সূরা আত তাওবা; (২২তম পর্ব)

সূরা আত তাওবা; আয়াত ৯৫-৯৯

সূরা তাওবার ৯৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

سَيَحْلِفُونَ بِاللَّهِ لَكُمْ إِذَا انْقَلَبْتُمْ إِلَيْهِمْ لِتُعْرِضُوا عَنْهُمْ فَأَعْرِضُوا عَنْهُمْ إِنَّهُمْ رِجْسٌ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ

“তোমরা জিহাদ থেকে যখন মুনাফিকদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে তখন তারা আল্লাহর শপথ করবে-যাতে তোমরা তাদের দোষ-ক্রটি উপেক্ষা কর। সুতরাং তুমি তাদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নাও। নিঃসন্দেহে তারা অপবিত্র। তাদের কৃতকর্মের ফলস্বরূপ জাহান্নাম তাদের অবাসস্থল।” (৯:৯৫)

তাবুক অভিযান থেকে মুসলমানরা যখন মদিনায় ফিরে আসে তখন যুদ্ধ ফেরারী মুনাফিকরা মুসলমানদের কাছে গিয়ে তাদের অপরাধ ঢাকা দেয়ার জন্য আল্লাহর শপথ করে নানা অজুহাত দেখানোর চেষ্টা করে এবং মুসলমানরা যাতে তাদের এই অপরাধ উপেক্ষা করে সেজন্য তারা অনুরোধ জানাতে থাকে। কিন্তু আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দেন,মুসলমানরা যেন মুনাফিকদেরকেই উপেক্ষা করে চলে এবং সামাজিকভাবে তাদেরকে যেন বয়কট করা হয়। ফলে যারা তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, এমন মুনাফিকদের সাথে লেনদেন বা মেলামেশা না করার জন্য আল্লাহর রাসূল মুসলমানদের নির্দেশ দেন।

আয়াতের শেষ অংশে তাদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থার কারণ উল্লেখ করে বলা হয়েছে,তারা অত্যন্ত গর্হিত কাজ করেছে,তাদের ভেতরটা অপবিত্র, কাজেই পরকালেও তাদের আবাসস্থল হবে জাহান্নাম।

সবসময় শপথ বা কসমকেও গুরুত্ব দেয়া যায় না। কারণ মুনাফিক বা কপট প্রকৃতির মানুষ ঈমানদারদেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্য কসম খেয়ে বা শপথ করে কথা বলে থাকে। এছাড়া এই আয়াত থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি যে, মুনাফিক এবং অসৎ মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা উচিত। তাদের সাথে সম্পর্ক না রাখাই উত্তম কাজ। কারণ মুনাফিকী এবং কপটতা সংক্রামক ব্যাধির মত। এ থেকে সকলেরই দূরে থাকা উচিত।

এই সূরার ৯৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَحْلِفُونَ لَكُمْ لِتَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنْ تَرْضَوْا عَنْهُمْ فَإِنَّ اللَّهَ لَا يَرْضَى عَنِ الْقَوْمِ الْفَاسِقِينَ

“মুনাফিকরা তোমার সামনে কসম খাবে যাতে তুমি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হও (তবে জেনে রেখো) তুমি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেও আল্লাহ কখনো সত্য ত্যাগী সম্প্রদায়ের প্রতি সন্তুষ্ট হবে না।"(৯:৯৬)

মুনাফিকরা মুসলমানদের সাথে যত সুন্দর করেই কথা বলুক, তা যে আসলে মন থেকে নয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঈমানদার মুসলমানদেরকে সন্তুষ্ট করাও তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য নয়,তারা সামাজিক প্রতিপত্তি ধরে রাখার জন্য এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বেশি বেশি কসম খায় এবং সুন্দর করে মন ভোলানো কথা বলে। নবী করিম (সা:)বলেছেন,কেউ যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে,তাতে মানুষের সমর্থন না থাকলেও আল্লাহতায়ালা মানুষের মনকে তার প্রতি সদয় করে দেন। কিন্তু কেউ যদি আল্লাহর অসন্তুষ্টিকে উপেক্ষা করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কাজ করে তাহলে আল্লাহতায়ালা মানুষের মনকে তার প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে দেন। এখানেই মূল পার্থক্য,মুনাফিক বা কপট চরিত্রের মানুষ সব সময় জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তাদের সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে। কিন্তু যারা ঈমানদার তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।

মুনাফিকদের মনে পাপ বা অপকর্মের জন্য কোন অনুশোচনাবোধ নেই, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের কোন চেষ্টাও তাদের মধ্যে নেই। মানুষকে ধোঁকা দিয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই তাদের উদ্দেশ্য। কাজেই এ ধরনের অসৎ মানুষের প্রতি সমর্থন দেয়া বা তাদের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করা উচিত নয়।

এই সূরার ৯৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

الْأَعْرَابُ أَشَدُّ كُفْرًا وَنِفَاقًا وَأَجْدَرُ أَلَّا يَعْلَمُوا حُدُودَ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ عَلَى رَسُولِهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ

"(আল্লাহর রাসূলের শিক্ষা থেকে দূরে থাকার কারণে)আরবের বেদুঈনরা কুফরী ও কপটতায় অত্যন্ত কঠোর হয়ে থাকে এবং আল্লাহ তার রাসূলের প্রতি যা অবতীর্ণ করেছেন তারা সীমারেখা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার ক্ষেত্রে এরা অধিক যোগ্য। আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।" (৯:৯৭)

রাসূলে খোদা (সা:)এর যুগে আরবের মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। আরবদের অনেকেই ছিল নগরবাসী। আবার একটি অংশ ছিল বেদুঈন বা মরুবাসী। আগের আয়াতগুলো নগরবাসী বা মদিনায় বসবাসরত মুনাফিকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু  ৯৭ নম্বর ও তার পরবর্তী দুই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে মরুবাসী বেদুঈনদের ক্ষেত্রে। এখানে বলা হয়েছে,ইসলামী শিক্ষা এবং ইসলামী সংস্কৃতির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকার কারণে ধর্মীয় জ্ঞান ও অনুভূতি যাদের কম তাদের ব্যাপারে উদাসীন বা অমনোযোগী হলে হবে না। কারণ শক্রদের প্ররোচনায় তারা অরাজকতার দিকে পা বাড়াতে পারে। এখানে আ'রাবী শব্দের অর্থ হচ্ছে- বেদুঈন বা মরুবাসী। তবে বিভিন্ন বর্ণনায় অনেক ব্যাপক অর্থেও এই পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, কোনো কোনো স্থানে এই শব্দ দিয়ে  ধর্ম ও ধর্মীয় অনুশাসনের ব্যাপারে কম জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদেরকে বুঝানো হয়েছে।

ইসলামী কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও নিয়মনীতি যেখানে অনুপস্থিত সেখানে নিয়মিত বসবাস করলে কুফর কপটতার মত মানসিক ব্যাধিগুলো মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। এই আয়াত থেকে আমরা এটা ধরে নিতে পারি যে,যারা ইসলামী অনুশাসন ও সংস্কৃতি পরিত্যাগ করে জাহেলী যুগের অনুশাসন বা সংস্কৃতিকে আকঁড়ে ধরে,পবিত্র কুরআন তাদেরকে বেদুঈন বা মরুবাসী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

সূরা তাওবার ৯৮ ও ৯৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمِنَ الْأَعْرَابِ مَنْ يَتَّخِذُ مَا يُنْفِقُ مَغْرَمًا وَيَتَرَبَّصُ بِكُمُ الدَّوَائِرَ عَلَيْهِمْ دَائِرَةُ السَّوْءِ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ (98) وَمِنَ الْأَعْرَابِ مَنْ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ وَيَتَّخِذُ مَا يُنْفِقُ قُرُبَاتٍ عِنْدَ اللَّهِ وَصَلَوَاتِ الرَّسُولِ أَلَا إِنَّهَا قُرْبَةٌ لَهُمْ سَيُدْخِلُهُمُ اللَّهُ فِي رَحْمَتِهِ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

"আরব এই বেদুঈনদের একটি দল আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের অর্থ ব্যয়কে অর্থদণ্ড বা জরিমানা হিসেবে মনে করে এবং তোমাদের ভাগ্য বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষা করে, তাদেরই ভাগ্য বিপর্যয় ঘটুক। আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।” (৯:৯৮)

“আবার বেদুঈন বা মরুবাসীদের অনেকেই আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে এবং যা ব্যয় করে তাকে আল্লাহর নৈকট্য ও রাসূলের দোয়া লাভের উপায় মনে করে। জেনে রাখো এটা তাদের জন্য আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়। আল্লাহ তাদেরকে নিজের রহমতের অর্ন্তভুক্ত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল করুণাময়।"(৯:৯৯)

এই আয়াতে দরিদ্র বঞ্চিত মানুষকে দান-খয়রাতের ব্যাপারে দুই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী ফুটে উঠেছে। যারা ইসলামী অনুশাসন এবং সংস্কৃতির সাথে ভালোভাবে পরিচিত নয় তারা এ ধরনের দান খয়রাতকে আর্থিক ক্ষতি হিসেবে এমনকি জরিমানা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে এবং যারা সাহায্য গ্রহণ করে তারা তাদের মঙ্গল কামনা না করে বরং তাদেরকে তিরস্কার করে। অপর দিকে যারা ইসলামী সংস্কৃতির সাথে পরিচিত এবং পরকালে বিশ্বাসী আল্লাহর রাস্তায় দান করাকে সৌভাগ্যের কাজ বলে মনে করে এবং বিশ্বাস করে যে, এই দান পরকালের জন্য বড় বিনিয়োগের মাধ্যমে দুনিয়াতেই মানুষের এবং নবীজির দোয়া লাভ করা সম্ভব হচ্ছে। অন্যদিকে মহান আল্লাহও পরকালে এই দানের বিনিময়ে উপযুক্ত প্রতিদান দেবেন।

মুনাফিক বা কপট চরিত্রের মানুষের মনে যেহেতু আল্লাহ ও পরকালের প্রতি আস্থা নেই তাই তারা দান খয়রাতকে আর্থিক ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করে।