আল হাসানাইন (আ.)

সূরা আত তাওবা; (২৬তম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা আত তাওবা; আয়াত ১১৩-১১৮

সূরা তাওবার ১১৩ ও ১১৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ (113) وَمَا كَانَ اسْتِغْفَارُ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ إِلَّا عَنْ مَوْعِدَةٍ وَعَدَهَا إِيَّاهُ فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ أَنَّهُ عَدُوٌّ لِلَّهِ تَبَرَّأَ مِنْهُ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ لَأَوَّاهٌ حَلِيمٌ

"আত্মীয়-স্বজন হলেও অংশীবাদী মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী ও ঈমানদারদের জন্য সংগত নয়। যখন এটা স্পষ্ট হয়ে যে তারা জাহান্নামী।” (৯:১১৩)

“ইব্রাহিম তার পিতার জন্য প্রার্থনা করেছিল। এজন্য যে, তিনি তাকে এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অতঃপর যখন এটা তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, সে আল্লাহর শক্র তখন ইব্রাহিম (আ.) তার ব্যাপারে নিস্পৃহ হন। ইব্রাহিম (আ.) তো কোমল হৃদয় ও সহনশীল।"(৯:১১৪)

তাফসীরে মাজমাউল বায়ানে এই আয়াতের শানে নযুল সম্পর্কে বলা হয়েছে, মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই আল্লাহর রাসূলের কাছে জানতে চান। তাদের মা-বাবা এবং নিকট আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যারা মুশরিক অবস্থায় মারা গেছে তাদের জন্য এস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করে দোয়া করা যাবে কি না? এই প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে সূরা তাওবার ১১৩ নম্বর আয়াতটি নাযিল হয়।

এই আয়াতে রাসূলে খোদা ও ঈমানদার মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করে সরাসরি বলা হয়েছে, আত্মীয়-স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা সংগত নয়। কারণ যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোন বস্তুকে সমকক্ষ হিসেবে দাঁড় করায় বা শিরক করে এবং সে অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় নেয় তারা জাহান্নামী। কাজেই তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা সংগত নয়। আর তা করে কোনো লাভও হবে না। তাছাড়া ক্ষমা প্রার্থনা করা বা এস্তেগফার করে দোয়া করা ভালোবাসার প্রমাণ বহন করে। এজন্য তা মুশরিকদের ক্ষেত্রে নিষেধ করা হয়েছে।

পরের আয়াতটিতে বলা হয়েছে, হযরত ইব্রাহীম (আ.) তার অভিভাবকের ব্যাপারে তখনই ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। যখন তিনি তাকে সুপথে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে  আশাবাদী ছিলেন। এজন্য তিনি তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে যদি শিরক বা অংশীবাদী বিশ্বাস পরিত্যাগ করো তাহলে অতীতের ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব। কিন্তু শিরকের ব্যাপারে তার অবিচল মনোভাবের কারণে হযরত ইব্রাহিম (আ.) তার প্রতি বিরক্ত ও নিস্পৃহ হয়ে পড়েন।

এই আয়াত থেকে আমরা বুঝে নিতে পারি যে, শিরক হচ্ছে অমার্জনীয় পাপ। মুশরিকদের জন্য আল্লাহর রাসূলও যদি ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তাতেও কোনো ফল হবে না। তবে কেউ যদি তাওবা করে এবং অনুতপ্ত হয়ে সত্য পথে ফিরে আসে তাহলে মহান আল্লাহ হয়ত তাকে ক্ষমা করে দেবেন।

এই সূরার ১১৫ ও ১১৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُضِلَّ قَوْمًا بَعْدَ إِذْ هَدَاهُمْ حَتَّى يُبَيِّنَ لَهُمْ مَا يَتَّقُونَ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ (115) إِنَّ اللَّهَ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَمَا لَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ

"আল্লাহ কোনো জাতিকে হেদায়েত করার পর পথভ্রষ্ট করেন না। যতক্ষণ না তাদের জন্য সুস্পষ্টভাবে বলে দেন, সেসব বিষয় যা তাদের পরিহার করে চলা উচিত। নিঃসন্দেহে আল্লাহ সব বিষয়ে অবহিত।” (৯:১১৫)

“আকাশ-মণ্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌম ক্ষমতা আল্লাহরই । তিনি জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু ঘটান। আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন অভিভাবক নেই। সাহায্যকারীও নেই। " (৯:১১৬)

আল্লাহ রাব্বুল আ'লামীন মানুষকে বিবেক বুদ্ধি দিয়েছেন এবং যুগে যুগে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। ঐশিবাণী অবতীর্ণ করেছেন যাতে মানবজাতি সত্য ও সঠিক পথ চিনতে পারে। মানুষের কাছে সত্যের বাণী না পৌঁছা পর্যন্ত তিনি কাউকে দোষী সাব্যস্ত করেন না বলে শাস্তি দেন না। তিনি কেবল তাদেরকেই শাস্তি দেন যাদের কাছে সত্যের বাণী পৌঁছার পরও তা অমান্য করে।

অনেক ঈমানদার মুসলমান এটা মনে করেন যে, তারা আহলে নাজাত বা মুক্তিপ্রাপ্ত, তারা বেহেশতে যাবেনই। তাদের কোন ভয় নেই, এই বিশ্বাস একজন মুসলমানের জন্য অনেক ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। কারণ একজন ঈমানদার যে উদাসিনতার কারণে পাপে নিমজ্জিত হয়ে কাফেরে পরিণত হবেন না সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না।

জেনে শুনে আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধাচারণ করার পরিণতিতে একজন ঈমানদার পথভ্রষ্ট বা গুমরাহ হয়ে পড়তে পারে কাজেই বিভ্রান্তিতে নিপতিত হওয়ার ভয় বা আশংকা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়। মানুষকে আল্লাহর বিধান সম্পর্কে অবহিত করার পর যদি সে তা অমান্য করে তাহলেই তার ওপর ঐশি শাস্তি নেমে আসে।

এই সূরার ১১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَقَدْ تَابَ اللَّهُ عَلَى النَّبِيِّ وَالْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ الَّذِينَ اتَّبَعُوهُ فِي سَاعَةِ الْعُسْرَةِ مِنْ بَعْدِ مَا كَادَ يَزِيغُ قُلُوبُ فَرِيقٍ مِنْهُمْ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ إِنَّهُ بِهِمْ رَءُوفٌ رَحِيمٌ

"আল্লাহ অনুগ্রহ পরায়ণ হলেন নবীর প্রতি এবং মুহাজির ও আনসারদের প্রতি, যারা তাবুক যুদ্ধের কঠিন মুহূর্তে (তাবুক যুদ্ধের সময়) নবীর সঙ্গে ছিল। যখন তাদের একদলের অন্তর বিভ্রান্তিতে নিপতিত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। অতঃপর তিনি পুণরায় তাদের প্রতি দয়া-পরবশ হন, নিঃসন্দেহে তিনি তাদের প্রতি দয়াশীল ও করুণাময়।" (৯:১১৭)

এই আয়াতে তাবুক যুদ্ধের সময়কার কঠিন মুহূর্তের কথাই পুণরায় স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে।

গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে মরুভূমির অসহ্য তাপ অগ্রাহ্য করে তাবুক অভিযানে অংশগ্রহণের ব্যাপারে অনেক ঈমানদার মুসলমানও  সাহস পাচ্ছিলেন না। তারা নানা বাহানায় মদীনায় থেকে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পয়গম্বর (সা.) এবং তাঁর অনুসারীদের ওপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহের ফলে শেষ পর্যন্ত মুনাফিক ছাড়া বাদবাকী মুসলমানরা তাবুক অভিযানে অংশ নেয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। এভাবে ঈমানদাররা বিভ্রান্তি এবং আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার তালিকা থেকে মুক্ত হয়েছিলেন।

কঠিন মুহূর্তে ধর্মীয় নেতাদের অনুসরণ করা প্রকৃত ঈমানদার হওয়ার লক্ষণ। প্রত্যেক মানুষ এমনকি নবী-রাসূলরাও আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের প্রত্যাশী। একজন পাপী ব্যক্তির তাওবা যদি আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় তাহলে এটাই তার জন্য সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ।

এই সূরার ১১৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَعَلَى الثَّلَاثَةِ الَّذِينَ خُلِّفُوا حَتَّى إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ الْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنْفُسُهُمْ وَظَنُّوا أَنْ لَا مَلْجَأَ مِنَ اللَّهِ إِلَّا إِلَيْهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ لِيَتُوبُوا إِنَّ اللَّهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ

"অপর তিনজন যাদেরকে (তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদাসিনতার কারণে ) পেছনে রাখা হয়েছিল, যখন (জনগণের ধিক্কারের কারণে) পৃথিবী, বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য সংকুচিত হয়ে গেল এবং তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল। আর তারা বুঝতে পারলো যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন আশ্রয়স্থল নেই। অতঃপর তিনি সদয় হলেন তাদের প্রতি, যাতে তারা তাওবা করতে পারে নিঃসন্দেহে আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।" (৯:১১৮)

বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, যে তিন জন মুসলমান তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। যুদ্ধের পর তারা অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর রাসূলের কাছে এসে নিজেদের ভুল স্বীকার করেছিল। কিন্তু আল্লাহর রাসূল তাদের সাথে কথা বললেন না। অন্য মুসলমানদেরকেও তাদের সাথে কথা বলতে নিষেধ করলেন। এমনকি তাদের স্ত্রীদেরকেও একই কাজ করতে বললেন। এরপর ওই তিন ব্যক্তি মদীনার বাইরে গিয়ে প্রত্যন্ত প্রান্তরে অনুতাপ ও অনুশোচনায় আল্লাহর দরবারে হাত তুলে কাঁদলেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। মহান আল্লাহও তাদেরকে ক্ষমা করে দেন। এরপর আল্লাহর নবী তাদেরকে তাওবা কবুল হওয়ার সুসংবাদ দেন।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)