সূরা আত তাওবা; (১২তম পর্ব)

সূরা আত তাওবা; আয়াত ৪৮-৫১

সূরা আত তাওবার ৪৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

لَقَدِ ابْتَغَوُا الْفِتْنَةَ مِنْ قَبْلُ وَقَلَّبُوا لَكَ الْأُمُورَ حَتَّى جَاءَ الْحَقُّ وَظَهَرَ أَمْرُ اللَّهِ وَهُمْ كَارِهُونَ

“তারা (মুনাফিকরা) আগেও বিভেদ সৃষ্টির সুযোগ সন্ধানে ছিল এবং আপনার কাজগুলোকে উল্টা-পাল্টা করে দিচ্ছিল, যতক্ষণ না সত্য এসে গেল এবং আল্লাহর আদেশ ব্যক্ত হলো। যদিও তারা এতে মন্দবোধ করেছিল।” (৯:৪৮)

আগের কয়েকটি আয়াতে জিহাদের ব্যাপারে মুনাফিকদের বিভ্রান্তিকর ততপরতার কিছু অংশ ফুটে উঠেছে। আমরা তাফসিরে সে বিষয়ে মোটামুটিভাবে আলোচনাও করেছি। আগের আয়াতগুলো থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, সত্য-মিথ্যার যুদ্ধে মুনাফিক চরিত্রের মানুষদের উপস্থিতি কল্যাণকর নয় বরং তাদের উপস্থিতির ফলে তাদের কথা-বার্তা ও কাজ-কর্মে যে বিভ্রান্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয় তাতে মুসলিম বাহিনীর মনোবলের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে।

এই আয়াতে বলা হচ্ছে, আগেও দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুনাফিক চরিত্রের মানুষগুলো সত্যকে বিকৃত করে সাধারণ মানুষকে এমনকি বহু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে ধোঁকা দিয়েছে। গুজব তৈরি করা, গুজব ছড়িয়ে দেয়া, কোনো ঘটনাকে বিকৃত করা, ফেতনা এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে মুনাফিকদের চরিত্র। তারা বৈষয়িক স্বার্থে এবং সামাজিক অবস্থান ধরে রাখার জন্য অবলীলায় এসব নিকৃষ্ট কাজগুলো করে থাকে। কাজেই মুসলিম সমাজের নেতৃস্থানীয়দেরকে এসব ব্যক্তিদের ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে এটাও ঠিক যে, আল্লাহতালা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন যাতে সত্য প্রকাশিত হয়ে যায় এবং মুনাফিকদের মুখোশও উন্মোচিত হয় ও তারা অপমানিত হয়।

এই আয়াত থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, যখনই কোনো স্থানে অনৈক্য, বিভেদ ও ফেতনা দেখা দেবে তখনই কপট মুনাফিক চরিত্রের মানুষগুলোর ভূমিকা খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রত্যেক মানুষের চরিত্র যাচাই করে মুনাফিকদেরকে চিহ্নিত করতে হবে।

তবে এটাও ঠিক যে, মুনাফিকদের অশুভ পরিকল্পনা আল্লাহর ঐশি সাহায্যে ব্যর্থ হতে বাধ্য। সত্য সব সময় ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এগিয়ে যাবেই এবং এর বিজয় অবধারিত।

সূরা তাওবার ৪৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

 وَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ ائْذَنْ لِي وَلَا تَفْتِنِّي أَلَا فِي الْفِتْنَةِ سَقَطُوا وَإِنَّ جَهَنَّمَ لَمُحِيطَةٌ بِالْكَافِرِينَ

“তাদের মধ্যে এমন লোক আছে যারা বলে, আমাকে যুদ্ধ থেকে অব্যাহতি দিন এবং আমাকে পথভ্রষ্ট করবেন না। শুনে রাখো, তারাই ফিতনা বা পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত হয়ে আছে, নিঃসন্দেহে জাহান্নাম এই কাফেরদেরকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে।” (৯:৪৯)

ভীতু এবং কাপুরুষ মুনাফিকরা তাবুক যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য যেসব অজুহাত খাড়া করেছিল তার মধ্যে একটি ছিল যে, রোমক বাহিনীর সাথে থাকা সুন্দরী মেয়েরা তাদের অন্তরের ওপর প্রভাব ফেলবে। এরফলে তাদের ঈমান দুর্বল হয়ে যেতে পারে এবং তারা পথভ্রষ্ট হতে পারে। কাজেই তারা বলেছিল যুদ্ধের ব্যাপারে আমাদেরকে অব্যাহতি দিন যাতে আমরা এই ফেতনা থেকে বাঁচতে পারি।

পবিত্র কুরআন এর জবাবে বলেছে, জিহাদ বা ধর্ম যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাওয়া হচ্ছে সবচেয়ে বড় পাপ এবং এরচেয়ে বড় ফেতনা নেই-যেটা তারা করেছে। কাজেই তারা বুজুর্গ হিসেবে জাহির করার জন্য যা বলছে তা নিতান্তই অজুহাত মাত্র।

প্রকৃতপক্ষে জিহাদের ময়দানেই স্পষ্ট হয়ে যায়- কে আসল মুসলমান। অনেকেই এমন ভাব প্রকাশ করে যে, তারা যেন আল্লাহর রাসূল ও ইমামদের চেয়েও পরহেজগার। তাদের পরহেজগারী এত বেশি যে গুণাহ থেকে বাঁচার জন্য সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে জিহাদে অংশ নেবে না এটা ঠিক নয়।

এই আয়াত থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, যখনই কোনো অনৈক্য, বিভেদ ও ফেতনা দেখা দেবে, তখনই কপট বা মুনাফিক চরিত্রের মানুষগুলোর ভূমিকা খতিয়ে দেখার উদযোগ নিতে হবে। প্রত্যেক মানুষের চরিত্র যাচাই করে মুনাফিকদেরকে চিহ্নিত করতে হবে। তবে এটাও ঠিক যে, মুনাফিকদের অশুভ পরিকল্পনা আল্লাহর ঐশি সাহায্যে ব্যর্থ হতে বাধ্য। সত্য সব সময়ই ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে এগিয়ে যাবেই এবং এর বিজয় অবধারিত।

সূরা তাওবার ৫০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنْ تُصِبْكَ حَسَنَةٌ تَسُؤْهُمْ وَإِنْ تُصِبْكَ مُصِيبَةٌ يَقُولُوا قَدْ أَخَذْنَا أَمْرَنَا مِنْ قَبْلُ وَيَتَوَلَّوْا وَهُمْ فَرِحُونَ

“হে নবী! আপনার কোনো কল্যাণ হলে তারা কষ্টবোধ করে এবং কোনো বিপদ উপস্থিত হলে তারা বলে আমরা আগে থেকেই নিজেদের কাজ সামলে নিয়েছি এবং তারা ফিরে যায় উতফুল্ল চিত্তে।” (৯:৫০)

এই আয়াতে মুনাফিকদের চরিত্র এবং তাদের মনোভাব ব্যক্ত করা হয়েছে। যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা এবং এ ব্যাপারে মুসলমানদেরকে নিরুতসাহিত করার কারণ হচ্ছে- মুনাফিকরা চায় না মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করুক। মুসলমানদের বিজয় মুনাফিকদের জন্য কষ্টের কারণ। এজন্য মুসলমানদের ওপর কখনো চাপ সৃষ্টি হলে বা যুদ্ধে পরাজিত হলে মুনাফিক চরিত্রের মানুষরা দম্ভের সাথে বলে থাকে, আমরা আগেই এটা আন্দাজ করেছিলাম এজন্যই মুসলমানদের সাথে সংগ্রামে বা যুদ্ধে যাইনি।

এই সূরার ৫১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قُلْ لَنْ يُصِيبَنَا إِلَّا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَنَا هُوَ مَوْلَانَا وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ

“(হে রাসূল) ওদেরকে বলে দিন, আমাদের জন্য আল্লাহ যা নির্দিষ্ট করেছেন তা ছাড়া আমাদের অন্য কিছু হবে না। তিনি আমাদের কর্ম বিধায়ক এবং আল্লাহর ওপরই মুমিনদের নির্ভর করা উচিত।” (৯:৫১)

এই আয়াত তাদের জন্য সুস্পষ্ট জবাব যারা দম্ভ ও অহংকারের বশবর্তী হয়ে মুসলমানদের জন্য অপমানজনক মন্তব্য করে বেড়াত। আল্লাহ তার রাসূলকে নির্দেশ দেন তিনি যেন সুবিধাভোগী ও সুযোগসন্ধানী মুনাফিকদেরকে বলে দেন, মুসলমানরা পার্থিব স্বার্থ বা অন্যের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করে না, কাজেই বাহ্যিক পরাজয় তোমরা যেভাবে ব্যাখ্যা করছ তা মোটেও সঠিক নয়।

মুসলমানরা বিশ্বাস করে সকল মানুষ আল্লাহর বান্দা। অন্যায়-অবিচার এবং অসত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, প্রয়োজনে যুদ্ধ করা সকল মানুষের দায়িত্ব। এই দায়িত্ববোধ থেকে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যুদ্ধ করে। এ ক্ষেত্রে জয় পরাজয় মুসলমানদের বিবেচ্য নয়। দায়িত্ববোধ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি হচ্ছে মুসলিমদের বিবেচ্য বিষয়।  

মুসলমানরা জিহাদ করে-এটা তাদের কর্তব্য মনে করেই। এর পেছনে কর্তব্য বোধটাই কাজ করে। জয়-পরাজয় বা ফলাফল কি হবে তা বিবেচনা করা হয় না। মুসলমানরা বিশ্বাস করে জীবন ও মৃত্যু আল্লাহর হাতে। কেউ যুদ্ধে গেলেই মরে যাবে, আর ঘরে বসে থাকলে তার মৃত্যু হবে না-মুসলমানরা এই ধারণায় বিশ্বাসী নয়।