সূরা আল আনফাল;(৮ম পর্ব)

সূরা আল আনফাল; আয়াত ৩৪-৩৭

সূরা আনফালের ৩৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَمَا لَهُمْ أَلَّا يُعَذِّبَهُمُ اللَّهُ وَهُمْ يَصُدُّونَ عَنِ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَمَا كَانُوا أَوْلِيَاءَهُ إِنْ أَوْلِيَاؤُهُ إِلَّا الْمُتَّقُونَ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لَا يَعْلَمُونَ

“এবং তাদের কী-বা বলার আছে যে, আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেন না যখন তারা লোকদেরকে মসজিদুল হারাম হতে নিবৃত্ত করে? যদিও তারা এর তত্ত্বাবধায়ক নয়। মুত্তাকীগণই এর তত্ত্বাবধায়ক কিন্তু তাদের অধিকাংশই এটা সম্পর্কে অবগত নয়।” (৮:৩৪)

গত পর্বে আমরা এ সূরার আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছি, আল্লাহর নবীর উপস্থিতির কারণে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার জাতি বা গোষ্ঠীকে শাস্তি দেয়া থেকে বিরত থেকেছেন। আল্লাহর নবী বা পয়গম্বরদের উপস্থিতি কোনো জাতি বা জনগোষ্ঠীর উপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের শামিল। আর সূরা আনফালের ৩৪ নম্বর আয়াতে মুসলমানদের ওপর মক্কার মুশরিকদের অত্যাচার ও নিপীড়নের খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। মক্কার কাফের ও মুশরিকরা মুসলমানদেরকে কাবা ঘরের পাশে নামাজ ও ইবাদত করতে দিত না। মুসলমানরা সেখানে নামাজ পড়তে গেলে কাফেরদের তীব্র বিরোধিতা এবং নানা ধরনের অত্যাচারের মুখোমুখি হতেন। এমনকি তারা মুসলমানদের হজ্জ বা ওমরাহ করারও সুযোগ দিত না। তারা নিজেদেরকে কাবা ঘরের তত্ত্বাবধায়ক মনে করতো। এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, মুশরিকদেরকে তাদের এসব কাজের জন্য অবশ্যই শাস্তি দেয়া হবে। তারা নিজেদেরকে এমন এক পবিত্র স্থানের অভিভাবক ভাবছে যার উপযুক্ত তারা নয়। মসজিদুল হারাম বা কাবাঘর হচ্ছে আল্লাহর ঘর। মুশরিকরা জোর করে অন্যায়ভাবে এর দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করলেও তারা কোনোভাবেই এর তত্ত্বাবধায়ক নয়। তারা তাদের অন্যায় আচরণের জন্য কেবল পরকালেই শাস্তি ভোগ করবে না, এ দুনিয়াতেও তারা নানা রকম বিপদ ও বালা-মুসিবতে জর্জরিত থাকবে।

এ আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, সতকর্মশীল এবং মুত্তাকিরাই কেবল মসজিদ বা আল্লাহর ঘর দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করতে পারেন। যারা মুমিন লোকদেরকে আল্লাহর ঘর বা মসজিদে প্রবেশে বাধা দেয় আল্লাহ তাদেরকে কঠিন শাস্তি দেবেন। আজ মুসলমানদের প্রথম কেবলা আল কুদস মসজিদ, বিশ্ব ইহুদিবাদি চক্র বিশেষ করে আগ্রাসী ইসরাইলের হাতে বন্দি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ইহুদিবাদি সেনাদের বুটের আঘাতে আল কুদস মসজিদ প্রতিদিনই অপবিত্র হচ্ছে। ইহুদিবাদি ইসরাইল কেবল আল কুদসকেই অমর্যাদা করছে না তারা ফিলিস্তিনের নিরীহ জনগণের উপর বছরের পর বছর ধরে অত্যাচার ও নিস্পেষণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে এ পবিত্র মসজিদ জিয়ারত করতে দিচ্ছে না। অথচ বিশ্বের সব মুসলমানই আল্লাহর ঘর বা মসজিদে প্রবেশের অধিকার রাখেন।

এই সূরার ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 وَمَا كَانَ صَلَاتُهُمْ عِنْدَ الْبَيْتِ إِلَّا مُكَاءً وَتَصْدِيَةً فَذُوقُوا الْعَذَابَ بِمَا كُنْتُمْ تَكْفُرُونَ

“কাবা গৃহের কাছে শুধু শিস ও করতালি দেয়াই তাদের নামাজ, সুতরাং কুফরির জন্য তোমরা শাস্তি ভোগ কর।” (৮:৩৫)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এ আয়াতে মসজিদুল হারামের অভিভাবক বা তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে মুশরিকদের অযোগ্যতার কারণ বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মুশরিকরা কাবাঘরের পাশে নাচ-গান, করতালি বা শিস দেয়াকে নিজেদের ইবাদত বা প্রার্থনা বলে অভিহিত করলেও মহান আল্লাহর কাছে তা মোটেও গ্রহণযোগ্য ছিল না। আজও মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমানরা একটি নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো হয়ে আল্লাহর ইবাদতের ছলে নাচ-গান, লাফালাফি বা সামা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। অথচ ইসলামী নীতি-আদর্শ বা সংস্কৃতির সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

সূরা আনফালের ৩৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ لِيَصُدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ فَسَيُنْفِقُونَهَا ثُمَّ تَكُونُ عَلَيْهِمْ حَسْرَةً ثُمَّ يُغْلَبُونَ وَالَّذِينَ كَفَرُوا إِلَى جَهَنَّمَ يُحْشَرُونَ

“নিশ্চয় যারা অবিশ্বাসী, আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য তারা তাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, তারা ধন-সম্পদ ব্যয় করতেই থাকবে। অতঃপর তা তাদের মনস্তাপের কারণ হবে। এরপর তারা পরাভূত হবে এবং যারা অবিশ্বাস করে তাদের জাহান্নামে একত্রিত করা হবে।” (৮:৩৬)

এ আয়াতে রাসূলে খোদার বিরুদ্ধাচরণ ও তার ততপরতায় বাধা সৃষ্টির জন্য মক্কার কাফেররা যে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ বরাদ্দ করেছিল তার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কাফের ও মুশরিকরা যুক্তি ও তর্কের মাধ্যমে নবীজিকে হার মানাতে না পেরে সাধারণ মানুষকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখার জন্য এবং ইসলাম ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করবার জন্য বহু টাকা-কড়ি ব্যয় করে। কিন্তু অচিরেই তারা অনুতপ্ত হবে যখন দেখবে তাদের অর্থ-সম্পদ কোনো কাজে আসেনি এবং কার্যত: তাদের সমস্ত প্রচেষ্টা নিস্ফল হয়েছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, অনুতাপ ও হতাশা হচ্ছে তাদের পার্থিব পরিণতি কিন্তু পরকালে তাদের জন্য কঠোর শাস্তি অপেক্ষা করছে।

এ আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ইসলামের শত্রুরা বাহ্যত: তাদের বিরুদ্ধাচরণ ও হীন ততপরতা বন্ধ রাখলেও গোপনে তারা ঠিকই ইসলাম ও মুসলমানদের ধ্বংসের জন্য ততপর এমনকি এ কাজে তারা বিপুল অর্থও ব্যয় করছে। অবশ্য এ জন্য মুসলমানদের হতাশ হলে চলবে না। কারণ ব্যাপক প্রভাব প্রতিপত্তি ও ধন-সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কাফেরদের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।

সূরা আনফালের ৩৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 لِيَمِيزَ اللَّهُ الْخَبِيثَ مِنَ الطَّيِّبِ وَيَجْعَلَ الْخَبِيثَ بَعْضَهُ عَلَى بَعْضٍ فَيَرْكُمَهُ جَمِيعًا فَيَجْعَلَهُ فِي جَهَنَّمَ أُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ

“এটা এই জন্য যে, আল্লাহ কুজনকে সুজন হতে পৃথক করবেন এবং কুজনদের একে অন্যের ওপর রাখবেন, অতঃপর সবাইকে স্তুপীকৃত করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন-এরাইতো ক্ষতিগ্রস্ত।” (৮:৩৭)  

আগের আয়াতে ইসলামের শত্রুদের নান ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কথা বলার পর এ আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির কারণেই সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব বা লড়াই হয়ে থাকে। আর এটা এই জন্য যে, মহান আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করতে চান। তিনি দেখতে চান কারা সত পথের অনুসারী হয়ে নিজেদেরকে পবিত্র করেছে আর কারা নিজেদের প্রবৃত্তি বা কামনা-বাসনার দাসত্ব করে নিজেদেরকে পাপের কালিমায় লিপ্ত করেছে। অসত ও পাপী ব্যক্তিরা কেবল এ পৃথিবীতেই তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করবে না, পরকালেও তারা নিগৃহীত হবে এবং অত্যন্ত হেয়ভাবে তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।