সূরা ইউসুফ; (৮ম পর্ব)

সূরা ইউসুফ; আয়াত ২৫-২৭

সূরা ইউসুফের ২৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَاسْتَبَقَا الْبَابَ وَقَدَّتْ قَمِيصَهُ مِنْ دُبُرٍ وَأَلْفَيَا سَيِّدَهَا لَدَى الْبَابِ قَالَتْ مَا جَزَاءُ مَنْ أَرَادَ بِأَهْلِكَ سُوءًا إِلَّا أَنْ يُسْجَنَ أَوْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

"(ইউসুফ ও মিশরের রাণী) উভয়ে দৌড়িয়ে দরজার দিকে গেল এবং মহিলা ইউসুফের জামা পেছন দিক থেকে ছিড়ে ফেলল,উভয়ে মহিলার স্বামীকে দরজার কাছে পেল। মহিলা (কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে) বলল,যে ব্যক্তি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে কুকর্মের ইচ্ছা করে তাকে কারাগারে পাঠানো অথবা অন্য কোনো যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেয়া ছাড়া তার আর কি শাস্তি হতে পারে?"(১২:২৫)

এর আগের আলোচনায় বলা হয়েছে, মিশরের রাণী জুলেখা হযরত ইউসুফের প্রতি ভীষণ আসক্ত হয়ে পড়েছিল এবং তার সঙ্গে পাপকর্মে লিপ্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ফন্দি-ফিকির করতে লাগলো। এক পর্যায়ে দরজা-জানালা বন্ধ এক নিভৃত্য ঘরে হযরত ইউসুফকে আটকিয়ে সে পাপ কাজে লিপ্ত হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করল। কিন্তু হযরত ইউসুফ (আ.) জুলেখার কুপ্রস্তাবে রাজী হলেন না। তিনি দৌড়ে সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু জুলেখা যখন তাকে পেছন থেকে ধরার চেষ্টা করে তখন ইউসুফের জামার পেছন দিক ছিড়ে যায়। অবশেষে হযরত ইউসুফ যখন দরজার কাছে পৌঁছে গেলেন তখন আল্লাহর বিশেষ রহমতে তালাবদ্ধ দরজা খুলে যায়। কিন্তু দরজা দিয়ে বের হতেই হযরত ইউসুফ ও রাণী জুলেখা উভয়েই মিশরের রাজাকে দেখতে পেলেন। রাজা দু’জনের হন্তদন্ত অবস্থা দেখে এর কারণ জানতে চাইলেন। কিন্তু হযরত ইউসুফ কিছু বলার আগেই বিচলিত জুলেখা সব দোষ হযরত ইউসুফের উপর চাপিয়ে দিলেন। জুলেখা রাজাকে বলল, ইউসুফ বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে তাই তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হোক বা অন্য কোনো কঠিন শাস্তি দেয়া হোক।

এই ঘটনা থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, পাপ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য শুধু মুখে আল্লাহর সাহায্য কামনা করে বসে থাকলে হবে না। সেখান থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে।

এই সূরার ২৬ ও ২৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

قَالَ هِيَ رَاوَدَتْنِي عَنْ نَفْسِي وَشَهِدَ شَاهِدٌ مِنْ أَهْلِهَا إِنْ كَانَ قَمِيصُهُ قُدَّ مِنْ قُبُلٍ فَصَدَقَتْ وَهُوَ مِنَ الْكَاذِبِينَ (26) وَإِنْ كَانَ قَمِيصُهُ قُدَّ مِنْ دُبُرٍ فَكَذَبَتْ وَهُوَ مِنَ الصَّادِقِينَ

"ইউসুফ বলল, (এই মহিলাই) আমার কাছ থেকে অসৎকর্ম কামনা করেছিল। মহিলার পরিবারেরই একজন সাক্ষ্য দিল, যদি ইউসুফের জামার সম্মুখভাগ ছেড়া থাকে তাহলে মহিলা সত্য কথা বলেছে এবং ইউসুফ মিথ্যাবাদী।” (১২:২৬)

“কিন্তু তার জামা যদি পিছন দিক হতে ছেড়া থাকে তাহলে মহিলা মিথ্যা কথা বলেছে এবং ইউসুফ সত্যবাদী।" (১২:২৭)

হযরত ইউসুফ জুলেখার অভিযোগ শুনে স্তম্ভিত হয়ে যান। তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বললেন, এই মহিলা মিথ্যা বলছে, সেই অনেক দিন যাবত আমার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু আমি কখনই তাকে প্রশ্রয় দেইনি। দু’জনের কথা শোনার পর রাজা ভীষণ দোটানায় পড়ে গেলেন। একদিকে নিজের স্ত্রীকেও অবিশ্বাস করতে পারছেন না অপর দিকে ইউসুফ একজন ভৃত্য হয়ে এতবড় সাহস করবে সেটাও তিনি মিলাতে পারছেন না। এমন এক অবস্থায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত রাজার এক উপদেষ্টা বিষয়টির একটি ফয়সালা বের করলেন। তিনি বললেন,ইউসুফ যদি অসৎ উদ্দেশ্যে জুলেখার দিকে গিয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই দু’জনের মধ্যে সংঘাত হয়েছে। যদি দু’জনের মধ্যে সংঘাত বা ধস্তাধস্তি হয়,আর সে কারণে যদি ইউসুফের জামা ছেড়ে তাহলে তা ছিড়বে সামনের দিকে। আর ইউসুফ যদি এ ঘটনায় দোষী না হয়ে থাকে তাহলে সে নিশ্চয়ই পালাবার চেষ্টা করেছে। এ অবস্থায় জামা ছিড়লে তা ছিড়বে পিছনের দিকে। এই বক্তব্যের পর হযরত ইউসুফ নির্দোষ প্রমাণিত হলেন এবং জুলেখা মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হলেন। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে,রাজার যে উপদেষ্টা এই ফয়সালার কথা বললেন তিনি জুলেখারই আত্মীয় ছিলেন।

হযরত ইউসুফ ও জুলেখার ঘটনা হযরত মরিয়মের ঘটনাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। হযরত মরিয়ম যখন অন্তঃসত্ত্বা হলেন তখন সমাজ তাকে অপবিত্রতার দায়ে অভিযুক্ত করেছিল। এমনকি এই অন্যায় অভিযোগে তাকে হত্যা করতে উদ্যোত হয়েছিল। কিন্তু আসলে হযরত মরিয়ম ছিলেন পবিত্রতম নারী। হযরত ইউসুফও ছিলেন পবিত্র ও কলংকমুক্ত। কিন্তু তাকেও কলংকিত করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহতালা তাদেরকে ষড়যন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করেছেন। তাদের পবিত্রতার বিষয়টি এমনভাবে প্রমাণ করেছেন যা জগতবাসীর জন্য স্মরণীয় ঘটনা হয়ে রয়েছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, হযরত ইউসুফের পুরো ঘটনায় দেখা যাবে তার জামা তিন জায়গায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রথমবার হলো যখন তাকে তার ভাইয়েরা কূপে ফেলে দিয়ে তার জামায় রক্ত মেখে বাবার কাছে নিয়ে যায়, কিন্তু যখন তার বাবা দেখলেন, ইউসুফের জামা সম্পূর্ণ অক্ষত তখন তিনি বাঘে খাওয়ার ঘটনা বিশ্বাস করতে পারেননি। দ্বিতীয় ঘটনা হচ্ছে, এখানে তিনি যেভাবে জুলেখার অপবাদ থেকে রক্ষা পেলেন, তৃতীয় ঘটনা (যা সূরার শেষ দিকে বলা হয়েছে) হযরত ইউসুফের জামা যখন তার পিতা ইয়াকুবের চোখের উপর রাখা হয় তখন তিনি দৃষ্টিশক্তি পুনরায় ফিরে পান।