে-ইমরান : ১১০

বস্তুত এ ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নেহি আনিল মুনকার’ই তোমাদেরকে মানবজাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছে। অতএব,যে সমাজে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়ের প্রতিরোধ ব্যবস্থা নেই, সে সমাজ কখনও নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ উম্মত বলে দাবি করতে পারেনা।

মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘তোমরা অবশ্যই সৎ কাজের উপদেশ দেবে এবং অসৎ কাজে বাধা দান করবে,নতুবা অধর্মরাই তোমাদের কাধে চেপে বসবে।’ (ফুরুয়ে কাফী : ৪/৫৬)

ইমাম গাযযালী (র.) ‘তার এহইয়াউ উলুমে দ্বীন’ কিতাবে এ হাদিসটির একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন : ‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ’ পরিত্যাগ করলে সমাজের নিকৃষ্ট ব্যক্তিরা এতই দুর্দান্ত,পাষণ্ড,বেশরম ও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে,ভালো লোকেরা নিরুপায় হয়ে তাদের কাছে কোনো কিছু প্রত্যাশা করে । আর তারা তাদেরকে প্রত্যাখ্যান ও লাঞ্ছিত করে । তাই এ হাদিসের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা.) তার উম্মতকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেন : ‘তোমরা যদি মাথা উচু করে বাচতে চাও তবে ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নেহি আনিল মুনকার’ কায়েম কর। নতুবা তোমরা হীন-দুর্বল ও অপমানিত হবে ।’

কুরআন-হাদিসের আলোকে হযারত ইমাম হোসাইন (আ.) ইয়াযীদের শাসনের সূচনালগ্ন থেকেই এ অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। তাই ইমাম হোসাইন (আ.) বলেন :

‘আমি ক্ষমতা বা যশের লোভে কিংবা ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্য বিদ্রোহ করছি না। আমি আমার নানার উম্মতের মধ্যে সংস্কার করতে চাই। আমি চাই সৎ কাজে উদ্বুদ্ধ করতে এবং অসৎ কাজে বাধা দিতে,সর্বোপরি,আমার নানা এবং পিতা হযারত আলী (আ.) যে পথে চলেছেন,সে পথেই চলতে চাই।’ (মাকতালু খাওয়ারাযমী : ১/১৮৮)

কোনো প্রকার পার্থিব সুখ সম্ভোগের নিমিত্তে নিষ্পাপ শিশুগণসহ ইমাম হোসাইন কারবালায় শাহাদাত বরণ করেননি। মুনাফিক ইয়াযীদের বিশাল বাহিনীর সঙ্গে খেলাফতের মোহেও তিনি জিহাদ করেননি। মহানবী (সা.) প্রচারিত ইসলামকে বিশ্ববাসীর কাছে সমাদৃত ও উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত করার মহান ব্রত নিয়ে তিনি কারবালায় আত্মদান করেছেন। (আশুরা সংকলন,পৃ. ৫৯)

ইয়াযীদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ইমাম হোসাইন (আ.) কারবালায় যাননি। যুদ্ধ করার জন্যই যদি তিনি যেতেন, তাহলে শিশু ও বিবিগণকে সাথে নিয়ে কারবালায় যেতেন না। বরং আসল ও নকল মুসলমানের সঠিক পরিচিতি তুলে ধরার জন্যই তার কারবালায় আগমন। কারবালা প্রান্তরে ইমামের শেষ বাক্যাটি বড়ই তাৎপর্যপূণ। ইয়াযীদের সেনাবাহিনীতে সবাই ছিল মুসলমান । অথচ ইমাম তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে ছিলেন : ‘তোমাদের মধ্যে কি একজনও মুসলমান নেই?’ অর্থাৎ তোমরা সবাই নকল মুসলমান ।

ইমাম হোসাইনের এ বাক্যটিই সমগ্র মানব জাতিকে বুঝিয়ে দিয়েছে সকল অন্যায় ও মিথ্যার বিরুদ্ধে জেহাদ করা প্রত্যেক মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। এ পরম সত্য উপলদ্ধি করানোর জন্যই ইমামের এ শাহাদাত ।

বস্তুত নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত প্রভৃতিকেই মনে করা হয় ইসলামের মূল ভিত্তি কিন্তু মহানবী (সা.) প্রচারিত ইসলামের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে, শরীয়তের ঐ বিধি- বিধানগুলোর চেয়েও অন্তত ১০ বছর আগে অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর নবুওয়াতী জিন্দেগীর সূচনালগ্নেই ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নেহি আনিল মুনকার’- অর্থাৎ ‘ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধের’ কথা এসেছে। আমাদের রাসূল (সা.) তার নবুওয়াত প্রাপ্তির পর প্রথম ১০ বছর যে ইসলাম প্রচার করেন সে সময় নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাতের বিধান ছিল না । শরীয়তের এ বিধানগুলো আসে নবুওয়াত লাভের ১০ বছর পর মেরাজের রাত্রে । কিন্তু এর আগে তিনি দীর্ঘ১০ বছর কি করেছিলেন ? কেনো এ সময় মক্কার সমাজপতিদের সাথে তার সংঘাত হয়েছিল ? এর উত্তর হচ্ছে, মহানবী (সা.) প্রথম যে কালেমার বাণী প্রচার করেছিলেন এর মর্মবাণী ছিল মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্বকে উৎখাত করে এক আল্লাহর প্রভুত্বের ভিত্তিতে এক নয়া সমাজ বিনির্মাণ করা। মূলত এখানেই ছিল ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ। আর এ কারণেই মক্কাবাসীর সাথে তার সংঘাত হয়ে ছিল । অতএব, ইসলামে নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত প্রভৃতি রোকনগুলোর মতো ‘আমর বিল মারুফ ও নেহি আনিল মুনকার’ অন্যতম মৗলিক ভিত্তি এটা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এটা পালন না করলে নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করা যায়না।

কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের সমাজের অনেক আলেম ও বুদ্ধিজীবী ইসলামকে এভাবে উপস্থাপন করে থাকেন যে, ‘ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ও অন্যায়ের প্রতিরোধ’ করতে গিয়ে যদি জান- মালের ওপর হুমকি দেখা দেয়,তবে সেক্ষেত্রে তার উচিত ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নেহি আনিল মুনকার’ বর্জন করে জান-মাল ও ইজ্জত হেফাজত করা। এটা আসলে দুর্বল ঈমানের লক্ষণ।

কারণ হাদীসে আছে- ‘তোমরা অন্যায় কাজ হতে দেখলে হাত দিয়ে প্রতিরোধ করো,না হলে মুখ দিয়ে প্রতিবাদ করো। আর তাও সম্ভব না হলে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করো। তবে, এটা হচ্ছে দুর্বল ঈমানের লক্ষণ।’

তাই দেখা যায় রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর নয়নমনি হযারত ইমাম হোসাইন (আ.) অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করতে গিয়েই শাহাদাত বরণ করেছেন। এখানে এসেই আমরা উপলদ্ধি করতে পারি যে, ইমাম হোসাইন (আ.) ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নেহি আনিল মুনকার’- এর মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন। নিজের ও পরিবার পরিজনের জীবন উৎসর্গ করে তিনি কুরআনের এ মহান শিক্ষা তথা ইসলামের এ গুরুত্বপূর্ণ রোকনকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। হোসাইনী বিপ্লবের তাৎপর্য ও সার্থকতা এখানেই ।

উপসংহার

কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইনের শাহাদাত বরণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রামে এক অনন্যসাধারণ ঘটনা । দামেস্কের রাজক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর ইয়াযীদের ছিল বেতনভোগী এক সুসংগঠিত সেনাবাহিনী। পক্ষান্তরে, ইমাম হোসাইন (আ.) -এর এ ধরণের কোনো সেনাবাহিনী ছিল না। কিন্তু এরপরও ইমাম হোসাইন যেভাবে ইয়াযীদের শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছেন আদর্শিক লড়াইয়ের ইতিহাসে তা কেবল নবী - রাসূলের ইতিহাস ছাড়া অন্য কোনো ইতিহাসে খুজে পাওয়া যাবে না। ইয়াযীদের জন্য এটা ছিল রাজক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার লড়াই। পক্ষান্তরে, ইমাম হোসাইনের জন্য এটা ছিল আদর্শের লড়াই। ইমাম হোসাইন যদি নিজের জীবন বচানোর জন্য ইয়াযীদের হাতে বাইআত গ্রহণ করে ইসলামের অন্যতম ভিত ‘‘আমর বিল মারুফ ওয়া নেহি আনিল মুনকারের’ ব্যাপারে কোনো আপসরফায় উপনীত হতেন তাহলে ‘রাজতন্ত্র ও যুবরাজ’ প্রথারা ন্যায় একটি বিজাতীয় আদর্শ ও নিকৃষ্টতম বিদআত সেদিন ইসলামের কাছে প্রতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়ে যেত। তাই কারবালার প্রান্তরে তিনি তার জীবন দিয়েও ইসলামের এ ‘আমর বিল মারুফ ওয়া নেহি আনিল মুনকারের’ আদর্শ কে উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন।

মহামানবরা দেশ ও জাতির সীমানা পরিয়ে সমগ্র বিশ্বকে কী দিতে চান। তখন তিনি নিজের দেশ কিংবা নিজের জাতির জন্য নয়,সমগ্র মানবতাকে সেবা করতে অসীম বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখে যান। এ ধরনের ব্যক্তিত্বকে কেবল তার নিজের জাতিই সম্মান ও শ্রদ্ধা করে না, বরং বিশ্বের সকল মানুষই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে । মানবতা তাকে নিয়ে গর্ব করে। শহীদে কারবালা হযারত ইমাম হোসাইন (আ.) এ ধরণেই এক অমর ব্যক্তিত্ব ও কালজয়ী মহামানব। তার কথা, কাজ, ঘটনা -প্রবাহ, তার বিপ্লবীসত্তা সবকিছুই মানুষকে অনুপ্রেরণা দেয়। আরব- অনারব,প্রাচ্য-পাশ্চাত্য নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মুক্তিকামী মানুষের কাছেই ইমাম হোসাইন এক শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব । শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হোসাইনী বিপ্লব বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির সোপান হিসাবে পথ দেখিয়ে এসেছে। এর কারণ হলো, এ বিপ্লব ছিলো সম্পূর্ণভাবে ঐশী আদর্শে অনুপ্রাণিত। তদুপরি, এ বিপ্লবের নেতা ছিলেন এমন একজন কালজয়ী মহান বীর পুরুষ যিনি তলোয়ারের ওপরে রক্তের বিজয় এনে সত্যের পতাকা সমুন্নত রেখেছেন। মুসলিম সমাজের শিরায় শিরায় তিনি জাগিয়েছেন নতুন এক প্রাণস্পন্দন।

তাই কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইনের এ শাহাদাত তাকে মৃত্যুর মাঝে অমরত্ব দান করেছে। বনি উমাইয়্যা ভেবেছিল ইমাম হোসাইনকে হত্যা করে তারা সবকিছু চুকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শীঘ্রই তারা বুঝতে ও দেখতে পেল যে, জীবিত হোসাইনের চেয়ে মৃত হোসাইন (আ.) তাদের পথে আরও অনেক বেশি অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছেন। আরব-অনারব নির্বিশেষে বিশ্বের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের মনের মণিকোঠায় ইমাম হোসাইন এবং তার সাথীরা এক স্থায়ী আসন লাভ করলেন। অন্যদিকে ইয়াযীদ তার ঐ কীর্তির জন্য বিশ্ববাসীর কাছে চিরদিনের জন্য ঘৃণার প্রতীক হয়ে রইলো। তাই মওলানা মোহাম্মদ আলী জওহার যথার্থই বলেছেন :

‘কাতলে হোসেন আসলে মে মর্গে ইয়াযীদ হ্যায়,

ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালাকে বাদ।’

অর্থাৎ- ‘হোসাইনের হত্যাকাণ্ডের মধ্যেই ইয়াযীদের মৃত্যু নিহিত ছিল । প্রতিটি কারবালার পর এভাবেই ইসলামের উত্থান ঘটে।’

*সাবেক অধ্যাপক , ইসলামের ইতিহাস বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়