সূরা আল আনফাল;(১৩তম পর্ব)

সূরা আল আনফাল; আয়াত ৫৫-৫৯

সূরা আনফালের ৫৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

إِنَّ شَرَّ الدَّوَابِّ عِنْدَ اللَّهِ الَّذِينَ كَفَرُوا فَهُمْ لَا يُؤْمِنُونَ

"নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট নিকৃষ্ট জীব তারাই যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে এবং অবিশ্বাস করে।" (৮:৫৫)

আগের পর্বে আমরা পয়গম্বরদের প্রচারিত বাণীর ব্যাপারে অবিশ্বাসী কাফেরদের বিদ্রুপাত্মক কথাবার্তা এবং তাদের আচরণ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এই আয়াতে মূলত: এটাই বলা হচ্ছে যে, অবিশ্বাসী কাফেররা সত্যের বাণীকে অবজ্ঞা করে এবং নবী-রাসূলদেরকে বিদ্রূপ করে মানবীয় মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। তারা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে নিকৃষ্ট জীবের মত। এই সূরারই ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যারা সত্য জানার এবং বোঝার জন্য জ্ঞান ও বিবেককে কাজে লাগায় না, যারা এ নিয়ে চিন্তা করে না তারা আল্লাহর কাছে নিকৃষ্ট জীবের মত। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, "যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে এবং তা বিশ্বাস করে না তারা নিকৃষ্ট জীবের মত। কাজেই সমাজে অবিশ্বাসী কাফেরদের বাহ্যত অর্থ-সম্পদ বা প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকলেও প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে এদের কোনো মান-মর্যাদা নেই।

এই আয়াত থেকে বোঝা যায়- একজন মানুষের মর্যাদা তার ঈমান, বিশ্বাস ও বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের ওপর নির্ভর করে। কারণ পৃথিবীতে বিচরণশীল জীবজন্তু পরিবেশ ও মানব জীবনের জন্যই যে শুধু প্রয়োজন তাই নয় কোনো কোনো প্রাণী মানব জীবনের জন্য অপরিহার্য্য। কিন্তু মানুষের মধ্যে যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে এবং বিবেক, বুদ্ধি ও জ্ঞানকে কাজে লাগায় না তারা এসব জীব-জন্তুর  চেয়েও নিকৃষ্ট।

সূরা আনফালের ৫৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

الَّذِينَ عَاهَدْتَ مِنْهُمْ ثُمَّ يَنْقُضُونَ عَهْدَهُمْ فِي كُلِّ مَرَّةٍ وَهُمْ لَا يَتَّقُونَ

"ওদের মধ্যে তুমি যাদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ তারা প্রত্যেকবার তাদের চুক্তি ভঙ্গ করে এবং তারা সাবধান হয় না।"(৮:৫৬)

এই আয়াতে আল্লাহর রাসূলের সঙ্গে মদিনার ইহুদিদের সম্পর্কের বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ওরা প্রতিজ্ঞা করেছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে মক্কার মুশরিকদেরকে সাহায্য করবে না এবং মুসলমানদের বিপদ বা কষ্ট হবে এমন কোনো কাজ করবে। কিন্তু দেখা গেল তারা বারবারই তাদের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছে। এমনকি মক্কার মুশরিকদেরকে সাহায্য করে তারাই খন্দক যুদ্ধের পথ উন্মুক্ত করেছিল।

যদিও এই আয়াতে প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা অবিশ্বাসী কাফেরদের অভ্যাস বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তবে অনেক হাদিসে বলা হয়েছে- মুনাফিক বা কপট ব্যক্তিদের চরিত্র হচ্ছে তারা তাদের প্রতিজ্ঞা এবং প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না। এই আয়াতের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে এটা বোঝানো হয়েছে যে, কাফের মুশরিকদের সঙ্গে চুক্তি করা বৈধ এবং যতদিন তারা সে চুক্তি মেনে চলবে  মুসলমানরা তা লঙ্ঘন করতে পারবে না।

এ সূরার ৫৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

فَإِمَّا تَثْقَفَنَّهُمْ فِي الْحَرْبِ فَشَرِّدْ بِهِمْ مَنْ خَلْفَهُمْ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُونَ

"যুদ্ধে তোমরা যদি ওদেরকে নিজেদের আয়ত্বের মধ্যে পাও তবে ওদের পশ্চাতে যারা আছে তাদের হতে বিচ্ছিন্ন করে ওদেরকে এমনভাবে বিধ্বস্ত করবে যাতে ওরা শিক্ষা লাভ করে।" (৮:৫৭)

আগের আয়াতে কাফের-মুশরিকদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং চুক্তি লংঘনের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, অবিশ্বাসী কাফের-মুশরিকরা যেহেতু তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মুসলমানদের ক্ষতি করার বা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে তাই তাদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্য মুসলমানদেরকে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। এমন শিক্ষা দিতে হবে যাতে তাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয় এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বা যুদ্ধ করার চিন্তাও যেন তাদের মাথায় না আসে।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, মুসলমানদের পদক্ষেপ হচ্ছে সম্পূর্ণ আত্মরক্ষামুলক। যখন অমুসলিম, কাফের মুশরিকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বা যুদ্ধ শুরু করবে কিংবা চুক্তি ভঙ্গ করবে তখনই মুসলমানদেরকে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য উপদেশ দেয়া হয়েছে।

সূরা আনফালের ৫৮ ও ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِمَّا تَخَافَنَّ مِنْ قَوْمٍ خِيَانَةً فَانْبِذْ إِلَيْهِمْ عَلَى سَوَاءٍ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْخَائِنِينَ (58) وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا سَبَقُوا إِنَّهُمْ لَا يُعْجِزُونَ

"যদি তুমি কোন সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ভঙ্গের আশঙ্কা কর তবে তোমার চুক্তিও তুমি যথাযথভাবে বাতিল করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বাস ভঙ্গকারীদেরকে পছন্দ করেন না।” (৮:৫৮)

“আর অবিশ্বাসী কাফেররা যেন মনে না করে যে, তারা পরিত্রাণ পেয়েছে। নিশ্চয়ই তারা সত্য অনুসারীগণকে হতবল করতে পারবে না।" (৮:৫৯)

মদিনার ইহুদিদের বিশ্বাসঘাতকতা এবং চুক্তি লঙ্ঘনের ঘটনা বর্ণনার পর এ আয়াতে একটি সার্বজনীন এবং সাধারণ আইন হিসেবে বলা হচ্ছে, মুসলিম দেশ এবং সমাজের নেতাকে এতটাই সচেতন হতে হবে যে, শত্রু পক্ষের বিশ্বাসঘাতকতা বা ষড়যন্ত্রের লক্ষণ দেখা মাত্রই যেন তিনি সমুচিত ব্যবস্থা নিতে পারেন।

এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি করা যাবে না। কারণ যে কোনো সিদ্ধান্তহীনতা বা বিলম্ব মুসলিম সমাজের জন্য ক্ষতি বয়ে আনতে পারে। বরং মুসলিম সমাজের নেতারা যখনই আঁচ করবেন যে প্রতিপক্ষ বিশ্বাসঘাতকতা করতে যাচ্ছে, তখনই তিনি পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং মুসলিম দেশ বা সমাজকে অমুসলিম কাফেরদের ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করবেন। তবে এ ক্ষেত্রেও মুসলমানদেরকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। মুসলমানরা পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তারাও চুক্তি বাতিল বলে ঘোষণা দেবে এবং সব ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকবে। কিন্তু শত্রুপক্ষ আক্রমণ না করা পর্যন্ত মুসলমানরা কোনো অবস্থাতেই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে পারবে না।