সূরা আল আনফাল;(১০ম পর্ব)

সূরা আল আনফাল; আয়াত ৪২-৪৫

সূরা আনফালের ৪২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

إِذْ أَنْتُمْ بِالْعُدْوَةِ الدُّنْيَا وَهُمْ بِالْعُدْوَةِ الْقُصْوَى وَالرَّكْبُ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلَوْ تَوَاعَدْتُمْ لَاخْتَلَفْتُمْ فِي الْمِيعَادِ وَلَكِنْ لِيَقْضِيَ اللَّهُ أَمْرًا كَانَ مَفْعُولًا لِيَهْلِكَ مَنْ هَلَكَ عَنْ بَيِّنَةٍ وَيَحْيَا مَنْ حَيَّ عَنْ بَيِّنَةٍ وَإِنَّ اللَّهَ لَسَمِيعٌ عَلِيمٌ

“স্মরণ কর! তোমরা ছিলে উপত্যকার নিকট প্রান্তে এবং তারা ছিল দূর প্রান্তে। আর উষ্ট্রারোহী দল ছিল তোমাদের চেয়ে নিম্ন ভূমিতে, যদি তোমরা পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত করতে চাইতে তবে এ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটতো, কিন্তু বস্তুত: যা ঘটার ছিল আল্লাহ তা সম্পন্ন করার জন্য উভয় দলকে যুদ্ধক্ষেত্রে (সমবেত করলেন) যাতে যে কেউ ধ্বংস হবে সে যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট প্রকাশের পর ধ্বংস হয় এবং যে জীবিত থাকবে সে যেন, সত্যাসত্য স্পষ্ট প্রকাশের পর জীবিত থাকে, নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।” (৮:৪২)

সূরা আনফালের শুরু থেকেই এর বিভিন্ন আয়াতে বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করা হয়েছে। আর এ আয়াতে বদর যুদ্ধের স্থানের ভৌগোলিক অবস্থান, যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী ও শত্রু সেনাদের প্রস্তুতি এসব বিষয়ে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, তোমরা ছিলে দুই দল শত্রু সেনাদের মাঝখানে। একদল শত্রুসেনা যারা কিনা মক্কা থেকে রওনা হয়েছিল এবং অস্ত্রে-শস্ত্রে যারা ছিল পুরোপুরি সুসজ্জিত। আরেক দল ছিল মুশরিক বণিকগণ যারা মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেছিল। তোমরা মুশরিক বণিক দলের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের মালামাল গণিমত হিসেবে নিয়ে যুদ্ধ শেষ করতে চেয়েছিলে। কিন্তু মহান স্রষ্টা চান মুসলমানরা যেন অস্ত্রে সুসজ্জিত শত্রু বাহিনীর মুখোমুখি হয় এবং ঐশি মদদে তাদেরকে পরাজিত করে যাতে করে নিজেদের ঈমান ও মনোবল দৃঢ় করার পাশাপাশি শত্রুদের জন্যও মুসলমানদের দাবির সত্যতা প্রমাণিত হয় এবং যারা সত্য পথের সন্ধান পেতে চায় তারা যেন ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করে। আর যারা এ ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করবে তারাও যেন বুঝেশুনেই তা করে।

এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় মূলত: ইসলামের সত্যতার অন্যতম নিদর্শন এবং শিরক ও খোদাদ্রোহীতার অসারতা প্রমাণকারী। এ আয়াতের আরেকটি শিক্ষা হচ্ছে, যুক্তি ও যথার্থ দলিল-প্রমাণহীন অন্ধ ঈমানের চেয়ে জ্ঞান ও সচেতনতার সাথে আনা ঈমান বেশি মূল্যবান।

সূরা আনফালের ৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 إِذْ يُرِيكَهُمُ اللَّهُ فِي مَنَامِكَ قَلِيلًا وَلَوْ أَرَاكَهُمْ كَثِيرًا لَفَشِلْتُمْ وَلَتَنَازَعْتُمْ فِي الْأَمْرِ وَلَكِنَّ اللَّهَ سَلَّمَ إِنَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ

“স্মরণ কর, আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নে দেখিয়েছিলেন যে তারা সংখ্যায় অল্প, যদি তোমাকে দেখাতেন যে তারা সংখ্যায় অধিক তবে তোমরা সাহস হারাতে এবং যুদ্ধ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের রক্ষা করেছেন এবং অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে তিনি বিশেষভাবে অবহিত।” (৮:৪৩)

মুসলিম বাহিনী যুদ্ধের আগের রাতেও ভালো ঘুমাতে পারতো। যুদ্ধের দুশ্চিন্তা মাথায় থাকা অবস্থায় ঘুম আসাটা খুব কঠিন। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায়, মুসলিম বাহিনী যুদ্ধের আগের রাতেও বিভোর নিদ্রায় কাটিয়েছেন, এটা আসলে মুসলিম বাহিনীর প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত বা অনুগ্রহ ছিল। কারণ এই ঘুমের ফলে মুসলিম বাহিনী ক্লান্তি ও অবসাদ কাটিয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে এই আয়াতে বলা হচ্ছে, আল্লাহতালা নবী করিম (দ.) কে স্বপ্নে দেখান যে, শত্রুবাহিনী বিশাল হলেও তারা দুর্বল এবং বিচলিত। আল্লাহর রাসূল মুসলমানদেরকে তাঁর স্বপ্নের কথা বলেছেন। এতে মুসলমানদের মনে সাহস ও দৃঢ়তা ফিরে আসে এবং শত্রুপক্ষ সংখ্যায় অনেক বেশি হওয়ায় যে দুশ্চিন্তা ছিল তা মুসলমানদের মন থেকে দূর হয়ে যায়।

এই সূরার ৪৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 وَإِذْ يُرِيكُمُوهُمْ إِذِ الْتَقَيْتُمْ فِي أَعْيُنِكُمْ قَلِيلًا وَيُقَلِّلُكُمْ فِي أَعْيُنِهِمْ لِيَقْضِيَ اللَّهُ أَمْرًا كَانَ مَفْعُولًا وَإِلَى اللَّهِ تُرْجَعُ الْأُمُورُ

“স্মরণ কর যখন তোমরা শত্রুর সম্মুখীন হয়েছিলে তখন আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের দৃষ্টিতে স্বল্প সংখ্যক দেখিয়েছিলেন এবং তোমাদেরকেও তাদের দৃষ্টিতে স্বল্প সংখ্যক দেখিয়েছিলেন যা ঘটবার ছিল তা সম্পন্ন করার জন্য। সমস্ত বিষয় আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তিত হয়।” (৮:৪৪)

আল্লাহর রাসূলের স্বপ্ন দেখা ছাড়াও বাস্তবে মুসলিম বাহিনী যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে অত্যন্ত নগন্য দেখছিল, ফলে তাদের শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি পেয়েছিল। অপরদিকে, কাফের বাহিনীর চোখেও মুসলমানদের সংখ্যা খুব নগন্য মনে হচ্ছিল। ফলে বিজয়ের আশায় উদ্ধত হয়ে পড়ে এবং প্রতিপক্ষকে অবহেলা করে ফলে তাদের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে।

সূরা আনফালের ৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُوا وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

“হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা যখন কোনো দলের সম্মুখীন হবে তখন অবিচলিত থাকবে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলকাম হও।” (৮:৪৫)

এ আয়াতে মহান আল্লাহ মুমিনদের উদ্দেশ্য করে বলছেন, আমি যেভাবে নিজ অনুগ্রহে তোমাদের সাহায্য করেছি এবং নানা বিপদ-আপদ থেকে তোমাদের উদ্ধার করেছি ঠিক তেমনিভাবে তোমরাও নিজেদের দায়িত্বে অবহেলা করবে না এবং সত্যের পথে অবিচল থাকবে। সবসময় খোদার অনুগ্রহ এবং তার দয়া ও করুণার কথা মনে রাখবে, এতে তোমাদের ঈমানের দৃঢ়তা বাড়বে এবং শত বাধা-বিপত্তি এলেও ধর্ম ও আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হবে না।

এ আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, দৃঢ়তা হচ্ছে ঈমানের অন্যতম শর্ত। যে কোনো বিপদ-আপদ কিংবা সংকটাপন্ন অবস্থায়ও সত্যের পথে অবিচল থাকতে হবে। যুদ্ধের ময়দানে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে জয় লাভের ক্ষেত্রেও ধৈর্য্য এবং দৃঢ়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ আয়াত থেকে আমরা এও বুঝতে পারি যে, আল্লাহর স্মরণ মানুষকে স্বার্থপরতা থেকে মুক্তি দেয়। যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর মোকাবেলায় বিজয় লাভের ফলে মুসলমানদের মধ্যে যেন অহংকারবোধ জন্ম না নেয়। এজন্য আল্লাহর স্মরণের কথা বলা হয়েছে।