ইমামত নবুওয়াতের নির্বাহী ক্ষমতার ধারাবাহিকতা

ভূমিকা

মহানবী (সা.) নবুয়্যত, রিসালাত এবং ইসলামের আহকাম প্রচার ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব ছাড়াও ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের দয়িত্বে ও নিয়োজিত ছিলেন। বিচারকার্য ও সামরিক নেতৃত্ব ইত্যাদি এ থেকেই উৎকলিত হত। যেমনিকরে ইসলামে ইবাদত ও আচরণগত দায়িত্ব ছাড়াও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অধিকারগত ইত্যাদি কর্তব্যও বিদ্যমান, তেমনি করে ইসলামের নবী (সা.) প্রচার, প্রশিক্ষণ ও (আধ্যাত্মিক) পরিচর্যার দায়িত্ব ছাড়াও মহান আল্লাহ্‌র নিকট থেকে ঐশী বিধান প্রয়োগের ক্ষেত্রেও দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং সকল প্রকার প্রশাসনিক মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।

এটা অনস্বীকার্য যে, যদি কোন দ্বীন বিশ্বের শেষাবধি সকল প্রকার সামাজিক কর্তব্য পালনের দাবি করে তবে এ ধরনের বিষয়াদি সম্পর্কে উদাসীন থাকতে পারে না। অনুরূপ যে সমাজ এ দ্বীনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়, সে সমাজ এ ধরনের কোন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তব্য থেকে নিরুদ্দিষ্ট থাকবে, যা ইমামত নামে অভিষিক্ত, তাও হতে পারে না।

কিন্তু কথা হল মহানবী (সা.) এর তিরোধানের পর, কে এ দায়িত্ব লাভ করবেন? এবং তা কার কাছ থেকে দায়িত্ব প্রাপ্ত হবেন? মহান আল্লাহ্‌ এ মর্যাদা যেরূপে মহানবীকে (সা.) দিয়েছিলেন সেরূপে অন্য কাউকেও কি দিয়েছেন? এ দায়িত্বভার অন্য কারও গ্রহণের কোন বৈধতা রয়েছে কি? নাকি মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত এ মর্যাদা মহানবী (সা.)-এর জন্যেই নির্ধারিত ছিল এবং অতঃপর মুসলিম জনতাই তাদের ইমাম নির্বাচন করবে ও তাকে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে স্থান দিবে, তা-ও বিধিসম্মত? মানুষের কি এ ধরনের কোন অধিকার আছে? না নেই?

আর এটিই হল শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয়। অর্থাৎ একদিকে শিয়াদের বিশ্বাস যে ইমামত হল একটি ঐশী মর্যাদা, যা মহান আল্লাহ্‌ কর্তৃকই যথোপযুক্ত ও যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে প্রদান করা আবশ্যক। আর মহান আল্লাহ্‌, মহানবী (সা.) এর মাধ্যমে এ কর্মটি সম্পাদন করেছেন এবং আমীরুল মু’মীনিন আলীকে (আ.) তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষনা করেছেন। অতঃপর তাঁরই সন্তানদের মধ্য থেকে পরস্পরায় বারজনকে ইমামতের মর্যাদায় অভিসিক্ত করছেন। অপরদিকে সুন্নি মাযহাবের বিশ্বাস নবী (সা.)-এর তিরোধানের মাধ্যমে ঊর্ধ্বজগতের সাথে মানুষের সম্পর্ক কর্তিত হয়ে গেছে এবং মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় পৌঁছেছে। এখন তারা নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে কোরআনকে বুঝতে ও তাদের পথকে চিনে নিতে পারে। তাই তাদের পথপ্রদর্শনের জন্য ঐশী কোন ব্যক্তির আর প্রয়োজন নাই। আর নবী (সা.) এর পর ইমাম নির্বাচনের দায়িত্বও তাদের উপরই অর্পণ করা হয়েছে। এমনকি আহলে সুন্নাতের কোন কোন বিজ্ঞজন সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, যদি কেউ অস্ত্রের ভয় দেখিয়েও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তবে তার আনুগত্য করাও অন্যান্যদের জন্যে অপরিহার্য! স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে, এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি স্বৈরাচারী, অত্যাচারী ও প্রতারকদের অপরাধের জন্যে কতটা পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে এবং মুসলমানদের অবক্ষয় ও বিভেদের পথে কতটা সহায়ক হয়েছে!

প্রকৃতপক্ষে আহলে সুন্নাত ঐশী সস্পর্কহীন ইমামতের বৈধতা দিয়ে রাজনীতি থেকে ধর্মের পৃথকীকরণের প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন। আর শিয়া মাযহাবের বিশ্বাস, এটিই হচ্ছে ইসলামের সঠিক ও সত্য সুন্দর পথ থেকে এবং সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহর আনুগত্যের পথ থেকে বিচ্যুতির মূল কারণ। অনুরূপ শতসহস্র ধরনের বিচ্যুতি ও বিপথগামিতার সূতিকাগারও এখানেই, যেগুলো মহানবী (সা.) এর পরলোক গমনের পর থেকে মুসলমানদের মাঝে রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং করবে।

অতএব প্রতিটি মুসলমানের জন্যেই কোন প্রকার অন্ধ অনুকরণ ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ব্যতিরেকে এ বিষয়টির উপর পরিপূর্ণ গবেষণা ও অনুসন্ধান চালানো অপরিহার্য। আর সেই সাথে সত্য ও সঠিক মাযহাবের শনাক্তকরণের মাধ্যমে এর প্রচার ও প্রসারে সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিৎ।

উল্লেখ্য এ ব্যাপোরে ইসলামী বিশ্বের সামগ্রিক কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং বিভিন্ন মাযহাবের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি করে ইসলামের শত্রুদের জন্যে সুযোগ করে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এমন কোন কাজ করা যাবে না যা ইসলামী সমাজে ফাটল সৃষ্টি করবে এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে নিজেদের পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বিনষ্ট হবে। আর এ ক্ষতির অংশীদার মুসলমানরাই হবে, যার ফলশ্রুতি মুসলিম সমাজব্যবস্থার দুর্বলতা বৃদ্ধি ব্যতীত কিছুই নয়। কিন্তু মুসলমানদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্য সংরক্ষণ যেন, সঠিক ও সত্য মাযহাবের অনুসন্ধান ও শনাক্তকরণের জন্যে, অনুসন্ধান ও গবেষণার সুষ্ঠ পথকে রুদ্ধ না করে ফেলে। আর ইমামতের বিষয়সমূহের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুষ্ঠ পরিবেশ যেন ব্যাহত না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, এ বিষয়গুলোর সঠিক সমাধানের উপর মুসলমানদের ভাগ্য এবং ইহ ও পরলৌকিক কল্যাণ নির্ভর করে।

ইমামতের তাৎপর্য

ইমামতের আভিধানিক অর্থ হল নেতা, পথপ্রদর্শক এবং যে কেউ কোন জনসমষ্টির নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহন করবে তাকেই ইমাম (امام) বলা হয়ে থাকে -হোক সে সত্য পথের অনুসারী কিংবা মিথ্যা পথের অনুসারী। যেমন: পবিত্র কোরানে কাফেরদের পৃষ্ঠপোষকদের সম্পর্কে (ائمة الكفر) অর্থাৎ কাফেরদের নেতারা (সূরা তওবাহ-১২) কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে। তদনুরূপ মুসুল্লীরা নামাজের জন্যে যার পিছনে সমবেত হয়ে থাকেন, তাকে ‘ইমামুল জামা’ত’ নামকরণ করা হয়।

কিন্তু কালামশাস্ত্রের পরিভাষায় ইমামত হল ইহ ও পরলৌকিক সকল বিষয়ে ইসলামী সমাজের সর্বময় ও বিস্তৃত নেতৃত্ব প্রদান। ইহলৌকিক শব্দটি ইমামতের পরিসীমার ব্যাপকতা বুঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। নতুবা ইসলামী সমাজে ইহলৌকিক বিষয়াদিও দ্বীন ইসলামেরই অন্তর্ভুক্ত।

শিয়া মাযহাবের মতে এ ধরনের নেতৃত্ব কেবলমাত্র তখনই বৈধ হবে, যখন তা মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে অনুমোদিত হবে। আর প্রকৃতপক্ষে যিনি এ মর্যাদার অধিকারী হবেন, তিনি আহকাম ও ইসলাম পরিচিতির বর্ণনার ক্ষেত্রে সকল প্রকার ভুল-ভ্রান্তি থেকে সংরক্ষিত থাকবেন। অনুরূপ তিনি সকল প্রকার গুনাহতে লিপ্ত হওয়া থেকে পবিত্র থাকবেন। বস্তুতঃ পবিত্র ইমাম, একমাত্র নবুয়্যত ও রিসালাত ব্যতীত মহানবীকে (সা.), মহান আল্লাহ্‌ প্রদত্ত সকল মর্যাদার অধিকারী হবেন। ইসলামের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য যেমন নিঃশর্তভাবে গ্রহণযোগ্য, তেমনি প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়েও তাঁর আদেশ পালন করাও অপরিহার্য।

এভাবে শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে ইমামতের ক্ষেত্রে তিনটি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়:

প্রথমতঃ ইমামকে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নির্বাচিত হতে হবে।

দ্বিতীয়তঃ ইমামকে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে এবং সকল প্রকার ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকতে হবে।

তৃতীয়তঃ ইমামকে গুনাহ থেকে পবিত্র থাকতে হবে।

তবে মা’সুম হওয়াটা ইমামতের সমকক্ষ নয়। কারণ শিয়া মাযহাবের মতে হযরত ফাতিমা যাহরাও (সালামুল্লাহ আলাইহা) মা’সুম ছিলেন, যদিও তিনি ইমামতের অধিকারিণী ছিলেন না। অনুরূপ হযরত মারিয়াম (আ.) ও ইসমাতের অধিকারিণী ছিলেন এবং সম্ভবতঃ আল্লাহ্‌র ওলীগণের মধ্যেও অন্য কেউ এ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, যদিও আমরা তাঁদের সম্পর্কে অবগত নই। বস্তুতঃ মা’সুম ব্যক্তিগণের পরিচয় মহান আল্লাহ্‌ কর্তৃক উপস্থাপিত না হলে তাঁদেরকে চিনা সম্ভব নয়।

একটি ঐতিহাসিক পর্যালোচনা

বিশ্বাসগত বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখেন না এমন অধিকাংশ মানুষই মনে করেন যে, শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে ইমামত প্রসঙ্গে বিরোধ এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে শিয়াদের বিশ্বাস হলঃ মহানবী (সা.) ‘আলী ইবনে আবি তালিবকে’ (আ.) ইসলামী সমাজের পরিচালনার জন্যে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেছিলেন। কিন্তু আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস যে, এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি এবং রাসূল (সা.) উম্মতকে কোন নেতা মনোনীত করা ছাড়াই ত্যাগ করেছিলেন। আর তাই তাঁর মৃত্যুর পর জনগণ নিজেদের পছন্দ মত প্রথম খলিফাকে নেতা নির্বাচন করেছিল। প্রথম খলিফা যদিও নিজে জনগণ কর্তৃক নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তাঁর উত্তরাধিকারীকে নিজেই নির্বাচন করে গিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় খলিফা কর্তৃক পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের দায়িত্ব ছয় সদস্য বিশিষ্ট গোষ্ঠীর নিকট অর্পণ করা হয়েছিল। অপরদিকে চতুর্থ খলিফাও আবার প্রথমবারের মত সাধারণ মানুষ কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন। অতএব মুসলমানদের মধ্যে নেতা নির্বাচনের জন্যে সুনির্দিষ্ট কোন পন্থা ছিল না। ফলে চতুর্থ খলিফার পর যার সামরিক শক্তি অধিক ছিল, সে-ই এ স্থান দখল করেছিল, যেমন: অনৈসলামিক দেশসমূহেও মোটামুটি এ প্রক্রিয়া বিদ্যমান।

অন্যকথায়ঃ তারা এ রকম মনে করেন যে, প্রথম ইমাম নির্বাচনের ক্ষেত্রে শীয়াদের বিশ্বাস সেরূপ, যেরূপ আহলে সুন্নাত প্রথম খলিফা কর্তৃক দ্বিতীয় খলিফার নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিশ্বাস করেন, পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, মহানবী (সা.) এর বক্তব্য মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি, কিন্তু প্রথম খলিফার বক্তব্য মানুষ গ্রহণ করেছিল!

কিন্তু প্রশ্ন হল, প্রথম খলিফা এ অধিকার কোথা থেকে পেয়েছিলেন? আল্লাহ্‌র রাসূল (সা.) (আহলে সুন্নাতের বিশ্বাস মতে) ইসলামের জন্যে কেন তার (প্রথম খলিফা) মত আন্তরিকতা প্রদর্শন করেননি এবং নব গঠিত ইসলামী সমাজকে অভিভাবকহীন অবস্থায় রেখে গেলেন অথচ যুদ্ধের জন্যে মদীনা থেকে অন্যত্র যাওয়ার সময়ও একজনকে নিজের স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন এবং যেখানে স্বয়ং তিনিই (এ বিষয়ের উপর) তাঁর উম্মতদের মধ্যে মতবিরোধ ও বিভ্রান্তির সংবাদ দিয়েছিলেন? এছাড়া ও লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, শিয়া ও সুন্নী মাযহাবের মধ্যে মূলতঃ মতবিরোধ সর্বাগ্রে এখানেই যে, ইমামত কি এক ধর্মীয় মর্যাদা, যা ঐশী বিধানের অনুগামী ও আল্লাহ্‌ কর্তৃক নির্ধারিত বিষয়? নাকি পার্থিব রাজকীয় বা অন্য কোন পদ মর্যাদা, যা সামাজিক নীতিমালার অনুগামী? শিয়াদের বিশ্বাস যে, স্বয়ং মহানবীও (সা.) নিজ থেকে তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেননি। বরং মহান আল্লাহ্‌ কর্তৃক আদিষ্ট হয়েই এ কর্ম সম্পাদন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির দর্শন পবিত্র ইমামগণের নিয়োগদানের সাথে সস্পর্কযুক্ত। আর এ ধরনের ইমামের উপস্থিতিতেই রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর ইসলামী সমাজের অপরিহার্য বিষয়াদির নিশ্চয়তা প্রদান করা যেতে পারে।

এখানেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, কেন শিয়া মাযহাবের মতে ইমামত ‘মূল বিশ্বাসগত’ বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হয় -শুধুমাত্র একটি ফিকাহ্‌গত গৌণ বিষয় নয়। আর সেই সাথে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কেন তারা তিনটি শর্ত (ঐশী জ্ঞান, ইসমাত ও আল্লাহ্‌ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত) বিবেচ্য বলে মনে করেন এবং কেন শিয়া সাধারণের মধ্যে এ ভাবার্থগুলো ঐশী আহকাম, প্রশাসন ও ইসলামী সমাজের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতৃত্বের ধারনার সাথে এমনভাবে মিশে আছে, যেন ইমামত শব্দটি এ ভাবার্থগুলোর সবগুলোকেই সমন্বিত করে।

এখন শিয়াদের সামগ্রিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে, ইমামতের তাৎপর্য ও মর্যাদার আলোকে এর বৈধতা সম্পর্কে আলোচনা করব।

ইমাম থাকার প্রয়োজনীয়তা

আমরা জানি খতমে নবুওয়াতের দর্শন হল এই যে, ইসলাম হল পবিত্র, চিরন্তন, সার্বজনীন ও অবিস্মৃত ধর্ম এবং ইসলামের নবী (সা.)-এর পর আর কোন নবীর আবির্ভাব ঘটবে না। নবুয়্যতের পরিসমাপ্তির দর্শন, তখনই কেবলমাত্র নবীগণের আবির্ভাবের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করবে, যখন সর্বশেষ ঐশী শরীয়ত মানব মাযহাবের সকল প্রশ্নের জবাব প্রদানে সক্ষম হবে এবং বিশ্বের অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত এ শরীয়তের অটুট থাকার নিশ্চয়তা থাকবে।

উল্লেখিত নিশ্চয়তা পবিত্র কোরআনে রয়েছে এবং মহান আল্লাহ্‌ স্বয়ং সকল প্রকার বিকৃতি ও বিচ্যুতি থেকে প্রিয় গ্রন্থের সংরক্ষিত থাকার নিশ্চয়তা বিধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ইসলামের সকল বিধি-বিধান কোরানের আয়াতের বাহ্যিক যুক্তি থেকে প্রকাশ পায় না। যেমন: নামাযের রাকাত সংখ্যা ও পদ্ধতি এবং আবশ্যকীয় ও অনাবশ্যকীয় এমন অসংখ্য বিধান রয়েছে, যেগুলোকে পবিত্র কোরান থেকে উদঘাটন করা অসম্ভব। সাধারণতঃ পবিত্র কোরানে আহকাম ও কানুন বিশদভাবে বর্ণিত হয়নি। ফলে এগুলোর প্রশিক্ষণ ও সুস্পষ্ট বর্ণনার দায়িত্ব মহানবী (সা.)-এর উপর অর্পণ করা হয়েছে, যাতে তিনি মহান আল্লাহ্‌ প্রদত্ত জ্ঞানের (কোরআনের ওহী ব্যতীত) মাধ্যমে ঐগুলোকে মানুষের জন্যে বর্ণনা করেন। আর এভাবে ইসলাম পরিচিতির প্রকৃত উৎস হিসেবে তাঁর সুন্নাহ বিশ্বস্ত ও প্রামাণ্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।

কিন্তু হযরত (সা.)-এর নবুওয়াতের প্রচার কর্ম শুরুর পর দশ বছর ধরে নির্যাতন ও নিপীড়নের মধ্যে ছিলেন, অতঃপর আবি তালিবের উপত্যকায় কয়েক বছরের বন্দীদশা কাটিয়েছেন, মদীনায় হিজরতের পর শত্রুদের সাথে দশ বছর ব্যাপী যুদ্ধ ইত্যাদির মত জীবনের সংকটময় মুহূর্তগুলো সাধারণ মানুষের জন্যে ইসলামের বিভিন্ন আহ‌কাম, বর্ণনার পথে ছিল প্রধান অন্তরায়। অপর দিকে সাহাবাগণ যা শিখতেন তা সংরক্ষিত থাকারও কোন নিশ্চয়তা ছিল না। এমন কি অজু করার প্রক্রিয়া যা তেইশ বছর ধরে সাহাবাদের চোখের সামনে সম্পাদিত হয়েছে তাও বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অতএব যেখানে এ সুস্পষ্ট বিষয়টি (যা মুসলমানদের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ডের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল বা আছে এবং এর পরিবর্তন ও বিকৃতির মধ্যে কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য জড়িত ছিল না) বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে, সেখানে মানুষের ব্যক্তিগত ও গোত্রীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট জটিল ও সূক্ষ্ম নিয়মসমূহের বর্ণনার ক্ষেত্রে বিকৃতি ও ভ্রান্তির সম্ভাবনা অবশ্যই অধিকতর।

এ বিষয়টির আলোকে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, ইসলাম ধর্ম কেবলমাত্র তখনই এক পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ ধর্ম হিসেবে পৃথিবীর অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত মানুষের সকল প্রয়োজন ও প্রশ্নের জবাবদানে সক্ষম হবে যখন দ্বীনের মূলভাষ্যে, সমাজের এ সকল কল্যাণের নিশ্চয়তা বিধিত হবে, যেগুলো মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর সংকট ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। আর এ নিশ্চয়তা বিধানের পথ মহানবী (সা.)-এর যোগ্য উত্তরসুরি নির্বাচন ব্যতীত কিছুই নয়। এ উত্তরসুরিকে একদিকে যেমন ঐশী জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে, যাতে দ্বীনকে এর সকল দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তমরূপে বর্ণনা করতে পারেন। অপরদিকে তেমনি দৃঢ়রূপে পবিত্রতার অধিকারী হতে হবে,যাতে কুপ্রবৃত্তি ও শয়তানী প্ররোচনায় প্রভাবিত না হন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে দ্বীনের বিকৃতিতে লিপ্ত না হন। অনুরূপ মানব জাতির আধ্যাত্মিক পরিচর্যার ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর দায়িত্ব স্বীয় স্কন্ধে তুলে নিয়ে, উৎকর্ষের সর্বোচ্চ শিখরে যোগ্যতম ব্যক্তিদেরকে পৌঁছে দিতেও তাঁরা বদ্ধপরিকর। আর অনুকূল পরিস্থিতিতে সমাজের শাসন, পরিচালনা এবং ইসলামী বিধানকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা, বিশ্বে ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির দায়িত্বও তাঁরা গ্রহণ করে থাকেন।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, নবুয়্যতের পরিসমাপ্তি কেবলমাত্র তখনই প্রভুর প্রজ্ঞার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হতে পারে, যখন এমন পবিত্র ইমামগণকে নিয়োগ করা হবে, যাঁরা একমাত্র নবুয়্যত ব্যতীত মহানবী (সা.)-এর সকল গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হবেন।

আর এভাবেই একদিকে যেমন সমাজে ইমাম থাকার প্রয়োজনীয়তা প্রতিভাত হয়, অপরদিকে তেমনি তাঁদের ঐশী জ্ঞান ও পবিত্র মর্যাদাও। অনুরূপ মহান আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তাঁদের নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারটিও স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়। কারণ একমাত্র তিনিই জানেন এ ধরনের জ্ঞান ও মর্যাদা কাকে দিয়েছেন এবং তিনিই বস্তুতঃ তাঁর বান্দাগণের উপর বিলায়াত ও কর্তৃত্বের অধিকার রাখেন। আর তিনিই এর অধিকার অপেক্ষাকৃত হ্রাসকৃত মাত্রায় উপযুক্ত ব্যক্তিগণকে প্রদান করতে সক্ষম।

এখানে স্মরণযোগ্য যে, আহলে সুন্নাত কোন খলিফার ক্ষেত্রেই উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর কোনটিকেই স্বীকার করেন না। মহান আল্লাহ্‌ ও রাসূলের (সা.) পক্ষ থেকে নির্বাচিত হওয়ার দাবি যেমন তারা তুলেন না, তেমনি খলিফাগণের ঐশী জ্ঞান ও পবিত্রতার প্রসঙ্গও তুলেন না। বরং মানুষের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রশ্নের জবাব দানের ক্ষেত্রে তাদের অসংখ্য ভুল-ভ্রান্তি ও অযোগ্যতার দৃষ্টান্ত তারা তাদের বিশ্বস্ত গ্রন্থসমূহে তুলে ধরেছেন। উদাহরণস্বরূপ প্রথম খলিফা প্রসঙ্গে ইবনে কুতাইবা রচিত ‘আল ইমামাহ ওয়াস সিয়াসাহ’ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে যে, তিনি বলেছিলেন:

«انّ لي شيطانا يعتريني»

আমার পশ্চাতে এমন এক শয়তান বিদ্যমান যে আমাকে বিভ্রান্ত করে।

অনুরূপ দ্বিতীয় খলিফা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, তিনি প্রথম খলিফার আনুগত্য স্বীকারকে ‘فلته’  অর্থাৎ অবিলম্বকর্ম ও অবিবেচনাপূর্ণ কর্ম নামকরণ করেছেন। অনুরূপ দ্বিতীয় খলিফা অসংখ্যবার এ বাক্যটি স্বীয় কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন:

«لولاعليّ لهلك عمر»

যদি আলী না থাকতেন, তবে আমি ওমর ধ্বংস হয়ে যেতাম।

অর্থাৎ যদি আলী (আ.) না থাকতেন তবে ওমর ধ্বংস হয়ে যেতেন। এছাড়া তৃতীয় খলিফা এবং বনি উমাইয়্যা ও বনি আব্বাসের ভুল-ভ্রান্তির কথাতো বলারই অপেক্ষা রাখেনা। ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে কেউ ন্যূনতম ধারণা নিলেই এ সম্পর্কে উত্তমরূপে পরিজ্ঞাত হতে পারবেন।

একমাত্র শিয়া সম্প্রদায়ই দ্বাদশ ইমামের ক্ষেত্রে এ শর্তত্রয়ে বিশ্বাসী। উপরোক্ত আলোচনার আলোকে ইমামত প্রসঙ্গে তাদের বিশ্বাসের বৈধতা প্রমাণিত হয়। #আল-বাসাইর

মূল: আয়াতুল্লাহ্‌ মিসবাহ্‌ ইয়াজদির অমুজেশে আকায়েদ গ্রন্থ

অনুবাদ: মোহাম্মাদ মাঈনুদ্দীন

সঙ্কলন ও সম্পাদন: আবুল কাসেম

তথ্যসূত্র

১. আল আহ্‌কামুল সোলতানিয়াহ্‌, লিখেছেন আবু ইয়ালা এবং ‘আস সাওয়াদুল আ’যাম’ লিখেছেন আবুল কাশিম সামারক্বান্দি, পৃঃ ৪০-৪২।

২. সৌভাগ্যবশতঃ বিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ এ বিষয়ের উপর একাধিক ভাষায় ও একাধিক পদ্ধতিতে শতসহস্র গ্রন্থ রচনা করে সত্যানুসন্ধিৎসুগণের জন্যে গবেষণার পথকে বিস্তৃত করেছেন। উদাহরণতঃ আবাক্বাতুল আনওয়ার, আল গাদির, দালায়িলুস সিদক্ব, গায়াতুল মারাম এবং ইসবাতুল হুদাহ ইত্যাদি গ্রন্থের নাম উল্লেখ যোগ্য।

যারা পড়াশুনার যথেষ্ট সুযোগ পান না তারা ‘আল মুরাজিয়াত’ নামক একটি বই, যা শিয়া ও সুন্নী দু’জন মনীষীর মধ্যে বিনিময়কৃত পত্রসমূহের সমাহার, তা পড়তে পারেন। সৌভাগ্যবশতঃ বইটি বাংলায় অনুদিত করা হয়েছে।

৩. বাকারাঃ ১৫১, আলে-ইমরান-১৬৪, জুমুআ’-২, নাহল -৬৪, ৬৪, আহযাব- ২১, হাশর -৭।

৪. আল্লামা আমিনি (র.) সাতশতজন মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারীর নাম তার "আল গাদীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এক লক্ষেরও অধিক হাদীসের বর্ণনাকারী রয়েছে (আল গাদীর, খণ্ড-৫ পৃঃ-২০৮)।

৫. শারহে নাহজুল বালাগাহ : ইবনে আবিল হাদিদ, খণ্ড- ১, পৃষ্ঠা-৮৫ খণ্ড-৪, পৃঃ-২৩১-২৬২, এবং আল গাদীর : খণ্ড -৭, পৃঃ-১০২-১৮০।

৬. ইবনে আবদুল বার, আলইসতিয়াব, ৩য় খণ্ড, পৃ.১১০৩; শারহে নাহজুল বালাগাহ : খণ্ড -১, পৃঃ-১৪২-১৫৮ , খণ্ড-৩, পৃঃ-৫৭।

৭. আল গাদীর : খণ্ড - ৬, পৃঃ -৯৩ ও পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলো।