আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আল আনফাল;(১৬তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আল আনফাল; আয়াত ৭০-৭২

সূরা আনফালের ৭০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُلْ لِمَنْ فِي أَيْدِيكُمْ مِنَ الْأَسْرَى إِنْ يَعْلَمِ اللَّهُ فِي قُلُوبِكُمْ خَيْرًا يُؤْتِكُمْ خَيْرًا مِمَّا أُخِذَ مِنْكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ

"হে নবী! তোমাদের করায়ত্ব যুদ্ধবন্দিদেরকে বল, আল্লাহ যদি তোমাদের হৃদয়ে ভাল কিছু দেখেন, তবে তোমাদের নিকট হতে যা নেয়া হয়েছে তার চেয়ে উত্তম কিছু তিনি তোমাদেরকে দান করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।" (৮:৭০)

বদরের যুদ্ধে মক্কার অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও মুসলমানদের হাতে বন্দি হয়েছিল। তাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর চাচা আব্বাসও ছিলেন। মুসলমানদের অনেকেই তখন বলছিলেন, কোনো মুক্তিপণ বা 'ফিদ্‌ইয়াহ' না নিয়েই রাসূলের চাচা আব্বাসকে ছেড়ে দেয়া হোক। কিন্তু রাসূলে খোদা (সা.) এ ধরনের প্রস্তাবে সায় দিলেন না বরং সোজা বলে দিলেন, অন্যান্য বন্দিদের মত চাচা আব্বাসকেও ফিদইয়াহ বা মুক্তিপণ পরিশোধ করতে হবে।

এই আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলছেন, তোমাদের হাতে বন্দি হওয়ার পর যারা মুক্তিপণ পরিশোধের মাধ্যমে ছাড়া পেয়েছে তাদেরকে বলে দাও, তোমরা যদি সত্যকে গ্রহণ কর এবং মুসলমান হও তাহলে সৃষ্টিকর্তার অফুরন্ত কল্যাণের দ্বার তোমাদের জন্য খুলে যাবে এবং তোমরা ফিদইয়াহ বা মুক্তিপণ বাবদ যা দিয়েছো তার চেয়ে মূল্যবান জিনিস লাভ করবে। আর সৃষ্টিকর্তার করুণা এবং ক্ষমা লাভ করার চেয়ে উত্তম জিনিস আর কি হতে পারে?

এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, সকল অপরাধীর জন্য ক্ষমার রাস্তা খোলা। এমনকি যারা আল্লাহর নবীর বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করেছে তারাও তওবা বা অনুশোচনার মাধ্যমে এবং ইসলামের ডাকে সাড়া দিয়ে অতীত ভুলের জন্য ক্ষমা লাভ করতে পারেন।

এই সূরার ৭১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِنْ يُرِيدُوا خِيَانَتَكَ فَقَدْ خَانُوا اللَّهَ مِنْ قَبْلُ فَأَمْكَنَ مِنْهُمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ

"যুদ্ধবন্দিরা যদি তোমার সাথে বিশ্বাস ভঙ্গ করতে চায়, অবশ্য এর আগে তারা আল্লাহর সাথেও বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে, কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে তাদের ওপর শক্তিশালী করেছেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান।" (৮:৭১)

আগের আয়াতের ধারাবাহিকতায় এখানে বলা হচ্ছে, বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে এমন আশংকায় বন্দিদের সাথে অসদাচরণ করা যাবে না। বরং শত্রু পক্ষের বন্দিদের সাথে এমন আচরণ করতে হবে যাতে তার পক্ষে ইসলামের মর্মবাণী উপলব্ধি করার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই আয়াতে মুসলমানদেরকে আল্লাহ বলছেন, যদি তোমরা বন্দিদের সাথে সদাচরণ কর তাহলে তারা এ থেকে প্রভাবিত হবে। এমনও হতে পারে যে, তারা তোমাদের প্রতি শত্রুতা বাদ দিয়ে ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে এবং বিশ্বাসঘাতকতার মতলবও পরিত্যাগ করবে।

এই আয়াত থেকে আমরা এটা উপলব্ধি করতে পারি যে, আমরা যদি সঠিকভাবে আমাদের দায়িত্ব পালন করি তাহলে আল্লাই শত্রুদের উচিত জবাব দিবেন এবং মুসলমানদেরকে সাহায্য করবেন। এছাড়া ইসলামের শত্রুরা মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একজন মুসলমানের মাথায় কেউ বিশ্বাস ভঙ্গ করলো কি করলো না তার চেয়ে তাকে কিভাবে সত্য পথে আনা যায় সে চিন্তাই বেশি থাকবে।

এই সূরার ৭২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَوَوْا وَنَصَرُوا أُولَئِكَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَلَمْ يُهَاجِرُوا مَا لَكُمْ مِنْ وَلَايَتِهِمْ مِنْ شَيْءٍ حَتَّى يُهَاجِرُوا وَإِنِ اسْتَنْصَرُوكُمْ فِي الدِّينِ فَعَلَيْكُمُ النَّصْرُ إِلَّا عَلَى قَوْمٍ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ مِيثَاقٌ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ

"নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে, ধর্মের জন্য হিজরত করেছে, জীবন ও সম্পদ দ্বারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করেছে এবং যারা আশ্রয় দান করেছে ও সাহায্য করেছে তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু ও অভিভাবক। আর যারা ঈমান এনেছে কিন্তু ধর্মের জন্য হিজরত বা গৃহত্যাগ করেনি, হিজরত না করা পর্যন্ত তাদের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব তোমার নেই। আর ধর্ম সম্বন্ধে যদি তারা তোমাদের সাহায্য প্রার্থনা করে, তাদের সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। তবে যে সম্প্রদায়ের সঙ্গে তোমাদের চুক্তি রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে নয়। তোমরা যা কর আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা।"(৮:৭২)

মক্কা শরিফে ইসলাম ও আল্লাহর রাসুলের বিরুদ্ধে অত্যাচার,নির্যাতন এবং ষড়যন্ত্র যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন আল্লাহতালার নির্দেশে নবী করিম (সা.)মদিনা শরীফে হিজরত করেন, তখন অধিকাংশ মুসলমানও মক্কায় তাদের ঘর-বাড়ি সহায়-সম্পদ ফেলে আল্লাহর রাসূলের সাথে মদিনায় চলে যান, ইতিহাসে তারা মুহাজির মুসলমান হিসেবে পরিচিত হয়ে আছেন। আর মদিনায় যারা আল্লাহর রাসুল ও মক্কার মুসলমানদেরকে আশ্রয় দেন, তারা ইতিহাসে আনসার নামে পরিচিত। আনসাররা মুহাজির ভাইদের জন্য যে ত্যাগ করেছেন তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। রাসূল (সা.)মদিনায় মুহাজির ও আনসারদেরকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করলেন এবং তাদেরকে যে কোনো মতপার্থক্য থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। এই আয়াতে মুহাজির ও আনসারদের মধ্যকার ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে- যারা নিজেদের সহায় সম্পদের কথা চিন্তা করে মক্কা ছাড়তে চাননি তারা মদিনার এই ভ্রাতৃত্বের সুযোগ সুবিধার মধ্যে পড়বেন না। তবে তারা যদি শেষ পর্যন্ত হিজরত করেন তাহলে তারাও এর মধ্যে শামিল হবেন।

এরপর আয়াতটির শেষ দিকে বলা হয়েছে, মক্কায় থেকে যাওয়া মুসলমানদের যারা প্রচণ্ড চাপের কারণে হিজরত করতে পারেননি তারা যদি সাহায্য কামনা করে তাহলে তাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে। তবে তাদেরকে সাহায্য করতে গিয়ে এমন কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া যাবে না যাদের সাথে মুসলমানদের শান্তি চুক্তি বলবত রয়েছে।

এই আয়াত থেকে আমরা বুঝে নিতে পারি যে ধর্ম ও ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষার জন্য প্রয়োজন হলে পাপ পংকিলময় কোনো স্থান বা কাফেরদের এলাকা থেকে হিজরত করা জরুরী। এ ছাড়া একজন মুসলমান পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন তাকে সাহায্য করা সকল মুসলমানের দায়িত্ব। এই আয়াত থেকে এটাও বোঝা যায় যে, অবিশ্বাসী কাফেরদের সাথে কোনো শান্তিচুক্তি থাকলে যতক্ষণ তারা তা মেনে চলে মুসলমানরা তা লঙ্ঘন করতে পারবে না।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)