ইসলামে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের স্বাধীনতা

ভূমিকা

প্রাচ্যবিদরা যখনই ইসলামের ইতিহাসের এ পর্যায়ে উপনীত হন, তখনই তারা ইসলামের প্রতি তাদের তীক্ষ্ণ আক্রমণগুলো চালনা করতে থাকেন এবং (অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি ইসলাম ও মহানবীর) আচরণকে আকীদা-বিশ্বাস ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী বিবেচনা করেন। তবে তারা যদি সব ধরনের গোঁড়ামি পরিহার করে ইসলামের ইতিহাস অধ্যয়ন করতেন এবং এ বিষয়ে যা কিছু ঐতিহাসিক গ্রন্থাদিতে বর্ণিত হয়েছে, তার প্রকৃত উদ্দেশ্য পর্যালোচনা করতেন, তা হলে সম্ভবত তারা কম ভ্রান্তির শিকার হতেন এবং প্রত্যয়ন করতেন যে, এ পদক্ষেপ কখনই আকীদা-বিশ্বাস ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়, যা বিশ্বের সকল বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে সম্মানার্হ। আমরা এখানে এরূপ কিছু ঘটনার উল্লেখ করছি:

খায়বারের ইহুদীদের সাথে রাসূলের (সা.) আচরণ

ইসলামের প্রদীপ-নক্ষত্র মদীনার আকাশে আলো বিকিরণ শুরু করলে মদীনার ইহুদীরা মক্কার কুরাইশদের থেকেও মহানবী ও মুসলমানদের শত্রুর চোখে দেখতে লাগল এবং সর্বশক্তি দিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। মদীনা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী ইহুদীরা তাদের অপতৎপরতা ও মন্দ কর্মের মাধ্যমে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। তাদের মধ্যে খাইবরের ইহুদীদের সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল, তারা আরবের সকল গোত্রকে মদীনার ইসলামী সরকার উৎখাতে উস্কানি দিচ্ছিল এবং মুশরিকরা ইহুদীদের অর্থনৈতিক ও যুদ্ধ সরঞ্জামের পৃষ্ঠপোষকতায় আরবের সকল প্রান্ত থেকে মদীনার সন্নিকটে সমবেত হয়েছিল। এর পরিণতিতে খন্দকের (আহ্যাব) যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।

বিশ্বের সকল খোদায়ী ও মহান ব্যক্তি বিজয়ের মুহূর্তে অসহায় ও দুর্বল শত্রুদের সাথে উন্নত ও ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ করে থাকেন। শত্রুর অন্যায় আচরণকে উপেক্ষা করে তাদের সাথে দয়ার্দ্র আচরণ করেন। শত্রু আত্মসমর্পণ করার সময় থেকেই সহানুভূতির দ্বার তাদের জন্য উন্মোচিত করেন এবং সকল প্রতিশোধের স্পৃহা ও বিদ্বেষকে ভুলে যান।

তাই যে শত্রুরা তাদের প্রচুর অর্থ ও সম্পদ মুশরিকদের পেছনে খরচ করে তাদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে মদীনা আক্রমণে প্রলুব্ধ করেছিল ও এভাবে ইসলামের পতন ঘটাতে চেয়েছিল, খাইবর বিজয়ের পর মুসলমানদের মহান নেতা সেই ইহুদীদের জন্য তাঁর করুণায় মুক্তপক্ষ হলেন। তাদের প্রস্তাবকে তিনি মেনে নিলেন এবং সেখানে তাদের বসবাসের অনুমতি দিলেন। খাইবরের ভূমিও তাদের মালিকানায় থাকল। শুধু তাদের ভূমি থেকে উপার্জিত অর্থের অর্ধেক মুসলমানদের দিতে হবে। এমনকি ইবনে হিশামের মতে, এ প্রস্তাব রাসূল (সা.) নিজেই দেন এবং তাদেরকে কৃষিভূমি ও খেজুর বাগানের মালিক ও তত্ত্বাবধায়ক ঘোষণা করেন।

মহানবী (সা.) তাদের সবাইকে হত্যা করতে পারতেন এবং তাদেরকে সেখান থেকে বহিষ্কার ও ইসলাম গ্রহণে বাধ্যও করতে পারতেন। সাম্রাজ্যবাদের ছত্রছায়ায় প্রতিপালিত প্রাচ্যবিদরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এ প্রচার চালায় যে, ইসলাম শক্তি ও তরবারির ধর্ম এবং মুসলমানরা পরাজিত জাতিগুলোকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করেছিল। তা কখনোই সঠিক নয়; বরং তাঁরা সবসময় প্রতিপক্ষকে তাদের ধর্মের মৌলিক বিধি-বিধান ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানাদি পালনে পূর্ণ স্বাধীনতা দান করতেন। মহানবী (সা.) খাইবরের ইহুদীদের সাথে যুদ্ধ করে থাকলে তা এ কারণে করেছিলেন যে, তারা ইসলামের ও একত্ববাদী ধর্মের জন্য বিপজ্জনক শত্রু হিসেবে পরিগণিত হতো এবং সবসময়ই তারা ইসলামের নব প্রতিষ্ঠিত সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। তাই এক্ষেত্রে তাদের সাথে তিনি বাধ্য হয়েই যুদ্ধ করেন এবং তাদের নিরস্ত্র করে ইসলামী সরকারের অধীনে নিয়ে আসেন এবং এতে মুসলমানরা তাদের হতে নিরাপদ হয় ও তারাও পূর্ণ স্বাধীনতা সহকারে তাদের জীবন ও জীবিকার জন্য কাজ করার পাশাপাশি ধর্মীয় বিধান পালনের সুযোগ ভোগ করতে থাকে। এমনটি না করা হলে মুসলমানরা সমস্যায় পড়তেন এবং ইসলামের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হতো।

মহানবী (সা.) তাদের কাছ থেকে জিযিয়া (বিশেষ কর) গ্রহণ করেছেন এজন্য যে, তারা যেন ইসলামী সরকারের অধীনে পূর্ণ নিরাপত্তা সহকারে বসবাস করতে পারে। তাদের জীবন ও সম্পদ যেন কোনরূপ হুমকির সম্মুখীন না হয়, তার নিশ্চয়তা বিধান মুসলমানদের দায়িত্ব ছিল। ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকার তার মুসলমান অধিবাসীদের থেকে যে পরিমাণ অর্থ কর (যেমন: আয়কর, খাজনা ও ভূমিকর প্রভৃতি) হিসেবে গ্রহণ করে থাকে, তার ইহুদী ও খ্রিষ্টান নাগরিকদের থেকে তার চেয়েও কম অর্থ গ্রহণ করে থাকে। এটি যথার্থ হিসেব করেই করা হয়ে থাকে। মুসলমানরা খুম্স ও যাকাত দেয়া ছাড়াও ইসলামী রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কখনো কখনো নিজের উপার্জন ও মূলধন হতেও খরচ করতে বাধ্য। অন্যদিকে ইহুদী ও খ্রিষ্টানরা ইসলামের নিরাপত্তার পতাকাতলে জীবন যাপন করবে, তাদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত অধিকারগুলো ভোগ করবে এবং এর বিপরীতে মুসলমানদের মতোই বা তার চেয়ে কম অর্থ জিযিয়া হিসেবে দেবে। অথচ তারা ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকারকে রক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে ও এজন্য অর্থ খরচ করতে বাধ্য নয়। তাই এটি অন্যায্য কোন বিষয় নয়। ইসলামী রাষ্ট্রে জিযিয়া জোরপূর্বক চাঁদা গ্রহণও নয়।

প্রতি বছর মহানবী (সা.)-এর পক্ষে এক ব্যক্তি খাইবরে উৎপাদনের হিসাব গ্রহণ ও জিযিয়া আদায়ের জন্য যেতেন। যে ব্যক্তিত্বকে তিনি এ দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তিনি অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোক ছিলেন, যাঁর সুবিচার ও ন্যায়ানুগ আচরণে ইহুদীরা আশ্চর্যান্বিত হয়েছিল। এ ব্যক্তিত্ব হলেন আবদুল্লাহ্ ইবনে রাওয়াহা, যিনি পরবর্তীতে মুতার যুদ্ধে শহীদ হন। তিনি খাইবরের মোট ফসলে মুসলমানদের নির্ধারিত অংশের বিষয়ে অনেক সময় অনুমান করে বলতেন। ইহুদীরা ভাবত, তিনি হয় তো ভুল করে বেশি বলেছেন। তিনি তখন তাদেরকে বলতেন: "যদি তোমরা মনে কর, আমি ভুল করেছি, তবে যেহেতু উভয়ে সমান সমান পাওয়ার কথা, তাই আমি যে অনুমান করেছি, তার ভিত্তিতে পূর্বেই তোমাদের অর্থ দিয়ে দেব। ফসল বিক্রির পর দু’ভাগ করে নেয়ার দরকার নেই। পুরোটাই মুসলমানদের হবে, এতে যদি মুসলমানদের ক্ষতিও হয়।” ইহুদীরা তাঁর এ ন্যায্য কথায় বলত, এ ধরনের ন্যায়বিচারের ছায়াতেই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী টিকে রয়েছে।”

যুদ্ধলব্ধ সম্পদের মধ্যে একখানা তাওরাতও ছিল। ইহুদীরা রাসূলের কাছে তা ফিরিয়ে দেয়ার আবেদন জানালে তিনি বায়তুল মালের (রাষ্ট্রীয় কোষাগারের) দায়িত্বশীলকে তাদের নিকট তা ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন।

খ্রিস্টানদের সাথে রাসূল (সা.) এর আচরণ

মহানবী (সা.) নিজেই আইলা, আযরু ও জার্বার খ্রিস্টান অধ্যুসিত অঞ্চলেরে শাসনকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাদের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদন করেন। সমুদ্র তীরবর্তী নগরী আইলা লোহিত সাগরের তীরে নির্মাণ করা হয়েছিল এবং শামের সাথে এ নগরীর তেমন একটা দূরত্ব ছিল না। সেখানকার শাসনকর্তা ইউহান্না ইবনে রৌবাহ্ বুকে স্বর্ণনির্মিত ক্রুশ ঝুলিয়ে তাঁর শাসনকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে তাবুক অঞ্চলে এসে মহানবীকে একটি সাদা খচ্চর উপঢৌকন দিয়েছিলেন এবং মহানবীর প্রতি তাঁর আনুগত্যের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিলেন। মহানবীও তাঁকে সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন এবং তাঁকে উপঢৌকন প্রদান করেছিলেন।

তিনি খ্রিষ্টধর্মে বহাল থেকে প্রতি বছর তিনশত দীনার জিযিয়া (প্রত্যেক বিধর্মী নাগরিক ইসলামী হুকুমতের আওতা ও তত্ত্বাবধানে বসবাস করে ইসলামী প্রশাসনকে যে কর প্রদান করে) এবং আইলা অঞ্চল অতিক্রমকারী মুসলমানকে আপ্যায়ন করার ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করেন। এ মর্মে উভয় পক্ষের মধ্যে নিম্নরূপ একটি নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়:

এটা হচ্ছে মহান আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে ইউহান্না ও আইলার অধিবাসীদের জন্য অনাক্রমণ চুক্তি। এ চুক্তি মোতাবেক জল ও স্থলপথে ব্যবহৃত তাদের সমুদয় যানবাহন এবং শাম, ইয়েমেন ও সমুদ্র পথে যারা তাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে, তাদের সবাইকে মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা প্রদান করা হলো। তবে তাদের মধ্য থেকে যে কেউ কোন অপরাধ করবে এবং আইনবিরোধী কোন কাজ করবে, তার সম্পত্তি তাকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। সকল জল ও স্থলপথ তাদের জন্য উন্মুক্ত এবং এ সব পথে তাদের যাতায়াতের অনুমতিও প্রদান করা হলো।’

এ সন্ধিপত্র থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, কোন জাতি মুসলমানদের সাথে আপোষ ও সন্ধি করলে তাদের জন্য সব ধরনের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হতো।

নাজরানের খ্রিস্টানদের সাথে আচরণ

সত্তরটি গ্রাম সমেত নাজরান অঞ্চল হিজায ও ইয়েমেন সীমান্তে অবস্থিত। ইসলামের চূড়ান্ত পর্যায়ে আবির্ভাবকালে এ এলাকাটি হিযাজের একমাত্র খ্রিষ্টান অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল। এ এলাকার অধিবাসীরা বিভিন্ন কারণে মূর্তিপূজা ও পৌত্তলিকতা ত্যাগ করে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছিল।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও ধর্মীয় কেন্দ্রসমূহের প্রধানদের কাছে চিঠি-পত্র প্রেরণের পাশাপাশি মহানবী (সা.) নাজরানের আর্চবিশপ আবূ হারিসা-এর কাছে ইসলাম ধর্মের দাওয়াত দিয়েছিলেন:

"ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূবের প্রভুর নামে, (এ পত্রটি) মহান আল্লাহর নবী মুহাম্মদের পক্ষ থেকে নাজরানের মহামান্য আর্চবিশপের প্রতি। ইসহাক ও ইয়াকূবের প্রভুর প্রশংসা করছি এবং আপনাদের বান্দাদের (গায়রুল্লাহর) উপাসনা থেকে মহান আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আপনাদেরকে গায়রুল্লাহর কর্তৃত্ব ও আধিপত্য থেকে বের হয়ে মহান আল্লাহর আধিপত্যে (বেলায়েত) প্রবেশ করার আহ্বান জানাচ্ছি। আর যদি আপনারা আমার দাওয়াত গ্রহণ না করেন, তা হলে অন্ততঃপক্ষে ইসলামী সরকারকে কর (জিযিয়া) প্রদান করুন (যে, এ কর প্রদান করার দরুন আপনাদের জীবন ও ধন-সম্পদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হবে)। এর অন্যথা হলে আপনাদের প্রতি সমূহ বিপদ অর্থাৎ যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে।”

মহানবী (সা.)-এর প্রেরিত প্রতিনিধি দল নাজরানে প্রবেশ করে তাঁর পত্র নাজরানের প্রধান খ্রিষ্ট ধর্মযাজকের কাছে অর্পণ করেন। আর্চবিশপ ভালোভাবে পত্রটি পাঠ করেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য তিনি ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের নিয়ে একটি পরামর্শসভার আয়োজন করেন। এ পরামর্শসভা এ মর্মে অভিমত ব্যক্ত করে যে, নাজরানের প্রতিনিধি দল হিসেবে একদল লোক মুহাম্মদ (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে যেসব বিষয় তাঁর নবুওয়াতের সত্যতার দলিলস্বরূপ সেসব কাছে থেকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও যাচাই করার জন্য মদীনায় যাবে।

তাই নাজরানবাসীর মধ্য থেকে ষাটজন সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিকে এ প্রতিনিধি দলের সদস্য নির্বাচিত করা হয়। নাজরানের প্রতিনিধি দল মদীনা নগরীতে উপস্থিত হয় এবং অনেক আলোচনার পর মহানবী (সা.) মহান আল্লাহ্‌ নির্দেশে তাদেরকে মুবাহালার প্রস্তাব দেন। অর্থাৎ সবাই মরু-প্রান্তরে গিয়ে মহান আল্লাহর কাছে দুআয় রত হবেন এবং উভয় পক্ষ তাদের প্রতিপক্ষের ওপর লানত দেবেন ও ধ্বংস কামনা করবেন। প্রতিনিধি দল মহানবীর প্রস্তাব মেনে নেন। তবে মুবাহালার দিবসে নাজরানের নেতারা মহানবীকে বিশেষ আধ্যাত্মিক অবস্থায় তাঁর আপনজনদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় চারজনকে সাথে নিয়ে মুবাহালার ময়দানের দিকে আসতে দেখে মুবাহালা থেকে বিরত হয় এবং সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হয় যে, নাজরানের খ্রিষ্টানরা সামান্য কিছু জিযিয়া কর প্রদান করে ইসলামের পতাকাতলে নিজেদের ধর্মমতের ওপর বহাল থাকবে।

নাজরানের প্রতিনিধি দল মহানবী (সা.)-এর কাছে তাদের বার্ষিক করের পরিমাণ সন্ধিপত্রে লিপিবদ্ধকরণ এবং মহানবীর পক্ষ থেকে নাজরান অঞ্চলের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করারও আবেদন জানিয়েছিল। আমীরুল মুমিনীন আলী(আ.) মহানবীর নির্দেশে নিম্নোক্ত সন্ধিপত্র লিখেন:

"পরম করুণাময় ও চিরদয়ালু মহান আল্লাহর নামে। নাজরান অঞ্চল এবং তার উপকণ্ঠের অধিবাসীদের প্রতি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে (এ সন্ধিচুক্তি)। নাজরানবাসীদের সকল সহায়-সম্পত্তি সংক্রান্ত মুহাম্মদের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হচ্ছে এই যে, নাজরানের অধিবাসীরা প্রতি বছর দু’হাজার বস্ত্র- প্রতিটির মূল্য যেন ৪০ দিরহামের ঊর্ধ্বে না যায়, ইসলামী প্রশাসনের কাছে অর্পণ করবে। তারা এগুলোর অর্ধেক সফর মাসে এবং বাকী অর্ধেক রজব মাসেও প্রদান করতে পারবে। আর যখনই ইয়েমেনের দিক থেকে যুদ্ধের আগুন প্রজ্বলিত হবে, তখন নাজরানের অধিবাসীরা ইসলামী হুকুমতের সাথে সহযোগিতা স্বরূপ ৩০টি বর্ম, ৩০টি ঘোড়া এবং ৩০টি উট ঋণ বাবদ মুসলিম সেনাবাহিনীর কাছে অর্পণ করবে এবং নাজরান অঞ্চলে এক মাস মহানবীর প্রতিনিধিদের আতিথেয়তা ও আপ্যায়নের দায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত থাকবে। যখনই তাঁর পক্ষ থেকে কোন প্রতিনিধি তাদের কাছে যাবেন, তখন তারা অবশ্যই তাঁকে আপ্যায়ন করবে। নাজরান জাতির জান-মাল, ভূ-খণ্ড, এবং তাদের উপাসনাস্থলসমূহ মহান আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের হেফাযতে থাকবে; তবে তা এ শর্তে যে, এখন থেকেই তারা সব ধরনের সুদ গ্রহণ থেকে বিরত থাকবে। আর এর অন্যথা হলে তাদের থেকে মুহাম্মদের দায় মুক্ত হয়ে যাবে এবং তাদের বরাবরে তাঁর আর কোন প্রতিশ্রুতি বহাল থাকবে না।”

এ সন্ধিপত্র একটি লাল চামড়ার উপর লেখা হলে মহানবী (সা.)-এর দু’জন সাহাবী সাক্ষী হিসেবে এর নিচে স্বাক্ষর করলেন। অবশেষে মহানবী (সা.) সন্ধিপত্রের উপর মোহর অঙ্কিত করে তা প্রতিনিধি দলের নেতাদের হাতে অর্পণ করলেন। এ সন্ধিপত্র এক মহান নেতার চূড়ান্ত ন্যায়পরায়ণতার কথাই স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে এবং মহানবীর হুকুমত যে বিশ্বের অন্য সকল অত্যাচারী সরকার ও প্রশাসনের মতো ছিল না, তা এ ঘটনা থেকে ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়। উল্লেখ্য, এসব অত্যাচারী সরকার ও প্রশাসন প্রতিপক্ষের দুর্বলতা ও অসহায়ত্ব থেকে অবৈধ ফায়দা হাসিল করে এবং তাদের ওপর বিরাট করের বোঝা চাপিয়ে দেয়। অপর দিকে, ইসলামী হুকুমত (রাষ্ট্র) সব সময় শান্তি, ন্যায় এবং মানবীয় মূলনীতিসমূহ বিবেচনায় রেখে কখনই এসবের সীমারেখা অতিক্রম করে না অর্থাৎ এর বহির্ভূত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে না।#আল বাসাইর

তথ্যসূত্র

১. সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৩১।

২. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫৬।

৩. সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৩৪৫; ফুরুয়ে কাফী, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪০৫।

৪. সীরাতে ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃ. ৫২৬; সীরাতে হালাবী, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৬০ এবং বিহারুল আনওয়ার, ২১তম খণ্ড, পৃ. ১৬০।

৫. ইয়াকুত হামাভী তাঁর মু’জামুল বুলদান গ্রন্থের ৫ম খণ্ডের ২৬৬-২৬৭ পৃষ্ঠায় নাজরানবাসীদের খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করার কারণগুলো বর্ণনা করেছেন।

৬. ‘উসকুফ’ বা ‘আর্চ বিশপ’ শব্দটি গ্রীক ‘ইপেসকোপ’ শব্দ থেকে উৎসারিত, যার অর্থ হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী, তদারককারী, পর্যবেক্ষক ও নিয়ন্ত্রক। আর এখন এ শব্দটি ধর্মযাজক বা পাদ্রীর চেয়ে ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের খ্রিষ্টধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক পদ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।

৭. বিহারুল আনওয়ার, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮৫।

৮. ফুতহুল বুলদান, পৃ. ৭৬।