আখলাক বা চরিত্র (কর্তব্য ও অধিকার পরিচিতি)

কর্তব্য নির্ধারনের গুরুত্ব

বর্তমানে আমরা মানুষের হাতে জীবন যাপনের অসংখ্য উপকরণ দেখতে পাচ্ছি। এগুলো অর্জন এবং এগুলো থেকে উপকার হাসিল করার জন্যে মানুষকে দিনরাত প্রচেষ্টা চালাতেও দেখছি। অথচ এসব উপকরণ প্রথমে মানুষের অধীনে ছিল না। পরে ধীরে ধীরে মানবজাতির প্রচেষ্টার বদৌলতে এসব উপকরণ মানুষের ব্যবহারযোগ্য হয়েছে। মানুষ প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে বর্তমান উচ্চতম স্তর পর্যন্ত কোন সময়ই কাজ ও প্রচেষ্টা থেকে ক্ষান্ত হয়নি। বরং উত্তম জীবন-যাপনের উপকরণাদি সংগ্রহের জন্যে খোদাপ্রদত্ত সহজাত শক্তির মাধ্যমে মানুষ প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে।

এমন নয় যে মানুষ শুধু বাধ্য হয়েই কাজ করছে, বরং মানুষ হিসেবে তার বিভিন্ন কর্মপন্থা প্রদর্শন করে যাচ্ছে। মানুষ তার প্রাথমিক সচেতনতার মাধ্যমে উপলব্ধি করে থাকে যে, যেকোন পন্থায়ই হোক, তাকে জীবনের আনন্দ ও সৌভাগ্যের নিশ্চয়তা বিধানের জন্যে কাজ করতে হবে ও প্রচেষ্টা চালাতে হবে। তার প্রয়োজন সমূহ মিটাবার জন্যে তাকে পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্যেই মানুষ প্রতিটি পরিবেশেই কোন না কোন পন্থায় জীবিকা নির্বাহ করে।

মূলতঃ সৌভাগ্য অর্জনের একমাত্র পন্থা হিসেবে গণ্য কর্তব্য সমূহ ও করনীয় কাজগুলোর মূল্য ও তাৎপর্য, স্বয়ং মানবতারই মূল্য ও তাৎপর্য হিসেবে গণ্য। অন্য কিছুকেই আমরা এগুলো থেকে অধিকতর মূল্যবান ও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করতে পারিনা এবং অন্য কোনকিছুর মাধ্যমে এগুলোর পরিবর্তনও সম্ভব বলে আমরা মনে করিনা। ফলে, এ কর্তব্য সমূহ সম্পাদনের মাধ্যমে মানবতার প্রকৃত আকাঙ্ক্ষাগুলো পূরণ হয়ে থাকে। আর এগুলোই মানব জীবনকে সুন্দর ও সুখময় করে তোলে এবং তাদের সামনে সৌভাগ্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়।

সুতরাং মানুষ তার জীবনে যেসব বিষয়ের সম্মুখীন হয়, তার মধ্যে এ কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন এবং তা সম্পাদন করা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক বিষয়। কেননা, এর গুরুত্ব স্বয়ং মানুষেরই গুরুত্বের সমতুল্য। কোন ব্যক্তি যদি তার এ স্বতঃসিদ্ধ কর্তব্য সম্পাদনে বিরত থাকে, কিংবা তার সম্পাদনে ত্রুটিবিচ্যুতির আশ্রয় নেয়, তাহলে তার মানবিক মর্যাদাও অনুরূপভাবে ক্ষুন্ন হয়। স্বাভাবিকভাবেই সে তার দৈন্য ও মূল্যহীনতার কথা স্বীকার করে নেয়। অথবা যখন সে কোন আইন ভঙ্গ করে, তখন সে তার সমাজের ওপর এবং প্রকৃতপক্ষে তার নিজের অস্তিত্বের ওপর একটি নতুন আঘাত হানে।

আল্লাহ্‌ রাব্বুল আ’লামীন স্বীয় কালামে পাকে এরশাদ করেছেনঃ

﴿وَالْعَصْرِ ۞ إِنَّ الْإِنْسَانَ لَفِي خُسْرٍ ۞ إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ﴾

অর্থাৎঃ "মানুষ অবশ্যই হতভাগ্য ও ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তারা নয় যারা ঈমান পোষণ করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।” (সুরা আছর; আয়াত নং ১-৩)

আল্লাহ্‌ তায়ালা আরো এরশাদ করেছেনঃ

﴿ظَهَرَ الْفَسَادُ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ أَيْدِي النَّاسِ﴾

অর্থাৎঃ- "মানুষের কৃতকর্মের দরুন সমুদ্রে ও স্থলে (অর্থাৎ সারা বিশ্বে) বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে।” (সুরা রুম; আয়াত নং ৪১)

কর্তব্য নির্ধারনে মতভেদ

মানব জগতে কর্তব্য নির্ধারন ও তা সম্পাদনের গুরুত্ব একটি স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজন বিদিত বিষয়। এমন কোন মানুষ পাওয়া যাবেনা যে মানবীয় ফিৎরাতের অধিকারী হওয়া সত্বেও এ সত্যটিকে অস্বীকার করতে পারে। তবে যেহেতু মানবীয় কর্তব্য সমূহ সৌভাগ্য ও মানব জীবনের সাথে পুরোপুরি সম্পর্কযুক্ত এবং মানবীয় জীবন সম্বন্ধে দ্বীন, দ্বীনবহির্ভূত মতাদর্শগুলোর সাথে ভিন্নমত পোষণ করে, সেহেতু দ্বীনি কর্তব্য সমূহ ও অন্যান্য মতাদর্শ নির্ধারিত কর্তব্য সমূহের মধ্যে স্বভাবতঃই পার্থক্য দেখা যায়।

দ্বীন বিশ্বাস করে যে, মানব জীবন একটি অপরিসীম ও অন্তহীন জীবনেরই নাম যা মৃত্যুর সাথে সাথেই সমাপ্ত হয়ে যায়না। আর মৃত্যুর পর এ অনন্ত জীবনের মূলধন হচ্ছে পবিত্র ও সঠিক আকিদা-বিশ্বাস থেকে উৎসারিত সৎচরিত্র ও সৎকর্ম। যা মানুষ মৃত্যুর পূর্বে এ পৃথিবীতে অর্জন ও সম্পাদন করে থাকে। এজন্যেই ব্যক্তি ও সমাজের জন্যে দ্বীন যেসব কর্তব্য ও করনীয় কাজ নির্ধারণ করেছে তাকে চিরস্থায়ী জগতের জীবনেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। দ্বীন তার বিধিবিধান খোদা পরিচিতি ও খোদা উপাসনার আলোকে প্রণয়ন করেছে যার সুস্পষ্ট প্রতিফল মৃত্যুর পরে কিয়ামতের দিনে প্রকাশ পাবে।

ধর্মনিরপেক্ষ যেকোন মতাদর্শ শুধু এ জগতের দু’দিনের জীবনকেই গুরুত্ব প্রদান করে এবং মানুষের জন্যে এমন কয়েরটি কর্তব্য প্রণয়ন করে যেগুলোর মাধ্যমে বস্তুগত জীবনের ও দৈহিক কল্যাণ উত্তমরূপে সাধিত হয়ে থাকে। যা মানুষ ও জন্তু-জানোয়ারের মধ্যে অভিন্ন। আসলে এসব মতাদর্শে মানুষের জন্যে এমন একটি পাশবিক জীবনের পরিকল্পনা প্রদান করা হয়েছে, যা পশু-পাখীর অনুভূতি ও আবেগ থেকে উৎসারিত হয়ে থাকে।; যাতে মানুষের প্রকৃত দর্শন তথা চিরস্থায়ী ও আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি কোন গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি।

এজন্যেই অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে যে, মানবীয় মহান চরিত্র ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মহীন সমাজ থেকে ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে এবং ঐসব সমাজের সদস্যদের চারিত্রিক অবনতি দিন দিন প্রকটতর রূপ ধারণ করছে।

যদি কেউ কেউ বলেন, দ্বীনের ভিত্তি হচ্ছে তাকলিদ বা অনুসরণ। অর্থাৎ কয়েকটি কর্তব্য ও বিধিবিধানের সমষ্টিকে বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করে নেয়া। অথচ সামাজিক নিয়মাবলী যুগের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও তাল মিলিয়ে চলে।

এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, যেমন করে সমাজের প্রয়োজনীয় নিয়ম ও বিধিবিধান বাস্তবায়িত হওয়ার ক্ষেত্রে, তা বিনা দ্বিধায়ই বাস্তবায়িত হয়; তেমনি ধর্মীয় বিধিবিধানগুলোর বাস্তবায়নে একই নিয়ম প্রযোজ্য। সাধারণত যেহেতু দেশের নাগরিকরা তাদের দেশের যে বিধিবিধানের মূলতত্ত্ব বুঝতে পারেনা তা নিয়ে যুক্তিতর্ক ও সমালোচনায় লিপ্ত হয় না। কিন্তু তারা তা না বোঝার কারণে তা পালনের দায়িত্ব থেকে তাদের অব্যাহতি দেয়া হয় না। এদিক থেকে ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতি ও পন্থার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

তবে হ্যা, কোন দেশের প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি অধ্যয়ন করে এবং সে দেশের সাধারণ রীতিনীতি সম্বন্ধে গবেষণা করে ঐ দেশের কিছু সার্বিক ও নির্দিষ্ট খুটিনাটি (সামগ্রিক নয়)  বিধিবিধানের দর্শন জানা যায়।

ধর্মীয় বিধিবিধানেরও এরূপ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, বাস্তব পর্যবেক্ষণ, সৃষ্টি জগৎ ও মানুষের (বস্তুগত ও আধ্যত্মিক) সহজাত চাহিদার ওপর গবেষণার মাধ্যমে ধর্মের বিধিবিধানের সার্বিক দিকসহ কিছু খুটি নাটি বিষয় সম্পর্কে জানা এবং তার দর্শনকে উপলব্ধি করা যায়।

কোরআনে করিমে ও বহু হাদিসে উপলব্ধি, গবেষণা ও পর্যবেক্ষণের প্রতি মানুষকে আহবান করা হয়েছে। কিছু হুকুম-আহ্‌কামের সুবিধা ও উপকারের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। খোদায়ী আহ্‌কামের কারণ সমূহ বর্ণনায় হজরত রাসূলে আকরাম (সা.) ও তাঁর আহ্‌লে বাইত থেকে বহু রেওয়ায়েত দেখতে পাওয়া যায়।

কর্তব্য পরিচিতি

পবিত্র দ্বীন ইসলাম একটি সর্বকালীন ও সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থা। যা আল্লাহ্‌র তরফ থেকে মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের ব্যবস্থা হিসেবে সর্বশেষ নবীর ওপর নাজিল করা হয়েছে। মানব সমাজে এ ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করে মানবতার তরীকে অজ্ঞতা ও দুর্ভাগ্যের ঘুর্নাবর্ত থেকে উদ্ধার করা যায়।

দ্বীন যেহেতু একটি জীবন ব্যবস্থা, সেহেতু জীবনের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের জন্যে কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং মানুষকে তা পালনের নির্দেশ দিয়েছে।

আমাদের জীবন পদ্ধতি সামগ্রিকভাবে তিনটি বিষয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত:

প্রথম বিষয় স্বয়ং আল্লাহ্‌ তায়ালা–আমরা যাঁর সৃষ্টি এবং যাঁর নিয়ামতের হক অন্য যেকোন হকের চেয়ে অধিক; আর সে পবিত্র সত্তার প্রতি আমাদের যে কর্তব্য রয়েছে তা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা অন্য যেকোন ফরজ কাজ থেকে অধিকতর অপরিহার্য। দ্বিতীয় বিষয়টি আমরা নিজেরা। তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, আমাদের সমশ্রেণী মানুষ, যাদের সাথে বাধ্য হয়ে আমরা জীবন যাপন করছি এবং যাদের সাহায্য ও সহযোগিতার মাধ্যমে আমরা আমাদের কর্তব্য ও প্রচেষ্টা সম্পাদন করে থাকি।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নিয়ম মাফিক আমাদের তিনটি সামগ্রিক কর্তব্য রয়েছে –আল্লাহ্‌র প্রতি কর্তব্য, আমাদের নিজেদের প্রতি কর্তব্য এবং অন্যদের প্রতি কর্তব্য।

পরবর্তী প্রবন্ধগুলোতে আমরা উপরোক্ত তিন অধিকার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাল্লাহ্‌।

মূল: আল্লামাহ্‌ সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ হোসাইন তাবাতাবাঈ (সংক্ষিপ্ত ইসলাম পরিচিতি গ্রন্থ)

(সূত্র:আল বাসাইর)