সূরা আল আনফাল; (৫ম পর্ব)

সূরা আল আনফাল; আয়াত ২২-২৫

সূরা আনফালের ২২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

إِنَّ شَرَّ الدَّوَابِّ عِنْدَ اللَّهِ الصُّمُّ الْبُكْمُ الَّذِينَ لَا يَعْقِلُونَ

“আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম জীব সেই মূক ও বধির যারা কিছুই বোঝে না।” (৮:২২)

মানুষের সঙ্গে অন্যান্য জীব-জন্তুর পার্থক্য হচ্ছে মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি আছে, আর অন্যান্য জীবজন্তুর তা নেই। কাজেই মানুষ যদি কাজে-কর্মে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার চিন্তাশক্তি বা বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগায়, চিন্তা-ভাবনা বা যাচাই-বাছাই ছাড়াই অন্যের কথায় চলতে থাকে বা অন্যকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে থাকে তাহলে এই মানুষ আর পশুর মধ্যে পার্থক্য কী থাকে? কাজেই যারা বিবেক-বুদ্ধি এবং চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগায় না, অন্যের অন্ধ অনুসরণ বা অনুকরণ করতে থাকে, নিজেও যখন কোনো কথা বলে তাতেও চিন্তা বা জ্ঞান বুদ্ধির কোনো ছাপ থাকেনা এ ধরনের মানুষকে এই আয়াতে পশুর চেয়েও অধম বলা হয়েছে। কারণ পশুর বুদ্ধিবৃত্তি বা চিন্তাশক্তিই নেই, তাই পশুর কাছ থেকে তা আশা করা যায় না। আর মানুষকে আল্লাহতালা এই শক্তি দিয়েছেন। তারপরও যারা এর মর্ম বুঝে না তারা পশুর চেয়ে নিকৃষ্টের পর্যায়ে পড়ে যায়।

সূরা আনফালের ২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 وَلَوْ عَلِمَ اللَّهُ فِيهِمْ خَيْرًا لَأَسْمَعَهُمْ وَلَوْ أَسْمَعَهُمْ لَتَوَلَّوْا وَهُمْ مُعْرِضُونَ

“আল্লাহ যদি তাদের মধ্যে ভালো কিছু দেখতেন তবে তিনি তাদেরকেও শোনাতেন, কিন্তু তিনি তাদের শোনালেও তারা উপেক্ষা করে মুখ ফেরাত।” (৮:২৩)

আগের আয়াতে বলা হয়েছিল, অনেকের কান থাকা সত্ত্বেও সত্যের আহ্বান শুনতে পায় না এবং বাকশক্তি থাকা সত্ত্বেও সত্য প্রকাশের সময় বোবা হয়ে যায়। আর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, মহান আল্লাহ এ ধরনের লোকদের অন্তরকে পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখা সত্ত্বেও তারা তাদের নিকৃষ্ট ও হীন কাজ-কর্মের মাধ্যমে সত্যকে গ্রহণ করার মন-মানসিকতা হারিয়ে বসেছে। যার ফলে তাদের মধ্যে ভালো কোন প্রবণতা অবশিষ্ট নেই। তাছাড়া, এ ধরনের লোকেরা মনে মনে সত্যকে উপলব্ধি করলেও সেটা প্রকাশ করতে মেনে নিতে চায় না।

এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, মহান আল্লাহ প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী সামর্থ দান করেন। এ ছাড়া, মহান স্রষ্টা মানুষকে সত্য গ্রহণ করতে বাধ্য করার ক্ষমতা রাখা সত্ত্বেও মানুষকে এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দিয়েছেন।

সূরা আনফালের ২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اسْتَجِيبُوا لِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيكُمْ وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَحُولُ بَيْنَ الْمَرْءِ وَقَلْبِهِ وَأَنَّهُ إِلَيْهِ تُحْشَرُونَ

“হে বিশ্বাসীগণ! রাসূল যখন তোমাদের এমন কিছুর দিকে আহ্বান করে যা তোমাদের প্রাণবন্ত করে তখন আল্লাহ ও রাসূলের আহ্বানে সাড়া দেবে এবং জেনে রাখ যে, আল্লাহ মানুষ ও তার হৃদয়ের অন্তর্বর্তী স্থানে অবস্থান করেন এবং তারই নিকট তোমাদের একত্রিত করা হবে।” (৮:২৪)

এ আয়াতে মানুষকে এমন একটি জীবনের দিকে আহ্বান করা হচ্ছে, যা কিনা পার্থিব জীবনের সীমাবদ্ধতার অনেক উর্ধ্বে এবং যে জীবনের মাধ্যমে মানুষ চিন্তা-চেতনা, বুদ্ধি-বিবেক এবং আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে চরম উতকর্ষতা অর্জন করতে পারবে। আর এ জীবন লাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে-আল্লাহর ডাকে সাড়া দেয়া এবং নবীদের পথ-নির্দেশনা মেনে চলা। সূরা নাহলের ৯৭ নম্বর আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে, “পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকর্ম করবে সে যদি বিশ্বাসী বা ঈমানদার হয় তাকে আমি নিশ্চয়ই আনন্দময় জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।"

এ আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হচ্ছে, তোমাদের অন্তরে যা কিছুই থাকুক না কেন, তোমরা তা ব্যক্ত না করলেও আল্লাহ তা পুরোপুরি জানেন। এ ছাড়া কিয়ামত বা পুনরুত্থান দিবসে সব মানুষকেই আল্লাহর কাছে একত্রিত করা হবে। কাজেই এ পৃথিবীতে এমনকি মৃত্যুপরবর্তী জীবনের কোনো কিছুই আল্লাহর অগোচর নয়। কুরআনের অন্য একটি আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে মহান আল্লাহ মানুষের অতি নিকটে আছেন।

সূরা আনফালের ২৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَاتَّقُوا فِتْنَةً لَا تُصِيبَنَّ الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْكُمْ خَاصَّةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ

“তোমরা ধর্মদ্রোহীতাকে ভয় কর, যা বিশেষ করে তোমাদের মধ্যে যারা জালিম কেবল তাদেরই ক্লিষ্ট করবে না এবং জেনে রাখ যে, আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।” (৮:২৫)

যে সব অন্যায় বা পাপ কাজ  মানুষের ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে সেসবের শাস্তি কেবল পাপী ব্যক্তিকেই ভোগ করতে হয়। কিন্তু কিছু কিছু পাপ বা অন্যায় সমাজকেও প্রভাবিত করে এবং সমাজ এর দ্বারা কলুষিত হয়ে পড়ে। এ আয়াতে বলা হচ্ছে, যেসব অন্যায় বা মন্দ কাজ সমাজে প্রকাশ্যে হয়ে থাকে এবং তার বিরুদ্ধে কথা বলার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যারা এর প্রতিবাদ না জানিয়ে নিরবতা অবলম্বন  করবে তার পরিণামে শাস্তি সমাজের প্রত্যেককেই ভোগ করতে হবে। কাজেই সমাজের যে কোনো অন্যায় কলুষতা বা বিপথগামিতার ব্যাপারে সবাইকেই সচেতন ও সোচ্চার হতে হবে। এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, ঐশি শিক্ষা থেকে বিমুখ ব্যক্তি বা সমাজের ধ্বংস অনিবার্য। এ ছাড়া, যে কোনো বিশ্বাসী ব্যক্তির উচিত অন্যায় বা মন্দ কাজ থেকে অন্যকে বিরত থাকার সুপরামর্শ দেয়া।