নাহজুল বালাগা অবলম্বনে পরহেজগার ব্যক্তির গুণাবলী

বর্ণিত আছে যে,হাম্মাম নামক আমিরুল মোমেনিন হযরত আলীর (আ.) এক সহচর সর্বদা আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকতেন। তিনি একদিন বললেন,“হে আমিরুল মোমেনিন পরহেজগার লোকদের সম্পর্কে এভাবে একটু বর্ণনা করুন যেন আমি তাদেরকে দেখতে পাই।”আমিরুল মোমেনিন জবাব এড়িয়ে গিয়ে বললেন,“হে হাম্মাম,আল্লাহকে ভয় কর এবং সৎকর্মশীল হও । “নিশ্চয়ই,আল্লাহ তাদের সাথে আছেন যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মপরায়ণ।(সূরা আন নাহল, আয়াত: ১২৮)।”হাম্মাম এতে সন্তুষ্ট না হয়ে আমিরুল মোমেনিনকে কিছু বলতে অনুরোধ করলেন। এতে তিনি মহিমান্বিত আল্লাহর প্রশংসা ও তার রহমত প্রার্থনা করলেন এবং রাসূলের (সা.)-ওপর সালাম পেশ করে বললেনঃ

পরহেজগার ব্যক্তির গুণাবলী

এবার শোন,সর্বশক্তিমান ও মহিমান্বিত আল্লাহ সৃষ্টি-জগতের সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। বান্দার আনুগত্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন বলে তিনি সৃষ্টি করেননি অথবা তাদের পাপ থেকে নিরাপদ থাকার জন্য তিনি সৃষ্টি করেননি। কারণ কোন পাপীর পাপ তার কোন ক্ষতি করতে পারে না বা কারো আনুগত্য তার কোন উপকারে আসে না। তিনি সর্বত্র তাদের জীবনোপকরণ ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং দুনিয়াতে তাদের অবস্থান নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কাজেই,খোদা-ভীরুগণ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তাদের কথা-বার্তা যথার্থ,তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ মাত্রাবদ্ধ এবং তাদের চাল-চলন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তাদের জন্য আল্লাহ যা নিষিদ্ধ করেছেন সেসবের প্রতি তাদের চোখ বন্ধ এবং যে জ্ঞান তাদের উপকারে আসে তার প্রতি তারা কান-খাড়া রাখে। পরীক্ষার সময় তারা এমনভাবে থাকে যেন তারা আরাম-আয়েশে রয়েছে। যদি প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত না থাকতো তাহলে তাদের আত্মা পুরস্কারের আশায় ও শাস্তির ভয়ে এক মুহুর্তের জন্যও তাদের দেহে অবস্থান করতো না। তাদের হৃদয়ে স্রষ্টার মহত্ত্ব গেড়ে বসে আছে এবং স্রষ্টার মহত্ত্ব ছাড়া সব কিছুই তাদের দৃষ্টিতে নগণ্য। এ জন্য বেহেশত তাদের কাছে অতি নগণ্য যদিও তারা এর সুখ ভোগ করছে এবং দোযখও তাদের কাছে অতি নগণ্য যদিও তারা এর শাস্তি ভোগ করছে। তাদের হৃদয় শোকাহত,তারা পাপ থেকে সংরক্ষিত,তাদের দেহ কৃশ,তাদের অভাব-অনটন নেই বললেই চলে এবং তাদের আত্মা পবিত্র। তারা অল্প সময়ের দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে চিরস্থায়ী আরাম-আয়েশ অর্জন করে। এটা অত্যন্ত উপকারী লেনদেন যা আল্লাহ তাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন। দুনিয়া তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে,কিন্তু তারা দুনিয়ার দিকে ভ্রক্ষেপও করে না। দুনিয়া তাদেরকে ঘিরে ধরে,কিন্তু তারা নিজেদেরকে মুক্তিপণ দিয়ে বিনিময়ে দুনিয়া থেকে মুক্ত হয়ে গেছে।

পরহেজগার ব্যক্তির রাত্রিযাপন

রাত্রিকালে তারা পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে সুপরিমিত উপায়ে কুরআন তেলাওয়াত করে;এতে তাদের হৃদয়ে শোকের সৃষ্টি হয় এবং এতে তারা তাদের রোগের চিকিৎসা অনুসন্ধান করে। যখন তারা বেহেশত সম্বন্ধে কোন আয়াত পড়ে তখন তারা বেহেশতের জন্য লোভী হয়ে পড়ে এবং তাদের আত্মা এমনভাবে তার প্রতি ঝুকে পড়ে যেন তারা তাকে সম্মুখে দেখতে পায়। আবার যখন তারা দোযখের ভয় সংক্রান্ত আয়াত তেলাওয়াৎ করে তখন তারা এমনভাবে হৃদয়ের কান পেতে রাখে যেন তারা দোযখের শব্দ ও ক্রন্দন শুনতে পাচ্ছে। তারা রুকু করে,সেজদাবনত হয়ে মহিমান্বিত আল্লাহর কাছে সনির্বন্ধ মিনতি জানায়।

পরহেজগার ব্যক্তির দিনাতিপাত

দিবাভাগে তারা সহীষ্ণু,প্রাজ্ঞ,পরহেজগার ও খোদা-ভীরু। আল্লাহর ভয় তাদেরকে তীরের মতো কৃশ করে ফেলেছে। যে কেউ তাদের দিকে তাকালে তাদেরকে মনে করবে রুগ্ন,আসলে তা নয়। কেউ কেউ মনে করবে তারা পাগল;আসলে আল্লাহর ভয় তাদেরকে পাগল করে দিয়েছে। তারা তাদের অল্প সৎ আমলে সন্তুষ্ট হয় না এবং তাদের সৎ আমলকে বৃহৎ কিছু মনে করে না। তারা সর্বদা নিজেদেরকে দোষারোপ করে এবং তাদের কাজের জন্য ভীত সন্ত্রস্ত থাকে। যদি তাদের কাউকে প্রশংসা করা হয় তখন সে বলে,“আমি আমার নিজকে অন্যদের চেয়ে বেশি জানি এবং আমার প্রভু আমাকে তদপেক্ষা বেশি জানেন। হে আল্লাহ,তারা যেরূপ বলে আমার সাথে সেরূপ ব্যবহার করো না,তারা আমার সম্পর্কে যা চিন্তা করে তা অপেক্ষা আমাকে ভালো করে দাও এবং আমার যে সব দোষের কথা তারা জানে না। সে সব অপরাধ আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

পরহেজগার ব্যক্তির আলামত

এসব লোকের বৈশিষ্ট্য হলো-তারা দ্বীনে শক্তিশালী,কোমলতার সাথে দৃঢ়-সংকল্প,ইমানে সুদৃঢ়,জ্ঞানার্জনে আগ্রহী,ঐশ্বর্যে নমনীয়,ইবাদতে আসক্ত,উপোসে তৃপ্ত,দুঃখ-কষ্টে ধৈর্যশীল,হালালের প্রত্যাশী,হেদায়েতে আনন্দিত এবং লোভ-লালসার প্রতি ঘৃণাশীল। তারা ধার্মিকতার কাজ করে,কিন্তু তবুও ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে। সন্ধ্যায় তারা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে এবং ভোরে আল্লাহর জেকেরের জন্য উদ্বীগ্ন থাকে। তারা ভয়ের মধ্যে রাত্রিযাপন করে পাছে আল্লাহকে ভুলে রাত্রি চলে যায় এবং ভোরে আনন্দে উত্থিত হয় কারণ আল্লাহর নেয়ামত ও রহমত লাভ করেছে। যদি তারা নিজে কোন কিছু সহ্য করতে অস্বীকার করে তা শত চেষ্টা করেও তাদের কাছে আসতে পারে না। চিরস্থায়ী বিষয় হলো তাদের চোখের শীতলতা। ইহকালের কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয় বলে তারা তা থেকে দূরে সরে থাকে। তারা ধৈর্য সহকারে অন্যের থেকে জ্ঞান আহরণ করে এবং আমল সহকারে বক্তব্য পেশ করে।

তোমরা দেখতে পাবে,তাদের আশা-আকাঙ্খা অতি পরিমিত,দোষ-ত্রুটি নগণ্য,হৃদয় ভয়ে কম্পিত,আত্মা তৃপ্ত,খোরাক সামান্য ও সাধারণ,দ্বীন নিরাপদ,লালসা মৃত এবং ক্রোধ প্রদমিত। তাদের কাছ থেকে শুধু মঙ্গল আর কল্যাণই আশা করা যায়। তাদের কাছ থেকে মন্দ কিছু পাবার ভয় নেই। যারা আল্লাহকে ভুলে থাকে তাদের মাঝেও তারা আল্লাহর জেকেরকারী;আবার যারা আল্লাহর জেকেরকারী তাদের মাঝে তারা আল্লাহকে ভুলে থাকে না। অবিচারকারীদের প্রতিও তারা ক্ষমাশীল এবং যারা তাদেরকে বঞ্চিত করে তাদেরকেও তারা প্রদান করে। তাদের প্রতি যারা অসদাচরণ করে তাদের প্রতি তারা সদাচরণ করে ।

অশোভন উক্তি তাদের কাছে পাওয়া যায় না,তাদের গলার স্বর কোমল,তাদের মাঝে মন্দের কোন অস্তিত্ব নেই,সৎগুণ সদা বিরাজমান,কল্যাণে তারা অগ্রণী এবং ফেতনা তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। দুর্যোগের সময় তারা মর্যাদাশীল,দুঃখ-দুর্দশায় ধৈর্যশীল এবং সুসময়ে তারা কৃতজ্ঞচিত্ত। যাকে তারা ঘৃণা করে তার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে না এবং যাকে তারা ভালোবাসে তার খাতিরে পাপ করে না। প্রমাণ দাঁড় করানোর আগেই তারা সত্যকে স্বীকৃতি দেয়। তারা কখনো আমানতের খেয়ানত করে না এবং যা স্মরণ রাখা দরকার তা কখনো ভুলে যায় না। তারা কখনো অন্যকে গাল-মন্দ করে না,প্রতিবেশীর কোন ক্ষতি সাধন করে না,অন্যের দুর্ভাগ্যে আনন্দ অনুভব করে না,কখনো বিভ্রান্তিতে পা দেয় না এবং ন্যায় ও সত্য হতে কখনো সরে যায় না ।

যদি তারা নীরব থাকে তবে তাদের নীরবতা তাদেরকে শোকাহত করে না,যদি তারা হাসে তবে অট্টহাসি দেয় না এবং তাদের প্রতি কেউ অন্যায় করলে আল্লাহ্ কর্তৃক প্রতিশোধ গ্রহণ করা পর্যন্ত তারা ধৈর্যধারণ করে থাকে। তারা নিজের কারণেই দুর্দশাগ্রস্থ,কিন্তু অন্যরা তাদের কাছ থেকে উপকার পায়। তারা পরকালীন জীবনের খাতিরে নিজেকে অভাব-অনটনে রেখেছে এবং মানুষ তাদের কাছ থেকে নিরাপদ অনুভব করে। কঠোর তপস্যা ও পবিত্রতা দ্বারা তারা অন্যদের কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখে এবং নমনীয়তা ও দয়া দ্বারা তারা তাদের নিকটবর্তী হয়। আত্মশ্লাঘার কারণে তারা অন্যদের কাছ থেকে দূরে থাকে না আবার বঞ্চনা ও প্রতারণা করার জন্য তারা কারো নিকটবর্তী হয় না।

বর্ণিত আছে যে,আমিরুল মোমেনিনের বক্তব্য শুনে হাম্মাম মুর্ছিত হয়ে পড়েছিল এবং মৃত্যুবরণ করেছিল। তখন আমিরুল মোমেনিন বললেন,আল্লাহর কসম,এ ভয়েই আমি প্রথমে তার অনুরোধ এড়িয়ে গিয়েছিলাম। মনে দাগ কাটতে সক্ষম উপদেশ ভাবগ্রাহী হৃদয়ে এভাবেই ফলপ্রসূ হয়। কেউ একজন বললো,“হে আমিরুল মোমেনিন,আপনার উপদেশ হাম্মামের ওপর যেরূপ ফলপ্রসূ হয়েছে,আপনার ওপর সেরূপ হয়নি কেন?” আমিরুল মোমেনিন বললেন,তোমার ওপর লানত;মৃত্যুর জন্য নির্ধারিত সময় রয়েছে যা এগিয়েও আনা যায় না,পিছিয়েও নেয়া যায় না এবং মৃত্যুর কারণও পরিবর্তন করা যায় না। দেখ,এ ধরনের কথা,যা শয়তান তোমার জিহ্বায় রেখেছে,আর কখনো পুনরাবৃত্তি করো না ।#আল-হাসানাইন

(জেহাদুল ইসলাম কর্তৃক অনূদীত নাহজুল বালাঘা থেকে সংকলিত)