সূরা আত তাওবা;(২য় পর্ব)

সূরা আত তাওবা; আয়াত ৪-৬

সূরা তাওবার ৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

إِلَّا الَّذِينَ عَاهَدْتُمْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ثُمَّ لَمْ يَنْقُصُوكُمْ شَيْئًا وَلَمْ يُظَاهِرُوا عَلَيْكُمْ أَحَدًا فَأَتِمُّوا إِلَيْهِمْ عَهْدَهُمْ إِلَى مُدَّتِهِمْ إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِينَ

“তবে মুশরিক বা অংশীবাদীদের মধ্যে যাদের সঙ্গে তোমরা চুক্তিতে আবদ্ধ ও পরে যারা তোমাদের চুক্তি রক্ষায় কোনো ত্রুটি করেনি এবং তোমাদের বিরুদ্ধে কাউকেও সাহায্য করেনি, তাদের সাথে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পালন করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকিদেরকে পছন্দ করেন।” (৯:৪)

সূরা তাওবার প্রথম আয়াতেই আল্লাহ ও তার রাসূল মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিয়েছেন। অংশীবাদী বা মুশরিকদের অন্যায্য আচরণের কারণেই আল্লাহ ও তার রাসূল তাদের অসন্তুষ্টির কথা ওই আয়াতে ঘোষণা করেন। এর পাশাপাশি মুশরিকদেরকে চার মাসের সময় দেয়া হয় যাতে তারা এই সময়ের মধ্যে তাদের আকিদা-বিশ্বাস এবং আচরণের পরিবর্তন করার সুযোগ পায় অন্যথায় তারা যেন একত্ববাদের প্রাণকেন্দ্র পবিত্র মক্কা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।

সূরা তাওবার চার নম্বর এই আয়াতে বলা হচ্ছে, মুশরিকদের যেসব দল বা গোত্র তোমাদের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করেনি, তোমাদের শত্রুদের সাথে গোপন আতাত করেনি তাদের ক্ষেত্রে আগে উল্লেখিত ওই নির্দেশ প্রযোজ্য হবে না। বরং তাদের ক্ষেত্রে চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করতে হবে। অর্থাত চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তারা পবিত্র মক্কায় বসবাস করতে পারবেন।

আসলে এই আয়াতের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে এই শিক্ষাই দেয়া হয়েছে যে, প্রতিপক্ষ যদি মুশরিক বা বড় শত্রুও হয় তাদের সাথে কখনও চুক্তি ভঙ্গ করা যাবে না, যদি তারা ওই চুক্তিতে অটল থাকে। আরেকটি বিষয় আমরা বুঝে নিতে পারি যে, প্রতিশ্রুতি বা চুক্তি ভঙ্গ না করা তাক্‌ওয়ার লক্ষণ। কারণ শুধু নামাজ, রোজা করলেই মুত্তাকি হওয়া যায় না। মুত্তকি হওয়ার জন্য সামাজিক বন্ধন ও চুক্তির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাও জরুরী।

এই সূরার ৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 فَإِذَا انْسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِينَ حَيْثُ وَجَدْتُمُوهُمْ وَخُذُوهُمْ وَاحْصُرُوهُمْ وَاقْعُدُوا لَهُمْ كُلَّ مَرْصَدٍ فَإِنْ تَابُوا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآَتَوُا الزَّكَاةَ فَخَلُّوا سَبِيلَهُمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

“অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে অংশীবাদীদের যেখানে পাবে হত্যা করবে, তাদের বন্দী করবে, অবরোধ করবে এবং প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের জন্য ওঁত পেতে থাকবে, কিন্তু তারা যদি অনুতাপ বা তাওবা করে, যথাযথ নামাজ পড়ে, যাকাত দেয়, তবে তাদের পথ ছেড়ে দেবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (৯:৫)

চুক্তি ভঙ্গকারী ও চুক্তির প্রতি অনুগত মুশরিকদের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরার পর এখানে বলা হচ্ছে যারা চুক্তি লঙ্ঘন করেছে, গোপনে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, চার মাসের নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পর মক্কায় বসবাস করার কোনো অধিকার তাদের নেই। তারপরও যদি তারা মক্কায় বসবাস করে তাহলে তাদের জানমালের নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা থাকবে না।

এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, যারা মক্কায় ১৩টি বছর আল্লাহর রাসূল ও মুসলমানদেরকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করেছে, মদিনায় হিজরতের পরও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকেছে ইসলাম তাদের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করবে। এ ছাড়া, এই চুক্তি ভঙ্গকারী মুশরিকরা মক্কা বিজয়ের পর আল্লাহর রাসূলের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকেও অপব্যবহারের চেষ্টা করেছে।

যাই হোক, পবিত্র কুরআন ঘোষণা করেছে, চার মাসের নির্ধারিত সময় শেষ হলে এদেরকে যেখানেই পাবে বন্দী করবে, অবরোধ করবে। যদি তারা প্রতিরোধ করে বা সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তাহলে তাদেরকে হত্যা করা তোমাদের জন্য বৈধ। তাদের সামনে শুধু দু’টি পথ খোলা রয়েছে। মক্কা ছেড়ে চলে যাবে অথবা তাওবা করে ইসলাম গ্রহণ করবে, মূর্তিপুজা বাদ দিয়ে এক আল্লাহর এবাদত করবে, দেব-দেবীর নামে সম্পদ উতসর্গ না করে গরীব দুঃখীদের জন্য যাকাত প্রদান করবে। তারা যদি এটা করে তাহলে সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহও তাদের অতীতের ভুল-ভ্রান্তি ও পাপ ক্ষমা করে দিবেন।

এই আয়াত থেকে আমরা বুঝে নিতে পারি যে, চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী শত্রুর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করাও জরুরী। ভালোবাসা বা দয়া শুধু মুমিনদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য-ঈর্ষাপরায়ন শত্রুর ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। এছাড়া, এ আয়াত থেকে এটাও বুঝা যায় যে, ইসলাম তাওবার পথ সকলের সব সময়ের জন্য খোলা রেখেছে। এমনকি যুদ্ধের সময়ও তা সবার জন্য উন্মুক্ত।

এই সূরার ৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَإِنْ أَحَدٌ مِنَ الْمُشْرِكِينَ اسْتَجَارَكَ فَأَجِرْهُ حَتَّى يَسْمَعَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ أَبْلِغْهُ مَأْمَنَهُ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَا يَعْلَمُونَ

“আর মুশরিক বা অংশীবাদীদের মধ্যে কেউ তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে তুমি তাকে আশ্রয় দেবে যাতে সে আল্লাহর বাণী শুনতে পায়। অতঃপর তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেবে। কারণ তারা অজ্ঞ লোক।” (৯:৬)

আগের আয়াতে চুক্তি ভঙ্গকারী শত্রুদের সঙ্গে কঠোর অচরণের নির্দেশ দেয়ার পর এ আয়াতে বলা হচ্ছে, প্রতিশোধ গ্রহণ বা জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য ইসলাম যুদ্ধ বা জিহাদের নির্দেশ দেয়নি। ইসলাম যুদ্ধ বা জিহাদের নির্দেশ দিয়েছে সামাজিক কুসংস্কার ও অন্যায় অবিচার অপনোদনের উদ্দেশ্যে। কাজেই বলা হচ্ছে, তোমাদের প্রতিপক্ষ শিবিরের কেউ যদি তোমাদের কাছে আশ্রয় চায়, তোমাদের কথা শোনার জন্য আগ্রহ ব্যক্ত করে তাহলে তোমরা তাকে সে সুযোগ দেবে। আল্লাহর দ্বীন বুঝার জন্য তোমরা তাকে সাহায্য করবে এবং তাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেবে। এরপর সে সত্য গ্রহণ করুক আর নাই করুক এটা তার অধিকার। এই আয়াতে ইসলামের উদারতা ও মহানুভবতাই ফুটে উঠেছে। কারণ আল্লাহর এই নির্দেশের ফলে যুদ্ধের ময়দানেও শত্রুপক্ষের কেউ মুসলিম শিবিরে এসে, কথা বলে ইসলাম গ্রহণ না করেই পুণরায় স্বপক্ষে যোগ দিতে পারবে। এটা ইসলাম ও আল্লাহর নবীর উদারতারই প্রমাণ বহন করে।

এই আয়াতে ইসলামের একটি মৌলিক নীতিই প্রতিফলিত হয়েছে। ইসলাম মানব জাতিকে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত করেছে। ইসলাম চায় মানুষ নিজস্ব জ্ঞান ও স্বেচ্ছায় আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করুক, এ ক্ষেত্রে যেন কোনো ভয়-ভীতি বা জোর-জুলুম কাজ না করে। এ ছাড়া আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মানুষ অজ্ঞতা বা না জানার কারণেই ভুল পথে পরিচালিত হয়। কাজেই প্রতিটি মুসলমান এবং ইসলামী সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে, আল্লাহর বাণী সুন্দরভাবে প্রত্যেক মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং সত্য গ্রহণের ব্যাপারে অন্যকে সাহায্য করা।