আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আত তাওবা; (১৫তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আত তাওবা; আয়াত ৬১-৬৫

সূরা তাওবার ৬১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

وَمِنْهُمُ الَّذِينَ يُؤْذُونَ النَّبِيَّ وَيَقُولُونَ هُوَ أُذُنٌ قُلْ أُذُنُ خَيْرٍ لَكُمْ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَيُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِينَ وَرَحْمَةٌ لِلَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ يُؤْذُونَ رَسُولَ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

“মুনাফিকদের মধ্যে এমন লোক আছে যারা নবীকে কষ্ট দেয় এবং বলে সে তো কর্ণপাতকারী। বলে দিন, তার কান তোমাদের জন্য যা মঙ্গল তাই শুনে। তিনি আল্লাহকে বিশ্বাস করেন এবং মুমিনদের ওপর আস্থা রাখেন, তোমাদের মধ্যে যারা মুমিন তিনি তাদের জন্য রহমতস্বরূপ, তবে যারা আল্লাহর রাসূলকে কষ্ট দেয় তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।” (৯:৬১)

আগের পর্বগুলোতে সূরা তাওবার বিস্তৃত পরিসরে কপট বা মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য, তাদের আচার-আচরণ বিশেষ করে মুমিন মুসলমান ও নবীজীর সাথে তাদের অশোভন আচরণের বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। এই আয়াতেও মুনাফিকদের আরো কিছু আচরণ সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে। রাসূলে খোদা (সা.) যখন কারো সাথে কথা বলতেন তখন অত্যন্ত খোলা মন নিয়ে কথা বলতেন, প্রতিপক্ষের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, কাউকে অবজ্ঞা করতেন না, আল্লাহর রাসূলের এই উত্তম আচরণ নিয়ে মুনাফিকরা বিদ্রুপ করে বলতো এটা আবার কেমন পয়গম্বর! সহজ-সরল মানুষের মতই দেখি তিনি সবার সাথে কথা বলেন! মুনাফিকদের এই বিদ্রুপের জবাবে এই আয়াতেপাকে মহান আল্লাহ বলেছেন, তোমরা মহানবীর যে দিকটিকে দুর্বলতা হিসেবে দেখছো, আসলে তো তা একটি ইতিবাচক দিক। এর মাধ্যমে আল্লাহর নবীর চারিত্রিক মাধুর্যতাই ফুটে উঠেছে।

আল্লাহর নবীতো কোনো স্বৈরাচারি শাসক নন যে শুধু শাসন ও শোষণ করবে, অন্যকে অবজ্ঞা করে চলবে বরং আল্লাহর রাসূল মানবজাতির পথ-প্রদর্শক হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। তাই বিনয় ও অনাড়ম্বর আচরণ তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তিনি উত্তম ও পরিশীলিত আচরণের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করে নেবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে আল্লাহর নবীর কাছে ঈমানদারদের গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি। ঈমানদারদের সাথে তার সম্পর্ক দয়া ও মমতায় পরিপূর্ণ। এই আয়াতের মাধ্যমে আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, ইসলামী সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের উচিত সাধারণ মানুষের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক রক্ষা করা তাদের সুখ-দুঃখ, অসুবিধার কথা শ্রবন করা। এটাই ইসলামী আচরণ।

সূরা তাওবার ৬২ ও ৬৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَحْلِفُونَ بِاللَّهِ لَكُمْ لِيُرْضُوكُمْ وَاللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَقُّ أَنْ يُرْضُوهُ إِنْ كَانُوا مُؤْمِنِينَ (62) أَلَمْ يَعْلَمُوا أَنَّهُ مَنْ يُحَادِدِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَأَنَّ لَهُ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدًا فِيهَا ذَلِكَ الْخِزْيُ الْعَظِيمُ

“তারা তোমাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য তোমাদের সামনে আল্লাহর নামে কসম করে অথচ তারা যদি ঈমানদার হয়ে থাকে তবে আল্লাহ ও তার রাসূলকে সন্তুষ্ট করা অত্যন্ত জরুরী।” (৯:৬২)

“তারা কি জানে না, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরোধিতা কর, তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের অগ্নি, যেখানে সে স্থায়ী হবে, এটাই চরম লাঞ্ছনা।” (৯:৬৩)

এই আয়াতে কপট বা মুনাফিকদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠেছে। মুনাফিকদের রিয়া বা লোক দেখানো আচরণের প্রতি ইঙ্গিত করে এই আয়াতে বলা হয়েছে, ওরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পরিবর্তে জনসাধারণের সন্তুষ্টি বা দৃষ্টি আকর্ষণেই তৎপর। তাদের মাথায় শুধু একটি চিন্তা, কিভাবে মানুষের সামনে ভালো থাকা যায় এবং তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া যায়। মুমিন মুসলমানরা যাতে তাদের কথা বিশ্বাস করে সেজন্য তারা আল্লাহর নামে মিথ্যা শপথ করে কথা বলে। তারা যে আল্লাহর নবীর বিরুদ্ধাচারণ করছে, এতে তাদের মনে বিন্দুমাত্র ভয় নেই। বিভিন্ন বাহানায় তারা ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্বগুলো এড়িয়ে চলে এবং সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য মিথ্যা কসম খেয়ে কথা কবলে।

এই আয়াত থেকে আমরা এটা বুঝে নিতে পারি যে, ধর্মীয় বিশ্বাসের অপব্যবহার কপট বা মুনাফিক চরিত্রের মানুষের একটি সাধারণ অভ্যাস। ঈমানদার মুসলমানদের লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। কিন্তু মুনাফিকদের উদ্দেশ্য ঠিক এর উল্টো। তাদের সব কাজের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

এই সূরার ৬৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 يَحْذَرُ الْمُنَافِقُونَ أَنْ تُنَزَّلَ عَلَيْهِمْ سُورَةٌ تُنَبِّئُهُمْ بِمَا فِي قُلُوبِهِمْ قُلِ اسْتَهْزِئُوا إِنَّ اللَّهَ مُخْرِجٌ مَا تَحْذَرُونَ

“মুনাফিকরা এ ব্যাপারে ভয় করে যে, যদি মুসলমানদের ওপর এমন কোনো সূরা নাযিল হয়ে যায়, যাতে তাদের অন্তরের গোপন বিষয় অবহিত করা হবে, সুতরাং আপনি বলে দিন ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে থাকো, আল্লাহ তা অবশ্যই প্রকাশ করবেন, যে ব্যাপারে তোমরা ভয় করছো।” (৯:৬৪)

বিভিন্ন তাফসিরে এসেছে, তাবুক যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় মুনাফিক গোষ্ঠী আল্লাহর রাসূলের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করেছিল। তারা নবী করিম (সা.) কে হত্যার উদ্দেশ্যে তার উটটিকে গোপনে মরুভূমির দিকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মহান আল্লাহ ওহী বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে নবীজীকে এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করেন এবং মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, তাবুক যুদ্ধের সময় মুনাফিকরা মুসলিম বাহিনীকে সাহায্যের পরিবর্তে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে বলতো, এরা রোমের প্রাসাদ দখল করতে চায়, তারা নাকি রোমের শাসক হবে। এসব তাচ্ছিল্য ও ব্যঙ্গাত্মক কথার মাধ্যমে তারা মুসলমানদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা করতো।

ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে অন্যের দোষ ত্রুটি গোপন রাখা। মহান আল্লাহও মানুষের দোষ-দ্রুটি গোপন রাখেন। কিন্তু মুনাফিকদের মনোভাব ও ষড়যন্ত্র তিনি ফাঁস করে দেন, এটা আল্লাহতালার নিয়ম। ঈমানদার মুসলমানদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা, তাদেরকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা মুনাফিকদের স্বভাব। কারণ মুনাফিকদের কাছে জ্ঞান এবং যুক্তির কোনো গুরুত্ব নেই।

সূরা তাওবার ৬৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلْعَبُ قُلْ أَبِاللَّهِ وَآَيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ

“আর যদি তুমি মুনাফিকদেরকে জিজ্ঞাসা কর (কেন পয়গম্বর এবং মুসলমানদেরকে উপহাস কর) তাহলে তারা বলবে, আমরা তো কথার কথা বলছিলাম এবং ক্রীড়া কৌতুক করছিলাম। বলুন, তোমরা কি আল্লাহর সঙ্গে, তার নিদর্শনের সঙ্গে এবং তার রাসূলের সঙ্গে ঠাট্টা করছিলে।” (৯:৬৫)

মুনাফিকদের কাজ-কর্ম ফাঁস হয়ে পড়লে তারা বলে, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করার জন্য আসলে আমরা এসব বলিনি। একটু মজা করা আমাদের উদ্দেশ্য ছিল। তাই আপনারা মনে কিছু নেবেন না। এসব নানান কথা তারা কসম খেয়ে বলতে থাকে। তাই মহান আল্লাহ এই আয়াতে বলেছেন, তাহলে তোমরা কি আল্লাহ ও তার রাসূলকে খেলার বস্তুতে পরিণত করেছো, যে যখন যা খুশী বলে ফেলবে এবং পরে বলবে একটু মজা করার জন্য এসব বলেছি। 

এই আয়াত থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, ধর্ম নিয়ে ঠাট্টা করা যায় না। ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা ধর্মীয় বিধান নিয়ে বিদ্রুপ করা হলে ঐশি শাস্তি অনিবার্য হয়ে পড়ে।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)