বর্তমান যুগের দর্পণে ইমাম আলীর বাণীসমূহ

বিগত চৌদ্দ শ’ বছর থেকে এখন পর্যন্ত এ পৃথিবী হাজার বর্ণ ও রূপ ধারণ করেছে; কৃষ্টি-সভ্যতা পরিবর্তিত হয়েছে এবং সেই সাথে রুচিবোধেও পরিবর্তন এসেছে। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে, প্রাচীন কৃষ্টি-সভ্যতা ও সেকেলে পুরনো রুচিবোধের কাছে ইমাম আলীর বাণী, কথা ও ভাষণসমূহ পছন্দনীয় ও গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু আধুনিক রুচিবোধ ও চিন্তাধারায় তা ভিন্নভাবে মূল্যায়িত হবে। তবে আমাদের অবশ্যই জানা থাকা উচিত, কি বাহ্যিক আঙ্গিক, কি অন্ত র্নিহিত অর্থের দৃষ্টিকোণ- কোন দিক থেকে ইমাম আলীর বাণীর স্থান ও কালগত সীমাবদ্ধতা নেই। তাঁর বাণী মানবিক ও বিশ্বজনীন। আমরা এ ব্যাপারে পরে বিস্তারিত আলোচনা করব। তবে এ বিষয়ে অতীতে যে সব মন্তব্য করা হয়েছে সেগুলোর পাশাপাশি আমরা বর্তমান যুগের বিশেষজ্ঞ এবং পণ্ডিতদের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি এখানে উপস্থাপন করব।

মরহুম শেখ মুহাম্মদ আবদুহু যিনি মিসরের ভূতপূর্ব মুফতী ছিলেন তিনি প্রবাসে অবস্থান কালে অনেকটা আকস্মিকভাবেই নাহজুল বালাগার সাথে পরিচিত হন। এ পরিচিতি তাঁকে নাহজুল বালাগার একান্ত অনুরাগীতে পরিণত করে। এর ফলে তিনি এ পবিত্র গ্রন্থটি ব্যাখ্যা করেন এবং আরব বিশ্বের আধুনিক যুব প্রজন্মকে এ গ্রন্থটির সাথে পরিচিত করিয়ে দেন।

তিনি নাহজুল বালাগার ব্যাখ্যার ভূমিকায় লিখেছেন, “সমগ্র আরবী ভাষাভাষী জনগণের মধ্যে এমন এক ব্যক্তিকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে বিশ্বাস করে না পবিত্র কোরআন ও মহানবীর বাণীর পরে আলীর বাণী ও কথা সবচেয়ে বিশুদ্ধ, মর্যাদাবান, প্রাঞ্জল-সাবলীল, মাধুর্যমণ্ডিত, গভীর অর্থ ও তাৎপর্যবহ এবং ব্যাপক ও সর্বজনীন।”

কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডীন আলী আল জুন্দী ‘আলী ইবনে আবি তালিব : “শে’রুহু ও হিকামুহু” (আলী ইবনে আবি তালিব : তাঁর কবিতা ও জ্ঞানগর্ভমূলক বাণীসমূহ) নামক গ্রন্থে ইমাম আলীর গদ্য-সাহিত্য সম্পর্কে লিখেছেন, “এ সব বাণী ও কথায় এমন এক বিশেষ ধরনের সংগীতের ঝংকার ও মূর্ছনা (বিদ্যমান) রয়েছে যা আবেগ-অনুভূতির গভীরে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। অন্ত্যমিলবিশিষ্ট বা ঝংকারপূর্ণ কবিতা বা (গদ্য) বক্তব্যের মাপকাঠিতে তা এতটা সুবিন্যস্ত ও সুশৃঙ্খলিত যে, তা গদ্যমিশ্রিত পদ্য বা কাব্য বলা যায়।”

তিনি কুদামাহ্ ইবনে জাফর থেকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, “কেউ কেউ সংক্ষিপ্ত বাণী রচনায় সিদ্ধহস্ত এবং কেউ কেউ দীর্ঘ বক্তৃতা রচনার ক্ষেত্রে পারদর্শী; আর ইমাম আলী (আ.) যেমন সকল ফজীলত ও মর্তবার ক্ষেত্রে সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও অগ্রগামী ছিলেন ঠিক তদ্রুপ এ দু’ ক্ষেত্রেও (সংক্ষিপ্ত জ্ঞানগর্ভমূলক বাণী এবং দীর্ঘ বক্তৃতা রচনার ক্ষেত্রে) সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও অগ্রগামী ছিলেন।”

সমসাময়িক প্রসিদ্ধ মিসরীয় লেখক ও সাহিত্যিক ত্বাহা হুসাইন ‘আলী ওয়া বানুহু’ (আলী ও তাঁর বংশধরগণ) নামক গ্রন্থে এমন এক ব্যক্তির কাহিনী বর্ণনা করেছেন, যে উটের যুদ্ধ (জঙ্গে জামাল) চলাকালে সংশয়গ্রস্ত হয়ে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেছিল : তালহা ও যুবাইয়েরের মত ব্যক্তিরা কিভাবে ভুল পথে থাকতে পারেন? ঐ লোকটি তার মনের এ কথা আলীর কাছে উত্থাপন করেছিল এবং তাঁকে বলেছিল, “এ ধরনের বিরাট ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তিরা কি ভুল পথে যেতে পারেন?” তখন আলী (আ.) তাকে বলেছিলেন,

“তুমি মারাত্মক ভুলের মধ্যে আছ (তুমি বিপরীত কাজটিই করেছ; সত্য ও মিথ্যাকে ব্যক্তিসমূহের মর্যাদা ও অপদস্থতার মাপকাঠি বিবেচনা করার পরিবর্তে ব্যক্তিবর্গের মর্যাদা ও হীনতা-দীনতা যা আগে থেকে ধারণা করে রেখেছিলে তা সত্য ও মিথ্যার মাপকাঠি বলে নির্ধারিত করেছ। তুমি সত্যকে কি ব্যক্তিগণের মর্যাদার সাথে তুলনা করে চিনতে চাও? এর বিপরীত আচরণ কর [অর্থাৎ সত্যের মাপকাঠিতে ব্যক্তিদেরকে চেনার চেষ্টা কর]), সর্বাগ্রে সত্যকে চেন, তাহলে সত্যপন্থীদেরকেও চিনতে পারবে। আর মিথ্যাকে চিনতে চেষ্টা কর তাহলে মিথ্যাপন্থীদেরকেও চিনতে পারবে।...”

তখন কে সত্যপন্থী ও সত্যের সমর্থক এবং কে মিথ্যাপন্থী ও মিথ্যার সমর্থক তা তোমার কাছে গুরুত্ববহ হবে না। আর বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের ভুল করা বা ভুলের মধ্যে থাকার বিষয়টিও তোমার কাছে বিস্ময়কর লাগবে না এবং এতে তুমি আর কখনো সংশয়গ্রস্তও হবে না।

ত্বাহা হুসাইন উপরোক্ত বাক্যগুলো উদ্ধৃত করার পর লিখেছেন, “আমি ওহী ও মহান আল্লাহর বাণীর (পবিত্র কোরআন) পর এই উত্তরের চেয়ে অপেক্ষাকৃত মহিমান্বিত ও বলিষ্ঠ উত্তর প্রত্যক্ষ করি নি এবং জানিও না।”

‘আমীরুল বায়ান’ (বাগ্মিতা ও ভাষণের নেতা) উপাধিতে ভূষিত শাকীব আর্সলান সমসাময়িক কালের অন্যতম প্রতিথযশা আরব সাহিত্যিক ও লেখক। মিশরে তাঁর সম্মানে আয়োজিত এক সভায় একজন আলোচক বক্তব্য প্রদানকালে বলেছিলেন, “ইসলামের ইতিহাসে সত্যিকার অর্থে কেবল দু’ ব্যক্তি ‘আমীরুল বায়ান’ নামকরণের উপযুক্ত। তাঁদের একজন আলী ইবনে আবি তালিব এবং অপর ব্যক্তি হলেন শাকীব।”

শাকীব আর্সলান এ ধরনের উক্তিতে খুব অসন্তুষ্ট হলেন এবং বক্তৃতা-মঞ্চে গিয়ে তাঁর এ বন্ধু যিনি এ ধরনের একটি তুলনা করেছেন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছিলেন, “আমি কোথায়? আর আলী ইবনে আবি তালিব কোথায়? আমি তো আলীর জুতার ফিতার সমান ও উপযুক্ত নই।”(সমসাময়িক কালের একজন লেবাননবাসী আলেম জনাব মুহাম্মদ জাওয়াদ মুগনিয়াহ্ তাঁর সম্মানে ইরানের পবিত্র মাশহাদ   নগরীতে কয়েক বছর পূর্বে যে কনফারেন্সের আয়োজন করেছিলেন সেখানে তিনি এ কাহিনীটি বলেছিলেন।)

সমসাময়িক লেবাননী খ্রিস্টান লেখক ‘মিখাইল নাঈমাহ্’ প্রখ্যাত লেবাননী খ্রিস্টান লেখক জর্জ জুরদাক প্রণীত ‘আল ইমাম আলী’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, “আলী কেবল যুদ্ধের ময়দানেই শ্রেষ্ঠ ছিলেন না, বরং তিনি সকল ক্ষেত্রেই শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনি আন্তরিকতার ক্ষেত্রে, চিত্তের পবিত্রতা, অতীব চিত্তাকর্ষক বাণী ও বক্তব্য প্রদানের ক্ষেত্রে, প্রকৃত মানবিকতার ক্ষেত্রে, বিশ্বাস বা ঈমানের উত্তাপের ক্ষেত্রে, গৌরবোজ্জ্বল প্রশান্তির ক্ষেত্রে, মজলুমদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে, যে কোন অবস্থায় সত্য ও প্রকৃত বাস্তবতা প্রকাশিত হলে সেই সত্য ও বাস্তবতার প্রতি আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ ও সকলের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন।

এখানেই আমরা আমাদের আলোচনার ইতি টানব। আর এর চেয়ে বেশি আলীর প্রশংসায় অন্যদের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দেব না। ইমাম আলীর বাণীর প্রশংসাকারী আসলে নিজেরই প্রশংসাকারী। কবির ভাষায় : সূর্যের প্রশংসাকারী আসলে নিজেরই প্রশংসাকারী।

আমাদের বক্তব্য এখানে স্বয়ং ইমাম আলীর বক্তব্য ও বাণী দিয়েই শেষ করব। একদিন ইমাম আলীর একজন সাথী একটি ভাষণ দিতে চাইলেন। কিন্তু তিনি ভাষণ দিতে পারলেন না। তাঁর কণ্ঠ যেন রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। আলী (আ.) বললেন,

“নিশ্চয়ই কণ্ঠ (ভাষা) ও বাকশক্তি মানুষের একটি অঙ্গ মাত্র এবং তা মন ও অনুধাবন শক্তিরই অধীন। যদি তার মন, অনুধাবন ও স্মরণশক্তি স্ফুটিত না হয় এবং পশ্চাৎগামী হয়ে যায় তখন তার কণ্ঠ, ভাষা ও বাকশক্তি আর কোন কাজেই আসবে না। কিন্তু যখন মানুষের মন, অনুধাবন ক্ষমতা ও স্মরণশক্তি উন্মুক্ত ও প্রস্ফুটিত হবে তখন তা কণ্ঠকে (বাকশক্তিকে) আর সুযোগ দেবে না।”

এরপর তিনি বললেন,

“নিশ্চয় আমরা (আহলে বাইত) বাণী, ভাষা ও বাগ্মিতার আমীর; ভাষাবৃক্ষের মূল আমাদের মধ্যেই বিস্তার লাভ করেছে, সুগভীরে গ্রোথিত রয়েছে এবং এর ডালপালাকে আমাদের ওপরেই মেলে রেখেছে।”( নাহজুল বালাগাহ্, খুতবা অংশ।)

জাহিয তাঁর ‘আল বায়ান ওয়াত তিবয়ীন’ গ্রন্থে আবদুল্লাহ্ ইবনে হাসান ইবনে আলী (আবদুল্লাহ্ মাহ্য নামেও পরিচিত) থেকে বর্ণনা করেছেন : আলী (আ.) বলেছেন : পাঁচটি বৈশিষ্ট্য দ্বারা আমরা অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। উক্ত পাঁচটি বৈশিষ্ট্য : বাগ্মিতা, বাক-অলংকার ও ভাষার প্রাঞ্জলতা-সাবলীলতা, মুখমণ্ডলের (দৈহিক) সৌন্দর্য, ক্ষমা, সাহসিকতা ও বীরত্ব এবং নারীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা।(ইসলাম রাসূল (সা.)-এর মাধ্যমে নারীর প্রতি জাহেলিয়াতের সমস্ত কুসংস্কার ও অনাচার দূর করে নারীকে প্রকৃত মর্যাদায়   সমাসীন করেছে। রাসূলের পর আহলেবাইত এই আচরণের প্রবক্তা ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এ কারণে নারীদের মধ্যে আহলে বাইতের জনপ্রিয়তা ছিল।)

এখন আমরা ইমাম আলীর বাণী ও কথার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি অর্থাৎ তাঁর বাণীসমূহের অন্তর্নিহিত অর্থের বহুমাত্রিক হবার বিষয়টি আলোচনা করব। আর এটিই হচ্ছে আমাদের এতদ্সংক্রান্ত প্রবন্ধসমূহের মূল আলোচ্য বিষয়।

প্রতি জাতিরই এমন সব সাহিত্যিক কীর্তি আছে যা শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম বলে গণ্য। গ্রীক ও অ-গ্রীক জাতির প্রাচীন শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মসমূহ এবং ইতালি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশ ও জাতির আধুনিক যুগের বেশ কিছু শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মের কথা বাদই দিলাম এবং এগুলোর আলোচনা ঐ সব ব্যক্তির যিম্মায় ন্যস্ত করলাম যারা ঐ সব ভাষা ও সাহিত্যের সাথে পরিচিত। আর এ সকল সাহিত্যকর্ম, অবদান ও কীর্তিসমূহের বিচার করার যোগ্যতা একমাত্র তাদেরই। আমাদের আলোচনাকে আরবী ও ফার্সী ভাষায় যে সব শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম ও কীর্তি রয়েছে কেবল সেগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখব। কারণ আমরা কম-বেশি এগুলো বুঝতে ও উপলব্ধি করতে সক্ষম।

অবশ্য আরবী ও ফার্সী ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মসমূহের ব্যাপারে সঠিক বিচার-বিশ্লেষণ একান্ত ভাবে সাহিত্যবিশারদ ও এ ভাষাদ্বয়ের বিশেষজ্ঞদের সাথেই জড়িত। এ সকল সাহিত্যিক শিল্পকর্ম বিশেষ একদিক থেকে শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম; তবে সকল দিক থেকে নয়; আর সঠিকভাবে বলতে গেলে, এ সকল শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক শিল্পকর্মের রচয়িতাগণ কেবল বিশেষ এক সীমিত ক্ষেত্রে তাঁদের শৈল্পিক দক্ষতা ও নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন; প্রকৃতপক্ষে তাঁদের শৈল্পিক দক্ষতা ও নৈপুণ্য সুনির্দিষ্ট ও সীমিত ক্ষেত্র ও বিষয়েই নিবদ্ধ ছিল। আর যদি তাঁরা কখনো তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রের গণ্ডী থেকে বের হয়েছেন অমনি যেন আকাশ থেকে ভূ-তলে পতিত হয়েছেন।

ফার্সী ভাষায় মরমী (আধ্যাত্মিক) গযল বা প্রেম-গীতি, সাধারণ গযল, উপদেশমূলক কাব্য, আত্মিক-আধ্যাত্মিক উপমা ও প্রবন্ধনির্ভর কাব্য, বীরত্বগাথা, কাসীদাহ্ (প্রশংসা বা নিন্দাবাচক কবিতা বা শোকগাথা) ইত্যাদি ক্ষেত্রসমূহে অনেক শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম ও সাহিত্যিক নিদর্শন রয়েছে। তবে আমাদের জানামতে আমাদের যে সব কবি বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন তাঁদের কেউই সাহিত্যের সকল ক্ষেত্র ও অঙ্গনে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক শিল্পকলা ও নিদর্শন রচনা করতে সক্ষম হন নি।

মরমী গযলে হাফিয, উপদেশমূলক কাব্য ও সাধারণ গযল রচনায় সা’দী, বীরত্বগাথা রচনায় ফেরদৌসী, আধ্যাত্মিক অতীন্দ্রিয়বাদী সূক্ষ্মদর্শী চিন্তা ও উপমা প্রবাদনির্ভর কাব্য রচনায় মৌলাভী (মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী), দার্শনিক দুঃখবাদমূলক কাব্যে উমর খৈয়াম, প্রেমোপাখ্যান ইত্যাদি রচনায় কবি নিযামী বিশিষ্ট শৈল্পিক দক্ষতা ও নৈপুণ্য প্রদর্শন এবং বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছেন। আর এ কারণেই এ সব বিষয়ে লিখিত শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক কর্মসমূহের মধ্যে পারস্পরিক তুলনা এবং একটির ওপর আরেকটিকে প্রাধান্য দেয়া সম্ভব নয়। বড়জোর বলা যায় এ সব কবি-সাহিত্যিকের প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্র ও অঙ্গনে দিকপাল এবং প্রথম স্থানের অধিকারী। আর এ সব প্রতিভাবান ব্যক্তিত্বের মধ্য থেকে কোন একজনও তাঁর নিজ ক্ষেত্রের গণ্ডী পেরিয়ে কখনো কখনো অন্য কোন অঙ্গনে প্রবেশ করেছেন তখন নতুন ক্ষেত্র ও অঙ্গনে তাঁদের রচিত সাহিত্যকর্ম এবং যে ক্ষেত্রে তাঁরা সিদ্ধহস্ত সে ক্ষেত্রে তাঁদের সাহিত্যকর্মের গুণগত মানে আকাশ-পাতাল পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে।

কি জাহেলিয়াতের যুগের, কি ইসলামী যুগের-সকল আরব কবির অবস্থাও ঠিক এমনই। নাহজুল বালাগায় বর্ণিত হয়েছে যে, একবার হযরত আলীকে জিজ্ঞেস করা হলো : আরবের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি কে? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “এ সকল কবি সবাই সাহিত্যের একই শাখায় কাব্য রচনা করেন নি (সকলে একই ময়দানে অশ্ব চালনা করেন নি) যার ফলে স্পষ্ট হয়ে যাবে, তাঁদের মধ্য থেকে কোন্ কবি অন্য সকলের চেয়ে অগ্রগামী ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হয়েছেন।” এরপর তিনি বললেন, “আর এ ব্যাপারে যদি মন্তব্য করতেই হয় তাহলে বলতে হয় ঐ ভ্রষ্ট বাদশাহ (অর্থাৎ ইমরাউল কায়েস) আরবের সকল কবির চেয়ে অগ্রগামী।”

ইবনে আবীল হাদীদ ‘নাহজুল বালাগার ব্যাখ্যা’ গ্রন্থে আলী (আ.)-এর উপরোক্ত বাক্যটির উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে সনদসহ নিম্নোক্ত কাহিনীটি বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “হযরত আলী রমযান মাসে প্রতিটি রজনীতে জনগণকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ করতেন এবং তাদেরকে মাংসের ব্যঞ্জন খাওয়াতেন। কিন্তু তিনি নিজে ঐ খাবার খেতেন না। নৈশভোজ শেষ হলে তিনি জনগণের উদ্দেশে ভাষণ এবং তাদেরকে উপদেশ দিতেন। এক রাতে আমন্ত্রিত মেহমানগণ নৈশভোজ চলাকালে অতীত কালের কবিদের ব্যাপারে আলোচনায় লিপ্ত হন। ভোজ শেষ হলে হযরত আলী (আ.) আলোচনায় অংশ গ্রহণ করলেন এবং বললেন : তোমাদের কাজ-কর্মের মাপকাঠি (হচ্ছে) ধর্ম। তাকওয়া হচ্ছে তোমাদের রক্ষাকবচ। শিষ্টাচার তোমাদের অলংকার। আর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা হচ্ছে তোমাদের মানসম্মানের দুর্গ। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে আবুল আসওয়াদ দু’আলী ছিলেন যিনি ইতোপূর্বে কবিদের ব্যাপারে যে আলোচনা হচ্ছিল তাতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে ইমাম আলী বললেন : সর্বশ্রেষ্ঠ কবি কে ছিলেন- এ ব্যাপারে তোমার অভিমত ব্যক্ত কর। তখন আবুল আসওয়াদ দু’আলী আবু দাউদ আয়াদীর একটি কবিতা পাঠ করলেন এবং বললেন : আমার অভিমত হচ্ছে এ ব্যক্তি (আবু দাউদ) সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। ইমাম আলী তখন বললেন : তুমি ভুল বললে। আসলে বাস্তবতা এমনটি নয়। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ যখন দেখলেন, যে বিষয়টি ইতোপূর্বে তাদের আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল সে ব্যাপারে ইমাম আলী (আ.) আগ্রহ দেখিয়েছেন তখন তাঁরা সমস্বরে বলে উঠলেন : হে আমীরুল মুমিনীন! এ ব্যাপারে আপনি আপনার অভিমত ব্যক্ত করুন। আপনার দৃষ্টিতে সর্বশ্রেষ্ঠ কবি কে? আলী (আ.) বললেন : এ ব্যাপারে রায় দেয়া সম্ভব নয়। কারণ যদি তাঁরা (সকল কবি) একই দিকে অর্থাৎ কবিতা ও কাব্যের কোন একটি নির্দিষ্ট শাখায় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতেন তাহলে তখন তাঁদের ব্যাপারে বিচার করে আমরা বিজয়ীর নাম ঘোষণা করতে পারতাম। আর যদি আমাকে অবশ্যই অভিমত ব্যক্ত করতে হয় তাহলে বলতে হবে, যে ব্যক্তি ব্যক্তিগত অভিরুচির প্রভাবে প্রভাবিত না হয়ে এবং ভয়ে ভীত না হয়ে (বরং কেবল খেয়াল বা কল্পনা শক্তির প্রভাবে এবং কাব্যরসের বশবর্তী হয়ে) কবিতা রচনা করেছে সেই অন্য সবার ওপর অগ্রগামী। তখন সবাই জিজ্ঞেস করল : হে আমীরুল মুমিনীন! সে কে? তখন তিনি বললেন : ভ্রষ্ট বাদশাহ ইমরাউল কায়েস।”

কথিত আছে, প্রসিদ্ধ আরবী ব্যাকরণবিদ (নাহু শাস্ত্র) ইউনুসকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল : কে জাহেলিয়াত-যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি? তখন ইউনুস বলেছিলেন, “সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ইমরাউল কায়েস যখন সে অশ্বারোহী (অর্থাৎ যখন তার সাহসিকতা বোধ তাকে উদ্বুদ্ধ করত এবং যখন সে বীরগাথা গাইতে ইচ্ছা করত); অপর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি নাবেগাহ্ আয্-যুবইয়ানী যখন সে ভীত ও শংকিত হয়ে আত্মরক্ষা করতে চাইত। আর অপর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি যুহাইর ইবনে আবি সালামাহ্ যখন সে কিছু পছন্দ করে তা বর্ণনা করার ইচ্ছা করত। আর অপর একজন সর্বশ্রেষ্ঠ কবি আ’শা যখন সে সংগীতের মূর্ছনায় উদাস ও উন্মত্ত হয়ে পড়ত।”

এ ব্যক্তির একান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, এ সব কবির প্রত্যেক্যেই তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে ছিলেন যোগ্যতাসম্পন্ন ও সিদ্ধহস্ত। আর তাঁরা যে সব শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক নিদর্শন ও শিল্পকর্ম রচনা করেছেন তা তাঁরা সেই সকল ক্ষেত্রেই করেছেন যে সব ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতিভা ও যোগ্যতা ছিল। তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন তাঁর নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিভাবান ও দিকপাল এবং তাঁদের নিজস্ব ক্ষেত্রের বাইরে তাঁরা তাঁদের প্রতিভা প্রয়োগ করেন নি।

জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় ইমাম আলী

আমীরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.)-এর বাণীসমূহ যা আজ ‘নাহজুল বালাগাহ্’ নামে আমাদের হাতে বিদ্যমান তার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তা নির্দিষ্ট কোন ক্ষেত্র বা বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। ইমাম আলী কেবল একটি ময়দান বা ক্ষেত্রে অশ্ব চালনা করেন নি, বরং তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অশ্ব চালনা করেছেন যা ছিল কখনো কখনো পরস্পর বিপরীতধর্মী। ‘নাহজুল বালাগাহ্’ একটি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক শিল্পকর্ম, তবে তা উপদেশ, বীরত্বগাথা অথবা প্রেমগীতি ও প্রেমোপাখ্যান অথবা প্রশংসা গীত ও ব্যঙ্গ কাব্যের মত নির্দিষ্ট একটি মাত্র বিষয় ও ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা বিভিন্ন ক্ষেত্র ও বিষয়কে কেন্দ্র করেই রচিত।

যেহেতু শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছে, তবে যদিও একটি ক্ষেত্র বা বিষয়ে লিখিত শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম সংখ্যায় খুব বেশি নয়, বরং সীমিত, যা হোক, এতদ্সত্ত্বেও তা আছে। আর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মের পর্যায়ে নয়, বরং বিভিন্ন বিষয়ে স্বাভাবিক ও সাধারণ মানগত পর্যায়ে রচিত একক সাহিত্যকর্মের সংখ্যাও প্রচুর। তবে যে বাণী শ্রেষ্ঠ কর্ম এবং কোন একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়, বরং সকল ক্ষেত্র ও বিষয়ের সাথেই সংশ্লিষ্ট তা হচ্ছে ‘নাহজুল বালাগাহ্’।

আমরা পবিত্র কোরআনের কথা বাদই দিলাম। কোন শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম খুঁজে পাওয়া যাবে কি যা ‘নাহজুল বালাগা’র মত বৈচিত্র্যময়? ভাষা বা কথা আত্মারই প্রতিনিধি। প্রত্যেক ব্যক্তির ভাষা ঐ জগতের সাথে সম্পর্কিত যার সাথে ঐ ভাষা বা বাণীর কথকের আত্মাও জড়িত। স্বভাবতই যে বাণী বা কথা বহু জগতের সাথে জড়িত তা এমন এক মনোবল ও মানসিকতার নির্দেশক যা কোন একটি নির্দিষ্ট জগতের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। যেহেতু আলীর আত্মা কোন নির্দিষ্ট জগতের সাথে জড়িত নয়, বরং তা সকল জগতেই উপস্থিত; আর আধ্যাত্মিক সাধকদের পরিভাষায় তাঁর আত্মা ইনসানে কামিল, একটি সামগ্রিক মহাবিশ্ব ও পূর্ণাঙ্গ অস্তিত্বজগৎ, সকল মাননীয় সত্তাগত গুণের আধার এবং সকল পর্যায় সমন্বিত, সেহেতু তাঁর বাণীও কোন নির্দিষ্ট জগতে সীমাবদ্ধ নয়। ইমাম আলীর বাণীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, আমাদের এ যুগের বহুল প্রচলিত পরিভাষা অনুসারে তা বহুমাত্রিক এবং তা একমাত্রিক নয়।

ইমাম আলীর বাণী ও তাঁর আত্মার বহুমাত্রিক হবার বিশেষত্বটি এমন কোন বিষয় নয় যা সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। তা এমনই এক বিষয় যা ন্যূনতম পক্ষে ১০০০ বছর আগে থেকেই বিস্ময়াবোধের সৃষ্টি করেছিল। সাইয়্যেদ রাযী যিনি ১০০০ বছর পূর্বে জীবিত ছিলেন তিনি এ বিষয়টি অনুধাবন করেছেন এবং এ ব্যাপারে তীব্র অনুরাগ প্রদর্শন করেছেন। তাই তিনি বলেছেন, “আলীর অত্যাশ্চর্যজনক বিষয়াদি যা কেবল তাঁর মাঝেই সীমাবদ্ধ এবং কেউই এ ক্ষেত্রে তাঁর শরীক ও সমকক্ষ নয়, তা হচ্ছে, দুনিয়াবিমুখতা, সদুপদেশ ও সতর্কীকরণ সংক্রান্ত তাঁর যে সব বাণী আছে সেগুলো নিয়ে যদি কেউ স্বতন্ত্র ও গভীরভাবে চিন্তা করে এবং সাময়িকভাবে ভুলে যায় যে, এ বাণীর (নাহজুল বালাগাহ্ গ্রন্থের) রচয়িতা নিজেই এক বিরাট ও সুমহান সামাজিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী, তাঁর নির্দেশ সকল স্থানে কার্যকর এবং তিনি নিজেই তাঁর যুগের একচ্ছত্র অধিপতি, তাহলে সে মোটেও সন্দেহ করবে না যে, এসব বাণী ঐ ব্যক্তির যিনি তাকওয়া- পরহেজগারী ও দুনিয়াবিমুখতা ব্যতীত আর কিছুই চেনেন না এবং মানেন না, ইবাদত-বন্দেগী ও যিকির করা ব্যতীত যাঁর আর কোন কাজ নেই, যিনি গৃহের কোণ অথবা পাহাড়ের পাদদেশকে একাকী নিভৃতে ইবাদত করার জন্য বেছে নিয়েছেন, যিনি নিজের কণ্ঠ ও স্বরধ্বনি ব্যতীত আর কিছুই শুনতে পান না, নিজ সত্তা ব্যতীত আর কিছুই যাঁর দৃষ্টিগোচর হয় না এবং যিনি সমাজ ও সমাজ জীবনের কোলাহল সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন।

কেউ বিশ্বাস করবে না যে, দুনিয়াবিমুখতা, সতর্কীকরণ ও সদুপদেশের ক্ষেত্রে এসব সুন্দর কথা ও বাণী ঐ ব্যক্তির যিনি যুদ্ধের ময়দানে শত্রু সেনাদলের মাঝে অনুপ্রবেশ করেন, রণক্ষেত্রে যাঁর (নাঙ্গা) তলোয়ার ঝিলিক দেয় এবং শত্রুদের মাথা কাটার জন্য প্রস্তুত, যিনি বীরদেরকে ধরাশায়ী করেন, যাঁর তরবারি থেকে শত্রুদের রক্ত ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরতে থাকে, অথচ ঠিক এ অবস্থায়ই তিনি আবার সাধক পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে ত্যাগী এবং ইবাদতকারী বান্দাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ইবাদতকারী।”   এরপর সাইয়্যেদ রাযী বলেছেন, “আমি এ বিষয়টি বহুবার আমার বন্ধু-বান্ধবদের কাছে উপস্থাপন করেছি। আর এভাবে আমি তাদের বিস্ময়ানুভূতির উদ্রেক ঘটিয়েছি।” শেখ মুহাম্মদ আবদুহুও নাহজুল বালাগার এই বিশেষ দিক ও বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ এর বহুমাত্রিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। নাহজুল বালাগায় অন্তরায়সমূহের পরিবর্তন ও বিভিন্ন জগতের দিকে পাঠককে পরিচালিত করার বিষয়টি অন্য সব কিছুর চেয়ে বেশি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং তাঁকে বিস্ময়াভিভূত করেছে। তিনি এ বিষয়টি ‘নাহজুল বালাগার ব্যাখ্যা’-এর ভূমিকায় ব্যক্ত করেছেন।

আলী (আ.)-এর ভাষা ও বাণীসমূহ ছাড়াও সার্বিকভাবে তাঁর আত্মা ব্যাপক, সর্বজনীন ও বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আর এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই তিনি সর্বদা প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি ছিলেন ন্যায়পরায়ণ শাসক, রাত্রি জাগরণকারী, ইবাদতকারী। তিনি ইবাদতের মিহরাবে ক্রন্দন করতেন এবং যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল অকুতোভয় সৈনিক। তিনি ছিলেন দয়ালু ও হৃদয়বান অভিভাবক। তিনি ছিলেন গভীর চিন্তাশীল ও প্রজ্ঞাবান দার্শনিক। তিনি ছিলেন যোগ্য সেনাপতি ও নেতা। তিনি যেমন শিক্ষক ছিলেন তেমনি ছিলেন বক্তা, বিচারপতি, মুফতী, কৃষিজীবী, লেখক অর্থাৎ তিনি ছিলেন ‘ইনসানে কামিল’। মানব জাতির সকল আত্মিক-আধ্যাত্মিক দিক-পর্যায় ও জগৎসমূহ ছিল তাঁর নখদর্পণে। সাফীউদ্দীন হিল্লী (মৃ. ৮ম হিজরী) আলী (আ.) সম্পর্কে বলেছেন,

جمعت في صفاتك الأضداد - ولهذا عزت لك الأنداد

زاهد حاكم حليم شجاع - فاتك ناسك فقير جواد

شيم ما جمعن في بشر قط - ولا حاز مثلهن العباد

خلق يخجل النسيم من اللطف - وبأس يذوب منه الجماد

جل معناك أن تحيط به - الشعر و يحصي صفاتك النقاد

তোমার গুণাবলীর মধ্যে সমাবেশ ঘটেছে পরস্পর বিপরীতধর্মী বিষয়সমূহ

আর এ কারণেই তোমার প্রতি আকৃষ্ট ও বন্ধু ভাবাপন্ন হয়েছে শত্রুগণ

তুমি ত্যাগী (সাধক), শাসনকর্তা, ধৈর্যশীল, সাহসী

শত্রুনিধনকারী, উৎসর্গকারী, দরিদ্র ও দানশীল

কভু যদি কোন মানবের মাঝে হয় এগুলোর সমাবেশ তাহলে তা হবে কতই না প্রশংসনীয়

এসব বৈশিষ্ট্যের ন্যায় কোন কিছুই কোন মানুষ কভু করে নি অর্জন

তোমার স্বভাব-চরিত্রের কমনীয়তা ভোরের মৃদুমন্দ সমীরণকেও করে লজ্জিত

আর তোমার শক্তি ও সাহসের কাছে কঠিন পাথরও হয় বিগলিত

 তোমার মান-মর্যাদা এতটা মহান ও উচ্চ যে, তা কাব্যে করা যায় না প্রকাশ

আর না গণনাকারী তোমার গুণাবলী গণনা করতে সক্ষম।

এ সব কিছু বাদ দিলেও অপর একটি আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে এটি যে, আলী (আ.) যদিও আধ্যাত্মিকতা ও অজড় বিষয়াদির ব্যাপারে বক্তব্য রেখেছেন তবুও তিনি ভাষার প্রাঞ্জলতা সাবলীলতা, বলিষ্ঠতা ও মাধুর্যকে পূর্ণত্বের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। মদ, প্রেমাস্পদ, আত্মগৌরব ও এ ধরনের বিষয়সমূহ ইমাম আলী আলোচনা করেন নি যেগুলোর ব্যাপারে কথা বলা ও আলোচনার ক্ষেত্র উন্মুক্ত রয়েছে। অধিকন্তু তিনি কথা বলার জন্য বা নিজের ভাষা ও বাগ্মিতার শৈল্পিক নৈপুণ্য প্রকাশ করার জন্য কথা বলেন নি, বক্তৃতা দেন নি। ভাষা ছিল তাঁর কাছে মাধ্যম; তবে তা উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি চাইতেন না এভাবে তাঁর নিজের পক্ষ থেকে একটি শিল্পকর্ম ও একটি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক কীর্তি ও নিদর্শন রেখে যেতে। সর্বোপরি, তাঁর বাণী, কথা ও বক্তব্য সর্বজনীন এবং তা স্থান-কাল-পাত্রের গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর বাণী ও বক্তব্যের উপলক্ষ ‘মানুষ’। আর এ কারণেই তাঁর বক্তব্যের নেই কোন ভৌগোলিক সীমারেখা, নেই কোন কালভিত্তিক সীমাবদ্ধতা। এ সব কিছু (স্থান-কাল-পাত্র) বক্তার দৃষ্টিতে বক্তৃতা ও বক্তব্যের ক্ষেত্রকে সীমিত এবং স্বয়ং বক্তার ওপরেও সীমাবদ্ধতা আরোপ করে। পবিত্র কোরআনের শব্দগত আলৌকিকত্বের ক্ষেত্রে প্রধানতম দিকটি হচ্ছে যদিও পবিত্র কোরআনের বিষয়বস্তু ও অন্তর্নিহিত অর্থ পুরোপুরি পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হবার যুগের বহুল প্রচলিত বক্তব্য, বাণী ও কথার বিষয়বস্তু থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আর তা নব্য সাহিত্য-যুগের শুভ সূচনাকারী এবং ভিন্ন জগৎ ও পরিমণ্ডলের সাথেই বেশি সংশ্লিষ্ট, তথাপি এ গ্রন্থের (পবিত্র কোরআন) ভাষাগত সৌন্দর্য, সাবলীলতা ও প্রাঞ্জলতা আলৌকিক। নাহজুল বালাগাহ্ অন্য সকল দিক ও ক্ষেত্রের মত এ ক্ষেত্রেও পবিত্র কোরআন দ্বারা প্রভাবিত এবং প্রকৃতপ্রস্তাবে এ গ্রন্থটি (নাহজুল বালাগাহ্) পবিত্র কোরআনেরই সন্তান।