আল হাসানাইন (আ.)

সূরা হুদ;(৮ম পর্ব)

0 বিভিন্ন মতামত 00.0 / 5

সূরা হুদ; আয়াত ২৯-৩২

সূরা হুদের ২৯ ও ৩০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَيَا قَوْمِ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مَالًا إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى اللَّهِ وَمَا أَنَا بِطَارِدِ الَّذِينَ آَمَنُوا إِنَّهُمْ مُلَاقُو رَبِّهِمْ وَلَكِنِّي أَرَاكُمْ قَوْمًا تَجْهَلُونَ (29) وَيَا قَوْمِ مَنْ يَنْصُرُنِي مِنَ اللَّهِ إِنْ طَرَدْتُهُمْ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ

 “হে আমার সম্প্রদায়! ধর্ম প্রচারের প্রতিদান হিসেবে আমি তোমাদের কাছে ধনসম্পদ চাই না। আমার শ্রমফল আল্লাহর নিকট রয়েছে। (তোমাদের কারণে) আমি বিশ্বাসী ঈমানদারদেরকে তাড়িয়ে দেব না। (কারণ) তারা অবশ্যই তাদের প্রতিপালকের সাক্ষাত লাভ করবে। তবে আমি দেখতে পাচ্ছি তোমরাই এক অজ্ঞ সম্প্রদায়।”(১১:২৯)

“আর হে আমার সম্প্রদায়! আমি যদি তাদেরকে তাড়িয়ে দিই তাহলে আল্লাহর দরবারে কারা আমার সাহায্যকারী হবে? তবুও কি তোমরা অনুধাবন করবে না?"(১১:৩০)

গত পর্বের আলোচনায় বলা হয়েছে, হযরত নূহ (আ.) যখন তার সম্প্রদায়কে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের জন্য আহ্বান জানান, তখন সমাজের বিত্তবান ও প্রতাপশালীদের অধিকাংশই তা প্রত্যাখ্যান করে। তারা হযরত নূহ (আ.) এবং তার অনুসারীদেরকে হেয় করার জন্য বলে বেড়াতে থাকে যে, যারা হযরত নূহকে রাসূল হিসাবে বিশ্বাস করেছে তারা মুর্খ এবং সমাজের খুবই নীচু স্তরের মানুষ। তাদের এই মন-মানসিকতার জবাবে এই আয়াতে বলা হয়েছে, প্রথমত: ধর্ম প্রচারের জন্য হযরত নূহ (আ.) তোমাদের কাছে ধন সম্পদ কামনা করছেন না এবং তিনি কোন পদমর্যাদা লাভেরও প্রত্যাশী নন। ফলে এ ধরনের আশঙ্কায় তোমাদের বিচলিত হওয়ার কোন কারণ নেই। দ্বিতীয়ত: তোমাদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য সমাজের দুর্বল ও দরিদ্র মানুষকে হযরত নূহ দুরে সরিয়ে দেবে এমন আশা করাও ঠিক হবে না। কারণ আল্লাহর কাছে ধনী হিসাবে গরীবের উপর তোমাদের কোনই শ্রেষ্ঠত্ব নেই। ফলে এ ধরনের কোন কিছু করা হলে তারা যদি প্রতিফল হিসাবে বা কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে হযরত নূহের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ তোলে তাহলে সেদিন তার জবাব দেয়ার মত কিছু থাকবে না। আয়াতের শেষভাগে বলা হয়েছে, এ জাতীয় অনর্থক দাবির ফলে তাদের মুর্খতা ও অজ্ঞতাই প্রামাণিত হয়। কারণ তারা শুধু বৈষয়িক মাপকাঠিতেই সব কিছু বিবেচনা করে এবং নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে।

এই আয়াত থেকে আমরা দু’টি জিনিস উপলদ্ধি করতে পারি:

এক. নবী-রাসূলগণ ধন-সম্পদ এবং পার্থিব মোহ থেকে মুক্ত। এটাই তাদের সত্যতার প্রমাণ বহন করে।

দুই. সমাজের অভিজাত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্য দরিদ্র শ্রেণীকে অবহেলা করা বা তাদেরকে দুরে ঠেলে দেয়া উচিত নয়। বরং অভিজাত শ্রেণীর উচ্চাভিলাষ ও অযৌক্তিক প্রত্যাশাকেই উপেক্ষা করা উচিত।

এই সূরার ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَلَا أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ وَلَا أَقُولُ إِنِّي مَلَكٌ وَلَا أَقُولُ لِلَّذِينَ تَزْدَرِي أَعْيُنُكُمْ لَنْ يُؤْتِيَهُمُ اللَّهُ خَيْرًا اللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا فِي أَنْفُسِهِمْ إِنِّي إِذًا لَمِنَ الظَّالِمِينَ

"আমি তোমাদেরকে বলি না, আমার নিকট আল্লাহর ধন-ভাণ্ডার আছে, এ কথাও বলি না যে, অদৃশ্য সম্বন্ধে আমি অবগত। এটাও বলি না যে, আমি ফেরেশতা। তোমাদের দৃষ্টিতে যারা তুচ্ছ তাদের সম্পর্কে আমি বলি না যে, আল্লাহ তাদের কখনোই মঙ্গল দান করবেন না। তাদের অন্তরে যা আছে আল্লাহ তা ভালো করেই জানেন। সুতরাং এমন কথা বললে আমি অবশ্যই সীমালঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবো।”(১১:৩১)

হযরত নূহ (আ.) তার সম্প্রদায়ের আরো কিছু অবান্তর ধারণার জবাব দিয়েছেন। তাদের ধারণা ছিল হযরত নূহ (আ.) নিশ্চয়ইই কোন গুপ্তধন বা সোনার খনি লাভ করেছেন এবং যারা তার আনুগত্য করবে নিশ্চয়ই তিনি তাদের মধ্যে তা বন্টন করবেন। তারা এটাও মনে করতো হযরত নূহ হয়তো, অদৃশ্য সম্বন্ধে জ্ঞান রাখেন। তাই তিনি ভবিষ্যত বাণীর মাধ্যমে তার অনুসারীদেরকে সম্ভাব্য বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবেন। তাদের মধ্যে অনেকের ধারণা ছিল পয়গম্বররা নিশ্চয়ই ফেরেশতাদের মত। সাধারণ মানুষের মত যদি খাবার গ্রহণ করে, বিয়ে করে, সংসার করে, তাহলে পয়গম্বর হলো কি করে?"

হযরত নূহ (আ.) এসব অবান্তর ধারণার জবাবে বললেন, আমি একজন মানুষ এবং সাধারণ মানুষের মতই আমি জীবন যাপন করি। শুধু পার্থক্য হলো, মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ আমার কাছে ওহী পাঠায় এবং তার ওহী বা বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব তিনি আমার উপর অর্পন করেছেন। আমার হাতে কোন গুপ্ত ধনের ভাণ্ডার নেই,অদৃশ্য সম্বন্ধেও আমার কোন জ্ঞান নেই। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ যতটুকু আমাকে অবহিত করেন, তার মধ্যেই আমার জ্ঞান সীমিত। আর আমার অনুসারীদের ব্যাপারে তোমাদের মন্তব্যও গ্রহণযোগ্য নয়। পয়গম্বরের অনুসারীদেরকে সমাজের অভিজাত শ্রেণীর মধ্য থেকেই হতে হবে এমন ধারণা অযৌক্তিক। কাজেই আমার অনুসারীদেরকে দরিদ্র বলে তোমরা যেভাবে হেয় করার চেষ্টা করছো তাতে আমার কিছু আসে যায় না।

নবী-রাসূলগণ হলেন,আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি। আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার গুরুদায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত। তাদের কথা ও কাজে কোন অসামঞ্জস্যতা নেই। তারা মানুষকে সৎপথে পরিচালিত করার জন্য চেষ্টা করেন। তাই বলে মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য কখনোই মিথ্যা অঙ্গীকার করেন না।

সূরা হুদের ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

قَالُوا يَا نُوحُ قَدْ جَادَلْتَنَا فَأَكْثَرْتَ جِدَالَنَا فَأْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِينَ

" তারা বললো, হে নূহ! আপনি আমাদের সাথে অতিমাত্রায় বিতণ্ডা করেছেন, সুতরাং আপনি সত্যবাদী হলে, সেই শাস্তি নিয়ে আসুন যে সম্পর্কে আপনি আমাদেরকে সতর্ক করেছেন।" (১১:৩২)

হযরত নূহ (আ.) এর যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য খণ্ডন করার মত যুক্তি যখন তারা পেল না তখন তারা হযরত নূহের বক্তব্যকে অহেতুক বিতর্ক বা বিতন্ডা বলে আখ্যায়িত করলো। তারা হযরত নূহ (আ.)এর বক্তব্য অনুধাবন করার চেষ্টা না করে, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বললো, আপনার কথা সত্য হয়ে থাকলে ঐশী শাস্তি নিয়ে আসুন। আমরা আপনার কথিত শাস্তি দেখতে চাই।

আপনার মতামত

মন্তব্য নেই
*
*

আল হাসানাইন (আ.)