সূরা আত তাওবা; (২৭তম পর্ব)

সূরা আত তাওবা; আয়াত ১১৯-১২২

সূরা তাওবার ১১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ

"হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।" (৯:১১৯)

এর আগে কয়েকটি আয়াতে আল্লাহর বিধান অমান্যকারীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, যারা বাস্তবে আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস করতে পারেনি বরং এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, আল্লাহর নির্দেশে মুসলমানরা তাদেরকে বয়কট করেছে। তাদেরকে তিরস্কার করেছে। ১১৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যারা ঈমান বা বিশ্বাসের দৃঢ়তার কারণে সত্যপন্থী হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন। তাদের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করা উচিত।

ঈমান বা বিশ্বাসের কতগুলো স্তর এবং পর্যায় আছে। শুধুমাত্র আল্লাহ এবং পরকালে বিশ্বাস করাই যথেষ্ট নয়। একজন ঈমানদারকে অবশ্যই কাজে-কর্মে সত ও নিষ্ঠাবান হতে হবে। শুধু মুখে বললেই ঈমান অর্জিত হয় না। অন্তরে বিশ্বাস, মৌখিক ঘোষণা এবং কার্যে তা পরিণত করাকে ঈমান বলা হয়। এই আয়াতে ঈমানদারদেরকে সত্যবাদিতার উপদেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সত্যপন্থীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকতে।

এই আয়াতের মাধ্যমে আমাদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে, সত্যবাদী ও সতকর্মশীলদের সংসর্গ- মানুষকে বিভ্রান্তি থেকে রক্ষায় সহায়তা করে এবং ভালো মানুষ হওয়ার অনুপ্রেরণা  যোগায়। নিষ্ঠা ও সত্যবাদিতার গুরুত্ব এত বেশি যে মহান আল্লাহ তার প্রিয় নিষ্পাপ অলিদের সম্পর্কে সত্যবাদী বা সাদেকীন শব্দ ব্যবহার করেছেন।

সূরা আত তাওবার ১২০ ও ১২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

مَا كَانَ لِأَهْلِ الْمَدِينَةِ وَمَنْ حَوْلَهُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ أَنْ يَتَخَلَّفُوا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ وَلَا يَرْغَبُوا بِأَنْفُسِهِمْ عَنْ نَفْسِهِ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ لَا يُصِيبُهُمْ ظَمَأٌ وَلَا نَصَبٌ وَلَا مَخْمَصَةٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَطَئُونَ مَوْطِئًا يَغِيظُ الْكُفَّارَ وَلَا يَنَالُونَ مِنْ عَدُوٍّ نَيْلًا إِلَّا كُتِبَ لَهُمْ بِهِ عَمَلٌ صَالِحٌ إِنَّ اللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ (120) وَلَا يُنْفِقُونَ نَفَقَةً صَغِيرَةً وَلَا كَبِيرَةً وَلَا يَقْطَعُونَ وَادِيًا إِلَّا كُتِبَ لَهُمْ لِيَجْزِيَهُمُ اللَّهُ أَحْسَنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

"মদীনাবাসী ও পার্শ্ববর্তী মরুবাসীদের উচিত নয় রাসূলুল্লাহর সঙ্গ ত্যাগ করে পেছনে থেকে যাওয়া এবং রাসূলের জীবনের চেয়ে নিজেদের জীবনকে প্রিয় মনে করা। কারণ আল্লাহর রাস্তায় যে তৃষ্ণা, ক্লান্তি ও ক্ষুধা তাদের স্পর্শ করে  ও তাদের যেসব পদক্ষেপ কাফেরদের মনে ক্রোধ সৃষ্টি করে এবং শক্রদের পক্ষ থেকে তাদের ওপর যে আঘাত আসে তার প্রত্যেকটি সতকর্ম হিসেবে গণ্য হয়। আল্লাহ সতকর্মপরায়ণদের শ্রমফল নষ্ট করেন না।” (৯:১২০)

“তারা অল্প বিস্তর যা কিছু ব্যয় করে, যত প্রান্তর তারা অতিক্রম করে তার সবই তাদের নামে লেখা হয়। যেন তারা যা করে আল্লাহ তার উতকৃষ্ট পুরস্কার তাদেরকে দিতে পারেন।" (৯:১২১)

পবিত্র কুরআনের কোন নির্দেশ ব্যক্তি –স্থান বা কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই আয়াতে বাহ্যত মদীনা শরীফ এবং এর আশেপাশে বসবাসরত জনগণের উদ্দেশ্যে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে তা সর্বকালে এবং সকলের জন্যই প্রযোজ্য হবে। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, এবাদত বন্দেগীই যে শুধু সতকর্ম হিসেবে বিবেচিত হবে এমন নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আল্লাহর রাস্তায় যা কিছু করা হবে সবই সতকর্ম হিসেবে গণ্য হবে। একজন ঈমানদার যদি আল্লাহর পথে ক্ষুধা-তৃষ্ণা বা অন্য কোনভাবে কষ্ট করেন তাহলে তাও আমলে সালেহ বা সতকর্ম হিসেবে বিবেচিত হবে। এবং মহান পরওয়ারদেগার তার জন্য  পুরস্কৃত করবেন। এমনকি মুসলিম দেশ বা সমাজের বিরুদ্ধে যদি শক্রপক্ষ অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক অবরোধ আরোপ করে, এরফলে মুসলমানদেরকে দুঃখ-কষ্ট স্বীকার করতে হয় সেটিও সতকর্ম হিসেবে আল্লাহ গ্রহণ করবেন।

এই আয়াতে আরও বলা হয়েছে যে, বিক্ষোভ-মিছিল বা প্রতিবাদ আন্দোলনের মত যে সব পদক্ষেপ ইসলামের শক্রদেরকে ক্ষুব্ধ করে কিন্তু ঈমানদারদেরকে অনুপ্রাণিত করে সেটাও আমলে সালেহ বা সতকর্মের অংশ  হিসেবে গণ্য হবে। মহান আল্লাহ এসব কাজের জন্য পুরস্কৃত করার অঙ্গীকার করেছেন।

এই আয়াত থেকে আমরা কয়েকটি বিষয় বুঝে নিতে পারি-

এক.  ইসলামী সমাজের নেতা হিসেবে নবী করীম (দ.)এর জীবন রক্ষা করার গুরুত্ব অন্য যে কোন মুসলমানের জীবনের চেয়ে অনেক বেশি। কাজেই ইসলামী সমাজের নেতা বা রাহবারের জীবন রক্ষার জন্য সকল মুসলমানের সচেষ্ট থাকতে হবে।

দুই. ঐশি পুরস্কার লাভের জন্য কিছু কষ্ট স্বীকার করতে হয়। কষ্ট ছাড়া রত্ম হাসিল করা যায় না।

তিন. ভালো কাজ তা কম হোক আর বেশিই হোক আল্লাহর দরবারে লিপিবদ্ধ থাকে।

এই সূরার ১২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ

"মুমিনেদের সকলের একসঙ্গে অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়। তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ বের হয় না কেন? যাতে তারা দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে। যখন তারা নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসবে তখন তাদেরকে সতর্ক করবে, যাতে তারা (পাপ ও আল্লাহর বিরুদ্ধাচারণের ব্যাপারে) সতর্ক হতে পারে।" (৯:১২২)

ইসলাম ধর্মে জ্ঞান অর্জনের জন্য বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। জ্ঞান অর্জনের জন্য হিজরত বা ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার গুরুত্ব জিহাদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এই আয়াতে ঈমানদারদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, ধর্মীয় বিধি-বিধান গভীরভাবে উপলব্ধির জন্য এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য যোগ্য-সামর্থবান একদল মুসলমানকে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে হবে এবং সুদূর কোন দেশ  বা শহরে গিয়ে হলেও জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এরপর নিজ এলাকায় ফিরে এসে জ্ঞানের আলো বিতরণের কাজে নিযুক্ত হতে হবে এবং নিজের গ্রাম বা শহরের মানুষকে ধর্মীয় বিধি-বিধান সম্পর্কে সচেতন করার জন্য কাজ করতে হবে। রাসূলেখোদা (সা.) যখন হযরত আলীকে ইয়েমেনে পাঠান তখন বলেছিলেন, হে আলী! ইয়েমেনের অধিবাসীদেরকে ধর্মীয় বিধি-বিধান এমনভাবে শেখাবে যেন তারা ধর্ম বিষয়ে সুপণ্ডিত হয়ে গড়ে ওঠে। হযরত আলীও তার সন্তানদেরকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলতেন, ফকিহ বা যোগ্য আলেম হতে হবে। কারণ ফকিহ বা ধর্মীয় আইনে সুপণ্ডিত আলেমরা হলেন পয়গম্বরদের উত্তারিকারী।

ইসলাম ধর্মে  জ্ঞান অর্জনের ব্যাপারে খুব বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এমনকি যুদ্ধ চলাকালীন সময়েও জ্ঞান চর্চার ব্যাপারে উদাসীন না থাকার জন্য সতর্ক করা হয়েছে।

এই আয়াতে জ্ঞানী ও জ্ঞান অনুসন্ধিতসুদের জন্য দু'টো হিজরত বা অভিবাসনের কথা বলা হয়েছে। একটি হচ্ছে, জ্ঞান অর্জনের জন্য হিজরত আর অন্যটি হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের পর নিজ এলাকায় প্রত্যাবর্তনের জন্য হিজরত।