ইসলাম ও জাতীয়তাবাদী

ইসলাম যে সময় আবির্ভূত হয় সে সময় আরব জাতির মাঝে বংশ গোত্র ও জাতিভক্তি চরম পর্যায়ে ছিল। তখন আরবদের মাঝে আরব জাতীয়তাবাদ তেমন প্রসার লাভ করে নি, কারণ আরবরা অন্যান্য জাতির মোকাবিলায় তখনও একক জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। তাই আরবদের গোঁড়ামি গোত্রবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং তারা নিজ গোত্র নিয়েই গর্ব করত। কিন্তু ইসলাম তাদের এ গোত্রভক্তির প্রতি কোন গুরুত্ব দেয় নি; বরং এর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে এবং কোরআন স্পষ্ট বলেছে,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُواإِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ

হে মানব জাতি! আমরা এক পুরুষ ও নারী হতে তোমাদের সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্তি করেছি যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হও (পরস্পরকে চিনতে পার), নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট সবচেয়ে সম্মানিত সে যে সর্বাধিক তাকওয়াসম্পন্ন।’ নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্বজ্ঞাতা। (সূরা হুজুরাত: ১৩)

এ বিষয়ে কোরআনের আয়াত, রাসূল (সা.)-এর বিভিন্ন হাদীস এবং বিভিন্ন আনারব গোত্র ও জাতির সঙ্গে তাঁর আচরণ ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিকে পূর্ণরূপে তুলে ধরে।

পরবর্তীতে উমাইয়্যা বংশের ক্ষমতায় আরোহণ এবং তাদের ইসলাম বিরোধী নীতির কারণে একদল আরব জাতীয়তার বিষয়টিকে ব্যবহার করে জাতি ও বংশগত গোঁড়ামির অগ্নি প্রজ্বলিত করে। অনারব অন্যান্য জাতি বিশেষত ইরানীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে ও পূর্বে বর্ণিত আয়াতসমূহকে স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদেরকে সমতাকামী ও সাম্যের পক্ষ শক্তি বলে প্রচার করে। তারা আয়াতে ব্যবহৃত شعوبا শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে নিজেদের شعوبي বলত। কোন কোন মুফাসসিরের মত এবং ইমাম সাদিক (আ.)-এর হাদীস হতে বোঝা যায় আরবী ‘কাবায়িল’ শব্দ এমন একটি একক যা ঐ গোত্রসমূহের জন্য ব্যবহৃত হয় যারা বংশগতভাবে একত্রে বসবাস করে এবং شعوب গোত্র হতে বৃহত্তর একক যারা জাতি হিসেবে একত্রে বসবাস করে। সুতরাং শুয়ুবীরা নিজেদের এ নামে সম্বোধিত করার কারণ স্পষ্টত বোঝা যায় তাদের আন্দোলন আরব জাতীয়তার গোঁড়ামির বিরুদ্ধে ইসলামের মৌলনীতি নির্ভর একটি আন্দোলন ছিল। অন্তত বলা যায়, এ আন্দোলনের ভিত্তি এর ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। যদিও এ আন্দোলনের কিছু সংখ্যক লোক এর গতিকে ইসলাম বিরোধিতার দিকে টানার চেষ্টা করে থাকে তদুপরি পুরো আন্দোলনকে ইসলামবিরোধী বলা যায় না। সকল ঐতিহাসিকই রাসূল (সা.)-এর নিকট হতে এ বাক্যটি পুনঃপুন বর্ণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন,

«أيّها النّاس كلّكم لآدم و آدم من تراب لا فضل لعربيّ على عجميّ إلّا بالتّقوى»

‘হে মানবকূল! তোমরা সকলেই আদমের সন্তান, আদম মাটি হতে সৃষ্ট হয়েছে। আরব অনারবের ওপর কোন শ্রেষ্ঠত্ব রাখে না একমাত্র তাকওয়া ব্যতীত।’

মহানবী (সা.) তাঁর এক হাদীসে স্বজাতির পূর্ববর্তীদের নিয়ে গর্ব করার বিষয়টিকে দুর্গন্ধময় বলে অভিহিত করেছেন এবং যে সকল ব্যক্তি এরূপ কাজ করে তাদের جُعل অর্থাৎ তেলাপোকার (আরশোলা) সঙ্গে তুলনা করেছেন। হাদীসটি এরূপ:

«ليدعن رجال فخرهم بأقوام إنّما هم فحم من فحم جهنّم أو ليكوننّ أهون على الله من الجعلان الّتي تدفع بأنفها النّتن»

‘যারা নিজ জাতীয়তা নিয়ে গর্ব করে, তারা জেনে রাখুক এই গর্ব জাহান্নামের ইন্ধন বৈ কিছু নয়, (যদি তারা এ কর্ম পরিত্যাগ না করে) আল্লাহর নিকট নাসারন্ধ্রে দুর্গন্ধ বহনকারী তেলাপোকা অপেক্ষাও নিকৃষ্ট বলে পরিগণিত হবে।’

রাসূল (সা.) আবুযার গিফারী, মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ কিন্দী এবং আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে যেভাবে গ্রহণ করতেন ঠিক তেমনিভাবে সালমান ফরসী ও বেলাল হাবাশীকে গ্রহণ করতেন। কারণ সালমান ফারসী (ইরানী) অন্যদের হতে এতটা অগ্রগামী হতে পেরেছিলেন, নবী (সা.)-এর ‘আহলে বাইত’ বলে তাঁর নিকট হতে উপাধি লাভ করেছিলেন।

রাসূল সব সময় লক্ষ্য রাখতেন অন্যদের মধ্যে জাতিভক্তির যে বাড়াবাড়ি রয়েছে তা যেন মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে। উহুদের যুদ্ধে একজন ইরানী মুসলিম যুবক শত্রুপক্ষের এক ব্যক্তিকে তরবারী দ্বারা আঘাত করে বলল, “এই তরবারীর আঘাত গ্রহণ কর আমার মত এক ইরানী যুবকের নিকট হতে।” নবী (সা.) এ বিষয়টি জাতিগত গোঁড়ামির সৃষ্টি করতে পারে বলে তৎক্ষণাৎ যুবককে বললেন, ‘কেন তুমি বললে না, এক আনসার যুবক হতে?’ অর্থাৎ ইসলাম যে বিষয়টিকে গর্বের উপকরণ মনে করে তা না করে কেন জাতীয় ও গোত্রীয় বিষয়কে টেনে আনলে?

নবী (সা.) অন্য এক স্থানে বলেছেন,

«ألا إنّ العربيّة ليست بأب والد و لكنّها لسان ناطق فمن قصر به عمله لم يبلغ به حسبه»

আরবীয়তা কারো পিতৃত্ব নয়; বরং একটি ভাষা। তাই যার আমল ও কর্ম অপূর্ণ, পিতৃত্ব ও বংশীয় পরিচয় তাকে কোথাও পৌঁছাবে না।’

রাওজায়ে কাফীতে উল্লিখিত হয়েছে: ‘একদিন সালমান ফারসী মদীনার মসজিদে বসেছিলেন। রাসূলের প্রসিদ্ধ সাহাবীদের অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বংশ ও গোত্রীয় পরিচয় নিয়ে সকলে আলোচনা করছিলেন। সকলেই নিজ গোত্র ও বংশ পরিচয় সম্পর্কে কিছু বলছিলেন ও এর মাধ্যমে নিজেকে সম্মানিত করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। হযরত সালমানের পালা আসলে তাঁকে সকলে নিজ বংশ পরিচয় সম্পর্কে কিছু বলতে বললেন। ইসলামের শিক্ষায় প্রশিক্ষিত এ মনীষী তখন নিজ গোত্র, বংশ ও জাতীয় পরিচিতির কোন গর্ব না করে বললেন:  

“আমি সালমান, আল্লাহর এক বান্দার সন্তান”

আরও বললেন:

“আমি পথভ্রষ্ট ছিলাম, আল্লাহ্ আমাকে মুহাম্মদের মাধ্যমে হেদায়েত করেছেন। আমি দরিদ্র ছিলাম, তিনি মুহাম্মদের মাধ্যমে আমাকে ধনী করেছেন। আমি দাস ছিলাম, মুহাম্মদের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাকে মুক্ত ও স্বাধীন করেছেন। এটিই আমার বংশ পরিচয়”।

এমন সময় রাসূল (সা.) সেখানে প্রবেশ করলে হযরত সালমান তাঁকে ঘটনা বর্ণনা করলেন। রাসূল সমবেত লোকদের (যাদের অধিকাংশই কুরাইশ ছিলেন) উদ্দেশে বললেন,

«يا معشر قريش إنّ حسب الرّجل دينه و مروئته خلقه و أصله عقله»

"হে কুরাইশ! ব্যক্তির গর্ব হলো তার ধর্ম (তার রক্ত ও বংশ নয়), তার পৌরুষত্ব হলো তার চরিত্র ও সুন্দর স্বভাব, তার ভিত্তি হলো তার আকল (বুদ্ধিবৃত্তি) ও চিন্তাশক্তি।”

মানুষের মূল তার বংশের ভিত্তিতে নয়; বরং বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তাশক্তির ভিত্তিতে। ‘পচনশীল ও দুর্গন্ধযুক্ত অস্থিমাংস নিয়ে গর্ব করা অপেক্ষা দীন, চরিত্র, আকল ও অনুধাবন ক্ষমতা নিয়ে গর্ব কর।’ চিন্তা করুন এ হতে উত্তম ও অধিকতর যুক্তিযুক্ত কথা কি হতে পারে?

জাতি ও বংশগৌরবের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহর উপর্যুপরি তাগিদ মুসলমানদের মনে বিশেষত অনারব মুসলমানদের মধ্যে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলেছিল। এ কারণেই আরব-অনারব সকল মুসলমানই ইসলামকে তাদের স্বকীয় ও নিজস্ব বলে মনে করত। এ জন্যই উমাইয়্যা শাসকদের জাতিগত গোঁড়ামি অনারব মুসলমানদেরকে ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করতে পারে নি। তারা জানত খলীফাদের এ সকল কর্মের সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। তাই এ সকল খলীফার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ ছিল-কেন ইসলামী বিধান অনুযায়ী কাজ করা হয় না।

ইসলামের নবী (সা.) বিভিন্ন সময় যেমন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, "আমি তোমাদের মতই মানুষ, কালো হাবাশী দাস এবং সম্ভ্রান্ত কুরাইশের মধ্যে খোদাভীতির মানদণ্ড বহির্ভূত কোন পার্থক্য নেই”- তেমনি বাস্তবেও তার নমুনা তিনি দেখিয়েছেন। ইরানীরা স্বপ্নে ও কল্পকাহিনীতেও যা ভাবেনি ও অন্তরে যার আকাঙ্ক্ষাই শুধু করেছিল বাস্তবে খোলাফায়ে রাশেদীনের মধ্যে বিশেষত আলী (আ.)-এর মধ্যে তা হতেও আশ্চর্যজনক কিছু লক্ষ্য করেছিল। (সূত্র:আল বাসাইর)

তথ্যসূত্র:

১. তোহাফুল উকুল, পৃ ৩৪; সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪১৪।

২. সুনানে ইবনে দাউদ, ২য় খণ্ড, ৬২৪ পৃষ্ঠা।

৩. সাফিনাতুন বিহার, سَلَمَ ধাতু।

৪. সুনানে আবু দাউদ, ২য় খণ্ড, ৬২৫ পৃষ্ঠা।

৫. বিহারুল আনওয়ার, ২১ খণ্ড, ১৩৭ পৃষ্ঠা।

৬. রাওজায়ে কাফী, ৮ম খণ্ড, ২০৩ নং হাদীস।