সূরা ইউনুস;(৫ম পর্ব)

সূরা ইউনুস; আয়াত ১৯-২৩

সূরা ইউনুসের ১৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন-

وَمَا كَانَ النَّاسُ إِلَّا أُمَّةً وَاحِدَةً فَاخْتَلَفُوا وَلَوْلَا كَلِمَةٌ سَبَقَتْ مِنْ رَبِّكَ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ فِيمَا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ

"মানুষ ছিল একই জাতি, পরে তারা মতভেদ সৃষ্টি করে। তোমার প্রতিপালকের পূর্ব ঘোষণা না থাকলে তারা যে বিষয়ে মতভেদ ঘটায় তার মীমাংসা তো হয়েই যেতো।" (১০:১৯)

সব মানুষই একত্ববাদের মন-মানসিকতা বা একত্ববাদের স্বভাব প্রকৃতি নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। এই বিবেচনায় সৃষ্টির শুরুতে সব মানুষ ছিল এক জাতি। কিন্তু কালের পরিক্রমায় বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতির কারণে মানুষের মনে শিরক বা বহুত্ববাদের ধারণা জন্ম নেয়। এর পরিণতিতে মানব সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক ভাগ হচ্ছে একত্ববাদ বা সত্যের নিশানদার আর অপর ভাগ হচ্ছে দ্বিত্ব বা বহুত্ববাদে বিশ্বাসী।

বিশ্ব প্রতিপালক মহান আল্লাহ মানুষকে বিবেক বৃদ্ধি দিয়েছেন, সত্য ও মিথ্যা উপলব্ধির যোগ্যতা দিয়েছেন এবং তিনি এটা চেয়েছেন যে মানুষ তার ইচ্ছা ও বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে নিজের পথ নির্ধারণ করুক। যারা বিভ্রান্ত ও বিচ্যুত হয় আল্লাহ তাদের ইচ্ছা ও কাজে কোন বাঁধা সৃষ্টি করেন না, এই জগতে মানুষকে এক্ষেত্রে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। এই আয়াতে এ বিষয়ে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, প্রকৃতির নিয়ম যদি এটা হতো, আর আল্লাহ যদি এই জগতেই মানুষকে প্রতিদান দিয়ে দিতেন তাহলে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের মধ্যকার মতভেদ এখানেই মিটে যেত।

মতবিরোধ, মতভেদ এ সব মানব সমাজের অপরিহার্য একটি বিষয়। মানুষ তার ইচ্ছা ও কর্মে স্বাধীন, এটাই মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট্য। মানুষ তার বিচার বুদ্ধির মাধ্যমে নিজস্ব পথ বেছে নেবে, সত্যকে গ্রহণ করবে, অসত্যকে প্রত্যাখ্যান করবে, এটাই মানুষের  জন্য মাহাত্ম বা গৌরব। বিশ্বাস যদি জোর জবরদস্তির মাধ্যমে হয় তাহলে তাতে মাহাত্ম্যের কিছু নেই।

সূরা ইউনুসের ২০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন :

 وَيَقُولُونَ لَوْلَا أُنْزِلَ عَلَيْهِ آَيَةٌ مِنْ رَبِّهِ فَقُلْ إِنَّمَا الْغَيْبُ لِلَّهِ فَانْتَظِرُوا إِنِّي مَعَكُمْ مِنَ الْمُنْتَظِرِينَ

"তারা বলে তার প্রতিপালকের নিকট থেকে কোনো নির্দশন বা আশ্চর্যজনক ঘটনা কেন তার কাছে অবতীর্ণ হয় না? বলুন! অদৃশ্যের জ্ঞান তো কেবল আল্লাহরই আছে। সুতরাং তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমিও তোমাদের সঙ্গে প্রতীক্ষা করছি।" (১০:২০)

প্রত্যেক নবী-রাসূলই মুজিযার অধিকারী ছিলেন। মুজিযা হচ্ছে- আশ্চর্যজনজক বা অলৌকিক এমন কিছু বিষয় যা কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। বিশ্বনবীরও এ রকম মুজিযা ছিল। তবে পবিত্র কুরআনকেই বিশ্বনবীর সবচেয়ে বড় মুজিযা হিসেবে মনে করা হয়। কারণ এ ধরনের বিজ্ঞানময় কোনো গ্রন্থ মানুষের পক্ষে রচনা করা সম্ভব নয়। আজ পর্যন্ত কোনো মানুষ এত নিগুঢ় অর্থ সম্পন্ন কোনো গ্রন্থ কুরআনের পাশে দাঁড় করাতে পারেনি। কিন্তু মক্কার মুশরিকরা সব সময়ই শুধু অজুহাত খুঁজে বেড়াতো। তারা প্রতিদিনই নতুন নতুন মুজিযা দেখানোর জন্য আল্লাহর রাসূলের প্রতি আবদার করতো। মুশরিকদের এসব অযাচিত আবদারের জবাবে আল্লাহর রাসূল বললেন, মুজিযা আমার হাতে নয় বরং তা সম্পূর্ণ আল্লাহর হাতে। আল্লাহ যখন চান তখনই কেবল মুজিযা সংঘটিত হয়।

আসলে মুশরিকদের অবদার সত্য উপলব্ধির জন্য ছিল না, তারা রং-তামাশা বা আনন্দ করার জন্য তারা মুজিযার আবদার করতো।

আগের আয়াতেও বলা হয়েছে, তাদের আবদার সব সময়ই ছিল অযৌক্তিক। তারা এই কুরআনের পরিবর্তে ভিন্ন কুরআন উপস্থাপনেরও দাবি জানিয়েছিল। এ ছাড়া, তারা বলতো, আপনি যদি সত্যিই নবী হয়ে থাকেন তাহলে আকাশে উড়ে দেখান তো, অথবা বলুনতো আপনার স্বর্ণনির্মিত প্রাসাদ নেই কেন?

নবী-রাসূলদের অলৌকিক ক্ষমতা আল্লাহরই প্রদত্ত। সত্যকে প্রতিভাত করার জন্য পয়গম্বরগণ আল্লাহরই ইচ্ছায় এমন কিছু অসাধারণ কাজ সম্পাদন করেন যা সাধারণ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। পয়গম্বরগণ ইচ্ছা করলেই এসব অলৌকিক কর্ম বা মুজিযা সম্পন্ন করার ক্ষমতা রাখেন না বরং আল্লাহ  যখন চান তখনই পয়গম্বরগণ সে ক্ষমতা অর্জন করে থাকেন।

সূরা ইউনুসের ২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذَا أَذَقْنَا النَّاسَ رَحْمَةً مِنْ بَعْدِ ضَرَّاءَ مَسَّتْهُمْ إِذَا لَهُمْ مَكْرٌ فِي آَيَاتِنَا قُلِ اللَّهُ أَسْرَعُ مَكْرًا إِنَّ رُسُلَنَا يَكْتُبُونَ مَا تَمْكُرُونَ

“মানুষকে দুঃখ-দুর্দশা স্পর্শ করার পর আমি যখন তাদেরকে অনুগ্রহের আস্বাদ দেই তখন তারা (কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে) ততক্ষণাত আমার নিদর্শনকে বিদ্রুপ করে। বলুন! আল্লাহ বিদ্রুপের শাস্তি দানে আরও ততপর। তোমরা যে বিদ্রুপ কর তা আমার ফেরশতাগণ লিখে রাখে।" (১০:২১)

একবার মক্কায় প্রচণ্ড খরা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে দুঃখ-দুর্দশা ও ভয়াবহ খাদ্য সংকটে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর রাসূল দোয়া করেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পয়গম্বরের দোয়া কবুল করেন। এরপর মওসুমি বৃষ্টির ফলে মক্কায় আবার স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু মুশরিকরা প্রচার করতে থাকে, তাদের দেব-দেবীর কল্যাণে এই বৃষ্টিপাত হয়েছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সূরা ইউনুসের ২১ নম্বর আয়াতটি অবতীর্ণ হয়ে। এখানে মুশরিকদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, যদি সত্যিই তোমরা সত্য অনুসন্ধানী হয়ে থাকতে তাহলে এটা বুঝতে পারতে যে, এই বৃষ্টির ঘটনাটি ছিল আসলে আল্লাহর মুজিযা।

কিন্তু তোমরা আল্লাহর এই অনুগ্রহের কথা স্বীকার না করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছো এবং এত বড় একটি ঘটনাকে নিষ্প্রাণ প্রতিমার কাজ বলে প্রচার করেছো। মুশরিকদের এটা জেনে রাখা উচিত, অসংখ্য-অগণিত ফেরেশতা মানুষের কৃতকর্মের খতিয়ান লিখে যাচ্ছেন। কাজেই এতে কোন সন্দেহ নেই যে, শেষ বিচারের দিন মুশরিকদেরকে তাদের  সকল কথা ও কাজের জন্য হিসাব দিতে হবে। তবে তাদের প্রতারণা ও অকৃতজ্ঞতার জন্য এ জগতেও তারা আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হবে। আল্লাহর বিচার থেকে রেহাই পাওয়ার কোন রাস্তা তাদের নেই।

সূরা ইউনুসের ২২ ও ২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

هُوَ الَّذِي يُسَيِّرُكُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ حَتَّى إِذَا كُنْتُمْ فِي الْفُلْكِ وَجَرَيْنَ بِهِمْ بِرِيحٍ طَيِّبَةٍ وَفَرِحُوا بِهَا جَاءَتْهَا رِيحٌ عَاصِفٌ وَجَاءَهُمُ الْمَوْجُ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ وَظَنُّوا أَنَّهُمْ أُحِيطَ بِهِمْ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ لَئِنْ أَنْجَيْتَنَا مِنْ هَذِهِ لَنَكُونَنَّ مِنَ الشَّاكِرِينَ (22) فَلَمَّا أَنْجَاهُمْ إِذَا هُمْ يَبْغُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّمَا بَغْيُكُمْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ مَتَاعَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ثُمَّ إِلَيْنَا مَرْجِعُكُمْ فَنُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ

“তিনিই তোমাদেরকে জলে ও স্থলে ভ্রমণ করান এবং তোমরা যখন নৌকায় আরোহণ কর ও নৌকাগুলো আরোহী নিয়ে অনুকূল বাতাসে চলতে থাকে তখন আরোহীগণ তাতে আনন্দিত হয়। এরপর এগুলো যখন ঝড়ের কবলে পড়ে এবং চতুর্দিক থেকে তরঙ্গাহত হয় তখন তারা মনে করতে থাকে মৃত্যু তাদেরকে পরিবেষ্টন করে ফেলেছে, আর তখন তারা আন্তরিক বিশ্বাসে আল্লাহকে ডেকে বলে, তুমি এ থেকে আমাদেরকে মুক্ত করলে অবশ্যই আমরা কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হব।” (১০:২২)

“এরপর তিনি যখনই তাদেরকে বিপদমুক্ত করেন তখনই তারা দেশে অন্যায়ভাবে দৌরাত্ম করতে থাকে। হে মানুষ! এই দৌরাত্ম আসলে তোমাদের নিজেদের প্রতিই হয়ে থাকে। পার্থিব জীবনের সুখ অতি ক্ষণিকের জন্য, পরে আমারই কাছে তোমাদেরকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তখন আমি তোমাদেরকে তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবো।" (১০:২৩)

এ পর্বের শুরুতেই বলা হয়েছে, একত্ববাদ বা একজন স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস হচ্ছে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এই আয়াতে বলা হয়েছে, ভোগ বিলাসিতা এবং পার্থিব জগতের চাকচিক্য মানুষের এই সহজাত প্রবৃত্তিকে ম্লান করে দেয়। কিন্তু মানুষ যখন চরম কোন সংকটে পড়ে এবং আশা-ভরসার কিছু পায় না তখন তার মধ্যকার সুপ্ত ওই প্রবৃত্তি আবার জেগে ওঠে। তখন সঙ্কট থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় সে মন থেকে আল্লাহকে ডেকে ওঠে এবং তার সাহায্য কামনা করে। কিন্তু এটা দুঃখজনক যে, মানুষ অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু ভুলে যায় এবং আবার সৃষ্টিকর্তার অবাধ্য হয়ে যায়। সে ভুলে যায় তার এ জীবন ক্ষণস্থায়ী, তাকে স্রষ্টার আহবানে সাড়া দিয়ে আবার ফিরে যেতে হবে।

হ্যাঁ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সঙ্কট মানুষের ফিতরত বা সহজাত প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলে। তাই মৃত্যুর দুয়ারে একজন নাস্তিককেও সৃষ্টিকর্তার স্মরণাপন্ন হতে দেখা যায়।

তবে দুর্যোগকালে ক্ষণিকের জন্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি এই যে বিশ্বাস, তার কোনো মূল্য আল্লাহর কাছে নেই। ঈমানের মূল্য তখনই যখন তা হবে স্বতঃস্ফুর্ত এবং সব সময়ের জন্য। একজন প্রকৃত ঈমানদার যখন সুখে থাকেন তখনও আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখেন, আবার দুর্যোগ এলেও তিনি আল্লাহর ওপর আস্থা হারান না।