নাহজুল বালাগায় পরাপ্রাকৃতিক (আধ্যাত্মিক-অজড়) বিষয়াদির ক্ষেত্রে দার্শনিক অনুধাবন ও উপলব্ধিসমূহের মূল্য

শহীদ আয়াতুল্লাহ্ মুর্তাজা মুতাহ্হারী

মূল ফার্সী থেকে মো. মুনীর হোসেন খান কর্তৃক অনূদিত

আমরা বলেছি যে,নাহজুল বালাগা’য় স্রষ্টাতত্ত্ব সংক্রান্ত বিষয়াদি দু’ভাবে উপস্থাপিত ও আলোচিত হয়েছে : এর একটি প্রক্রিয়ায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ (বস্তুজগৎ) অথবা এর সমুদয় ব্যবস্থা যেগুলো এর মাঝে বিদ্যমান ও ক্রিয়াশীল সেগুলো এমন এক আয়নাতুল্য দেখানো হয়েছে যা এর অস্তিত্বদাতার (স্রষ্টা) জ্ঞান ও পূর্ণতা নির্দেশক। আর অন্য প্রক্রিয়ায় খাঁটি বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাধারা এবং বিশুদ্ধ দার্শনিক বিচার-বিশ্লেষণ ব্যবহার করা হয়েছে। নাহজুল বালাগার স্রষ্টাত্তত্ব বিষয়ক অধিকাংশ আলোচনার ভিতই হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাধারা এবং দার্শনিক বিচার-বিশ্লেষণ। মহান আল্লাহর পবিত্র সত্তার পূর্ণতা নির্দেশক (গুণ ও বিষয়াদি) এবং দোষ-ক্রটি প্রত্যাখ্যানকারী গুণ ও বিষয়াদির ক্ষেত্রে কেবল এ দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটিই ব্যবহার করা হয়েছে।

আমরা যতটা জানতে পেরেছি তদনুসারে এ ধরনের আলোচনার মূল্য ও গুরুত্বের এবং এগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সন্দেহ ও সিদ্ধান্তহীনতা বিদ্যমান আছে। সব সময় এমন কিছু মানুষ বিদ্যমান ছিল এবং আছে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক,শারয়ী (শরীয়তগত) অথবা উভয়বিদ দৃষ্টিকোণ থেকেই এ ধরনের আলোচনা-পর্যালোচনাকে অবৈধ (নাজায়েজ) বলে মনে করে। আবার বর্তমানকালে একদল লোক দাবী করেন যে,ইসলামের মূল নির্যাস এ ধরনের বিশ্লেষণ এবং আলোচনা-পর্যালোচনার সাথে মোটেও খাপ খায় না। আর মুসলমানরা গ্রীক দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে,বরং পবিত্র কোরআন থেকে দিক নির্দেশনা না নিয়েই এ ধরনের বিষয়ের গণ্ডিতে প্রবেশ করেছিল এবং তারা যদি সূক্ষ্মভাবে পবিত্র কোরআনের দিক নির্দেশনা ও শিক্ষামালা মেনে চলত তাহলে তারা এ ধরনের জটিল আলোচনা ও বিষয়াদির মাঝে নিজেদেরকে নিয়োজিত করত না। এ ধরনের ব্যক্তিবর্গ এ কারণেই নাহজুল বালাগার এ অংশ যে হযরত আলী (আ.)-এর বাণী এবং তাঁর সাথেই সংশ্লিষ্ট সে ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে।

হিজরী দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে একদল লোক শারয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক-দার্শনিক আলোচনাসমূহের বিরোধিতা করত। এ গোষ্ঠিটি দাবী করত যে,মুসলমানদের ওপর ফরয হচ্ছে সাধারণ জনতা যে মাত্রা ও পরিমাণে বুঝে থাকে ঠিক ততটুকু পরিমাণ ও মাত্রায় পবিত্র কোরআন ও হাদীসের শব্দগুলোর যেসব বাহ্য অর্থ বোধগম্য কেবল সেগুলো মেনে নেয়া এবং এগুলোর ক্ষেত্রে যে কোন ধরনের প্রশ্নোত্তর,অনুসন্ধান ও গবেষণা হচ্ছে বিদআত। মাঝে মাঝে উদাহরণস্বরূপ “পরম করুণাময় (মহান আল্লাহ্) মহান আরশের ওপর অধিষ্ঠিত অর্থাৎ কর্তৃত্বশীল”-পবিত্র কোরআনের এ আয়াতটির ব্যাপারে কোন ব্যক্তি যদি প্রশ্ন করত তাহলে তারা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ত ও ব্যথিত হতো। তারা এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করাকে অবৈধ গণ্য করত এবং বলত : আরশের ওপর মহান আল্লাহর উপবিষ্ট হওয়ার ধরন এবং প্রকৃত স্বরূপ আমাদের অজানা এবং তা আমাদের কাছে অজ্ঞাত-অস্পষ্ট,আর (এ ব্যাপারে) প্রশ্ন করাই হচ্ছে বিদআত।

হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে এ দলটি যারা পরবর্তীতে আশ’আরী মতাবলম্বী বলে পরিচিতি লাভ করে তারা মু’তাযিলা মতাবলম্বীদের ওপর বিজয়ী হয়েছিল। উল্লেখ্য যে,মু’তাযিলারা এ ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও অনুশীলন বৈধ বলে মনে করত। তবে মু’তাযিলাদের ওপর আশ’আরীদের এ বিজয় আসলে মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের ওপর এক বিরাট মারণাঘাত হানে। হিজরী দশম শতাব্দী থেকে হিজরী চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত,বিশেষ করে হিজরী দশম ও একাদশ শতাব্দীতে আহলে বাইতের মতাদর্শের অনুসারীদের মধ্যে আখবারীরা মূলত আশ’আরী চিন্তা-চেতনারই অনুসারী ছিল। আর এটি ছিল শারয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে।

কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইউরোপে প্রকৃতিবিজ্ঞান চর্চা করার ক্ষেত্রে কিয়াসভিত্তিক বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতির ওপর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষণ পদ্ধতির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার ফলশ্রুতিতে এ ধরনের ধ্যান-ধারণার উন্মেষ ঘটে যে,কেবল প্রকৃতিবিজ্ঞানের চর্চার ক্ষেত্রেই নয়,বরং কোথাও বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতির নির্ভরযোগ্যতা নেই। আর কেবল নির্ভরযোগ্য দর্শনই হচ্ছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দর্শন। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির স্বাভাবিক পরিণতি হয়েছিল এই যে,আধ্যাত্মিক অর্থাৎ ঐশ্বরিক ভাববাদী বিষয়াদি সন্দেহযুক্ত ও অনির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হতে থাকে। কারণ এগুলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও পরীক্ষা-নিরীক্ষণভিত্তিক পর্যবেক্ষণসমূহের সীমারেখা ও গণ্ডির আওতা বহির্ভূত।

মুসলিম বিশ্বে একদিকে আশ’আরী মতবাদের অতীত নজীর ও পূর্ব-অভিজ্ঞতা এবং অন্যদিকে পাশ্চাত্যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও পরীক্ষা-নিরীক্ষণ পদ্ধতির অব্যাহত ও বিস্ময়কর সাফল্যসমূহ একদল অশিয়া মুসলিম লেখক ও চিন্তাবিদকে তীব্রভাবে আলোড়িত ও প্রভাবিত করেছে এবং এক ধরনের মিশ্র অভিমত ও দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষ ঘটিয়েছে যা শারয়ী ও বুদ্ধিবৃত্তিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই স্রষ্টাতত্ত্বে যুক্তিনির্ভর বুদ্ধিবৃত্তিক পদ্ধতির ব্যবহারকে অবৈধ ও প্রত্যাখ্যাত বলে বিশ্বাস করে। তাঁরা শারয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে দাবী করেছেন যে,পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে স্রষ্টা-পরিচিতির একমাত্র নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হচ্ছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষণভিত্তিক পদ্ধতি অর্থাৎ সৃষ্টিজগৎ সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণা। আর এ ছাড়া যা কিছু আছে সেগুলো সবই অনর্থক। তাঁদের মতে পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মানব জাতিকে প্রকৃতিজগতের বিভিন্ন নিদর্শন ও প্রপঞ্চ অধ্যয়ন ও গবেষণা করার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। আর পবিত্র কোরআন সৃষ্টির উৎসমূল এবং পারলৌকিক জীবন বা আখেরাতের মূল চাবিকাঠি ও সকল অজানা রহস্যের সমাধান কেবল এ প্রকৃতির মাঝে নিহিত আছে বলেই বিশ্বাস করে! আবার তাঁরা বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের নিজেদের লেখা ও রচনাবলীতে ইউরোপের ইন্দ্রিয়বাদী দার্শনিকদের অভিমত ও বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।

ফরীদ ওয়াজদী তাঁর ‘আলা ইতলালিল মাযহাবিল মাদ্দী’* নামক গ্রন্থে,ভারতের সাইয়্যেদ আবুল হাসান নাদভী তাঁর ‘মাযা খাসিরাল আ’লাম বি ইনহিতাতিল মুসলিমীন’ নামক গ্রন্থে,এবং সাইয়্যেদ কুতবের মতো ‘ইখওয়ানুল মুসলিমীন’-এর লেখকবৃন্দ তাঁদের রচিত গ্রন্থসমূহে এ অভিমত ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার এবং তাঁদের পরিপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির তীব্র নিন্দা ও কঠোর সমালোচনা করেছেন।

নাদভী ‘জাহেলিয়াত থেকে ইসলামের দিকে মুসলমানদের উত্তরণ’ শীর্ষক অধ্যায়ে ‘স্রষ্টাতত্ত্বের দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ও বর্ণিত বিষয়াদি’-এর শিরোনামে লিখেছেন :

“মহান নবিগণ মানব জাতিকে মহান আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলী,সৃষ্টি জগতের উদ্ভব ও পরিসমাপ্তি এবং মানব জাতির চূড়ান্ত পরিণতি সম্পর্কে অবগত করেছেন এবং (এ সব বিষয় সংক্রান্ত) প্রয়োজনীয় তথ্যাবলীও তাঁদের কাছে বিনামূল্যে সরবরাহ করেছেন। আর এভাবে তাঁরা যে সব বিষয়ের মৌলিক ভিত্ ও পূর্বজ্ঞাত নিয়ম-কানুন মানুষের কর্তৃত্বের মধ্যে নেই সেগুলোর প্রতি তাদের (মানব জাতির) মুখাপেক্ষিতা ও প্রয়োজনটিও দূর করে দিয়েছেন। কারণ এগুলো হচ্ছে পঞ্চেন্দ্রিয় অর্থাৎ বস্তুজগৎ বহির্ভূত জ্ঞান (অধিবিদ্যা) এবং মানব জাতির জ্ঞান ও চিন্তা-চেতনার বিচরণক্ষেত্রই হচ্ছে কেবল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়াদি অর্থাৎ বস্তু এবং বস্তুজগৎ,কিন্তু মানব জাতি এ মহা নেয়ামতের মূল্য বুঝতে পারেনি বলেই তারা এ সব বিষয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণায় রত হয়েছে আসলে যা অন্ধকার ও অজ্ঞাত অঞ্চলে পদচারণা বৈ আর কিছুই নয়।”

এ গ্রন্থ যা মুসলমানদের পতনের ব্যাপারে আলোচনা করে এর আরেকটি অধ্যায়ে লেখক ‘উপকারী জ্ঞান ও শাস্ত্রসমূহের প্রতি কম গুরুত্বদান’-এ শিরোনামে মুসলিম আলেম ও পণ্ডিতদের এভাবে সমালোচনা করেছেন : “ইসলামী মনীষী ও আলেমগণ গ্রীকদের কাছ থেকে যে অধিবিদ্যা ও অতিপ্রাকৃতিক বিষয়াদি শিক্ষা করেছিলেন সেগুলোর ব্যপারে যে মাত্রায় তাঁরা আলোচনা ও গবেষণা করেছেন এবং গুরুত্ব দিয়েছেন ঠিক তেমন গুরুত্ব তাঁরা বিজ্ঞান এবং ব্যবহারিক জ্ঞান ও শাস্ত্রের ব্যপারে দেননি। গ্রীক অধিবিদ্যা ও পরাপ্রাকৃতিক বিদ্যা এবং তাদের ঐশ্বরিক দর্শন আসলে তাদের মূর্তিপূজা বিষয়ক আকীদা বিশ্বাস ব্যতীত আর কিছুই নয় যেগুলোর একটি শাস্ত্রীয় ও তাত্ত্বিক রূপ দেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে কতকগুলো অলীক ধারণা,কল্পনা,অনুমান এবং মুখরোচক বুলি যেগুলোর আসলেই কোন তাৎপর্য ও বাস্তবতা নেই। মহান আল্লাহ্ মুসলমানদেরকে ঐশী শিক্ষা প্রদান করার মাধ্যমে এ ধরনের বিষয় যেগুলো রাসায়নিক বিশ্লেষণের সাথে বৈসাদৃশ্য নয় সেগুলোর ব্যাপারে অধ্যয়ন,অনুসন্ধান,গবেষণা,আলোচনা,পর্যালোচনা এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার ব্যাপারে অমুখাপেক্ষী করেছেন। কিন্তু মুসলমানরা এ মহা নেয়ামত পেয়েও অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে এবং তাদের মেধা ও প্রতিভাকে এ ধরনের বিষয়ের ক্ষেত্রে ব্যয় করেছে।”

নিঃসন্দেহে ফরীদ আল ওয়াজদী ও নাদভীর দৃষ্টিভঙ্গি আসলে আধুনিক ও সমকালীন স্টাইলে বিধৃত অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দর্শনের সাথে সম্পর্কিত হয়ে আশ’আরী মতবাদের পুনঃপ্রত্যাবর্তন।

আমরা এখানে দার্শনিক উপলব্ধি ও বোধের মূল্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনায় ব্রত হতে পারব না। উসূলে ফালসাফাহ্ ওয়া রাভেশে রিয়ালিয্ম্’ গ্রন্থের ‘জ্ঞাত তথ্যাবলীর গুরুত্ব ও মূল্য’ সংক্রান্ত প্রবন্ধ এবং ‘অনুভূতি ও উপলব্ধিসমূহের মাঝে বহুত্বের উদ্ভব’ শীর্ষক প্রবন্ধে এ ব্যাপারে যথেষ্ট তাত্ত্বিক আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু বক্ষমান এ প্রবন্ধে আমরা এ বিষয়টি পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিকোণ থেকে অনুসন্ধান করব এবং দেখব যে,পবিত্র কোরআন কি স্রষ্টাতত্ত্ব সংক্রান্ত অধ্যয়ন ও গবেষণার একমাত্র পথ বলতে প্রকৃতিজগৎ (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তজগৎ) অধ্যায়ন করাকেই বুঝিয়ে থাকে এবং এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান অন্য কোন পথ ও পদ্ধতির স্বীকৃতি দান করে না?

তবে আগেই একটি বিষয় স্মরণ করা অত্যাবশ্যক যে,‘স্রষ্টাতত্ত্ব সংক্রান্ত বিষয়াদির ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর উৎসসমূহ ব্যবহার করতে হবে কি হবে না’-এ বিষয়কে কেন্দ্র করেই কেবল আশ’আরী ও অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যকার মতবিরোধ ও পার্থক্য আবর্তিত হয় না,বরং তাদের মধ্যকার এ পার্থক্য ব্যবহারের ধরনের মধ্যেই নিহিত আছে।

আশ’আরীদের মতে তাআব্বুদ অর্থাৎ কোন ধরনের প্রশ্ন ও আপত্তি করা ব্যতিরেকেই মেনে নেয়ার মাধ্যমেই এ ব্যবহার সুনিশ্চিত হতে হবে। অর্থাৎ যেহেতু আমরা মহান আল্লাহকে একত্ব (وحدت),জ্ঞান (علم),শক্তি (قدرت) এবং অন্য সকল সুন্দর নামে (أسماء الحسنى) বিভূষিত করি সেহেতু আমরা জানি না বা জানতে পারব না যে,মহান আল্লাহ্ আসলেই এ সব বিশেষণ ও বৈশিষ্ট্যের দ্বারা বিভূষিত কি না? কারণ এ সব বিষয়ের মূলনীতি আমাদের কর্তৃত্বের বলয়ের মধ্যে নেই। তাই আমাদেরকে মেনে নিতেই হবে যে,মহান আল্লাহ্ এমনই।” এ ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআনের আয়াত এবং হাদীসমূহের ভাষ্যের ভূমিকা হচ্ছে ধর্মের দৃষ্টিতে আমাদের কিভাবে চিন্তা ও বিশ্বাস করতে হবে যাতে করে আমরা ঠিক সেভাবেই চিন্তা ও বিশ্বাস করতে পারি-তা জানা।

তবে,আশ’আরী বিরোধীদের মতে,অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও যৌক্তিক বিষয়ের ন্যায় এ সব বিষয়ও বোধগম্য। অর্থাৎ কতগুলো মৌলিক নিয়ম-নীতি এ ক্ষেত্রেও ক্রিয়াশীল ও বিদ্যমান যে,যদি মানুষ সঠিকভাবে এসব মৌলিক নীতিমালার সাথে পরিচিত হয় তাহলে সে এগুলো বুঝতে পারবে। কোরআন-হাদীসভিত্তিক দলিল-প্রমাণাদির ভূমিকা হচ্ছে এই যে,এগুলো বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তা-চেতনার অনুপ্রেরণা দানকারী এবং মানুষকে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা এবং উপলব্ধি করতে উদ্বুদ্ধ করে। এগুলো প্রয়োজনীয় ও বোধগম্য মূলনীতি ও নিয়ম আমাদের হাতে তুলে দেয়। মূলত চিন্তামূলক বিষয়াদির ক্ষেত্রে তাআব্বুদ অর্থাৎ নিছক মেনে নেয়া ও অন্ধ অনুসরণের কোন অর্থই হয় না। নির্দেশ অনুসারে এবং পারিভাষিকভাবে অর্থাৎ ফরমায়েশীভাবে (কারোর দ্বারা আদিষ্ট ও প্রভাবিত হয়ে) মানুষের চিন্তা,বিচার-বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেন একটি চাক্ষুষ দেখার বিষয়কে ফরমায়েশীভাবে দেখার মতোই। আর এটি যেন ফরমায়েশীভাবে দ্রষ্টা ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করার অনুরূপ যে,“আমরা এ জিনিসকে কেমন দেখতে পাচ্ছি? ছোট না বড়? সাদা না কালো না নীল? সুন্দর অথবা কুৎসিত?” নিছক অনুসরণ অর্থে চিন্তা-ভাবনা আসলে চিন্তা-ভাবনা না করা এবং চিন্তা-ভাবনা ব্যতিরেকে মেনে নেয়া ছাড়া এর আর কোন অর্থ নেই।

সংক্ষেপে,মানুষের পক্ষে ঐশী বাণী আনয়নকারীদের শিক্ষা-দীক্ষা হতে আরো অধিক অগ্রসর হওয়া সম্ভব কি অসম্ভব-এ ব্যপারে কোন কথা নেই। মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি,ঐশী শিক্ষা হতে অগ্রসর কোন আধ্যাত্মিক শিক্ষার অস্তিত্ব থাকতেই পারে না। যা কিছু ঐশী এবং মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছেছে সেটাই হচ্ছে আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও মারেফাতের উন্নতি ও পূর্ণতার সর্বশেষ পর্যায়। বরং কথা হচ্ছে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তামূলক যোগ্যতার ক্ষেত্রে মানবীয় বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তাধারা কি এসব বিষয়াদির মূলনীতি মালা উপস্থাপন ও প্রদর্শন করে তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিক্রমণ করতে সক্ষম না কি অক্ষম?

তবে প্রকৃতি সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণার দিকে পবিত্র কোরআনের আহ্বান এবং মহান আল্লাহ্ এবং অতিপ্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান ও পরিচিতি অর্জনের জন্য প্রকৃতিজগতের মাধ্যম হওয়া প্রসঙ্গ।

ঐশ্বরিক (আধ্যাত্মিক) জ্ঞান ও পরিচিতির নিদর্শন হিসাবে প্রকৃতি ও সৃষ্টিলোকের প্রপঞ্চ ও ঘটনাবলীর প্রতি মানব জাতির চিন্তাকে নিয়োজিত করণ পবিত্র কোরআনের শিক্ষামালার মূল ভিতসমূহের অন্তর্গত অন্যতম মূলনীতি। আর পবিত্র কোরআন যে অস্বাভাবিক মাত্রায় জোর দিয়ে থাকে যে,মানব জাতি আকাশ,পৃথিবী,উদ্ভিদ,প্রাণী ও মানুষ সম্পর্কে গবেষণা করবে এবং তাত্ত্বিক ও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান কার্য সম্পন্ন ও পরিচালনা করবে- এ ব্যাপারে কোন কথা নেই। তবে মুসলমানরা যে এ পথে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। সম্ভবত এ ধরনের অনগ্রসরতার আসল কারণ ছিল ঐ গ্রীক দর্শন যা পূর্ণ মাত্রায় ন্যায়-অনুমানভিত্তিক (কিয়াসভিত্তিক অর্থাৎ Syllogistic) এবং নিরেট বুদ্ধিবৃত্তিক,এমনকি প্রকৃতি বিদ্যাসমূহের (পদার্থ,রসায়ন ও জীববিদ্যা) ক্ষেত্রেও গ্রীক দর্শন এই একই পদ্ধতি গ্রহণ করেছিল। তবে বিজ্ঞানের ইতিহাসে যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ বিদ্যমান সেগুলোর ভিত্তিতে ইসলামী বিজ্ঞানী ও তাত্ত্বিক পণ্ডিতগণ গ্রীকদের ন্যায় ব্যবহারিক পরীক্ষা-নিরীক্ষণ পদ্ধতিকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করেন নি। মুসলমানরাই ব্যবহারিক পরীক্ষা-নিরীক্ষণ পদ্ধতির আদি আবিষ্কারক ও উদ্ভাবক বলে গণ্য। এ ক্ষেত্রে যা খ্যাতি লাভ করেছে সেটার বিপরীতে বলতে হয় যে,ইউরোপ আসলে এ পদ্ধতির উদ্ভাবক নয়,বরং মুসলমানদের পদাঙ্কানুসারী।

চিহ্ন,প্রভাব ও নিদর্শনাদি সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণার মূল্য

এতসব কিছু সত্ত্বেও যে বিষয়টি প্রণিধান ও চিন্তাযোগ্য তা হচ্ছে এই যে,পৃথিবী ও আকাশসমূহে বিরাজমান সৃষ্ট বিষয়াদি নিয়ে গবেষণার প্রতি পবিত্র কোরআন কি এভাবে গুরুত্ব দান করেছে যে,তা অন্য যে কোন পথ ও পদ্ধতিকে বাতিল করে দেয়? অথবা পবিত্র কোরআন যেভাবে মানব জাতিকে মহান আল্লাহর নিদর্শনসমূহের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করার আহ্বান জানিয়েছে ঠিক তেমনি তা আরেক ধরনের চিন্তা পদ্ধতির দিকেও কি আহবান জানিয়েছে?

মূলত যে সব তত্ত্বজ্ঞান পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে কাম্য এবং এ মহান আসমানী গ্রন্থে যেগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে সেগুলোর সাহায্য নিয়েই সৃষ্টিলোক এবং মহান আল্লাহর সৃষ্টি কর্মের নিদর্শনসমূহের ব্যাপারে অধ্যয়ন ও গবেষণার প্রকৃত মূল্যটাই বা কতটুকু?

বাস্তবতা হচ্ছে,যে সব বিষয় স্পষ্ট করে পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত ও আলোচিত হয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে সৃষ্টিলোক ও সৃষ্টি প্রক্রিয়ার নিদর্শনাদি সংক্রান্ত অধ্যয়ন ও গবেষণা যতটুকু সাহায্য করতে ও অবদান রাখতে পারে সেটার মাত্রা অত্যন্ত সামান্য। পবিত্র কোরআন স্রষ্টাতত্ত্বে এমন সব বিষয় উপস্থাপন করেছে যেগুলো প্রকৃতিজগৎ ও সৃষ্টিলোক অধ্যয়ন করে কখনই অনুধাবন করা যাবে না।

সৃষ্টিজগতের নিদর্শনাদি অধ্যয়ন করার গুরুত্ব শুধু এতটুকু যে,তা স্পষ্ট করে যে,একটি প্রজ্ঞাবান ও জ্ঞানী পরিচালিকা শক্তি এ বিশ্বব্র‎‎হ্মাণ্ড পরিচালনা করছে। ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষালব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে এ নিখিল বিশ্বের প্রতিফলনকারী আয়না হওয়াটা শুধু এতটুকু পরিসরেই সীমাবদ্ধ যে,এর একটি পরা প্রাকৃতিক স্বরূপ ও বাস্তবতা আছে এবং একজন ক্ষমতাবান-জ্ঞানী স্রষ্টা এ বিশ্বজগতের সার্বিক ব্যবস্থা পরিচালনা করছেন।

কিন্তু একজন জ্ঞানী,প্রজ্ঞাবান ও ক্ষমতাবান প্রভু যে এ নিখিল বিশ্ব পরিচালনা করছেন-মানব জাতি এতটুকু জানুক কেবল এতেই পবিত্র কোরআন সন্তুষ্ট নয়। এ বিষয়টি সম্ভবত অন্য সকল আসমানী গ্রন্থের ক্ষেত্রে সত্য হতে পারে। তবে যে পবিত্র কোরআন সর্বশেষ আসমানী বাণী এবং যা মহান আল্লাহ্ ও আধ্যাত্মিক জগৎ সম্পর্কে অনেক বিষয় উত্থাপন করেছে সেই কোরআনের ক্ষেত্রে তা মোটেও প্রযোজ্য নয়।

বিশুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়াদি

সর্বপ্রথম মৌলিক বিষয় হচ্ছে উক্ত পরা প্রাকৃতিক শক্তির ওয়াজিবুল উজূদ (অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্ববান) হওয়া এবং সৃষ্ট (مخلوق) না হওয়া। আর শুধু সৃষ্টিজগতের নিদর্শনাদি অধ্যয়ন ও গবেষণা একাই এ মৌলিক বিষয় ও সমস্যার সমাধান দিতে অক্ষম। বিশ্বজগতের আয়নাটা বড়জোড় এক শক্তিশালী ও জ্ঞানী স্রষ্টার কর্মতৎপরতার অস্তিত্ব নির্দেশ করতে পারে যিনি নিখিল বিশ্ব পরিচালনা করছেন। তবে স্বয়ং উক্ত পরিচালনাকারীরই প্রকৃত অবস্থা কেমন? তিনি কি আরেকটি সত্তার প্রভাবাধীন ও বশীভূত,নাকি তিনি স্ব-প্রতিষ্ঠিত? আর যদি তিনি অন্য কোন সত্তার বশীভূত ও নিয়ন্ত্রণাধীন হন,তাহলে উক্ত নিয়ন্ত্রণকারী সত্তাই বা কেমন?

পবিত্র কোরআনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কেবল এটিই নয় যে,আমরা জানব,একজন জ্ঞানী ও সক্ষম সত্তা এ নিখিল বিশ্ব পরিচালনা করছেন। পবিত্র কোরআনের প্রকৃত লক্ষ্য হচ্ছে,আমাদের জানতে হবে প্রকৃত পরিচালনাকারী হচ্ছেন মহান আল্লাহ্ এবং তিনিই হচ্ছেন ‘কোন কিছুই তাঁর সদৃশ নয়’ (لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ)-এর বাস্তব নমুনা যাঁর সত্তা সকল পূর্ণতার আধার এবং আরেকভাবে বলতে গেলে যিনি হচ্ছেন নিরঙ্কুশ পূর্ণতা। আর পবিত্র কোরআনের ভাষায় : ‘তিনি ঐ সত্তা যাঁর আছে সর্বোচ্চ পর্যায়ের উপমা’। প্রকৃতিজগৎ অধ্যয়ন করার মাধ্যমে আমরা কিভাবে এ ধরনের ধারণা ও তাৎপর্যসমূহের সাথে পরিচিত হতে পারব?

আরেকটি বিষয় হচ্ছে মহান আল্লাহর একত্ব ও অদ্বিতীয়ত্ব। পবিত্র কোরআন এ বিষয়টি যুক্তি ও দলিল-প্রমাণের আলোকে উপস্থাপন করেছে এবং যুক্তিবিদ্যার পরিভাষায় এক ধরনের প্রাকল্পিক ন্যায়-অনুমান (قياس استثنائي অর্থাৎ Hypothetical Syllogism)-এর আলোকে বিষয়টি উপস্থাপন ও প্রতিষ্ঠিত করেছে। পবিত্র কোরআন এমন এক দলিল-প্রমাণ উপস্থাপন করেছে ইসলামী দর্শনে যা পারস্পরিক খণ্ডনভিত্তিক যুক্তি-প্রমাণ (برهان تمانع) নামে অভিহিত। পবিত্র কোরআন কখনো কখনো ক্রিয়াশীল কারণসমূহের পারস্পরিক খণ্ডন পদ্ধতিতে আলোচনা পেশ করেছে :

لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ إِلَّا اللَّـهُ لَفَسَدَتَا

“আপনি বলে দিন : যদি আসমান ও যমীনে আল্লাহ্ ব্যতীত বহু উপাস্য থাকত তাহলে আসমান ও যমীন ধ্বংস হয়ে যেত।”

আবার কখনো কখনো পবিত্র কোরআন চূড়ান্ত লক্ষ্য স্থিরকারী কারণসমূহের পারস্পরিক খণ্ডন পদ্ধতিতে এতৎসংক্রান্ত আলোচনা করেছে। পদ্ধতিটি হলো :

مَا اتَّخَذَ اللَّـهُ مِن وَلَدٍ وَمَا كَانَ مَعَهُ مِنْ إِلَـٰهٍ ۚ إِذًا لَّذَهَبَ كُلُّ إِلَـٰهٍ بِمَا خَلَقَ وَلَعَلَا بَعْضُهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ

“মহান আল্লাহ্ কোন সন্তান গ্রহণ করেন নি; আর যদি তাঁর সাথে কোন উপাস্য থাকত তাহলে প্রত্যেক উপাস্যই যা সৃষ্টি করেছে তা নিয়ে পৃথক হয়ে যেত এবং তারা পরস্পর প্রাধান্য বিস্তার করত।”

পবিত্র কোরআন কখনই সৃষ্টিলোকে বিদ্যমান ব্যবস্থা অধ্যয়ন করার মাধ্যমে মহান স্রষ্টার একত্ব সংক্রান্ত জ্ঞান আহরণ করার আবেদন ও সুপারিশ করে নি এভাবে যে,তা (কোরআন) প্রকৃতিজগতে বিদ্যমান ব্যবস্থা অধ্যয়ন করার মাধ্যমে পরা প্রাকৃতিক (অজড়-অবস্তুগত) স্রষ্টা সংক্রান্ত প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করার তাগীদ করেছে। আর এ ধরনের সুপারিশ আসলেও ঠিক নয়।

পবিত্র কোরআনে এ ধরনের অনেক বিষয় আলোচিত হয়েছে। যেমন :

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ

‘তাঁর মতো কোন কিছু নেই’ ।

وَلِلَّـهِ الْمَثَلُ الْأَعْلَىٰ

‘আর মহান আল্লাহরই আছে সর্বোচ্চ উপমা’ ।

له الأسماء الحسنى و الأمثال العليا

‘তাঁরই রয়েছে সুন্দরতম নামসমূহ এবং সর্বোচ্চ উপমাসমূহ’

الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ

‘বাদশাহ্,অতি পবিত্র,পরাক্রমশালী,বিশ্বাসী,নিরাপত্তা বিধায়ক,কর্তৃত্বশালী,জবরদস্ত ও গর্বকারী’ ।

فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّـهِ

‘তোমরা যে দিকেই ঘুরো না কেনো,সেখানেই মহান আল্লাহর মুখমণ্ডল (অস্তিত্ব) বিদ্যমান’ ।

وَهُوَ اللَّـهُ فِي السَّمَاوَاتِ وَفِي الْأَرْضِ

‘তিনিই আল্লাহ্ আসমানসমূহে এবং পৃথিবীতে (বিদ্যমান)’

هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ

‘তিনিই প্রথম,তিনিই শেষ,তিনি প্রকাশমান,তিনিই গোপন’

الحي القيّوم

‘চিরঞ্জীব,চিরস্থায়ী’ ।

الله الصّمد

‘মহান আল্লাহ্ই অভাবশূন্য,অমুখাপেক্ষী’ ।

لم يلد و لم يُولد

‘তিনি জন্ম দেন নি এবং জন্মগ্রহণ করেন নি’ ।

و لم يكن له كفوا أحد

‘আর তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই’ ।

পবিত্র কোরআন এ ধরনের বিষয় কোন্ উদ্দেশ্যে উত্থাপন ও আলোচনা করেছে? এটা কি এজন্য যে,যে সব বিষয় বোধগম্য নয় এবং উপলব্ধি করা যায় না অর্থাৎ নাদভীর ভাষায় যেগুলোর মূলনীতিসমূহ মানুষের অনুধাবন ক্ষমতার বাইরে সেগুলো মানুষের কাছে উপস্থাপন করেছে এবং মানব জাতিকে উপলব্ধি ও অনুধাবন করা ব্যতিরেকেই চোখ-কান বন্ধ করে মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে অথবা আসলেই কি চেয়েছে যে,মানুষ এ সব বৈশিষ্ট্যসহকারে মহান আল্লাহকে চিনবে? আর যদি পবিত্র কোরআন ইচ্ছা করে থাকে যে,মানুষ মহান আল্লাহকে এ সব বৈশিষ্ট্যসহকারে চিনুক তাহলে তা কিভাবে ও কোন্ পথে হবে? প্রকৃতিজগৎ সংক্রান্ত অধ্যয়ন ও গবেষণা কিভাবে আমাদেরকে এ সব তত্ত্বজ্ঞানের সাথে পরিচিত করাবে?

সৃষ্টিলোক সংক্রান্ত গবেষণা ও অধ্যয়ন আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দেয় যে,মহান আল্লাহ্ জ্ঞানী অর্থাৎ তিনি জ্ঞানের ভিত্তিতে সকল সৃষ্টকে সৃষ্টি করেছেন; কিন্তু পবিত্র কোরআন আমাদের কাছে যা প্রত্যাশা করে তা কেবল এই নয় যে,তিনি যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তা তাঁর জ্ঞানের ভিত্তিতেই তিনি সৃষ্টি করেছেন,বরং পবিত্র কোরআন যা আমাদের কাছে প্রত্যাশা করে তা হচ্ছে,

إنّه بكلّ شيء عليم لا يعزب عن علمه مثقال ذرة قل لو كان البحر مدادا لكلمات ربّي

“নিশ্চয়ই তিনি সব জিনিস ও বিষয় সম্পর্কে জ্ঞাত। অণু-পরমাণুও তাঁর জ্ঞান হতে লুক্কায়িত নয়। আপনি বলে দিন,সমগ্র সাগর-মহাসাগর যদি আমার প্রভুর বাণী বা কথা লিপিবদ্ধ করার জন্য কালি হয়ে যেত...।”

অর্থাৎ মহান আল্লাহর জ্ঞান অসীম। তাঁর শক্তি ও ক্ষমতাও অসীম। কিভাবে এবং কোথা হতে সৃষ্টিলোককে চাক্ষুষ ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য গবেষণা,অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে মহান আল্লাহর জ্ঞান,শক্তি ও ক্ষমতার অসীম হবার বিষয়টি অনুধাবন করা সম্ভব হবে?

পবিত্র কোরআনে আরো অনেক বিষয় বর্ণিত হয়েছে। যেমন উচ্চমার্গের গ্রন্থসমূহ,লওহ মাহফূয (সংরক্ষিত ফলক),প্রতিষ্ঠিত ও বিলুপ্তকরণের ফলক (লওহে মাহ্ভ ওয়া ইসবাত),জাবর ও ইখতিয়ার (বাধ্য-বাধকতা ও স্বাধীনতা),ওহী (ঐশী প্রত্যাদেশ),ইশরাক (ঐশ্বরিক দ্যূতির বিচ্ছুরণ ও প্রতিফলন) ইত্যাদি।

এগুলোর কোন একটিও সৃষ্টিজগৎ সংক্রান্ত পঞ্চেন্দ্রিয়ভিত্তিক গবেষণা ও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে অধ্যয়ন ও অনুধাবন করা আদৌ সম্ভব নয়।

পবিত্র কোরআন অবশ্যই এ সব বিষয় শিক্ষণীয় পাঠ হিসাবেই মানব জাতির কাছে উপস্থাপন করেছে। আর ‘তারা কি পবিত্র কোরআন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে না,নাকি তাদের

অন্তঃকরণসমূহ তালাবদ্ধ’ (أفلا يتدترون القرآن أم على قلوب أقفالها) এবং ‘যে গ্রন্থ আমরা আপনার ওপর অবতীর্ণ করেছি তা বরকতময় যাতে করে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে’ (كتاب أنزلناه إليك مبارك ليدبروا آياته)-এ ধরনের আয়াতসমূহের আলোকে এ সব পাঠ অর্থাৎ উপরিউক্ত বিষয়াদি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করার উপদেশ দিয়েছে এবং এগুলোর ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করেছে।

এ সব বাস্তবতায় উপনীত হবার জন্য বাধ্য হয়েই কোন একটি পদ্ধতিকে পবিত্র কোরআন নির্ভরযোগ্য বিবেচনা করেছে ও স্বীকৃতি দিয়েছে এবং কখনই এ সব বাস্তবতাকে কতগুলো অবোধ্য অজ্ঞাত বিষয় হিসাবে উপস্থাপন করে নি।

পবিত্র কোরআন যে সব পরা প্রাকৃতিক বিষয় উত্থাপন ও আলোচনা করেছে সেগুলোর বৃত্ত ও পরিধি আসলে বস্তুগত প্রাকৃতিকজগৎ অধ্যয়ন ও গবেষণার মাধ্যমে এতৎসংক্রান্ত যে জবাব পাওয়া যায় তার চাইতেও অনেক বিস্তৃত ও ব্যাপক। এ সব পরা প্রাকৃতিক বিষয়ই মুসলমানদেরকে কখনো কখনো আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমণ,আবার কখনো কখনো বুদ্ধিবৃত্তিক ও চিন্তামূলক পদ্ধতির মাধ্যমে এ সব বিষয়ের রহস্যের কুল-কিনারা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে।

সুতরাং যারা দাবি করে যে,পবিত্র কোরআন ঐশ্বরিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে কেবল বস্তুগত প্রাকৃতিক জগৎ অধ্যয়ন ও গবেষণাই যথেষ্ট বলে বিবেচনা করে তারা এ সব পরা প্রাকৃতিক বিষয় যেগুলো পবিত্র কোরআনে আলোচিত ও উত্থাপিত হয়েছে এবং এ পবিত্র আসমানী গ্রন্থের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সেগুলোর ব্যাপারে কী বলবে?

যে সব বিষয় সম্পর্কে পূর্ববর্তী দু’টি অধ্যায়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে সেগুলো উপস্থাপন এবং আলোচনা করার ক্ষেত্রে হযরত আলী (আ.)-এর আসল উদ্দেশ্যই হচ্ছে পবিত্র কোরআনের সঠিক ব্যাখ্যা (তাফসীর)। যদি আলী না হতেন তাহলে সম্ভবত পবিত্র কোরআনের বুদ্ধিবৃত্তিক তত্ত্বজ্ঞানসমূহ চিরকালের জন্য ব্যাখ্যা করাই অসম্ভব হয়ে যেত।

এখন যেহেতু আমরা এ ধরনের আলোচনার গুরুত্বের দিকে সামান্য ইঙ্গিত করেছি সেহেতু আমরা নাহজুল বালাগার কতিপয় নমুনা এখানে উল্লেখ করছি।

তথ্যসূত্র :

১. সুন্নী বিশ্বে আহলে হাদীসের মতো শিয়া বিশ্বে আহলে বাইতের হাদীস ও বাণীর অনুসারী। তারা ইজতিহাদবিমুখ এবং ইজতিহাদের বিরোধিতা করে।

২. উসূলে ফালসাফাহ্ ওয়া রাভেশে রিয়ালিয্ম,৫ম খণ্ডের ভূমিকা।

৩. মাযা খাসিরাল আ’লাম্ বি ইনহিতাতিল মুসলিমীন্ (মুসলমানদের পতনের কারণে জগৎ কী হারিয়েছে?) গ্রন্থের ৪র্থ অধ্যায়,পৃ. ৯৭।

৪. প্রাগুক্ত,পৃ. ৩৫।

৫. উসূলে ফালসাফাহ ওয়া রাভেশে রিয়ালিয্ম,৫ম খণ্ডের ভূমিকা।

৬. উসূলে ফালসাফাহ্ ওয়া রাভেশে রিয়ালিয্ম,৫ম খণ্ড।

৭. সূরা আল মুমিনূন : ৯১।

(চলবে)