কাযা ও কাদর

সাইয়্যেদ মুজতবা মুসাভী লারী

নূর হোসেন মজিদী কর্তৃক ইংরেজি থেকে অনূদিত

কাযা ও কাদর ইসলামী আকায়েদের (মৌলিক বিশ্বাসের) এমন দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে এবং প্রায়শই যার ভুল ব্যাখ্যা করা হয়। এ ভুল ব্যাখ্যার কারণ হলো বিষয়টি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব অথবা ক্ষেত্রবিশেষে কোন অসদুদ্দেশ্য। এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করার জন্য এখানে আমরা বিষয়টি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।

আমরা সামান্য চিন্তা করলেই দেখতে পাব যে,এ বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টিই সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ,যৌক্তিকতা ও নিয়ম-কানুনের ওপর ভিত্তিশীল। প্রতিটি জিনিসকেই একটি নিখুঁত পরিমাপের ভিত্তিতে এর যথাস্থানে স্থাপন করা হয়েছে। যে কোন কিছুই যে সব কারণ ও উপাদানের ওপর নির্ভরশীল তা থেকেই তাকে চিহ্নিতকরণের বৈশিষ্ট্যসমূহ উদ্ভূত হয়ে থাকে।

ঠিক যেভাবে প্রতিটি প্রপঞ্চ সুনির্দিষ্ট কারণ থেকে তার প্রাথমিক অস্তিত্ব লাভ করে,একই কারণ থেকে তার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যসমূহ লাভ করে থাকে; তার আকার-আকৃতি ও আয়তন বা পরিমাণও একই উৎস থেকে উদ্ভূত হয়। যেহেতু কারণ ও ফলাফলের মধ্যে একটি মিল থাকে,তাই কারণ অনিবার্যভাবেই ফলাফলের মধ্যে এমন গুণ-বৈশিষ্ট্য প্রদান করবে যার সাথে তার নিজের সত্তার মূল সুরের বা মূল মর্মের সম্পর্ক রয়েছে।

ইসলামী বিশ্বদৃষ্টিতে কাযা ও কাদরের তাৎপর্য হচ্ছে বিশ্বলোকের সকল বিষয়ের ক্ষেত্রে এবং সকল কিছুর পরিমাণ ও সীমার ব্যাপারে তাঁর অলঙ্ঘনীয় ফয়সালা। মানুষের কর্মসহ সৃষ্টি-ব্যবস্থায় যা কিছু সংঘটিত হয় তা সে সবের কারণসমূহের দ্বারা সুনির্দিষ্ট ও অবশ্যম্ভাবী হয়ে যায়। যে কারণ ও বিধির ওপর সমগ্র বিশ্বব্যবস্থা টিকে আছে এটিই তার অনিবার্য দাবি।

কাযা বা ফয়সালা মানে হচ্ছে কোন কিছু নির্ধারিত হয়ে যাওয়া-যার পরিবর্তন সম্ভব নয়। এ বিষয়টি দ্বারা আল্লাহ্তায়ালার সৃজনশীলতা ও তাঁর কাজকে বুঝায়। অন্যদিকে কাযা বা তাকদীর মানে হচ্ছে পরিমাণ বা অনুপাত এবং এর দ্বারা সৃষ্টি-ব্যবস্থার প্রকৃতি ও গুণকে এবং এর সুশৃঙ্খল বৈশিষ্ট্যকে বুঝায়। এর মানে হচ্ছে আল্লাহ্তায়ালা এ সৃষ্টিলোককে সুপরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল কাঠামো প্রদান করেছেন। অন্য কথায়,কাদর হচ্ছে সকল সৃষ্টির সাথে আল্লাহ্তায়ালার সৃজনশীলতার সংশ্লিষ্টতা।

এ বিষয়টিকে ভিন্নভাবেও প্রকাশ করা যেতে পারে। তা হচ্ছে,তাকদীর মানে বাহ্যিক ও বাস্তবভাবে কোন কিছুর সীমা ও অনুপাত নির্দিষ্ট করে দেয়া,মানসিকভাবে নয়। একজন স্থপতি যখন কোন কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করার প্রস্তাব করেন তখন তিনি তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবে কার্যকর করার আগে মনে মনে এটির বৈশিষ্ট্যসমূহ এবং এর দিক ও মাত্রাসমূহ তৈরি করেন। কোরআন মজীদে এই সুনির্দিষ্ট ধরন-ধারণ,রূপ,বৈশিষ্ট্য ও অনুপাতের কথা বলা হয়েছে এভাবে :

إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ

“নিঃসন্দেহে আমি প্রতিটি জিনিসকে সুনির্দিষ্ট অনুপাতে সৃষ্টি করেছি।”-(সূরা কামার : ৪৯)

আল্লাহ্তায়ালা আরো এরশাদ করেন :

قَدْ جَعَلَ اللَّـهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا

“আল্লাহ্ প্রতিটি জিনিসের জন্যই অনুপাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন।” (সূরা আত তালাক : ৩)

কোরআনে কাযা শব্দটি যুক্তিসঙ্গত ও প্রাকৃতিক প্রয়োজন অর্থে তথা যে কারণ কোন জিনিসের আত্মপ্রকাশ অনিবার্য করে তোলে তার সবগুলো অংশকে একত্রে বুঝায়। এর মানে হচ্ছে যখন কোন কিছু উদ্ভবের জন্য প্রয়োজনীয় ও সুনির্দিষ্ট পরিমাণে সংশ্লিষ্ট উপাদান,শর্তাবলী ও কারণ পরস্পর সম্পৃক্ত হবে তখন তার উদ্ভবের জন্য আল্লাহ্ তায়ালার ইচ্ছা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কার্যকর হবে।

আল্লাহ্ সকল জিনিসের ক্ষেত্রেই তার স্থান-কাল পরিস্থিতি এবং তৎসহ তার সীমা ও অনুপাতকে দৃষ্টিতে রেখে তার ভিত্তিতে ফয়সালা প্রদান করেন। বস্তুত এ সৃষ্টিলোকে যে কোন উপাদান বা কারণ প্রকাশিত হয় তা আল্লাহ্ তায়ালার ইচ্ছা ও জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ এবং তিনি এ সৃষ্টিলোকের জন্য যে লক্ষ্য নির্ধারণ করে রেখেছেন তা বাস্তবায়নের হাতিয়ার মাত্র।

যে কোন জিনিসের বিকাশ ও উন্নয়নের সম্ভাবনা ঐ জিনিসের সত্তার ভিতরেই নিহিত রাখা হয়েছে। পদার্থ গতিরূপ প্রাকৃতিক বিধির ওপর নির্ভরশীল। পদার্থের মধ্যে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহণ এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়া অতিক্রম করার সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে। বিভিন্ন উপাদানের প্রভাবে পদার্থ বিভিন্ন অবস্থা ও গুণাবলীর অধিকারী হয়। পদার্থ বিশেষ বিশেষ প্রাকৃতিক উপাদান থেকে শক্তি গ্রহণ করে যা তাকে অগ্রগতি লাভে সাহায্য করে,কিন্তু যখন অন্য কতক সুনির্দিষ্ট উপাদানের সাথে তার সংঘর্ষ ঘটে তখন তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে ও নিশ্চি‎‎হ্ন হয়ে যায়। কখনো কখনো তা বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে অগ্রসর হয় এবং শেষ পর্যন্ত তার উন্নতির উচ্চতম পর্যায়ে উপনীত হয়। আবার কখনো কখনো তা স্থবির হয়ে হয়ে যায় ও আর সামনে অগ্রসর হতে পারে না। কোন কোন ক্ষেত্রে তার গতি দ্রুত ও অনুভবযোগ্য এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তাতে পরবর্তী স্তরসমূহ অতিক্রমের জন্য প্রযোজনীয় গতির অভাব থাকে এবং তা খুবই ধীর গতিতে অগ্রসর হয়।

অতএব,দেখা যাচ্ছে যে,বিভিন্ন জিনিসের বহিঃপ্রকাশ সরাসরি বা প্রত্যক্ষভাবে একমাত্র কাযা ও কাদরের সাথে সম্পৃক্ত নয়। কেননা কারণই ক্রিয়ার প্রকৃতি নির্ধারণ করে। যেহেতু বস্তুগত জিনিসগুলো বিভিন্ন ধরনের কারণের সাথে সম্পৃক্ত সেহেতু সেগুলো অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন পথের অনুসরণ করবে। প্রতিটি কারণই তার অধীন বা তার সাথে সম্পৃক্ত সত্তাকে একটি বিশেষ পথের সাথে সংবদ্ধ করে দেয়।

উদাহরণস্বরূপ এক ব্যক্তি অ্যাপেনডিসাইটিস রোগে ভুগছে। এ হচ্ছে বিশেষ কারণ থেকে উদ্ভূত পরিণতি। অতঃপর তার জন্য দু’টি স্বতন্ত্র পরিণতি অপেক্ষা করছে। হয় সে অ্যাপেনডিসাইটিসের জন্য অস্ত্রোপচার করাতে সম্মত হবে; তাহলে সে আরোগ্য লাভ করবে অথবা সে এতে অসম্মত হবে যার ফলে অ্যাপেনডিসাইটিসের কারণে তার মৃত্যু ঘটবে। এ দু’টি পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ইখতিয়ারই তার রয়েছে এবং এভাবেই বিষয়টি ভাগ্যলিপি বা পরিণতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে।

অতএব,দেখা যাচ্ছে যে,ভাগ্যলিপি বা পরণিতি (অনেক ক্ষেত্রেই) পরিবর্তনযোগ্য। কিন্তু ব্যক্তি যে কোন সিদ্ধান্তই গ্রহণ করুক না কেন তা আল্লাহ্ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত ভাগ্যলিপি বা পরিণতির বাইরে নয় (কারণ আল্লাহ্তায়ালা অনেক বিষয়কেই এভাবে পরিবর্তনশীল করে নির্ধারণ করছেন)।

অতএব,কোন ব্যক্তি যদি তার হাত গুটিযে বসে থাকে আর বলে,‘আমি যদি বেঁচে থাকি,তাহলে এটিই আমার ভাগ্যলিপি,আর যদি আমার ভাগ্যলিপিতে তা লেখা না থাকে,তাহলে আমি যতই চিকিৎসা করাই না কেন,আমি মরে যাব’,তাহলে তার সে কথা মোটেই সঠিক ও যুক্তিসঙ্গত নয়।

প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে,আপনি যদি চিকিৎসা নেন ও সুস্থ হয়ে যান তাহলে এটিই আপনার ভাগ্যলিপি। আর আপনি যদি চিকিৎসা না নেন এবং মারা যান,তাহলে এটিই আপনার ভাগ্যলিপি। আপনি যেখানেই যান এবং যা কিছুই করুন না কেন তা অবশ্যই ভাগ্যলিপির আত্ততাভুক্ত।

যে সব লোক অলস ও উদাসীন এবং এ কারণে কাজ করতে অস্বীকার করে,তারা প্রথমে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়; অতঃপর যখন কপর্দকশূন্য হয়ে পড়ে তখন ভাগ্যলিপিকে দোষারোপ করে। তারা যদি কাজ করার সিদ্ধান্ত নিত এবং তার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করত তাহলে একইভাবে তা তাদের ভাগ্যলিপির ফলাফল হতো। অতএব,আপনি কর্মতৎপর ও অধ্যবসায়ী হোন অথবা অলস হোন,কোন অবস্থায়ই আপনি ভাগ্যলিপির লঙ্ঘন করতে পারেন না।

অতএব,ভাগ্যের পরিবর্তন মানে কার্যকারণ বিধির বিরোধিতা বা ভাগ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ নয়। এ বিশ্বে ফলাফল প্রদানকারী কোন উপাদানকেই সর্বজনীন কারণবিধির বহির্ভূত গণ্য করা যেতে পারে না। যা কিছু ভাগ্যে পরিবর্তন ঘটায় তা স্বয়ং কারণ বিধিরূপ শৃঙ্খলের একেকটি আংটাস্বরূপ এবং কাযা ও কাদরের বহিঃপ্রকাশ। অন্য কথায় বলা চলে যে,একটি ভাগ্যলিপির (কাদর) দ্বারা আরেকটি ভাগ্যলিপি পরিবর্তিত হয়ে যায়।

বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানে যেখানে কোন প্রপঞ্চের কেবল একটি দিকের প্রতি নির্দেশ করা হয় এবং প্রপঞ্চের মাত্র সুনির্দিষ্ট কয়েকটি দিককে এগিয়ে নেয়ার বিষয়টি প্রদর্শন করা হয়,তার বিপরীতে অধিবিদ্যার বিধি-বিধান সংযুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে সংশ্লিষ্ট প্রপঞ্চের সাথে সম্পৃক্ত হয় না। যদিও বিভিন্ন বিধি-বিধান একটি প্রপঞ্চকে নিয়ন্ত্রিত করে এগিয়ে দেয় তথাপি প্রপঞ্চটি কতখানি নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করল তা বিধিবিধানে বিবেচিত নয়। বরং অধিবিদ্যার ব্যাপকভিত্তিক বিধি-বিধানে স্বয়ং প্রপঞ্চ ও তাকে নিয়ন্ত্রিতকরণ বা এগিয়ে দেয়া-উভয়ই একত্রে বিবেচিত হয়। অতএব,প্রপঞ্চটি যে দিকেই যেতে চায় না কেন,তা অপরিহার্যভাবেই ঐ বিধি-বিধানের আতওতাভুক্ত থাকে।

এ ক্ষেত্রে বিষয়টিকে একটি বিশালায়তন মাঠের সাথে তুলনা করা চলে। কেউ মাঠের সর্ব উত্তরে বা সর্ব দক্ষিণে যেখানেই থাকুক না কেন,সে এ মাঠের মধ্যেই থাকছে। কারণ,এর সকল অংশই মাঠের অন্তর্ভুক্ত।

সংক্ষেপে বলা চলে যে,কাযা ও কাদর কার্যকারণ মূলনীতির সর্বজনীনতারই প্রতিনিধিত্ব করে মাত্র-অন্য কিছু নয়। কাযা ও কাদর এমন এক অধিবিদ্যাগত সত্যের প্রতিনিধিত্ব করে যাকে বৈজ্ঞানিক উপাত্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অভিন্ন পন্থায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পরিমাপ করা সম্ভব নয়।

কার্যকারণ মূলনীতির বক্তব্য হচ্ছে এই যে,প্রতিটি প্রপঞ্চেরই একটি কারণ রয়েছে,কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শুধু এর ভিত্তিতে কোন ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। বস্তুত এ হচ্ছে এমন একটি বৈশিষ্ট্য (সংক্রান্ত ধারণা) যা পুরোপুরি অধিবিদ্যাগত সচেতনতাশূন্য। কারণ,অধিবিদ্যাগত বিধানসমূহ হচ্ছে এক ধরনের বর্ণনামূলক জ্ঞান এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রপঞ্চের জন্য স্থিতিশীল ভিত্তি। এ কারণে কোন্ বিশেষ প্রপঞ্চ সংঘটিত হলে তাতে কোন পার্থক্য নেই। এ হচ্ছে একটি মজবুত ও স্থির মহাসড়কের ন্যায়। লোকেরা এ মহাসড়কের কোন্ দিক থেকে কোন্ দিকে যাচ্ছে বা কোন্ অংশ দিয়ে যাতায়াত করছে তাতে কোন পার্থক্য নেই; সর্বাবস্থায় তারা এ মহাসড়কেই চলাচল করছে।

আমিরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.) একটি ভাঙা দেয়ালের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন; মনে হচ্ছিল যে,দেয়ালটি ধসে পড়বে। তখন সহসা তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হলো : “আপনি কি বুঝতে পারছেন যে,আল্লাহ্ তায়ালা কি নির্ধারণ করে রেখেছেন?” তিনি বললেন,“আমি আল্লাহর নির্ধারণ (কাদর) থেকে আল্লাহর নির্ধারণের আশ্রয় গ্রহণ করছি।” অর্থাৎ “আমি এক ভাগ্যলিপি থেকে আরেক ভাগ্যলিপির দিকে গমন করেছি। ভাগ্যলিপির জন্য বসা ও গাত্রোত্থান অভিন্ন। ভাঙা দেয়ালটি যদি আমার ওপর ধসে পড়ে এবং তাতে আমি আঘাত পাই,তাহলে তা-ই হবে ভাগ্যলিপি,আর আমি যদি বিপজ্জনক জায়গা থেকে সরে যাই এবং আঘাত পাওয়া থেকে বেঁচে যাই তাহলে তাও হবে ভাগ্যলিপি।”

যে সব ব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক বিধান বিশ্বজগতকে পরিচালনা করছে এবং অলঙ্ঘনীয়রূপে কার্যকর রয়েছে কোরআন সে সবকে ‘আল্লাহর সুন্নাত’ বলে অভিহিত করেছে। এরশাদ হয়েছে :

وَلَن تَجِدَ لِسُنَّةِ اللَّـهِ تَبْدِيلًا

“হে রাসূল! আপনি কখনই আল্লাহর সুন্নাতে কোন পরিবর্তন দেখতে পাবেন না।”-(সূরা আল আহযাব : ৬২)

আল্লাহ্ তায়ালার অলঙ্ঘনীয় রীতি বা সুন্নাতে আরো যা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে তা-ই যা নিম্নোক্ত আয়াতে বিধৃত হয়েছে :

وَعَدَ اللَّـهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ

“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যথাযথ কর্ম সম্পাদন করেছে আল্লাহ্ তাদের সাথে অঙ্গীকার করেছেন যে,তাদেরকে অবশ্যই ধরণির বুকে সুপ্রতিষ্ঠা ও স্বীয় প্রতিনিধিত্ব প্রদান করবেন।”-(সূরা আন নূর : ৫৫)

পবিত্র কোরআনের ঘোষণা অনুযায়ী আল্লাহ্তায়ালার আরেকটি অলঙ্ঘনীয় রীতি হচ্ছে :

إِنَّ اللَّـهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ

“নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ কোন জনগোষ্ঠীর অবস্থাকে পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের মধ্যকার অবস্থার পরিবর্তন ঘটায়।”-(সূরা আর রাদ : ১১)

দীনী বিশ্বদৃষ্টি অনুযায়ী সত্যসমূহ কেবল বস্তুগত কার্যকারণের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রপঞ্চসমূহকে কেবল সে সবের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সম্পর্ক ও তাদের বস্তুগত মাত্রাসমূহের ভিত্তিতে বিবেচনা করা উচিত নয়। অবস্তুগত উপাদানসমূহ বস্তুগত উপাদানসমূহের বহির্ভূত ক্ষেত্রসমূহে নিয়ন্ত্রণের অধিকারী এবং কোন প্রপঞ্চের আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে এ সব অবস্তুগত উপাদানের স্বাধীন ও সিদ্ধান্তকর ভূমিকা রয়েছে।

এ বিশ্ব কোনভাবেই ভালো-মন্দের মধ্যকার পার্থক্যের সাথে সম্পর্কহীন নয়। মানুষের কার্যাবলী তার জীবদ্দশায় কতগুলো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পরিবার-পরিজন,আত্মীয়-স্বজন এবং অধীনদের প্রতি দয়া,অনুগ্রহ ও মহানুভবতা এবং আল্লাহ্ তায়ালার সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা ও সেবা হচ্ছে এমন কতক উপাদান যা বিভিন্ন অবস্তুগত উপায়-উপকরণের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত মানুষের ভাগ্যলিপিতে এক ধরনের পরিবর্তন আনয়ন করে এবং তার জন্য শান্তি,সুখ এবং আল্লাহ্ তায়ালার অনুগ্রহ বৃদ্ধির কারণ হয়।

অন্যদিকে জুলুম-অত্যাচার,অবিচার,পরশ্রীকাতরতা,অহমিকা,আগ্রাসী মনোবৃত্তি ইত্যাদি তিক্ত ফল প্রদান করে এবং অনিবার্যভাবেই ক্ষতিকর ফলাফল নিয়ে আসে। অতএব,এ দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে,প্রকৃতিতে এক ধরনের প্রতিদান ব্যবস্থা নিহিত রয়েছে। কারণ,এ বিশ্বজগতের এক ধরনের উপলব্ধি ক্ষমতা ও চেতনা রয়েছে; এ বিশ্ব দেখতেও পায়,শুনতেও পায়। এর প্রতিদান প্রদানের পদ্ধতি কাযা ও কাদরেরই এক ধরনের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এ থেকে পালিয়ে যাওয়া অসম্ভব,আপনি যেখানেই যান না কেন আপনি তার মুঠোর মধ্যেই থাকবেন।

একজন বিজ্ঞানী বলেন,“বলবেন না যে,এ বিশ্বের উপলব্ধি ক্ষমতা নেই। কারণ,তাহলে কার্যত আপনি আপনার নিজেকেই উপলব্ধি-ক্ষমতাহীন বলে অভিযুক্ত করবেন। আপনি এই বিশ্বেরই একটি অংশবিশেষ হিসাবে অস্তিত্ব লাভ করেছেন। সুতরাং এ বিশ্বের যদি সচেতনতা না থাকে তাহলে আপনার মধ্যেও কোনরূপ সচেতনতা নেই।”

ভাগ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে অবস্তুগত উপাদানসমূহের ভূমিকা প্রসঙ্গে কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে আলোকপাত করা হয়েছে :

وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَىٰ آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِم بَرَكَاتٍ مِّنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَـٰكِن كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُم بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ

“জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনয়ন করত এবং (আল্লাহ্ কর্তৃক নিষিদ্ধ তাদের জন্য ক্ষতিকর কাজ থেকে) বেঁচে থাকত তাহলে অবশ্যই আমি তাদের জন্য আসমান ও যমিনের বরকতসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা (সত্যকে গ্রহণে) অস্বীকৃতি জানাল। সুতরাং তারা যা অর্জন করেছিল সেজন্য আমি তাদেরকে পাকড়াও করলাম।”-(সূরা আল আ’রাফ : ৯৬)

অপর এক আয়াতে এরশাদ হয়েছে :

وَمَا كُنَّا مُهْلِكِي الْقُرَىٰ إِلَّا وَأَهْلُهَا ظَالِمُونَ

“কোন জনপদের অধিবাসীরা জালেম না হয়ে থাকলে আমি সে জনপদকে ধ্বংস করি না।”-(সূরা আল কাসাস : ৫৯)

অদৃষ্টবাদের সমর্থকরা তাদের মতের সমর্থনে প্রমাণ হিসাবে কাযা ও কাদর-এর উল্লেখ করে থাকে। তাদের মতে কারো পক্ষেই স্বাধীনভাবে কোন কর্ম সম্পাদন করা সম্ভব নয়। কারণ,আল্লাহ্ তায়ালা সাধারণ ও বিশেষ এবং ভালো-মন্দ নির্বিশেষে মানুষের সকল কাজকেই পূর্ব থেকে নির্ধারণ করে রেখেছেন। অতএব,কোন মানুষের জন্যই নিজ থেকে কোন কাজ বেছে নেয়ার সুযোগ নেই।

প্রকৃতপক্ষে অদৃষ্টবাদ ও অলঙ্ঘনীয় পরিণতির মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। যে কোন প্রপঞ্চই,যখন তার সবগুলো কারণ,অন্য কথায় পূর্ণ কারণ বিদ্যমান হয়,তখন তা সংঘটিত হতে বা অস্তিত্ব লাভ করতে বাধ্য। আর পূর্ণ কারণরূপ শৃঙ্খলের আংটাসমূহের একটি হচ্ছে মানুষের চি‎‎হ্ন যা স্বীয় সুনির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে। মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি প্রদান করা হয়েছে। এ কারণে তার কাজকর্মের পিছনে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে। আর সে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কতক স্বয়ংক্রিয় প্রাকৃতিক বিধানের (যেমন : মধ্যাকর্ষণের টানে বৃষ্টির ফোঁটাসমূহ নিচে নেমে আসে) অনুসরণ করে না। এর অন্যথা হলে স্বাধীন ইচ্ছার অধিকারী মানুষ তার অন্তরে নিহিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়নের চেষ্টা করত না। আর এ বাস্তব অবস্থা অদৃষ্টবাদীদের দাবির সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ,অদৃষ্টবাদীরা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাকে অকার্যকর গণ্য করে এবং সকল কারণকে এককভাবে আল্লাহ্ তায়ালার সাথে এবং মানুষের সত্তার বহির্ভূত উপাদানসমূহের সাথে সম্পর্কিত করে। বস্তুত কাযা ও কাদরে বিশ্বাসী কেবল তখনই অদৃষ্টবাদে পর্যবসিত হয় যখন মনে করা হয় যে,কাযা ও কাদর মানুষের ক্ষমতা ও ইচ্ছাকে অকার্যকর বা নিরর্থক করে দেয় এবং এ কারণেই মানুষ যা কিছু করে তাতে তার নিজের ইচ্ছার কোন ভূমিকা বা প্রভাব আছে বলে মনে করা হয় না। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে,কাযা ও কাদর আল্লাহ্ তায়ালা কর্তৃক নির্ধারিত কারণ ও ফলাফল-এর ব্যবস্থাপনা ছাড়া আর কিছুই নয়।

পবিত্র কোরআন জানাচ্ছে যে,যারা নবী-রাসূলগণের বিরোধিতা করেছিল এবং আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল তাদের কেউ কেউ কাযা ও কাদরকে অদৃষ্টবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছিল। কারণ,তারা চাচ্ছিল না যে,(তৎকালে) বিদ্যমান পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটুক এবং তারা যে বিকৃত রেওয়ায ও রীতি-নীতির অনুসরণ করছিল তার পরিবর্তে তাওহীদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হোক।

সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহে এরশাদ হয়েছে :

وَقَالُوا لَوْ شَاءَ الرَّحْمَـٰنُ مَا عَبَدْنَاهُم ۗ مَّا لَهُم بِذَٰلِكَ مِنْ عِلْمٍ ۖ إِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُونَ أَمْ آتَيْنَاهُمْ كِتَابًا مِّن قَبْلِهِ فَهُم بِهِ مُسْتَمْسِكُونَ

“তারা বলে : রাহমান (আল্লাহ্) যদি চাইতেন (যে,আমরা ফেরেশতাদের উপাসনা না করি,তাহলে) আমরা তাদের উপাসনা করতাম না। এ ব্যাপারে তাদের কোন জ্ঞান নেই,তারা তো কেবল অনুমানভিত্তিক কথা বলছে। আমরা কি এর (কোরআনের) পূর্বে কোন কিতাব দিয়েছিলাম,অতঃপর তারা তা আঁকড়ে ধরে আছে?”-(সূরা আয যুখরূফ : ২০-২১)

অদৃষ্টবাদীদের বিপরীতে রাসূলে আকরাম (সা.)-এর ঐশী শিক্ষার অনুসারিগণ বিদ্যমান অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত হননি,বরং তাঁরা বিদ্যমান রীতি-নীতি উৎখাতেরও একটি পছন্দনীয় ভবিষ্যত নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। আল্লাহ্ তায়ালা কোরআন মজীদে মানব জাতিকে স্বৈরতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উৎসাহিত করেছেন,এ সংগ্রামে তাদেরকে বিজয়ী করার অঙ্গীকার করেছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন যে,শেষ পর্যন্ত ধরণির বুকে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য যে চূড়ান্ত সরকার ক্ষমতাধিকারী হবে সে সরকার হবে সুবিচার প্রতিষ্ঠাকারী সরকার; তখন মিথ্যা তিরোহিত হয়ে যাবে এবং সব কিছুর চূড়ান্ত (ও উত্তম) ফলাফল মুত্তাকী লোকদের ইখতিয়ারে আসবে।

কোরআনের সে অঙ্গীকারবিশিষ্ট আয়াতটি হচ্ছে :

وَنُرِيدُ أَن نَّمُنَّ عَلَى الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا فِي الْأَرْضِ وَنَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَنَجْعَلَهُمُ الْوَارِثِينَ

“আর আমি ইচ্ছা করলাম যে,ধরণির বুকে দুর্বল করে রাখা লোকদের ওপর অনুগ্রহ বর্ষণ করব এবং তাদেরকে নেতা বানাব ও তাদেরকে (পৃথিবীর) উত্তরাধিকারী বানাব।”-(সূরা আল কাসাস : ৫)

وَعَدَ اللَّـهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَىٰ لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّن بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا ۚ يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا

“যারা ঈমান এনেছে এবং যথাযথ কর্ম সম্পাদন করেছে আল্লাহ্ তাদের সাথে অঙ্গীকার করেছেন যে,অবশ্যই তিনি তাদেরকে ধরণির বুকে প্রতিনিধিত্ব প্রদান করবেন,ঠিক যেভাবে তিনি তাদের পূর্ববর্তীদেরকে প্রতিনিধিত্ব প্রদান করেছিলেন,আর তিনি তাদের জন্য যে দীনকে মনোনীত করে দিয়েছেন তাদের জন্য সে দীনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দেবেন,আর (শত্রু) থেকে তাদের ভয়-ভীতির পরে তাদের সে অবস্থাকে নিরাপদ অবস্থায় পরিবর্তিত করে দেবেন; তারা আমার দাসত্ব করবে এবং আমার সাথে কোন কিছু শরীক করবে না।”-(সূরা আন নূর : ৫৫)

وَأَوْرَثْنَا الْقَوْمَ الَّذِينَ كَانُوا يُسْتَضْعَفُونَ مَشَارِقَ الْأَرْضِ وَمَغَارِبَهَا الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا ۖ وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ الْحُسْنَىٰ عَلَىٰ بَنِي إِسْرَائِيلَ بِمَا صَبَرُوا ۖ وَدَمَّرْنَا مَا كَانَ يَصْنَعُ فِرْعَوْنُ وَقَوْمُهُ وَمَا كَانُوا يَعْرِشُونَ

“আর যে জনগোষ্ঠীকে দুর্বল করে রাখা হয়েছিল তাদেরকে আমি যে ভূ-খণ্ডে বরকত প্রদান করেছি তার পূর্ব দিককার অঞ্চলসমূহের ও পশ্চিম দিককার অঞ্চলসমূহের (পুরো ভূ-খণ্ডের) উত্তরাধিকারী করলাম; আর এভাবেই বনি ইসরাইলের ব্যাপারে আপনার রবের কথা (অঙ্গীকার) পূর্ণ হলো,কারণ তারা ধৈর্য ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিল; আর আমি ফিরআউন ও তার সম্প্রদায়ের শিল্প এবং যে সব প্রাসাদ তারা নির্মাণ করেছিল তা ধ্বংস করেছি।”-(আল আরাফ : ১৩৭)

অতএব,দেখা যাচ্ছে কোরআনে ঈমান ও কুফরের মধ্যে এবং বঞ্চিত জনগোষ্ঠী ও স্বৈরাচারীদের মধ্যে একটি পারস্পরিক বৈপরীত্যের চিত্র অঙ্কন করেছে এবং আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছে যে,এ বিশ্ব মিথ্যার ওপরে সত্যের এবং নিপীড়কদের ওপর বঞ্চিতদের বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে; এমন একটি বৈপ্লবিক অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে যা পূর্ণতা অভিমুখে সকল সৃষ্টির অগ্রযাত্রার সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল।

নবী-রাসূলগণের দাওয়াত,পুরস্কার ও শাস্তির অঙ্গীকার,বেহেশ্ত ও দোযখ এ সবকিছুই প্রমাণ করে যে,মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য আছে। আর কোরআন মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তিকে এসব কর্মের সাথে সম্পৃক্ত করেছে।

কাযা ও কাদর-এর প্রকৃত তাৎপর্যভিত্তিক তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষ স্বাধীনতার অধিকারী এবং সে তার নিজের ভাগ্যের জন্য দায়ী ও তা নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়িত্বশীল। ভাগ্যলিপি কার্যত কর্মের মধ্যেই নিহিত। কোনো জনগোষ্ঠী যদি শক্তিশালী হয়ে থাকে এবং কোন জনগোষ্ঠী পরাজিত ও পদানত হয়ে থাকে,তাহলে তাদের কর্মের কারণেই। কারণ,কাযা ও কাদর এটিই নির্ধারণ করে দিয়েছে যে,কোনো জনগোষ্ঠী যদি উন্নতি ও অগ্রগতির পন্থা অবলম্বন করে এবং সম্মান ও মর্যাদার পথে চলে তাহলে তার ভাগ্য তদ্রূপই হবে,আর কোনো জনগোষ্ঠী যদি আত্মকেন্দ্রিকতা ও উদাসীনতায় নিমগ্ন হয়ে পড়ে,তাহলে সে জনগোষ্ঠী পরাজিত,লাঞ্ছিত ও দুর্দশাগ্রস্ত হওয়া ছাড়া আর কিছুই আশা করতে পারে না।

পবিত্র কোরআন এ ব্যাপারে স্পষ্ট ভাষায় এরশাদ করেছে :

ذَٰلِكَ بِأَنَّ اللَّـهَ لَمْ يَكُ مُغَيِّرًا نِّعْمَةً أَنْعَمَهَا عَلَىٰ قَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ

“এটি এ কারণে যে,আল্লাহ্ কোন জনগোষ্ঠীকে অনুগৃহীত করার পর সে অনুগ্রহকে পরিবর্তিত করে দেননি যতক্ষণ না তারা নিজেরাই তাদের নিজেদের মধ্যকার অবস্থাকে পরিবর্তিত করেছে।”-(সূরা আনফাল : ৫৩)

নিঃসন্দেহে এরূপ হতে পারে যে,আমরা যেভাবে প্রত্যাশা করি আমাদের ইচ্ছা সেভাবে পূর্ণ নাও হতে পারে। কিন্তু এ থেকে কিছুতেই প্রমাণিত হয় না যে,মানুষকে তার কাজ-কর্ম সম্পাদনে বাধ্য করা হয়েছে এবং তার কাজ-কর্ম পূর্ব থেকেই নির্ধারিত হয়ে আছে। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে এই যে,মানুষের ঐচ্ছিক কাজ-কর্মের সীমিত হওয়া কিছুতেই তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হওয়ার সাথে সাংঘর্ষিক নয়। অন্যদিকে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হওয়ার মানে এ নয় যে,তার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি সীমাহীন।

আল্লাহ্ তায়ালা সৃষ্টিলোকের সুবিশাল ক্ষেত্রে অসংখ্য ক্রিয়াশীল উপাদান উপস্থাপন করেছেন। মানুষের কাছে অনেক সময় এসব উপাদান এবং এসব উপাদান থেকে উদ্ভূত প্রপঞ্চসমূহ স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে,আবার অনেক সময় তা ধরা পড়ে না। কাযা ও কাদরের একটি সতর্ক ও বাস্তববাদী ব্যাখ্যা মানুষকে এসব উপাদানকে চেনা ও চিহ্নিত করার জন্য কঠোর চেষ্টা-সাধনা ও অধ্যবসায়ে অনুপ্রাণিত করে। কারণ,এগুলোকে জানতে ও চিহ্নিত করতে পারলে তার পক্ষে অধিকতর সাফল্য অর্জনের উদ্দেশ্যে চেষ্টা-সাধনা করা সম্ভব হবে। কেননা এটি অত্যন্ত স্পষ্ট ব্যাপার যে,মানুষের সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে তার সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় সকল বস্তুগত উপাদান হস্তগত করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না,ফলে তার আশা-আকাঙ্ক্ষা কম-বেশি অপূর্ণ থেকে যায়।

কার্যকারণের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো সত্তার ভাগ্য বা পরিণতি তার পূর্ববর্তী কারণসমূহের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কোন ব্যক্তি কোন ঐশী মূলনীতির অস্তিত্বকে গ্রহণ করুক বা না করুক,তাতে মানুষের স্বাধীনতা ও ভাগ্যলিপির প্রশ্নে কোনরূপ ব্যতিক্রমের অবকাশ নেই। কারণ,কোনো ব্যক্তি কারণ ও ফলাফলের ব্যবস্থাকে আল্লাহ্ তায়ালার ইচ্ছার সাথে সম্পর্কিত গণ্য করতে পারে,অথবা সে মনে করতে পারে যে,এটি একটি স্বতন্ত্র বিষয় এবং ঐশী মূলনীতির সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। অবস্থা যেখানে এরূপ সেখানে এটি বলা চলে না যে,কাযা ও কাদরের তত্ত্বে বিশ্বাস থেকে অদৃষ্টবাদের জন্ম হয়েছে। আমরা কাদর বলতে যা বুঝাতে চাই তা হচ্ছে প্রতিটি প্রপঞ্চের তার কারণসমূহের সাথে অবিচ্ছেদ্য সংযোগ যার মধ্যে মানুষের ইচ্ছা ও নির্বাচনও অন্তর্ভুক্ত। অতএব,আমরা কোনভাবেই কারণ-বিধিকে অস্বীকার করছি না।

কাযা ও কাদর প্রতিটি প্রপঞ্চকে তার বিশেষ কারণের মাধ্যমে অস্তিত্বে নিয়ে আসে। খোদায়ী ইচ্ছা একটি বিশ্বজনীন মূলনীতি ও বিধানরূপে সমগ্র বিশ্বলোককে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করে। যখন যেখানে যে কোন পরিবর্তনই ঘটুক না কেন,তা কোন না কোন ঐশী নীতি ও নিয়মের ভিত্তিতেই ঘটে থাকে। বিষয়টি এরূপ না হলে কখনই কাযা ও কাদরের বাহ্যিক প্রকাশ ঘটত না। বস্তুত বিশ্বজনীন কারণ-বিধির মূলনীতিতে বিশ্বাসী যে কোনো বৈজ্ঞানিক চৈন্তিক গোষ্ঠীই-তা স্বীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আস্তিক্যবাদীই হোক বা বস্তুবাদীই হোক-বিভিন্ন প্রপঞ্চের মধ্যকার সম্পর্ক ও তার কারণের সত্যতা স্বীকার করতে বাধ্য।

এখন,মানবীয় কাজ-কর্মসহ একটি প্রপঞ্চের সংঘটন এবং তার কারণসমূহের মধ্যকার সংযোগ যদি মানুষকে তার কাজের ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় ও পূর্ব নির্ধারিতে পরিণত করে তাহলে তা আস্তিক্যবাদ ও নাস্তিক্যবাদ উভয়ের ওপরই আপত্তি নিয়ে আসবে। কারণ,এ উভয় ধরনের মতাদর্শই কারণ-বিধিকে গ্রহণ করে। কিন্তু কোন প্রপঞ্চের সংঘটন ও তার কারণের মধ্যকার সম্পর্ক যদি মানুষকে স্বয়ংক্রিয় বলে উপসংহারে উপনীত হতে বাধ্য না করে (প্রকৃতপক্ষেও তা করে না),তাহলে সে ক্ষেত্রে এ প্রশ্ন দেখা দেয় যে,এ ব্যাপারে আস্তিক্যবাদ ও বস্তুবাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

এ ক্ষেত্রে আস্তিক্যবাদী ও বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টিরে মধ্যে পার্থক্য এখানে যে,বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টির বিপরীতে আস্তিক্যবাদী বিশ্বদৃষ্টির আদর্শিক চিন্তা-চেতনা এবং অবস্তুগত উপাদানসমূহকে প্রভাব বিস্তার বা ফলাফল সৃষ্টিতে পুরোপুরি সক্ষম বলে গণ্য করে। বরং সৃষ্টিকর্মের জালে এসব উপাদান বস্তুগত উপাদানসমূহের তুলনায় সূক্ষ্মতর ও জটিলতর। আল্লাহ্ তায়ালার ওপর ঈমান পোষণকারী বিশ্বদৃষ্টি মানুষকে সাহস,দৃঢ়তা,দৃষ্টির প্রসারতা,অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা ও মনের শক্তি প্রদান করে এবং তাকে উদ্দেশ্যহীনতার অতল গহ্বরে নিপতিত হওয়া থেকে রক্ষা করে; শুধু তা-ই নয় তাকে সীমাহীন উন্নতির সিঁড়িতে তুলে দেয়।

অতএব,আল্লাহ্ তায়ালার ওপর ঈমান পোষণকারী ব্যক্তি কাযা ও কাদরে দৃঢ় প্রত্যয় পোষণ করে এবং সে অনুভব করে যে,মানুষ ও বিশ্বজগৎ সৃষ্টির পেছনে জ্ঞানময় উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। এ কারণে সে আল্লাহ্ তায়ালার ওপর নির্ভর করে সহজ-সরল সুদৃঢ় পথে অগ্রসর হয়। কারণ সে জানে যে,আল্লাহ্ তায়ালা তাকে সহায়তা ও রক্ষা করবেন। তাই সে তার কাজের ফলাফলের ব্যাপারে অধিকতর আত্মবিশ্বাসী ও অধিকতর আশাবাদী হয়।

কিন্তু বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টির অধিকারী ব্যক্তির মানসিক কাঠামো তাকে বস্তুগত কাযা ও কাদরে বিশ্বাসী করে তোলে (অর্থাৎ সে মনে করে যে,কেবল বস্তুগত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই তার ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করে),ফলে ঈমানদার লোকেরা যেভাবে আত্মবিশ্বাসী,দৃঢ় প্রত্যয়ী ও আশাবাদী হয়ে থাকে,বস্তুবাদীর পক্ষে তা হওয়া সম্ভবপর নয়। সে তার লক্ষ্য অর্জনের পথে একটি নিশ্চিত পৃষ্ঠপোষকতা লাভ থেকে বঞ্চিত থাকে।

অতএব,এতে কোন সন্দেহ নেই যে,সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া ও ফলাফলের বিচারে এ দু’টি মতাদর্শের মধ্যে বিরাট ও সুগভীর পার্থক্য রয়েছে। আনাতোলি ফ্রান্স বলেন : “ধর্মের একটি শুভ ফল এই যে,তা মানুষকে স্বীয় অস্তিত্ব এবং স্বীয় কর্মের ফলাফল সম্পর্কে যুক্তি প্রয়োগ করতে শেখায়। আমরা যখন আস্তিক্যবাদীদের দর্শনের মূলনীতিসমূহ প্রত্যাখ্যান করি-বিজ্ঞান ও মুক্তির যুগে আমাদের প্রায় সকলেই যা করে থাকে-তখন আমাদের পক্ষে এ সম্পর্কে জানার কোনো উপায় থাকে না যে,কেন আমরা এ জগতে এসেছি এবং এ দুনিয়ার পদার্পনের পর আমাদের কী অর্জন করা উচিত।

ভাগ্যলিপির গূঢ় রহস্য আমাদের মধ্যে কতগুলো শক্তিশালী গূঢ় রহস্যের উদ্ভব ঘটায়। আমরা যদি জীবনের অনিশ্চয়তাজনিত দুঃখজনক অভিজ্ঞতা পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে চাই তাহলে আমাদের একদমই চিন্তা করা চলবে না। কারণ,আমাদের দুঃখ-কষ্টের মূল আমাদের অস্তিত্বের কারণ সম্বন্ধে আমাদের পরিপূর্ণ অজ্ঞতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। আমরা যদি আমাদের শারীরিক ও আত্মিক বেদনা এবং আত্মা ও ইন্দ্রিয়নিচয়ের পীড়নের পেছনে নিহিত কারণ জানতে পারি এবং বিশ্বাস করি যে,এসব কিছু স্রষ্টার ইচ্ছায় সংঘটিত হচ্ছে,তাহলে এসব কিছুই আমাদের জন্য সহনীয় হবে।

প্রকৃত বিশ্বাসী ব্যক্তি যে আত্মিক পীড়ন সহ্য করে,তা থেকে সে আনন্দ লাভ করে। এমনকি সে যে সব পাপ কাজ করে তাও তার আশাকে মুছে দিতে পারে না,কিন্তু যে জগতে বিশ্বাসের আলোকরশ্মি নির্বাপিত হয়ে গেছে,সেখানে ব্যথা-বেদনা ও অসুস্থতা স্বীয় তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে এবং কুৎসিত রসিকতায় পরিণত হয় যা এক ধরনের নির্মম পরিহাস মাত্র।”

কাযা ও কাদরের একটি ভুল ব্যাখ্যা

কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবী কাযা ও কাদর সম্বন্ধে ভ্রমাত্মক ধারণা পোষণ করে। তারা মনে করে যে,কাযা ও কাদরের ধারণা মানুষের মধ্যে অথর্ব অবস্থা ও অকমর্ন্যতা সৃষ্টি করে এবং জীবনকে উন্নত করার জন্য সকল প্রকার চেষ্টা-সাধনা চালানো থেকে মানুষকে বিরত রাখে।

পাশ্চাত্যজগতে এরূপ ধারণা গড়ে ওঠার জন্য কাযা ও কাদর সম্বন্ধে যথাযথ জ্ঞানের অভাবই দায়ী। বিশেষ করে ইসলামী শিক্ষায় কাযা ও কাদর বলতে কী বুঝায় সে সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। আর প্রাচ্যজগতে পতন ও পশ্চাৎপদতার কারণে পাশ্চাত্যের এ ধারণা প্রভাব বিস্তার করেছে।

এ এক সর্বজনবিদিত ব্যাপার যে,ব্যক্তিমানুষ বা ঐতিহাসিক সম্প্রদায়সমূহ যখনই তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে উপনীত হতে ও স্বীয় চিন্তা-মতাদর্শ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে,তার প্রকৃত কারণ যা-ই হোক না কেন,তখন তারা ভাগ্য,দুর্ঘটনা,ভাগ্যলিপি ইত্যাদি শব্দের সাহায্যে নিজেদেরকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে।

নবীকুল শিরোমণি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এ বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে স্বীয় অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন : “এমন একটি সময় আসবে যখন আমার উম্মতের অনেক লোক পাপ কাজ সম্পাদন করবে এবং তাদের পাপাচার ও নোংরা কাজের পক্ষে ছাফাই গাওয়ার জন্য বলবে : আল্লাহ্ তায়ালার কাযা ও কাদরই নির্ধারণ করে রেখেছিল যে,আমরা এ কাজ করব। তোমরা যদি এ ধরনের লোকদের সাক্ষাৎ পাও,তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দেবে যে,তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।”

কাযা ও কাদর মানুষকে তার জীবনের লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য সংগ্রাম করার পথে বাধা দেয় না। যথেষ্ট দীনী জ্ঞানের অধিকারী লোকেরা জানে যে,ইসলাম মানুষের প্রতি নৈতিক ও বস্তুগত উভয় দিক থেকে তাদের জীবনকে উন্নত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা সাধনা করার আহ্বান জানায়। মানুষকে ব্যাপক চেষ্টা-সাধনায় উদ্বুদ্ধকরণের জন্য এ এক শক্তিশালী উপাদান।

কাযা ও কাদর সম্বন্ধে যথেষ্ট ধারণার অধিকারী নন এমন একজন পাশ্চাত্য চিন্তাবিদ হচ্ছেন জ্যাঁ পল সার্ত্রে। তিনি মনে করেন যে,একই সাথে স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত ভাগ্যলিপি এবং মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করা অসম্ভব। অতএব,স্রষ্টায় বিশ্বাস ও মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাস এ দু’টির যে কোন একটিকে বেছে নিতে হবে। তিনি বলেন : “যেহেতু আমি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি সেহেতু আমি স্রষ্টায় বিশ্বাস করতে পারি না। কারণ,আমি যদি তাঁর ওপর বিশ্বাস করি,তাহলে আমাকে ভাগ্যলিপির ধারণায় বিশ্বাস করতে হবে। আর আমি যদি ভাগ্যকে গ্রহণ করি তাহলে আমাকে স্বাধীনতা পরিত্যাগ করতে হবে। আমি স্বাধীনতা গ্রহণ করেছি সেহেতু আমি স্রষ্টায় বিশ্বাস করি না।”

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভাগ্যলিপি অর্থাৎ কাযা ও কাদরে বিশ্বাস এবং মানুষের স্বাধীনতার মধ্যে কোন বৈপরীত্য নেই। আল্লাহ্ তায়ালার ইচ্ছা বিশ্বজনীন এ ধারণা প্রদানের পাশাপাশি কোরআন মানুষের মুক্ত-স্বাধীন ও সক্রিয় ভূমিকার কথা ব্যক্ত করে। কোরআন মানুষকে ভালো ও মন্দ এবং কুৎসিত ও সুন্দরের জ্ঞানের ভিত্তিতে এ থেকে স্বাধীনভাবে বেছে নেয়ার মাধ্যমে সচেতনভাবে স্বীয়ভাগ্য গঠনে সক্ষম বলে গণ্য করে। এরশাদ হয়েছে :

إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا

“নিঃসন্দেহে আমি পথ প্রদর্শন করেছি; চাইলে সে সঠিক পথ বেছে নিয়ে কৃতজ্ঞ হোক,অথবা সে (পথভ্রষ্ট হয়ে) অকৃতজ্ঞ হোক।”-(সূরা আদ দাহর : ৩)

وَمَنْ أَرَادَ الْآخِرَةَ وَسَعَىٰ لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَـٰئِكَ كَانَ سَعْيُهُم مَّشْكُورًا

“আর যে ব্যক্তি আখিরাতের (আখিরাতের শুভ প্রতিদান লাভের) ইচ্ছা করে এবং সে জন্য চেষ্টা করে যেরূপ চেষ্টা করা উচিত,আর সে যদি মুমিন হয়ে থাকে,তাহলে তাদের চেষ্টা-সাধনার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানো হবে,তাদেরকে এর পুরস্কার প্রদান করা হবে।”-(সূরা বনি ইসরাইল : ১৯)

যারা অদৃষ্টবাদের আশ্রয় নেয় এবং বলে,‘আল্লাহ্ চাইলে আমরা তাঁকে ব্যতিরেকে অন্য কারো উপাসনা করতাম না’ (সূরা নাহল : ৩৫),তারা তাদের পাপাচারের দায়িত্ব খোদায়ী ইচ্ছা এবং কাযা ও কাদরের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। শেষ বিচারের দিনে তাদের এ ছাফাই পুরোপুরি প্রত্যাখ্যাত হবে।

কোরআন মজীদের কোনো আয়াতই ব্যক্তি বা সমাজের কোনো অন্যায়-অনাচার ও পাপাচারকে কাযা ও কাদরের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা হয়নি। অনুরূপভাবে কোন কলুষিত সমাজ যদি নিজের সংস্কার সাধান করতে চায় সে ক্ষেত্রে কাযা ও কাদর তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এমন একটি আয়াতও পাওয়া যাবে না যাতে আল্লাহ্ তায়ালার ইচ্ছা দ্বারা মানুষের ইচ্ছা অকার্যকর করে রাখার কথা বলা হয়েছে,অথবা বলা হয়েছে কাযা ও কাদরের কারণেই মানুষ দুভোর্গের সম্মুখীন হয়েছে।

কোরআনে বারবার বলা হয়েছে যে,স্বৈরাচারী ও পাপাচারীদেরকে আল্লাহ্ তায়ালার ক্রোধের শিকার হতে হবে এবং তাদের জন্য কষ্টদায়ক শাস্তি অপেক্ষা করছে।

যেহেতু আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর বান্দাদেরকে খুবই ভালবাসেন এবং তিনি তাদের প্রতি খুবই দয়ালু,সেহেতু তিনি তাদেরকে অগণিত নেয়ামত প্রদান করেছেন,সে সাথে তিনি তাদের প্রতি নম্র ও তাদের কাছ থেকে অনুতাপ গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত। তিনি পাপীদের জন্য সব সময়ই সংশোধন এবং বিশুদ্ধতা ও ন্যায়ানুগতায় প্রত্যাবর্তনের পথ উন্মুক্ত রেখেছেন। আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর বান্দাদের তওবা গ্রহণ করেন; বস্তুত এ হচ্ছে বান্দাদের প্রতি তাঁর দয়া ও অনুগ্রহেরই প্রমাণ।

যদিও জ্ঞাত অন্য সকল প্রাণশীল সৃষ্টির তুলনায় মানুষের ইচ্ছাশক্তি অনেক বেশি ও অনেক ব্যাপক এবং তা অধিকতর সৃজনশীল ভূমিকা পালন করে,তবে তার ইচ্ছা কেবল তার কাজ-কর্ম ও তৎপরতার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া সীমিত ক্ষেত্রেই কার্যকর। অতএব,সে তার জীবনকালে যা চাইবে তা-ই করতে পারবে এমন নয়।

অনেক সময় দেখা যায় যে,মানুষ কোন কিছু করতে চায়,কিন্তু সেজন্য সে যত কঠোরভাবেই চেষ্টা করুক না কেন সে তা করতে সক্ষম হয় না। এর কারণ এ নয় যে,আল্লাহর ইচ্ছা মানুষের ইচ্ছার বিরোধিতা করছে এবং সে যা করতে চাচ্ছে তা করতে বাধা দিচ্ছে। বরং এ ক্ষেত্রে মানুষের জ্ঞান বহির্ভূত কতক বাহ্যিক ঘটনা তার পথে বাধাস্বরূপ কাজ করছে এবং তাকে তার লক্ষ্য অর্জনে বাধা দিচ্ছে। ব্যক্তি ও সমাজ অনবরতই এ ধরনের বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।

প্রকৃত ব্যাপার এই যে,প্রাকৃতিক ক্ষেত্রে এমন কোন কারণ নেই যা ফলাফলবিহীন এবং এমন কোন ফলাফল নেই যার পেছনে কারণ নিহিত নেই। আর যেহেতু আমাদের উপলব্ধি ক্ষমতা ও জ্ঞানার্জন মাধ্যম সীমিত ও সীমিত ক্ষমতা সম্পন্ন এবং কেবল মানবিক ক্ষেত্রের মধ্যে তার কার্যকারিতা সীমাবদ্ধ তাই আমাদের জন্য এটি মেনে নেয়া কঠিন নয় যে,আমাদের সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা ঠিক যেভাবে আমরা চাই সেভাবে পূরণ হবে না।

আল্লাহ্ তায়ালা এ সৃষ্টিজগতে শত শত কোটি উপাদান সৃষ্টি করেছেন যা নিজ নিজ কাজ করে যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব উপাদানের কতগুলো মানুষের কাছে স্পষ্ট থাকে,কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে সক্রিয় অনেক উপাদান মানুষের কাছে অজ্ঞাত থাকে। ফলে সে এসব উপাদান বা বিষয় সামনে রেখে হিসাব-নিকাশ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হয় না। এটিও কাযা ও কাদরের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়। কিন্তু তা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা কেড়ে নেয় না বা তাকে সন্তোষজনক জীবনের অধিকারী হবার চেষ্টা-সাধনা চালাতে বাধা দেয় না,বরং তা তাকে চিন্তা-গবেষণা ও কর্মতৎপরতায় উৎসাহিত করে,শুধু তা-ই নয়,বরং তার অভ্যন্তরীণ সত্তার গভীরে সঞ্জীবনী শক্তি সঞ্চার করে। এ ক্ষেত্রে সে তার জ্ঞান নিয়ে পর্যালোচনা করে এবং যতখানি সুস্পষ্টভাবে সম্ভব জীবনে অধিকতর সাফল্যে উপনীত হবার পথ উন্মুক্তকরণের উপাদানগুলো চি‎হ্নিত করার চেষ্টা করে।

অতএব,কাযা ও কাদরে বিশ্বাস মানুষকে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হাসিল ও আদর্শ বাস্তবায়নে এগিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে একটি বিরাট সম্ভাবনাময় উপাদান।

মানুষের মুক্তি ও দুর্ভাগ্যের বিষয় সম্পর্কে এখানে সংক্ষেপে শুধু এতটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে,মানুষের মুক্তি ও দুর্ভাগ্য তার কাজের ওপরে নির্ভরশীল। মানুষের ইচ্ছা বহির্ভূত বিষয়সমূহ অথবা আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে মানুষের অস্তিত্বের মাধ্যে যে প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ নিহিত রাখা হয়েছে তার ওপরে তার মুক্তি ও দুর্ভাগ্য নির্ভরশীল নয়।

মানুষের পারিপার্শ্বিক ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত উপাদানসমূহ অথবা মানুষের মধ্যে নিহিত স্বাভাবিক সক্ষমতা তার মুক্তি বা দুর্ভাগ্যকে প্রভাবিত করে না; এগুলো তার ভাগ্য গঠন করে না। মানুষের ভবিষ্যৎ যা নির্ধারণ করে,অন্য কথায় তার মুক্তি বা দুর্ভাগ্যের বিষয়টি যে অক্ষের চারিদিকে আবর্তিত হয় তা হচ্ছে,সে মানুষের উন্নতি ও অধঃগতির কারণগুলোর মধ্য থেকে কোনটি বেছে নিল এবং সে তার বুদ্ধিমত্তা,জ্ঞান ও অন্যান্য শক্তির সঠিক ব্যবহার করল কিনা।

সৌভাগ্য ও মুক্তি প্রাকৃতিক সক্ষমতাসমূহের প্রাচুর্যের ওপর নির্ভরশীল নয়। তবে এ কথা সত্য যে,যে ব্যক্তি অন্যদের তুলনায় অধিকতর সক্ষমতার অধিকারী তার দায়িত্ব-কর্তব্যও অপেক্ষাকৃত বেশি। যদি তার পক্ষ থেকে সামান্য ভুল সংঘটিত হয় তাহলে দুর্বল ও শক্তিহীনদের অনুরূপ ভুলের তুলনায় তার গুরুত্বও বেশি। প্রতিটি ব্যক্তিকেই তার মেধা,প্রতিভা ও সক্ষমতা অনুযায়ী হিসাব দিতে হবে।

এটি পুরোপুরি সম্ভব যে,যার ভেতরে নিহিত সক্ষমতা এবং তার ইখতিয়ারে থাকা ধন-সম্পদের পরিমাণ খুবই সামান্য,কিন্তু তা সত্ত্বেও সে যদি তার জীবনকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করে এবং তার ওপরে অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে তাহলে সে এমন সৌভাগ্যে উপনীত হতে পারবে যা একজন মানুষের সমুন্নত মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যশীল। তাকে যা এরূপ ফলাফল অর্জনে সক্ষম করে তোলে তা হচ্ছে তার সীমিত সক্ষমতাকেই সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য তার ব্যাপক চেষ্টা-সাধনা।

এর বিপরীতে,যে ব্যক্তিকে প্রচুর অভ্যন্তরীণ গুণাবলী ও সক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে,অথচ সে তার নিজের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করতে পারেনি,শুধু তা-ই নয়,সে সেগুলো অপব্যবহার করে স্বীয় মানবিক মর্যাদাকে পদদলিত করেছে এবং নিজেকে অন্যায়-অনাচার ও পাপাচারের পঙ্কে নিক্ষেপ করেছে,এ ধরনের ব্যক্তি নিঃসন্দেহে চরম হতভাগ্য,কারণ সে কখনই মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করবে না।

পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ رَهِينَةٌ

“প্রতিটি ব্যক্তিই সে যা অর্জন করেছে সে জন্য দায়ী।”-(সূরা আল মুদ্দাস্সির : ৩৮)

অতএব,কোন ব্যক্তির মুক্তি বা দুর্ভাগ্য তার কৃত কাজ-কর্মের ওপর নির্ভরশীল,তার প্রাকৃতিক গঠন বা মনস্তাত্ত্বিক গুণ-বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভরশীল নয়। এ হচ্ছে আল্লাহ্ তায়ালার ন্যায়বিচারের স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ।

শিয়া মাযহাবের বৈশিষ্ট্যজ্ঞাপক অন্যতম আকীদা হচ্ছে ‘বাদা’। এ পরিভাষাটির অর্থ হচ্ছে,মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক উপাদানসমূহ (বা তার কোন একটি) পরিবর্তিত হয়ে গেলে তার ভাগ্যও পরিবর্তিত হয়ে যায়। অর্থাৎ দৃশ্যত যা চিরন্তন অথবা অলঙ্ঘনীয় বলে মনে হয় মানুষের কাজ-কর্ম ও আচরণে পরিবর্তন ঘটার ফলে তাতে পরিবর্তন সংঘটিত হয়। বিভিন্ন বস্তুগত উপাদান যেভাবে মানুষের ভাগ্যকে পরিবর্তিত করে দেয় ঠিক সেভাবেই অবস্তুগত উপাদানসমূহও নতুন প্রপঞ্চ প্রকাশ করতে পারে।

এরূপ হওয়া সম্ভব যে,এ ধরনের অবস্তুগত উপাদান এমন গুপ্ত বিষয়কে প্রকাশ করে দেবে যা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দৃশ্য বাহ্যিক গতিধারার বিপরীত। প্রকৃতপক্ষে কারণসমূহ ও পরিস্থিতিতে পরিবর্তনের মাধ্যমে আল্লাহ্ তায়ালার পক্ষ থেকে একটি নতুন প্রপঞ্চের উদ্ভবের ফয়সালা দেয়া হয় যা যে প্রপঞ্চের উদ্ভব হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল তার তুলনায় সৃষ্টির জন্য অধিকতর কল্যাণকর। এটি নাযিলকৃত বিধান মানসূখ করার নীতির সাথে তুলনীয়। পূর্ববর্তী বিধান বাতিল করে নতুন করে বিধান প্রবর্তন করা থেকে এটি বুঝায় না যে,ঐশী বিধানদাতা পূর্ববর্তী বিধান প্রদানকালে অজ্ঞতার বশে ভুল করেছিলেন; বরং এর কারণ হচ্ছে,পূর্ববর্তী বিধানটি ছিল সাময়িক এবং তার কার্যকারিতার মেয়াদ শেষ হবার পর তা বাতিল করা হয়েছে।

‘বাদা’কে এভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় যে,পূর্বে অজ্ঞাত কোন বাস্তবতা প্রকাশিত হবার পর আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর পূর্ব সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। কারণ,এরূপ ধারণা আল্লাহ্ তায়ালার জ্ঞানের বিশ্বজনীনতার ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। সুতরাং কোন মুসলমানই এরূপ ধারণা পোষণ করতে পারে না।

দোয়া ও মোনাজাত হচ্ছে আরেকটি বিষয় যার ক্রিয়াশীলতাকে ছোট করে দেখার উপায় নেই। এতে কোনই সন্দেহ নেই যে,আল্লাহ্ তায়ালা প্রত্যেকের অন্তরের গোপন রহস্যাবলী সম্বন্ধে অবগত। কিন্তু তাঁর সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যক্তির দোয়া ও মোনাজাতের ভূমিকা প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার চেষ্টা-সাধনা ও কাজ-কর্মের অনুরূপ। এ ছাড়াও দোয়া ও মোনাজাতের মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়ারও স্বতন্ত্র ভূমিকা রয়েছে।

প্রকৃতিতে প্রতি মুহূর্তেই নতুন নতুন প্রপঞ্চের আর্বিভাব ঘটছে যার আবির্ভাবের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী কারণসমূহ ভূমিকা পালন করে থাকে। অনুরূপভাবে অস্তিত্বলোকের বিশাল অঙ্গনে মানুষকে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের পানে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে দোয়া ও মোনাজাতের সুগভীর প্রভাব রয়েছে। আল্লাহ্ তায়ালা যেভাবে প্রতিটি প্রাকৃতিক উপাদানের জন্য একেকটি ভূমিকা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন,ঠিক সেভাবেই তিনি দোয়া ও মোনাজাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

কোন ব্যক্তি যখন বিভিন্ন অসুবিধার মধ্যে নিপতিত হয় তখন কিছুতেই তার নিরাশ হওয়া উচিত নয়। কারণ,কারো জন্য আল্লাহ্ তায়ালার দয়া ও অনুগ্রহের দরজা কখনই বন্ধ হয়ে যায় না। হতে পারে যে,পরদিনই এমন কোন নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটবে,যে সম্পর্কে তার পক্ষে কোনভাবেই ধারণা করা সম্ভব নয়। আল্লাহ্ তায়ালা কোরআন মজীদে নিজের সম্পর্কে এরশাদ করেন :

كُلَّ يَوْمٍ هُوَ فِي شَأْنٍ

“প্রতিদিনই তিনি স্বীয় ভূমিকায় অধিষ্ঠিত আছেন।”-(সূরা আর রহমান : ২৯)

অতএব,কারোই স্বীয় কর্মতৎপরতা ও চেষ্টা-সাধনা পরিত্যাগ করা উচিত নয়। যে ব্যক্তি যথাযথ কর্ম সম্পাদন করতে চায়,অথচ তার সাথে দোয়া ও মোনাজাতের আশ্রয় নেয় না,আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আ.)-এর ভাষায় তার অবস্থা হচ্ছে এমন ব্যক্তির ন্যায় যে একটি ছিলাবিহীন ধনুক থেকে তীর নিক্ষেপ করতে চায়।

ব্যক্তিকে একদিকে যেমন তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে উপনীত হবার জন্য অব্যাহত চেষ্টা চালাতে হবে,সেই সাথে আন্তরিকতা সহকারে তার আশা-আকাঙ্ক্ষাকে আল্লাহ্ তায়ালার নিকট পেশ করা উচিত এবং সীমাহীন শক্তি ও ক্ষমতার আধার যিনি তাঁর নিকট থেকে সর্বান্তকরণে সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত। তাহলে অবশ্যই আল্লাহ্ তাকে সাহায্য করবেন। কোরআনে এরশাদ হয়েছে :

وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ ۖ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ ۖ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ

“হে নবী! আমার বান্দারা যখন আপনার নিকট আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে তখন (তাদেরকে বলুন যে,) আমি অবশ্যই (তাদের) অত্যন্ত নিকটে,কোন আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে তখন আমি জবাব দেই,(তার আহ্বানে সাড়া দেই)। অতএব,তারা যেন আমার ডাকে সাড়া দেয় এবং আমার প্রতি ঈমান পোষণ করে তাহলে আশা করা যায় যে,তারা সঠিক পথ প্রাপ্ত হবে।”-(সূরা আল বাকারাহ্ : ১৮৬)

মানুষ যখন সকল বিষয় থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ও অন্যের মুখাপেক্ষিতার ফাঁদ এড়িয়ে যায় এবং সরাসরি আল্লাহর দিকে মুখ ফিরায় তখন তার নাফস্ আল্লাহর পানে ঊর্ধ্বলোকে আরোহণ করে এবং তাকে প্রকৃত সুখ-শান্তিতে নিমজ্জিত করে। তখন সে নিজেকে আল্লাহ্ তায়ালার সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্কের অধিকারী বলে অনুভব করে এবং তাঁর দয়া ও অনুগ্রহকে স্পষ্টভাবে অনুভব করে।

হযরত ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) তাঁর এক দোয়ায় (‘দোয়ায়ে আবু হামযা সুমালী’ নামে পরিচিত) আল্লাহ্ তায়ালার নিকট এই বলে আবেদন করেন :

“হে আমার স্রষ্টা! আমি আপনার নিকট পৌঁছার জন্য বিনয় ও আবেদন-নিবেদনের পথসমূহ উন্মুক্ত ও সুমসৃণ দেখতে পাচ্ছি এবং আপনাতে দেখতে পাচ্ছি আশার সীমাহীন উৎস। আমি জানি আপনার নিকট সাহায্য প্রার্থনা এবং আপনার দয়া ও অনুগ্রহ কামনার জন্য আপনি অনুমতি দিয়েছেন। যারাই আপনার নিকট দোয়া ও সাহায্য চায় তাদের সকলের জন্যই আপনার নিকট দোয়া ও মোনাজাতের দরজা উন্মুক্ত দেখতে পাচ্ছি। আমি নিশ্চিত যে,যারা আপনার নিকট দোয়া করে তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়ার জন্য এবং যারা আপনার নিকট আশ্রয় চায় তাদেরকে আশ্রয় দেয়ার জন্য আপনি প্রস্তুত রয়েছেন।”

এছাড়া পাপকর্ম ও ভালো কাজের প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে একটি হাদীসে বলা হয়েছে :

“যারা গুনাহের কারণে মারা যায় তাদের সংখ্যা স্বাভাবিক মৃত্যুবরণকারীদের তুলনায় অনেক বেশি। আর যারা তাদের নেক আমলের কারণে বেঁচে থাকে তাদের সংখ্যা স্বাভাবিক কারণে বেঁচে থাকা লোকদের তুলনায় বেশি।”(সাফিনাতুল বিহার,১ম খণ্ড,পৃ. ৪৮৮।)

এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে,আল্লাহর নবী হযরত যাকারিয়া (আ.) আল্লাহ্ তায়ালার নিকট একটি সন্তান প্রার্থনা করে দোয়া করেন এবং আল্লাহ্ তায়ালা সে দোয়া কবুল করেন। তেমনি হযরত ইউনুস (আ.) আল্লাহ্ তায়ালার নিকট যে অনুতাপ প্রকাশ করেন সে কারণে আল্লাহ্ তাঁকে ও তাঁর জাতিকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেন।

মহান স্রষ্টা আল্লাহ্ তায়ালা এ বিশ্বজগতের জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলী ও প্রাকৃতিক আইন দিয়েছেন। কিন্তু সেসব নিয়ম ও প্রাকৃতিক আইন কোনোভাবেই তাঁর সীমাহীন ক্ষমতাকে সীমিত করে না বা তাঁর ক্ষমতার প্রয়োগক্ষেত্রকে সঙ্কুচিত করে না। তিনি যেভাবে প্রবর্তন করেছেন সেভাবেই এসব আইনের ফলাফলের সাথে মিল রেখে বা এসবের ফলাফলকে রহিত করে দিয়ে এসব আইনে পরিবর্তন সাধন করার নিরঙ্কুশ ইখতিয়ারও তাঁর রয়েছে। যে একক সত্তার সযত্ন ও সামগ্রিক তত্ত্বাবধান গোটা সৃষ্টি-ব্যবস্থাকে অধীন করে রেখেছে সে সত্তা কখনই স্বীয় সৃষ্ট আইন-কানুন ও প্রপঞ্চসমূহের মোকাবিলায় অসহায় হতে পারেন না অথবা যা ইচ্ছা করেন তা সম্পাদনের ক্ষমতা ও সক্ষমতা হারাতে পারেন না।

আমরা যখন বলি যে,আল্লাহ্ তায়ালা এ বিশ্বজগতে স্বীয় সৃষ্ট প্রপঞ্চসমূহকে যখন খুশী পরিবর্তন করতে পারেন তার দ্বারা আমরা এ কথা বুঝাতে চাই না যে,তিনি এ বিশ্বের শৃঙ্খলা এবং এর সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন ধ্বংস করেন বা প্রকৃতির নিয়মাবলী,বিধি-বিধান ও মূলনীতিকে উল্টে দেন। বরং আমাদের অনুভূতি ও উপলব্ধির বাইরে বিদ্যমান অজানা মূলনীতি ও শর্তাবলীর অধীনে এই পরিবর্তন প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়িত হয়। যদি মানুষ সতর্কতার সাথে ও সূক্ষ্মভাবে এ বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেয় এবং সে যে সব বিশাল সম্ভাবনার মুখোমুখি হয় সেগুলোকে বিবেচনায় আনে তাহলে তা তাকে প্রকৃতিজগতের মধ্যে যে গুটিকতক নিয়ম সে পর্যবেক্ষণ করে থাকে সেগুলোর ভিত্তিতে সমস্ত বিষয় সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার উচ্চাভিলাষী প্রয়াস চালানো থেকে বিরত রাখবে।

টীকা :

১. এই প্রবন্ধটি লেখকের ফার্সী ভাষায় রচিত তাওহীদ ও ধর্মতত্ত্ব সংক্রান্ত গ্রন্থ ‘মাবানিয়ে এতেকাদাত দার ইসলাম’ (ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের মূল ভিতসমূহ)-এর পঞ্চম এবং সর্বশেষ অধ্যায়। প্রবন্ধটি তেহরান থেকে প্রকাশিত ইংরেজি সাময়িকী Al-Tawhid -এ শাওয়াল-যিলহজ্ব ১৪০৯ হি. সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।#alhassanain.org/bengali