সূরা ইউসুফ; (১ম পর্ব)

সূরা ইউসুফ; আয়াত ১-৩

সূরা ইউসুফে মোট ১১১ টি আয়াত রয়েছে। ইবনে আব্বাস ছাড়া সব মুফাসসিরে কুরআন মনে করেন, সম্পূর্ণ এই সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। তবে হযরত ইবনে আব্বাসের মতে, এই সূরার চারটি আয়াত তথা ১ম, ২য়, ৩য়, ও ৭ম আয়াত মদীনায় অবতীর্ণ হয়। যাই হোক, এই সূরায় হযরত ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনা ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে যা চিন্তাকর্ষক ও শিক্ষাপ্রদ।

এই সূরার ১ম ও ২য় আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন:

الر تِلْكَ آَيَاتُ الْكِتَابِ الْمُبِينِ (1) إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ قُرْآَنًا عَرَبِيًّا لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ

"অনন্ত করুণাময় পরম দয়ালু আল্লাহর নামে, আলীফ, লাম, রা, এগুলি সুস্পষ্ট গ্রন্থের আয়াত।” (১২:১)

“নিশ্চয়ই আমরা কুরআনকে আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করেছি যাতে তোমরা বুঝতে পার।” (১২:২)

কুরআনের আরো ২৯টি সূরার মত সূরা ইউসুফও হুরুফে মুকাত্তায়া দিয়ে শুরু হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই অক্ষরগুলো আল্লাহ ও তার রাসূলের মধ্যকার কোনো গোপন রহস্য যা অন্য কারো জানা নেই । এই অক্ষরগুলোর মাধ্যমে কুরআনের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বও ফুটে ওঠে, অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা যেন কুরআনের অলৌকিতা এসব অক্ষরের মাধ্যমে মানুষের কাছে উপস্থাপন করেছেন।

এই দুই আয়াত দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। প্রথমে বলা হয়েছে, কুরআন হচ্ছে সুস্পষ্ট গ্রন্থ যা আলোকবর্তিকার মতো মানুষের সামনে চির সত্যকে উদ্ভাসিত করে। দ্বিতীয়ত, কুরআনের আয়াত বা বাণী নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পরকালীন মুক্তি ও পুরস্কারের আশায় শুধু আবৃত্তি করার জন্য কুরআন অবতীর্ণ হয়নি; বরং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন গড়ে তোলার জন্য কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে, কাজেই কুরআনকেই জীবনের একমাত্র পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

কুরআন তেলাওয়াতের অনেক ফজিলত বা তাতপর্য রয়েছে, তাই শুধু তেলাওয়াতের জন্য কুরআন নাযিল হয়নি। কুরআন বোঝার চেষ্টা করতে হবে। কুরআনের বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করতে হবে। কারণ সৃষ্টির নানা রহস্যের সমাধান রয়েছে আল্লাহ প্রদত্ত এই ঐশী মহাগ্রন্থে, তাই জ্ঞানী ব্যক্তিরা তা উদঘাটন করে মানবজাতির কল্যাণের পথ সুগম করতে পারেন। এই সূরার ৩য় আয়াতে বলা হয়েছে:

نَحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ أَحْسَنَ الْقَصَصِ بِمَا أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ هَذَا الْقُرْآَنَ وَإِنْ كُنْتَ مِنْ قَبْلِهِ لَمِنَ الْغَافِلِينَ

“হে রাসূল ! ওহীর মাধ্যমে তোমার নিকট যে কুরআন প্রেরণ করেছি তাতে উত্তম কাহিনী বর্ণনা করছি। এর পূর্বে অবশ্য তুমি সে সম্পর্কে জানতে না।” (১২:৩)

এই আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার রাসূলকে বলেছেন, আমি ওহী বা প্রত্যাদেশ বাণীর মাধ্যমে আপনাকে এই কুরআন দিয়েছি এবং এতে যে সব কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তা এই ঐশী মহাগ্রন্থেরই অংশ। মানুষ যদি কোনো ঐতিহাসিক ঘটনাকে শুধু কাহিনী বা গল্প শোনার মানসিকতা নিয়ে মূল্যায়ন না করে তাহলে অতীত ইতিহাস মানুষের জন্য শিক্ষা নেয়ার মূল্যবান উপাদান হয়ে উঠতে পারে।

কুরআনে বর্ণিত ঘটনাবলী সন্দেহাতীত সত্য যা বিজ্ঞানের এই যুগে প্রমাণিত হয়েছে। হযরত আলী (আ.) ঈমাম হাসান ও হোসাইনকে লেখা এক চিঠিতে বলেছেন, আমি অতীত নিয়ে এত পড়াশোনা করেছি যে, মনে হয়েছে, আমি যেন ঐ যুগে বসবাস করেছি। সে যাই হোক কুরআন অতীত ইতিহাস সম্পর্কে অনেক অস্পষ্টতা দূর করেছে। অনেক ক্ষেত্রে মিথ্যা অতিরঞ্জন এবং কল্পকাহিনী থেকে মুক্ত করে সঠিক ঘটনা মানবজাতির সামনে উপস্থাপন করেছে। এসব কারণে কুরআনকে উত্তম কাহিনী সম্ভার বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। এসব কাহিনীর মধ্যে হযরত ইউসুফ (আ.)-এর কাহিনী অন্যতম; যার বর্ণনা চিত্তাকর্ষক ও সবর্কালের মানুষের জন্যে শিক্ষণীয়। একজন পরিণত যুবক কিভাবে কু-প্রবৃত্তি এবং শয়তানের কু-মন্ত্রণা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে তারই জীবন্ত আদর্শ এই ঘটনায় ফুটে উঠেছে।