সূরা আত তাওবা;(১ম পর্ব)

সূরা আত তাওবা; আয়াত ১-৩

সূরা আত তাওবা’র মোট ১২৯টি আয়াত রয়েছে। এ সূরাটি ‘সূরায়ে বারাআত’ নামেও পরিচিত। এই সূরার বিভিন্ন স্থানে তাওবা বা ঈমানদার লোকদের পাপ ক্ষমা করে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। তাই সূরাটি ‘তাওবা’ নামে পরিচিত হয়েছে। এ ছাড়া ‘বারাআত’ নামে পরিচিতি হওয়ার কারণ হচ্ছে এই সূরার শুরুতেই মুশরিকদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলা হয়েছে।

পবিত্র কুরআনের এটিই একমাত্র সূরা যা বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু হয়নি। মুফাসসিরগণ মনে করেন এই সূরার শুরুতেই যেহেতু চুক্তি ভঙ্গকারী মুশরিকদের সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছে এবং তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে কঠিন অবস্থান গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাতে মুশরিকদের ব্যাপারে মহান আল্লাহর ক্ষোভের বিষয়টিই প্রতিফলিত হয়েছে। ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ হচ্ছে আল্লাহর রহমত ও কৃপার প্রতীক। ফলে এই সূরার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ ব্যবহৃত হয়নি।

সূরা তাওবার প্রথম আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

بَرَاءَةٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى الَّذِينَ عَاهَدْتُمْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

“(এই আয়াত) আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা সেইসব মুশরিকদের সাথে যাদের সঙ্গে তোমরা পারস্পরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিলে।” (৯:১)

হিজরী ৮ম সালে মক্কা বিজয়ের পর নবী করিম (সা.) সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। মুশরিকরাও সাধারণ ক্ষমার আওতায় মক্কা শরিফে বহাল তবিয়তে বসবাস করছিল এবং তারা তাদের নিজস্ব নিয়ম রীতিতে প্রার্থনা করতো, পবিত্র কাবা ঘর তাওয়াফ করতো। মুশরিকদের একটি প্রথা ছিল তারা যে পোষাকে তাওয়াফ করতো তা দান করে দিত, আর যার পোষাক ছিল না সে উলঙ্গ অবস্থায় তাওয়াফ করতো বা প্রার্থনা করতো। এ অবস্থা মুসলমানদের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। তারা আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা করতে লাগলেন। এক পর্যায়ে পবিত্র মদিনায় সূরা তওবার প্রথম আয়াতটি অবতীর্ণ হয় এবং আল্লাহর রাসূল মক্কায় গিয়ে মুসলমানদেরকে আল্লাহর এই নির্দেশ অবহিত করার জন্য হযরত আলী (আ.)কে দায়িত্ব দেন। এই আয়াতের ভিত্তিতে আল্লাহর ঘর কাবা শরীফে প্রবেশ করা এবং হজ্ব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের ব্যাপারে মুশরিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। একই সঙ্গে মুসলমানদের সঙ্গে তাদের সকল চুক্তি বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়।

ইসলাম চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ না করার ব্যাপারে খুব বেশি জোর দিয়েছে। তবে এটা ততদিন পর্যন্ত যতদিন প্রতিপক্ষ চুক্তি বা প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল থাকবে। কাজেই মুশরিকরা যখন চুক্তির সীমালঙ্ঘন শুরু করে তখনই আল্লাহতালা তার রাসূলকে তা বাতিল ঘোষণা করার নির্দেশ দেন। ফলে এই সূরার ৪ নম্বর আয়াতে দেখা যায় চুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল মুশরিকদেরকে এই নির্দেশের বাইরে রাখা হয়েছে।

এই পবিত্র আয়াত থেকে আমরা এটা বুঝে নিতে পারি যে, বিভ্রান্ত  কোনো গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করাকে ইসলাম অনুমোদন করে। এ ছাড়া মুসলমানরা অবিশ্বাসী কাফেরদের সাথে চাইলে চুক্তি করতে পারে। কিন্তু প্রতিপক্ষ চুক্তির ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল না হলে মুসলমানরা তা বাতিল করার অধিকার রাখে।

এই সূরার দুই নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

فَسِيحُوا فِي الْأَرْضِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ وَأَنَّ اللَّهَ مُخْزِي الْكَافِرِينَ

“(হে মুশরিকগণ!)  চার মাস তোমাদেরকে সুযোগ দেয়া হলো, তোমরা এই দেশে স্বাধীনভাবে পরিভ্রমণ কর ও জেনে রাখো যে, তোমরা আল্লাহকে হীনবল করতে পারবে না এবং আল্লাহ অবিশ্বাসীদের লাঞ্ছিত করে থাকেন।” (৯:২)

সব ধরনের চুক্তি ও সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেয়ার পর আল্লাহতালা মুশরিকদেরকে চার মাসের সুযোগ দেন, যাতে তারা ভেবে-চিন্তে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে। তাদেরকে বলে দেয়া হয়, মুর্তিপূজা বা শিরক বাদ দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে হবে, তা না হলে মক্কা ত্যাগ করে বসবাসের জন্য অন্য কোনো স্থানে চলে যেতে হবে। কারণ তাওহীদের প্রাণকেন্দ্রে তারা কুসংস্কার ও জাহেলী যুগের পদ্ধতিতে মুসলমানদের পাশাপাশি তাওয়াফ করবে, প্রার্থনা করবে-এটা মুসলমানদের জন্য মানসিক কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে আয়াতের পরের অংশে বলা হচ্ছে, মুশরিকরা এটা যেন মনে না করে যে, মক্কা ত্যাগ করলেই আল্লাহর নাগালের বাইরে চলে গেল এবং আল্লাহর শাস্তি বা প্রতিদান থেকে মুক্তি পেয়ে গেল। তাদের মনে রাখা উচিত আল্লাহ অবিশ্বাসী কাফেরদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে লাঞ্ছিত করে থাকেন।

এই আয়াতে মুসলমানদের জন্য একটি বড় শিক্ষণীয় দিক রয়েছে, তা হচ্ছে কোনো ঘোষণা ছাড়া বা কোনো সুযোগ না দিয়েই শত্রু পক্ষের ওপর হামলা করা উচিত নয়। প্রথমে নিজেদের সিদ্ধান্ত বা নীতি প্রতিপক্ষকে জানাতে হবে এবং তাদেরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সুযোগ দিতে হবে।

এই সূরার ৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

  وَأَذَانٌ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى النَّاسِ يَوْمَ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ أَنَّ اللَّهَ بَرِيءٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ وَرَسُولُهُ فَإِنْ تُبْتُمْ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُوا أَنَّكُمْ غَيْرُ مُعْجِزِي اللَّهِ وَبَشِّرِ الَّذِينَ كَفَرُوا بِعَذَابٍ أَلِيمٍ

“মহান হজ্বের দিনে আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষ হতে মানুষের প্রতি এটা এক  ঘোষণা যে, আল্লাহর সাথে মুশরিকদের কোনো সম্পর্ক রইল না এবং তার রাসূলের সাথেও না। তবে যদি তাওবা বা অনুতাপ কর তাহলে তোমাদের কল্যাণ হবে। আর তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তবে জেনে রাখ যে তোমরা আল্লাহকে হীনবল করতে পারবে না। (হে নবী) তুমি কাফেরদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও।” (৯:৩)

এই আয়াতে মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা পুনরায় উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, হজ্বের সময় আরাফাহ কিংবা কুরবাণী ঈদের দিন বিপুল সংখ্যক মুসলমান যখন এক স্থানে সমবেত হয় তখন যেন মুসলমানদের সামনে এ কথা ভালো করে উপস্থাপন করা হয় যে, আল্লাহ ও তার রাসূল মুশরিকদের ওপর অসন্তুষ্ট। তবে তাদের জন্য এখনও পথ খোলা আছে, তারা যদি অনুতপ্ত হয় এবং তওবা করে তাহলে মুসলমানরা তাদেরকে আপন করে গ্রহণ করবে। আর এটা তাদের জন্য অত্যন্ত মঙ্গলজনক হবে। কারণ তারা যেখানেই যাক না কেন আল্লাহর নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়াতো কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কাজেই শিরক এবং অবাধ্য হয়ে থাকলে প্রতিফল দিবস বা কেয়ামতের দিন তাদেরকে অত্যন্ত কঠিন শাস্তির মুখোমুখী হতে হবে।

এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, ইসলামী রাষ্ট্রের নীতি কি হবে তা জনগণের কাছে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে যাতে মুসলিম-অমুসলিম সবাই তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত থাকতে পারে। এ ছাড়া পবিত্র হজ্ব হচ্ছে কাফের মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ এবং তাদের অপকর্মের প্রতিবাদের সবচেয়ে উত্তম সময়। কাজেই মুসলমানদের উচিত এই স্থান ও সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগানো।