সূরা ইউনুস;(১৪তম পর্ব)

সূরা ইউনুস; আয়াত ৬৮-৭৩

সূরা ইউনুসের ৬৮, ৬৯ ও ৭০ নম্বর আয়াতে

قَالُوا اتَّخَذَ اللَّهُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ هُوَ الْغَنِيُّ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ إِنْ عِنْدَكُمْ مِنْ سُلْطَانٍ بِهَذَا أَتَقُولُونَ عَلَى اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ (68) قُلْ إِنَّ الَّذِينَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللَّهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُونَ (69) مَتَاعٌ فِي الدُّنْيَا ثُمَّ إِلَيْنَا مَرْجِعُهُمْ ثُمَّ نُذِيقُهُمُ الْعَذَابَ الشَّدِيدَ بِمَا كَانُوا يَكْفُرُونَ (70(

"মুশরিকরা বলে আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি পবিত্র এবং এসব ধারণার উর্ধ্বে। তিনি অভাবমুক্ত, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা তাঁরই। এ বিষয়ে তোমাদের কোনো দাবী নেই, তোমরা কি আল্লাহ সম্পর্কে এমন কিছু বলেছে যে বিষয়ে তোমাদের কোনো জ্ঞান নেই !” (১০:৬৮)

“হে পয়গম্বর বলুন! যারা আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা উচ্চারণ করবে তারা সফলকাম হবে না।” (১০:৬৯)

পৃথিবীতে (ওদের জন্য কিছু সুখ সম্ভোগ আছে) পরে তাদেরকে আমার দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অতঃপর কুফর বা অবিশ্বাসের কারণে আমি তাদেরকে কঠোর শাস্তির আস্বাদ গ্রহণ করাব।" (১০:৭০)

ইসলাম হচ্ছে খাঁটি একত্ববাদের ধর্ম। মুসলমান হওয়ার জন্য প্রথম শর্ত হচ্ছে, তাকে বিশ্বাস করতে হবে আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর কোনো সমকক্ষ নেই এবং কোনো শরীক বা অংশীদার নেই। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ সর্বশক্তিমান এবং মহাপরাক্রমশালী। অক্ষমতা, দুর্বলতা এসব তাঁর ক্ষেত্রে অকল্পনীয়। তাঁর কোনো অভাব নেই, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। সব কিছুই তাঁর সৃষ্টি এবং সব সৃষ্ট বস্তুরই তিনি স্রষ্টা। কিন্তু তিনি নিজে সম্পূর্ণ অবস্তুগত সত্ত্বা। মানুষের সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে তাকে এবং তার সত্ত্বাকে পুরোপুরিভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কিন্তু পৃথিবীতে অনেক ধর্মমত দেখা যায় যে, তারা বিশ্বাস করেন সৃষ্টিকর্তা সন্তান গ্রহণ করেন। পৌত্তলিকদের একাংশ ফেরেশতাদেরকে ‘খোদার কন্যা’ বলে বিশ্বাস করে। ইহুদীরা মনে করে পয়গম্বর উজাইর (আ.) খোদার পুত্র, তেমনি খ্রিস্টানরা হযরত ঈসা (আ.)কে ‘খোদার পুত্র’ বলে বিশ্বাস করে। ইসলাম এসব বিশ্বাসকে স্পষ্ট বিভ্রান্তি বলে নাকচ করে দেয়। ইসলাম মনে করে আল্লাহ সম্পূর্ণ অবস্তুগত সত্ত্বা তার কোনো কিছুরই প্রয়োজন নেই। স্ত্রী, পুত্র, কন্যা গ্রহণ করা তার অসীম সত্ত্বার জন্য বেমানান। এসব দুর্বলতা বা প্রয়োজন কেবল তার সৃষ্টির জন্য প্রযোজ্য। এ আয়াতে বলা হয়েছে, যারা এ ধরনের ভ্রান্ত বিশ্বাস আঁকড়ে থাকবে পরকালে তাদেরকে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।

এই আয়াত থেকে আমরা এটা বুঝে নিতে পরি যে, আল্লাহ সব ধরনের বস্তুগত চাহিদা বা প্রয়োজনের উর্ধ্বে। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন, কারো ওপর নির্ভরশীল নন বরং জগতের সব কিছু তার মুখাপেক্ষী, তাঁর ওপর নির্ভরশীল। তিনি বিশ্বজগতের একক প্রভূ, একাকিত্বের কারণে কোনো বিরক্তি বা ভয় তাকে স্পর্শ করে না যে, এজন্য তাকে স্ত্রী বা সন্তান গ্রহণ করতে হবে। কারণ এ সবই তার অবস্তুগত সত্ত্বার জন্য অকল্পনীয়।

সূরা ইউনুসের ৭১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন-

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ نُوحٍ إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ يَا قَوْمِ إِنْ كَانَ كَبُرَ عَلَيْكُمْ مَقَامِي وَتَذْكِيرِي بِآَيَاتِ اللَّهِ فَعَلَى اللَّهِ تَوَكَّلْتُ فَأَجْمِعُوا أَمْرَكُمْ وَشُرَكَاءَكُمْ ثُمَّ لَا يَكُنْ أَمْرُكُمْ عَلَيْكُمْ غُمَّةً ثُمَّ اقْضُوا إِلَيَّ وَلَا تُنْظِرُونِ

"হে রাসূল! তাদেরকে নুহের বৃত্তান্ত শোনাও যে তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে আমার অবস্থিতি এবং আল্লাহর আদেশ সম্পর্কে তোমাদেরকে সচেতন করে তোলা যদি তোমাদের নিকট অসহ্য হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহই আমার একমাত্র ভরসা। তোমরা তোমাদের শরীকদেরকে সাথে নিয়ে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর এবং খুব চিন্তাভাবনা কর যাতে কোন কিছুই তোমাদের দৃষ্টির অগোচরে না থাকে। তারপর আমার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর এবং আমাকে বিন্দুমাত্র সুযোগ দিও না।" (১০:৭১)

হযরত নুহ (আ.) একনিষ্ঠভাবে তার সম্প্রদায়কে এক আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু বহু বছর নবুয়্যতের দায়িত্ব পালনের পর তিনি দেখলেন, খুব অল্প সংখ্যক মানুষই বিশ্বাস স্থাপন করেছেন এবং অধিকাংশই কুফরি এবং শিরক পরিত্যাগ করতে চাচ্ছে না। বরং তারা হযরত নুহ (আ.)কে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করতে উদ্যত হয়েছে। ওই সময়কার ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে এই আয়াতে আল্লাহতায়ালা ঈমানদার মুসলমানদের বলতে চেয়েছেন, ঐশী সাহায্যের ব্যাপারে বিশ্বাস রাখা উচিত কারণ মহান প্রতিপালক আল্লাহ অবশ্যই ঈমানদারদেরকে সাহায্য করবেন। হযরত নুহ (আ.) ও তার বিরুদ্ধবাদীদের ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্তের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে বলেছিলেন, তোমরা সম্মিলিতভাবে যা ইচ্ছা তাই কর। আমি কোনো কিছুতেই বিচলিত নই। কারণ আমার ভরসা একমাত্র আল্লাহ, আমি তাঁর ওপরই নির্ভর করি।

ঈমান এবং স্থির লক্ষ্য অন্যায় এবং অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য অপরিহার্য উপাদান। কারো যদি জীবনের লক্ষ্য ও গন্তব্য নির্দিষ্ট থাকে তাহলে কোনো কিছুই তাকে বিচলিত করতে পারে না। শাহাদাত তার কাম্য হয়ে ওঠে।

সূরা ইউনুসের ৭২ ও ৭৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

فَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَمَا سَأَلْتُكُمْ مِنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى اللَّهِ وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ (72) فَكَذَّبُوهُ فَنَجَّيْنَاهُ وَمَنْ مَعَهُ فِي الْفُلْكِ وَجَعَلْنَاهُمْ خَلَائِفَ وَأَغْرَقْنَا الَّذِينَ كَذَّبُوا بِآَيَاتِنَا فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُنْذَرِينَ (73(

"(নুহ (আ.) তার সম্প্রদায়কে বলেন) তোমরা ঐশী বিধানের প্রতি বিশ্বাসের আহ্বানে সাড়া না দিলে কিছু আসে যায় না, কারণ তোমাদের কাছে আমি শ্রমফল প্রার্থনা করিনি। আমার শ্রমফল আল্লাহর কাছে আছে। আমি তো আত্মসমর্পনকারীদের অর্ন্তভুক্ত হতে আদিষ্ট হয়েছি।” (১০:৭২)

“এরপর ওরা হযরত নুহকে মিথ্যাবাদী বলে সাব্যস্ত করে। আমি তাকে এবং তার সাথে যারা নৌকায় ছিল সকলকে উদ্ধার করি, তাদেরকে প্রতিনিধি করি। এবং যারা আমার নিদর্শন প্রত্যাখ্যান করেছিল তাদেরকে নিমজ্জিত করি। সুতরাং লক্ষ্য কর, যাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিল তাদের পরিণাম কি হয়েছে?” (১০:৭৩)

আল্লাহর নবী এবং রাসূলগণ তাদের ওপর ন্যস্ত খোদা প্রদত্ত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোন বাধা, ভয়-ভীতির তোয়াক্কা করেননি। পার্থিব ধন-সম্পদ, ভোগ বিলাসিতা তাদের অন্তরকে স্পর্শ করতে পারেনি। মানুষের কাছে তাদের কোন চাওয়া পাওয়া ছিল না, তাই তারা সরাসরি মানুষকে বলতেন, যদি সত্যের বাণী প্রত্যাখ্যান কর তাহলে আমাদের কিছু যায় আসে না। কারণ তোমাদের কাছে আমরা কোন প্রতিদান আশা করি না। সৃষ্টিকর্তা আমাদের ওপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন, আমরা কেবল সে দায়িত্বই পালন করছি।

এরপর হযরত নুহ (আ.)-এর সময়কার মহাপ্রলয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, তখন ঐশী শাস্তি হিসেবে প্লাবন এবং প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় সব কিছুকে তছনছ করে দেয়। যারা হযরত নুহ (আ.)-এর সাথে তার নৌকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন কেবল তারাই রক্ষা পেয়েছিলেন এবং তারাই পরবর্তীতে পৃথিবীতে উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন। আর যারা আল্লাহর রাসূলের সতর্কবাণী উপেক্ষা করেছিল তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।