হাদীসে সাকালাইন

নবী (সা.) তাঁর আহলে বাইতের অনেক ফযিলতের কথা বর্ণনা করেছেন। তাঁর ঐ সব বর্ণনা আহলে বাইতকে তাঁর উম্মতদের মধ্যে অতি উচ্চ আসনে আসীন করেছে। এই ফযিলতগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কোরআন ও আহলে বাইতের একাত্মতা এবং তাদের মধ্যকার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। তাদের মধ্যে যে দৃঢ় বন্ধন রয়েছে তা কেয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। শিয়া সুন্নী সকলেই যে হাদীসের ব্যপারে একমত তা হাদীসে ‘সাকালাইন’ নামে পরিচিত। নবী করিম (সা.) এরশাদ করেছেন :

 إنّى تارِكٌ فِيكُمْ الثَقْلَيْنِ کِتَابَ اللهِ و عِتْرَتِی أَهْلَ بَيْتِی إنْ تَمَسَّکْتُمْ بِهِمَا لَنْ تَضِلُّوا أبَداً

‘আমি তোমাদের জন্য অতি মূল্যবান দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি। একটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব, অপরটি হচ্ছে আমার রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়, আমার আহলে বাইত। তোমরা যদি এ দুটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধর তবে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।’ এ হাদিসটি সামান্য শব্দের তারতম্যভেদে বিভিন্ন বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে- সহিহ মুসলিম, ৭ম খণ্ড, পৃ:-১২২, দারুল যিল, বৈরুত; সহিহ তিরমিযি, ৫ম খণ্ড, পৃ:-৬৬৩, বৈরুত; মুসনাদে আহমাদ, ৩য় খণ্ড, পৃ:-১৪, বৈরুত; কানযুল উম্মাল, ১ম খণ্ড, পৃ:-১৮৭;  মুসতাদরাকে হাকেম, ৩য় খণ্ড, পৃ:-১৪৮, বৈরুত।

এই হাদীসটি নবী করিম (সা.) এর অনেক বিশিষ্ট সাহাবী বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসটি মুতাওয়াতির (অসংখ্য) সূত্রে বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। অনেকেই উল্লিখিত হাদীসটি বিশেরও অধিক সংখ্যক সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসের প্রেক্ষাপট ও দলীল সমূহের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে নবী (সা.) এই কথাগুলি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর সাহাবা ও অনুসারীদের সামনে বলেছেন এবং আহলে বাইত ও কোরআনের মধ্যে যে দৃঢ় বন্ধন রয়েছে, তা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।

ইবনে হাজার হাইসামি (একজন প্রসিদ্ধ সুন্নী আলেম) এ ব্যাপারে বলেছেন যে, উল্লিখিত হাদীসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেরও অধিক সংখ্যক সাহাবী এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই হাদীসটি বিদায় হজ্জ্বের সময় অথবা আরাফার দিনে স্বয়ং নবীর মুখ থেকে শুনেছেন এবং বর্ণনা করেছেন । কেউ কেউ বলেছেন নবী (সা.) তাঁর অসুস্থতার সময় বেশ কিছু সংখ্যক সাহাবীর সমাবেশে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। অন্য দল বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সা.) তায়েফ থেকে ফেরার পর একটা বক্তৃতা দেন এবং সেখানেও এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

কোরআন এবং আহলে বাইতের মধ্যে বিদ্যমান চিরস্থায়ী ও দৃঢ় বন্ধনের পেছনে একটা সূক্ষ্ণ ঐশী পরিকল্পনা রয়েছে। কোরআনের কিছু কিছু আয়াত সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করেছে যে, সকল যুগের ঐশী বাণীসমূহ দুটো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিল। প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সবসময় আল্লাহর ঐশী বাণী সে যুগের নবীর মাতৃভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই ওহীর পাশাপাশি একজন নির্ভরযোগ্য মানুষ ছিলেন, যিনি আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী এবং যিনি আল্লাহর দ্বীনকে এর সকল দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তমরূপে বর্ণনা করতে পারেন, সেই সাথে অদৃশ্যেরও জ্ঞান রাখেন। অন্যদিকে ঐ ব্যক্তি পূর্ণ পবিত্রতার অধিকারী এবং কু প্রবৃত্তি ও শয়তানের প্ররোচনায় কখনও প্রভাবিত হন না। আল্লাহর ওহী প্রচার এবং প্রসারের দায়িত্ব ছাড়াও তা বর্ণনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন। আর অনুকূল পরিস্থিতিতে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা এবং ইসলামী বিধানকে প্রতিষ্ঠা করা, বিশ্বে ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির দায়িত্বও তারা পালন করে থাকেন। সর্বোপরি তারা হচ্ছেন ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির দিশারী।

আলোচ্য হাদীসটি থেকে যে বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে তা নিম্নরূপঃ

১. পবিত্র কুরআন যেভাবে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত মানব জাতির মাঝে টিকে থাকবে, মহানবী (সা.) এর পবিত্র আহলে বাইতও তেমনি কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবেন। অর্থাৎ এ বিশ্বের কোন যুগই ইমাম বা প্রকৃত নেতাবিহীন অবস্থায় থাকবে না।

২. বিশ্বনবী (সা.) মানব জাতির কাছে এই দু’টো অমূল্য আমানত গচ্ছিত রাখার মাধ্যমে তাদের সর্বপ্রকার ধর্মীয় ও জ্ঞানের চাহিদা মিটিয়েছেন এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে গেছেন। মহানবী (সা.) তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণকে (আ.) সকল প্রকার জ্ঞানের ভান্ডার হিসেবে মুসলমানদের মাঝে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন। মহানবী (সা.) তাঁর পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) যে কোন কথা ও কাজকেই নির্ভরযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন।

৩. পবিত্র কুরআন ও মহানবী (সা.)-এর পবিত্র আহলে বাইতকে অবশ্যই পরস্পর থেকে পৃথক করা যাবে না। মহানবী (সা.)-এর আহলে বাইতের পবিত্র জ্ঞানধারা থেকে মুখ ফিরিয়ে তাদের উপদেশ ও হেদায়েতের গন্ডি থেকে বেরিয়ে যাবার অধিকার কোন মুসলমানেরই নেই।

৪. মানুষ যদি পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) আনুগত্য করে এবং তাঁদের কথা মেনে চলে, তাহলে কখনোই তারা পথভ্রষ্ট হবে না। কেননা, তারা সর্বদাই সত্যের সাথে অবস্থান করছেন।

৫. মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় সর্বপ্রকার ধর্মীয় ও অন্য সকল জ্ঞানই পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) কাছে রয়েছে। তাই যারা তাঁদের অনুসরণ করবে, তারা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না, এবং তারা অবশ্যই জীবনের প্রকৃত সফলতা লাভ করবে অর্থাৎ পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.) সর্ব প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত ও পবিত্র।

এ থেকেই বোঝা যায় যে, পবিত্র আহলে বাইত বলতে মহানবী (সা.) এর পরিবারের সকল আত্মীয়বর্গ ও বংশধরকেই বোঝায় না। বরং পবিত্র আহলে বাইত বলতে নবী বংশের বিশেষ ব্যক্তিবর্গকেই বোঝানো হয়েছে। ইসলাম সম্পর্কে পূর্ণজ্ঞানের অধিকারী হওয়া এবং সর্বপ্রকার পাপ ও ভুল থেকে তাঁদের অস্তিত্ব মুক্ত ও পবিত্র হওয়াই ঐ বিশেষ ব্যক্তিবর্গের বৈশিষ্ট্য। যাতে করে তাঁরা প্রকৃত নেতৃত্বের গুণাবলীর অধিকারী হতে পারেন। ঐ বিশেষ ব্যক্তিবর্গ হচ্ছেনঃ হযরত ইমাম আলী ইবনে আবি তালিব (আ.) এবং তাঁর বংশের অন্য এগারোজন সন্তান। তাঁরা প্রত্যেকেই একের পর এক ইমাম হিসেবে মনোনীত হয়েছেন। একই ব্যাখ্যা মহানবী (আ.) এর অন্য একটি হাদীসে পাওয়া যায়।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেনঃ “আমি মহানবী (সা.) কে জিজ্ঞাস করলাম যে, আপনার যেসব আত্মীয়কে ভালবাসা আমাদের জন্যে ওয়াজিব, তাঁরা কারা? মহানবী (সা.) বললেনঃ ‘তাঁরা হলেন আলী, ফাতিমা, হাসান এবং হোসাইন।” (ইয়ানাবী-উল-মুয়াদ্দাহ্‌, ৩১১ নং পৃষ্ঠা।)

হযরত যাবির (রা.) থেকে বর্ণিত বিশ্বনবী (সা.) বলেছেনঃ “মহান আল্লাহ্‌ প্রত্যেক নবীর বংশকেই স্বীয় পবিত্র সত্তার মাঝে নিহিত রেখেছেন। কিন্তু আমার বংশকে আলীর মাঝেই সুপ্ত রেখেছেন।” (ইয়ানাবী-উল-মুয়াদ্দাহ্‌, ৩১৮ নং পৃষ্ঠা।)#আল-হাসানাইন