সূরা ইউনুস;(৯ম পর্ব)

সূরা ইউনুস; আয়াত ৩৯-৪৪

সূরা ইউনুসের ৩৯ ও ৪০ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

بَلْ كَذَّبُوا بِمَا لَمْ يُحِيطُوا بِعِلْمِهِ وَلَمَّا يَأْتِهِمْ تَأْوِيلُهُ كَذَلِكَ كَذَّبَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الظَّالِمِينَ (39) وَمِنْهُمْ مَنْ يُؤْمِنُ بِهِ وَمِنْهُمْ مَنْ لَا يُؤْمِنُ بِهِ وَرَبُّكَ أَعْلَمُ بِالْمُفْسِدِينَ

"কাফেররা যেসব বিষয়ের জ্ঞান আয়ত্ত করেনি, সেসব বিষয়কে তারা মিথ্যা সাব্যস্ত করে। অথচ এর নিগুঢ় তত্ত্ব তাদের কাছে এখনও সুস্পষ্ট হয়নি। এভাবে ওদের পূর্ববর্তীগণও মিথ্যা আরোপ করেছিল। সুতরাং দেখ সীমালংঘনকারীদের পরিণাম কি হয়েছে!” (১০:৩৯)

“ওদের মধ্যে কেউ এতে বিশ্বাস করে এবং কেউ এতে বিশ্বাস করে না এবং তোমাদের প্রতিপালক অশান্তি সৃষ্টিকারীদের সম্বন্ধে সম্যক অবহিত।"(১০:৪০)

এর আগে কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, কাফের মুশরিকরা পবিত্র কুরআনের সত্যতার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলতো, কুরআন যে একটি ঐশীগ্রন্থ এবং কুরআনে যা বলা হয়েছে তা যে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহরই বাণী সে ব্যাপারে তারা সন্দেহের উদ্রেক করতো। সূরা ইউনুসের ৩৯ নম্বর আয়াতে এসব কাফের মুশরিকদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, তারা যুক্তি প্রমাণ ছাড়াই তাদের পূর্বসূরীদের কথাই পুনরাবৃত্তি করছে। কারণ প্রত্যেক পয়গম্বরই এ ধরনের অপবাদের মুখোমুখী হয়েছেন। তবে এসব মানুষের মধ্যে অনেকেই শেষ পর্যন্ত সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় এবং নির্দ্বিধায় সত্যকে গ্রহণ করে নেয়। আবার অনেকেই এই সৌভাগ্য অর্জন করতে সক্ষম হয় না। এসবই আল্লাহর ইচ্ছা, কারণ মহান প্রতিপালক আল্লাহরাব্বুল আলামীন মানুষকে চিন্তার স্বাধীনতা দিয়েছেন, তাই যে কেউ সত্যকে গ্রহণ করতে পারে, আবার তার বিপক্ষেও অবস্থান নিতে পারে।

এই আয়াত থেকে বুঝা যায়, অজ্ঞতা ও সত্য বিমুখতা হচ্ছে কুফরী ও শিরকের প্রধান কারণ। কেউ যদি যুক্তি ও জ্ঞানকে প্রাধান্য দেয় এবং সত্য উপলব্ধির চেষ্টা করে তাহলে নিঃসন্দেহে সত্য তার সামনে উদ্ভাসিত হবেই।

এ অবস্থায় উপনিত হওয়ার পর নবী-রাসূলদের প্রদর্শিত পথে চলার ক্ষেত্রে কোনো দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকে না।

এই সূরার ৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 وَإِنْ كَذَّبُوكَ فَقُلْ لِي عَمَلِي وَلَكُمْ عَمَلُكُمْ أَنْتُمْ بَرِيئُونَ مِمَّا أَعْمَلُ وَأَنَا بَرِيءٌ مِمَّا تَعْمَلُونَ

"হে পয়গম্বর, তারা যদি আপনার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে তবে আপনি বলে দিন আমার কর্মের দায়িত্ব আমার এবং তোমাদের কর্মের দায়িত্ব তোমাদের। আমি যা করি সে ব্যাপারে তোমরা দায়ী নও এবং তোমরা যা কর সে বিষয়েও আমি দায়ী নই।"(১০:৪১)

এই আয়াতে অবিশ্বাসী এবং ইসলাম বিরোধীদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তারা যদি ইসলামের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় তাহলে উদ্বিগ্ন বা দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। আপনার দায়িত্ব হচ্ছে পথ প্রদর্শন করা। এর বাইরে নবী-রাসূল বা ইসলামপন্থীদের কোনো দায়িত্ব নেই। কারণ জোর বা প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করাকে ইসলাম কোনভাবেই সমর্থন করে না। ইসলাম ধর্ম মতে ধর্মীয় বিশ্বাস হতে হবে, প্রজ্ঞার ভিত্তিতে এবং স্বেচ্ছা প্রণোদিতভাবে।

কাজেই কাফের মুশরিকরা সত্যকে বুঝার চেষ্টা করে না। আবার তাদের অনেকেই বুঝার পরও সত্য গ্রহণের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত। অনেকে আবার অন্য ধর্ম বা মতবাদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে মুসলমান হতে চায়। যেমন ইসলামের কিছু অংশ বাদ দিয়ে এবং অন্য মতবাদের কিছু অংশ গ্রহণ করে মুসলিম জামাতের অংশ হতে চায়। কিন্তু এভাবে আধা-আধি মুসলমান হওয়ার কোনো ব্যবস্থা ইসলামে নেই। পবিত্র কুরআনের কোনো অংশ বাদ দেয়া বা তাতে কিছু সংযোজন করার অধিকার কারো নেই। কাজেই এই আয়াতে বলা হয়েছে, হে রাসূল! আপনি কাফেরদেরকে বলে দিন, তোমাদের কাজ কর্ম এবং ধ্যান ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়, তোমরা যেহেতু সত্যকে গ্রহণ করলে না তাই তোমাদের প্রতি আমার কোনো দায়িত্বও থাকলো না।

এই আয়াত থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, জোর জবরদস্তির কোনো স্থান ইসলামে নেই। ঈমান বা বিশ্বাস হতে হবে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এবং স্বাধীন চিন্তা ও ইচ্ছার ভিত্তিতে।

এই সূরার ৪২, ৪৩ ও ৪৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

 وَمِنْهُمْ مَنْ يَسْتَمِعُونَ إِلَيْكَ أَفَأَنْتَ تُسْمِعُ الصُّمَّ وَلَوْ كَانُوا لَا يَعْقِلُونَ (42) وَمِنْهُمْ مَنْ يَنْظُرُ إِلَيْكَ أَفَأَنْتَ تَهْدِي الْعُمْيَ وَلَوْ كَانُوا لَا يُبْصِرُونَ (43) إِنَّ اللَّهَ لَا يَظْلِمُ النَّاسَ شَيْئًا وَلَكِنَّ النَّاسَ أَنْفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ

“ওদের মধ্যে কেউ কেউ তোমার কথার দিকে কর্ণপাত করে, কিন্তু তারা না বুঝলে তুমি কি বধিরকে তোমার কথা শোনাতে পারবে?” (১০:৪২)

“ওদের মধ্যে কেউ কেউ তোমার দিকে তাকিয়ে থাক, কিন্তু তুমি কি অন্ধ অন্ধকে পথ দেখাতে পারবে?” (১০:৪৩)

“নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি কোনো জুলুম করেন না, মানুষ নিজেই নিজের প্রতি জুলুম করে থাকে।"(১০:৪৪)

আল্লাহর রাসূলের যুগেও অনেক মানুষ নবীজীর আলোচনায় বসতো, কথা শুনতো কিন্তু তাদের মধ্যে কোন প্রভাব পড়তো না। তাদের সম্পর্কেই বলা হয়েছে, তাদের অন্তরে সত্যের বাণী কোনো প্রভাব ফেলে না, তারা যেন অন্ধ বা বধিরের মতো। এর কারণ হচ্ছে তারা আসলে সত্য উপলব্ধি করতে চায় না। ফলে সত্যের বাণীও তাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে না।

মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে মানুষের জ্ঞান ও চিন্তা শক্তি রয়েছে যা অন্যান্য প্রাণীর নেই। মানুষের যেমন দেখা বা শোনার শক্তি আছে পশু-পাখিরও তেমনি দেখা বা শ্রবণের শক্তি রয়েছে। কিন্তু পশু-পাখি তাদের দেখা বা শোনার বিষয়কে নিয়ে চিন্তা করতে পারে না। মানুষের উচিত তার জ্ঞান প্রজ্ঞাকে কাজে লাগানো। সত্য মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে সত্যকে গ্রহণ করতে না পারলে মানুষের ও অন্যান্য প্রাণীর আর কি পার্থক্য থাকে!

আল্লাহতায়ালা মানুষকে জ্ঞান বুদ্ধি দিয়েছেন সত্য উপলব্ধির জন্য, বাস্তবতাকে আবিষ্কারের জন্য, কাজেই যারা তাদের বিবেক বুদ্ধিকে কাজে লাগায় না, তারা আসলে নিজেদের প্রতি জুলুম করে এবং নিজেকে ইহকাল ও পরকালে ধ্বংসের দিকে ফেলে দেয়, এই আয়াতে এটাই বুঝানো হয়েছে।