সূরা আল আনফাল;(৯ম পর্ব)

সূরা আল আনফাল; আয়াত ৩৮-৪১

সূরা আনফালের ৩৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

قُلْ لِلَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ يَنْتَهُوا يُغْفَرْ لَهُمْ مَا قَدْ سَلَفَ وَإِنْ يَعُودُوا فَقَدْ مَضَتْ سُنَّةُ الْأَوَّلِينَ

“যারা কুফরি বা অবিশ্বাস করে তাদেরকে বলে দাও, যদি তারা বিরত হয় তবে যা অতীতে হয়েছে আল্লাহ তা ক্ষমা করবেন, কিন্তু তারা যদি অন্যায়ের পুণরাবৃত্তি করে তবে পূর্ববর্তীদের দৃষ্টান্ত তো রয়েছে।” (৮:৩৮)

মানুষের প্রতি সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বিশেষ একটি অনুগ্রহ হচ্ছে, তিনি মানব জাতির জন্য তওবা বা অনুশোচনার একটি রাস্তা খোলা রেখেছেন। কেউ ভুল বা পাপ করে সত্যি সত্যিই অনুতপ্ত হয়ে মন থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমার আকুতি জানালে মহান প্রতিপালক আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। এই তওবা মুমিন মুসলমানদের জন্য যেমন প্রযোজ্য তেমনি কোনো অবিশ্বাসী কাফের যদি সত্যের দিকে ফিরে আসে এবং তার অতীত জীবনের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চায় তাহলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। এই আয়াতে এটা বলা হচ্ছে যে, কোনো অবিশ্বাসী কাফের যখন ইসলাম গ্রহণ করে এবং সত্যের দিকে ফিরে আসে তখন তার অতীতের সব গুণাহ বা পাপ মাফ হয়ে যায়। হাদিস শরীফেও বলা হয়েছে, ‘ইসলাম গ্রহণের ফলে অতীতের গুণাহ মাফ করে দেন আল্লাহ। এজন্য নওমুসলিমের জন্য নামাজ রোজা বা অন্য এবাদতের ক্বাজা করতে হয় না।’

আয়াতের পরের অংশে অবশ্য সতর্ক করে দিয়ে বলা হচ্ছে, যদি তারা ভুল পথে চলা অব্যাহত রাখে বা কেউ যদি অতীত জীবনের দিকে ফিরে যায় তাহলে তার সঙ্গে এমন কঠিন আচরণ করা হবে যা এর আগে উদ্ধত কাফেরদের সঙ্গে করা হয়েছে। এ কথায় বোঝানো হচ্ছে- অতীতে যারা নবী-রাসূল বা আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তিদের সাথে শত্রুতা করেছে ইহকালেই নানা অশান্তি ও বিপদে অক্রান্ত হয়েছে তাদেরকেও একই পরিণতি ভোগ করতে হবে।

সূরা আনফালের ৩৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لَا تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ فَإِنِ انْتَهَوْا فَإِنَّ اللَّهَ بِمَا يَعْمَلُونَ بَصِيرٌ

“তোমরা তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে থাকবে যতক্ষণ না ফেতনা দূর হয় এবং আল্লাহর ধর্ম সামগ্রীকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারা যদি বিরত হয় তবে তারা যা করে নিশ্চয়ই আল্লাহ তা দেখেন।” (৮:৩৯)

আগের আয়াতে অবিশ্বাসী কাফেরদেরকে ইসলাম গ্রহণ, তওবা এবং সত্যের দিকে ফিরে আসার আহ্বান জানানোর পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে, তারা যদি এরপরও সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে চলে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত অব্যাহত রাখে তাহলে তোমরা অর্থাত মুমিন মুসলমানদের উচিত তাদের বিরুদ্ধে তাদের মোকাবেলায় অবতীর্ণ হওয়া যতক্ষণ না ফেতনা দূর হয় এবং সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান সময়ে ইসলামের জিহাদের বিধানের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, আবার একদল মানুষ জিহাদের নামে নিরীহ মানুষের জীবন বিপন্ন করে চলেছে। জিহাদের অর্থ দেশ জয় করা নয়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যুদ্ধের মাধ্যমে কোনো জাতিকে পদানত করা নয়। বরং অন্যায় অবিচার ও অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে বিশ্ব সমাজকে মুক্ত করার জন্য ইসলাম জিহাদের বিধান দিয়েছে। ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য জিহাদ করতে বলা হয়েছে। যেটা আল্লাহর বিধান কায়েমের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব।

এই আয়াতে ফেতনা দূর না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম করতে বলা হয়েছে। ‘ফেতনা’ শব্দটি পবিত্র কুরআনে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হলেও এই আয়াতে ফেতনার অর্থ বলতে মুফাসসিরগণ মনে করেন, ‘ফেতনা’ বলতে শেরক বা আল্লাহর সাথে অংশীস্থাপন করা এবং মুসলমানদের ওপর কাফের মুশরিকদের রাজনৈতিক ও মানসিক চাপকে বোঝানো হয়েছে। অমুসলিম কাফেররা মুসলিম দেশ এবং জাতিগুলোকে পদানত করতে এবং তাদেরকে শাসন ও শোষণ করার উদ্দেশ্যে যে চাপ সৃষ্টি করে থাকে-মুফাস্সেরগণ মনে করেন এটিও ফেতনা।

এই সূরার ৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ مَوْلَاكُمْ نِعْمَ الْمَوْلَى وَنِعْمَ النَّصِيرُ

“আর যদি তারা মুখ ফেরায় তবে জেনে রাখো যে, আল্লাহই তোমাদের অভিভাবক এবং উত্তম অভিভাবক এবং কত উত্তম সাহায্যকারী।” (৮:৪০)

দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এমন একটি রোগ যা কম বেশি প্রায় সকল মানুষের মধ্যেই আছে। অনেকেই দেখা যায় খুব ঘন ঘন সিদ্ধান্ত বা মত পাল্টান। আজ এই দলের সঙ্গে আবার কাল অন্য দলের সঙ্গে। আজ এই আদর্শ নিয়ে কথা বলছেন আবার কাল পুরোপুরি এই আদর্শের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। অনেকেই আজ মুসলমান আবার দু’দিন পর মুসলমানদের শত্রুপক্ষের সঙ্গে সুর মিলাচ্ছেন।

আল্লাহ এই আয়াতে প্রকৃত মুমিন মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে বলছেন, আক্বিদা-বিশ্বাসের ব্যাপারে কারো কারো দোদুল্যপনা দেখে মুমিনরা যেন নিজেদের আদর্শের ব্যাপারে সন্দিহান বা হতাশ না হন। সিসাঢালা প্রাচীরের মত তারা যেন ঈমান ও আকিদার ব্যাপারে অটল অবস্থান নেন। কারণ মহান আল্লাহ মহান প্রতিপালক হচ্ছেন মুমিনদের অভিভাবক এবং সাহায্যকারী। কাজেই সমাজের সবাই যদি মুমিনদের বিরুদ্ধে চলে যায় এবং তাদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগে তাহলেও উদ্বেগের কিছু নেই। কারণ মুমিন মুসলমানদের সঙ্গে আল্লাহ আছেন এবং থাকবেন।

এই সূরার ৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَاعْلَمُوا أَنَّمَا غَنِمْتُمْ مِنْ شَيْءٍ فَأَنَّ لِلَّهِ خُمُسَهُ وَلِلرَّسُولِ وَلِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَابْنِ السَّبِيلِ إِنْ كُنْتُمْ آَمَنْتُمْ بِاللَّهِ وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَى عَبْدِنَا يَوْمَ الْفُرْقَانِ يَوْمَ الْتَقَى الْجَمْعَانِ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

“জেনে রাখো যা তোমরা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বা গণিমত হিসেবে গ্রহণ কর, তার এক পঞ্চমাংশ আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল, রাসূলের স্বজন, পিতৃহীন এতিম, দরিদ্র এবং পথচারীদের জন্য, যদি তোমরা আল্লাহর ওপর এবং মীমাংসার দিন (বদরের দিন) দুই দল যখন পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিল, আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছিলাম তাতে বিশ্বাস কর এবং আল্লাহ সর্ব বিষয়ে শক্তিমান।” (৮:৪১)

আগের আয়াতে জিহাদের নির্দেশ দেয়ার পর এই আয়াতে বলা হচ্ছে, যুদ্ধের মাধ্যমে যে সম্পদ হস্তগত হয় তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী ব্যয় করতে হবে। যুদ্ধ করার উদ্দেশ্য যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি হয়ে থাকে তাহলে আল্লাহ যেভাবে নির্দেশ করবেন সেভাবেই সব হতে হবে। সবাই যেহেতু মানুষ তাই এমনও হতে পারে যে, একজন মুমিন অত্যাচার এবং শোষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে এবং সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। কিন্তু বস্তুগত স্বার্থ যেমন অর্থ-সম্পদের সামনে গিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে যেতে পারেন, অর্থ-কড়ি ও সম্পদের মোহে পড়ে আল্লাহর রাস্তায় দান করার ব্যাপারে অনিহা প্রকাশ করতে পারেন। তাই এই আয়াতে বলা হচ্ছে, ইসলামী রাষ্ট্রের পরিচালনা, এতিম ও দরিদ্র মানুষকে সাহায্য ও পুনর্বাসনের কাজে খুমস বা এক পঞ্চমাংশ আল্লাহর রাসূলের হাতে দিয়ে দিতে হবে। আলেমদের অনেকেই মনে করেন, খুমস বা এক-পঞ্চমাংশ দান করা শুধু গণিমতের মাল থেকেই নয় বরং প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে তার উপার্জনের এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর রাস্তায় দান করা।

আহলে বাইতের ঈমামগণ থেকে যেসব বর্ণনা এসেছে তাতে দেখা যায়, একজন মুমিনের কর্তব্য হচ্ছে- তার উপার্জনের এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেয়া। আর এই দান তুলে দিতে হবে বর্তমান সময়ের ফকিহ আলেমদের হাতে, যারা ওয়ারেসাতুল আম্বিয়া বা নবী করিম (দ.) এর উত্তরসূরী। ফকিহ আলেমগণ মুমিনদের এই দান ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কাজে এবং এতিম ও দরিদ্র মানুষের কল্যাণসহ আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করবেন।