সূরা হুদ;(৬ষ্ঠ পর্ব)

সূরা হুদ; আয়াত ২০-২৪

সূরা হুদের ২০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

أُولَئِكَ لَمْ يَكُونُوا مُعْجِزِينَ فِي الْأَرْضِ وَمَا كَانَ لَهُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ مِنْ أَوْلِيَاءَ يُضَاعَفُ لَهُمُ الْعَذَابُ مَا كَانُوا يَسْتَطِيعُونَ السَّمْعَ وَمَا كَانُوا يُبْصِرُونَ

"তারা পৃথিবীতেও আল্লাহকে অপারগ করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত তাদের কোন সাহায্যকারীও নেই। তাদের জন্য দ্বিগুণ শাস্তি রয়েছে। তাদের শোনার সামর্থ ছিল না এবং তারা দেখতেও পেত না।" (১১:২০)

এর আগের আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যারা মানুষকে আল্লাহর রাস্তায় চলতে বাধা সৃষ্টি করবে এবং সত্যকে গ্রহণ করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করবে,তাদের ইহকালীন জীবন হবে দুর্যোগে পরিপূর্ণ এবং পরকালেও থাকবে তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, তারা যেন এটা মনে না করে যে, আল্লাহর শাস্তি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে কিংবা আল্লাহর শক্তিকে খর্ব করা যাবে বরং এটা মনে রাখা উচিত,তারা যদি সম্মিলিতভাবে এবং সকলের পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে তা করতে চায়, কখনোই তা সম্ভব হবে না। এরপর এই আয়াতে বলা হয়েছে, এ ধরণে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকরী মানুষের শাস্তি হবে দ্বিগুণ। কারণ তারা নিজেরা যেমন বিভ্রান্ত হয়েছে তেমনি অন্যকেও বিভ্রান্ত করে তার পাপের বোঝা নিজের কাঁধে নিয়েছে।

হাদিস শরীফের অনেক বর্ণনায় দেখা যায়, মুর্খ মানুষের চেয়ে পথভ্রষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তির শাস্তি হবে কয়েক গুণ বেশী।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে,

এক. পরকালে বিচারের কাঠগড়া থেকে পালিয়ে যাওয়ার সাধ্য কারও নেই এবং সেদিন রাজা-বাদশাহ এবং সমাজের প্রতাপশালী কেউ কারো সাহায্য করতে পারবে না।

দুই. একগুঁয়েমী, অবাধ্যতা এবং বিদ্বেষ লালন করার কারণে কাফিরদের শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি লোপ পেয়ে গেছে, তাই সত্যকে তারা অনুধাবন করতে পারে না।

এই সূরার ২১ ও ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

أُولَئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ وَضَلَّ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَفْتَرُونَ (21) لَا جَرَمَ أَنَّهُمْ فِي الْآَخِرَةِ هُمُ الْأَخْسَرُونَ

“এরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করলো এবং যা তাদের কল্পনাপ্রসূত ছিল তা তাদের নিকট মিথ্যা প্রতিপন্ন হলো।” (১১:২১)

“পরলোকে এরাই হবে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত- এতে কোন সন্দেহ নেই।” (১১:২২)

সমাজের পথভ্রষ্ট নেতা ও প্রতাপশালী ব্যক্তিদেরকে উদ্দেশ্য করে এখানে বলা হয়েছে, তারা তাদের যাবতীয় পাথেয় এবং অবলম্বন হাতছাড়া করে ফেলেছে। ফলে তারা এখন অনন্তকালীন ক্ষতির নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে ইহজগত হচ্ছে একটি বিপণী কেন্দ্রের মত, এখানে মানুষ তার জীবন ও কর্ম বিক্রির জন্য উপস্থাপন করে। আর এর ক্রেতা হচ্ছে, মহান আল্লাহ, শয়তান এবং কুপ্রবৃত্তি। এর মধ্যে কেবল আল্লাহই মানুষের কৃতকর্মের উৎকৃষ্ট ও উত্তম মূল্য দিয়ে থাকেন। তাই আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো কাছে বিক্রি করা হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কারণ অন্য ক্রেতার কাছ থেকে যা পাওয়া যাবে তা সাময়িক। ইহজীবনেই তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। অনন্তকালীন জীবনের জন্য তা কোন কাজে আসবে না।

এই আয়াত থেকে আমাদের শিক্ষণীয় হচ্ছে,

সম্পদ ও পদমর্যাদা হারানো অবশ্যই মানুষের জন্য একটি বড় ক্ষতি, কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে মনুষ্যত্ব বিসর্জিত হওয়া। আরেকটি দিক হচ্ছে- বৈষয়িক ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব কিন্তু হারিয়ে যাওয়া জীবন আর ফিরে পাওয়া যায় না। ফলে পরলোকগত হওয়ার পর জীবনের ভুল ত্রুটি শোধরানোর আর সুযোগ আসে না।

সূরা হুদের ২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

إِنَّ الَّذِينَ آَمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَأَخْبَتُوا إِلَى رَبِّهِمْ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

“নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাসী, সৎকর্মপরায়ণ এবং তাদের প্রতিপালকের প্রতি বিনয়াবনত, তারাই বেহেশতবাসী, সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে।” (১১:২৩)

পথভ্রষ্ট এবং সত্যকে ত্যাগ করার কারণে ইহলোক ও পরলোক দুই জায়গাতেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের আবাস হবে জাহান্নামে। পক্ষান্তরে বিশ্বাসী সৎকর্ম পরায়ণ মুসলমানরা তাদের কর্মের পুরস্কার লাভ করবেন এবং অনন্ত শান্তির আবাস জান্নাতে প্রবেশ করবেন। এই আয়াতে বিনয় ও মিনতি প্রসঙ্গ এজন্যই বলা হয়েছে, যাতে দ্বীনদারীর কারণে কোন মুমিনের মনে অহংকার জন্ম না নেয়। কারণ অহংকার ও গর্ব এবাদত বন্দেগীকে নষ্ট করে দেয়। কাফির এবং একজন মুসলমানের মধ্যে এখানেই একটি বড় পার্থক্য। অবাধ্যতা, ঔদ্ধত্য এবং দম্ভ এসব হচ্ছে অবিশ্বাসী কাফিরদের বৈশিষ্ট্য অপরদিকে একজন মুমিন মুসলমান হচ্ছে আল্লাহর অনুগত ও বিনয়াবনত।

এই আয়াত থেকে আমরা উপলদ্ধি করতে পারি যে, মহান আল্লাহ মানুষকে সৎপথে আনয়নের জন্য যেমন সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন তেমনি আবার উত্তম পুরস্কারের ঘোষণাও দিয়েছেন। অবাধ্যদেরকে তাদের পরিণামের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন এবং পবিত্র অন্তরের অধিকারী মুমিনদেরকে তাদের প্রাপ্য উত্তম পুরস্কারের সুখবর জানিয়েছেন।

এই সূরার ২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

مَثَلُ الْفَرِيقَيْنِ كَالْأَعْمَى وَالْأَصَمِّ وَالْبَصِيرِ وَالسَّمِيعِ هَلْ يَسْتَوِيَانِ مَثَلًا أَفَلَا تَذَكَّرُونَ

“উভয় পক্ষের দৃষ্টান্ত হচ্ছে অন্ধ ও বধির এবং চক্ষুষ্মান ও শ্রবণশক্তি সম্পন্নের মত। তুলনায় দু’টি কি সমান? তবুও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করবে না?”(১১:২৪)

কাফির এবং মুমিন মুসলমানের মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা একটি উপমা ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ কাফির অবিশ্বাসীরা সত্যকে যেন দেখতে পায় না। সত্যের বাণী তাদের কানে যেন পৌঁছে না। ফলে তারা অন্ধ ও বধিরের মত। কিন্তু মুমিন মুসলমানরা সত্যের বাণী বিবেচনা করে তা গ্রহণ করে ফলে তারাই আসলে শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির অধিকারী। কিন্তু মানুষ খুব কমই এই বাস্তবতার প্রতি লক্ষ্য করে এবং এ থেকে কমই শিক্ষা নেয়। মানুষ অন্যান্য সকল প্রাণীর মত ইন্দিয়গ্রাহ্য সকল কিছু প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু মানুষের সাথে অন্যান্য প্রাণীর পার্থক্য হচ্ছে, মানুষ অতীন্দ্রিয় বিষয় নিয়ে ভাবে,উপলদ্ধি করে যা অন্যান্য প্রাণী পারে না।