ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোক প্রকাশের ইতিহাস

এখানে ইমামদের জীবদ্দশায় শোক পালনের নিশ্চিত প্রমাণ রয়েছে যার কিছু ঐতিহাসিক বর্ণনা তুলে ধরা হলো:

ঐতিহাসিক ইয়াকুবি তাঁর ‘তারীখ’ গ্রন্থে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকে উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামার অঝরে ক্রন্দনের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। উম্মুল মুমিনীন বলেন: "যেদিন হোসাইন শহীদ হন আমি আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে স্বপ্নে ধূলি ধুসরিত ও শোকে মূহ্যমান অবস্থায় দেখলাম। আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম: ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার এ অবস্থা কেন?’ তিনি বললেন: ‘আমার সন্তান হোসাইন ও তার আহলে বাইতকে আজ শহীদ করা হয়েছে। আমি এইমাত্র তাদের দাফন সম্পন্ন করে আসলাম।’

১. শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য বনি হাশেমের শোক প্রকাশ: ইমাম জাফর সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে: ‘কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পর বনি হাশেমের কোন নারী সুরমা ও মেহেদী ব্যবহার করে নি এবং বনি হাশেমের কোন ঘর থেকে খাবার রান্না করার চিহ্ন হিসেবে উনুন থেকে কোন ধোঁয়া বের হতে দেখা যায় নি, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইবনে যিয়াদ নিহত ও ধ্বংস হয়। কারবালার মর্মান্তিক ও রক্তাক্ত ঘটনার পর নিরবচ্ছিন্নভাবে আমাদের চোখে অশ্রু ছিল।’

২. ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর শোক প্রকাশ: ‘তীব্র শোক ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর ওপর এমন প্রভাব ফেলেছিল যে, তাঁর সমগ্র জীবন ছিল ক্রন্দনময়। তিনি তাঁর পিতা শহীদদের নেতার মুসিবতের জন্য সবচেয়ে বেশি অশ্রু ঝরিয়েছেন। তাঁর ভাই, চাচা, চাচাতো ভাই, ফুফু ও তাঁর বোনদের ভাগ্যে যা ঘটেছিল তা স্মরণ করে তিনি অঝোর ধারায় ক্রন্দন করতেন। এমনকি যখন তাঁর সামনে পান করার জন্য পানি নিয়ে আসা হতো তখন তিনি পানি দেখে ক্রন্দন শুরু করে দিতেন এবং বলতেন: ‘কিভাবে পান করব যখন রাসূল (সা.)-এর সন্তানদের পিপাসার্ত অবস্থায় শহীদ করা হয়েছে।’

আর তিনি বলতেন: ‘যখনই আমার দাদী ফাতিমা যাহরা (আ.)-এর সন্তানের শাহাদাতের কথা স্মরণ হয় তখনই আমার কান্না পায়।’

ইমাম সাদিক (আ.) তাঁর অন্যতম সাহাবী যুরারাকে বলেছেন: ‘আমার দাদা আলী ইবনুল হোসাইন (আ.) যখনই হোসাইন ইবনে আলী (আ.)-কে স্মরণ করতেন তখন এত বেশি ক্রন্দন করতেন যে, তাঁর দাড়ি ভিজে যেত ও তার ক্রন্দন দেখে উপস্থিত ব্যক্তিরাও ক্রন্দন করত।’

৩. ইমাম বাকির (আ.)-এর শোক প্রকাশ: ইমাম বাকির (আ.) আশুরার দিন ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠানের আয়োজন করতেন ও তাঁর ওপর মুসিবতের কথা স্মরণ করে ক্রন্দন করতেন। এ রকম কোন একটি শোকানুষ্ঠানে ইমাম বাকিরের উপস্থিতিতে কুমাইত নামক একজন কবি কবিতা পাঠ করেন। যখন কবিতা পাঠ করার এক পর্যায়ে এ অংশে এসে পৌঁছেন «قتيل بالطف» অর্থাৎ ‘তাফের ভূমিতে নিহত’, ইমাম (আ.) এ অংশ শোনামাত্র কান্নায় ভেঙে পড়লেন এবং তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন: ‘হে কুমাইত! এই কবিতার পুরস্কার হিসেবে আমার কাছে কোন সম্পদ থাকলে তোমাকে পুরস্কৃত করতাম। কিন্তু তোমার পুরস্কার হিসেবে ঐ দোয়াটি করব যা রাসূল (সা.) হাস্সান ইবনে ছাবিত সম্পর্কে করেছেন। আর দোয়াটি হলো: ‘আমাদের আহলে বাইতের পক্ষ সমর্থন ও তাদের প্রতিরক্ষা করার জন্য যখনই পদক্ষেপ নেবে তখনই রুহুল কুদ্‌সের (পবিত্র আত্মার) সমর্থন ও সহায়তা লাভ করবে।’

৪. ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর শোক প্রকাশ: ইমাম মূসা কাযিম (আ.) বলেন: "যখনই পবিত্র মুহররম মাস আসত, আমার পিতা ইমাম বাকির (আ.) আর হাসতেন না; বরং দুঃখ ও শোক তাঁর চেহারাতে স্পষ্ট হয়ে উঠত। তাঁর গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত। এভাবেই আশুরার দিন উপনীত হতো, এই মুসিবতের দিনে ইমামের দুঃখ ও শোক সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছত। তিনি বিরামহীনভাবে ক্রন্দন করতেন এবং বলতেন: ‘আজকে এমন একটি দিন যে দিন আমার দাদা হোসাইন ইবনে আলী শাহাদাত বরণ করেছেন’।”

৫. ইমাম মূসা কাযিম (আ.)-এর শোক প্রকাশ: ইমাম রেযা (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন: ‘যখন পবিত্র মুহররম মাস আসত তখন আমার পিতা মূসা কাযিম (আ.)-কে কেউ হাসতে দেখত না; এভাবে চলতে থাকত আশুরার দিন পর্যন্ত; এ দিনে দুঃখ-শোক, মর্মপীড়া-মুসিবত আমার পিতাকে ঘিরে ধরত; তিনি ক্রন্দন করতেন এবং বলতেন: ‘এ দিনে হোসাইন (আ.)-কে হত্যা করা হয়েছে।”

৬. ইমাম রেযা (আ.)-এর শোক প্রকাশ: ইমাম রেযা (আ.)-এর ক্রন্দন এত বেশি পরিমাণ ছিল যে, তিনি বলতেন: ‘ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মুসিবতের দিন আমাদের চোখের পাতাকে আহত করেছে, আমাদের অশ্রুধারা প্রবাহিত করেছে।’

বিশিষ্ট শিয়া কবি দেবেল খুজায়ী ইমাম রেযার নিকট আসলেন। ইমাম রেযা ইমাম হোসাইনের জন্য ক্রন্দন ও শোকের কবিতার গুরুত্ব তুলে ধরে বললেন: ‘হে দেবেল! যে ব্যক্তি আমার দাদার মুসিবতে ক্রন্দন করে আল্লাহ তা‘আলা তার গুনাহসমূহকে ক্ষমা করে দেন।’ অতঃপর তাঁর পরিবার ও উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে পর্দা টেনে দিলেন যাতে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর মুসিবতে তাঁরা ক্রন্দন করতে পারেন।

অতঃপর ইমাম রেযা (আ.) দেবেল খুজায়ীকে বললেন: ‘যতদিন জীবিত থাকবে ইমাম হোসাইনের জন্য শোকগাথা পাঠ কর। যতক্ষণ তোমার শারীরিক শক্তি থাকবে ততক্ষণ আমাদেরকে সহযোগিতা করতে কার্পণ্য কর না।’ এ কথা শুনে দেবেল খুজায়ী ক্রন্দনরত অবস্থায় নিম্নোক্ত কবিতাটি পাঠ করেছিলেন:

‘হে ফাতিমা! যদি হোসাইনকে কারবালার যমিনে পড়ে থাকতে দেখতেন; যিনি ফুরাত নদীর তীরে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন।

তখন অত্যধিক দুঃখ ও কষ্টের কারণে নিজের হাত দিয়ে মুখ চাপড়াতেন এবং আপনার গাল দিয়ে চোখের পানি প্রবাহিত হতো।’

এ কবিতা শুনে ইমাম রেযা (আ.) ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন শুরু করলেন।

৭. ইমাম মাহদী (আ.)-এর শোক প্রকাশ: রেওয়ায়াত অনুসারে ইমাম মাহদী (আ.) (আল্লাহ তাঁর আগমনকে ত্বরান্বিত করুন) আত্মগোপনকালীন এবং আত্মপ্রকাশের পর উভয় অবস্থায় তাঁর দাদার শাহাদাতের জন্য ক্রন্দন করছেন এবং করবেন। তিনি তাঁর সম্মানিত পিতামহ শহীদদের নেতা ইমাম হোসাইন (আ.)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন:

‘যদিও সময় আমাকে পশ্চাদ্বর্তী করেছে এবং আপনাকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে ভাগ্য আমাকে দূরে রেখেছে যে কারণে আপনার প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ পোষণকারীদের বিরুদ্ধে আমি যুদ্ধ করতে পারি নি, কিন্তু এখন প্রত্যেক সকাল-সন্ধ্যা আপনার জন্য ক্রন্দন করি এবং আপনার মুসিবতে আমার দু’চোখ থেকে অশ্রুপাতের বদলে রক্ত বর্ষিত হয়। আপনার ওপর ঘটে যাওয়া মুসিবত আমার হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করেছে।’১০

ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান তাঁর শাহাদাতের সময় থেকে চালু হয়েছিল, তবে আলে-বুইয়া বংশ ক্ষমতায় আসার (৩৫২ হিজরি) পূর্ব পর্যন্ত এই শোকানুষ্ঠান গোপনে অনুষ্ঠিত হতো।১১ চতুর্থ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান প্রকাশ্য ছিল না; বরং গৃহসমূহে গোপনে পালিত হতো। কিন্তু চতুর্থ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে শোকানুষ্ঠান অলিতে-গলিতে সর্বত্র প্রকাশ্যে পালিত হতো। সাধারণতভাবে মুসলিম ঐতিহাসিকরা বিশেষ করে যাঁরা সারা বছরের বিভিন্ন ঘটনাকে ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁরা ৩৫২ হিজরি ও তার পরবর্তী বছরগুলোর ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আশুরার দিনে শিয়াদের শোকানুষ্ঠান পালন সম্পর্কে লিখেছেন। এদের মধ্যে ইবনে জাওযির ‘মুনতাজেম’, ইবনে আসিরের ‘কামিল’, ইবনে কাসিরের ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’, ইয়াফেয়ীর ‘মিরআতুল জিনান’ গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য, এছাড়াও যাহাবী ও আরো অনেকে এ সম্পর্কে লিখেছেন।

ইবনে জাওযি বর্ণনা করেছেন: ৩৫২ হিজরিতে মুইয্যুদ্দৌলা দায়লামী জনগণকে আশুরার দিনে একত্র হয়ে শোক প্রকাশের নির্দেশ দেন। এ দিনে বাজারগুলো বন্ধ থাকত, কেনা-বেচা হতো না; কসাইরা ভেড়া, দুম্বা জবাই করত না, হালিম রান্না করত না। জনসাধারণ পানি পান করত না, বাজারগুলোতে তাঁবু টাঙ্গানো হতো ও শোক প্রকাশের নিয়ম অনুসারে তাঁবুগুলোতে চট ঝুলানো হতো, নারীরা তাদের মাথা ও মুখ চাপড়ে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোক প্রকাশ করতেন।১২

হামাদানীর বর্ণনা অনুসারে: এদিনে নারীরা অগোছালো চুলে শোক প্রকাশের প্রথা অনুযায়ী নিজেদের চেহারাকে কালো করত ও গলিতে পথ চলত এবং ইমাম হোসাইন (আ.)-এর শোকে নিজেদের চেহারায় আঘাত করত।

শাফেয়ীর বর্ণনা অনুসারে: প্রথম বারের মতো কারবালার শহীদদের জন্য প্রকাশ্যে শোক প্রকাশের ঘটনা ছিল এটা। ইবনে কাসির ৩৫২ হিজরির ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, সুন্নিরা শিয়াদের এ কাজে বাধা দিত না। কেননা, শিয়ারা সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল এবং সরকারও তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করত।

৩৫২ হিজরি থেকে পঞ্চম হিজরি শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত আলে বুইয়া শাসকরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। এ সময়ে বেশির ভাগ বছরগুলোতে উল্লিখিত রীতি অনুসারে সামান্য পরিসরে হলেও শোকানুষ্ঠান পালন করা হতো। যদি আশুরার দিন ও ইরানী নববর্ষ বা ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অধিবাসীদের শরৎকালীন ফসলী নববর্ষের প্রাচীন উৎসব একই সময়ে পড়ত, সেক্ষেত্রে আশুরার সম্মানে প্রাচীন নববর্ষের আনন্দ উৎসবকে দেরিতে উদ্যাপন করত।

এই বছরগুলোতে ফাতিমী ও ইসমাইলী সম্প্রদায় সবেমাত্র মিশরে ক্ষমতা দখল করে কায়রো শহরকে নির্মাণ করেছিল এবং তারাই আশুরার শোকানুষ্ঠানকে মিশরে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। মাকরিজীর লিখিত দলিল অনুসারে: ৩৬৩ হিজরির আশুরার দিনে শিয়াদের একটি দল প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ইমাম হাসান (আ.)-এর এর দুই কন্যাসন্তান সাইয়্যেদা কুলছুম ও সাইয়্যেদা নাফিছার দাফনস্থলে যেতেন এবং এই দু’টি পবিত্র স্থানে ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকগাথা পাঠ ও ক্রন্দন করতেন (এই বাক্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, উল্লিখিত অনুষ্ঠান এর পূর্বের বছরগুলোতেও যথারীতি প্রচলিত ছিল)। ফাতিমীদের শাসনকালে আশুরার অনুষ্ঠান যথারীতি প্রতি বছর পালিত হতো। এ কারণে বাজারগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হতো; জনসাধারণ সমবেত হয়ে কারবালার শোকাবহ কথা স্মরণ করে শোকগাথা পাঠরত অবস্থায় কায়রোর জামে মসজিদে যেত।

এর পরে মিশরে শিয়াদের বিচ্ছিন্নতা ও সমাজের সাথে সংশ্রবহীনতার কারণে শোকানুষ্ঠান অতটা প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত হতো না। যদিও শোকানুষ্ঠান আলে বুইয়ার শাসকদের পূর্বের অবস্থার চেয়ে উত্তম ছিল। কিছু সূত্র থেকে প্রমাণিত হয় ইরানের সাফাভী শাসনের প্রতিষ্ঠার পূর্বেও ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠান পালন করা হতো। বিশেষ ভাবে কাশেফীর গ্রন্থ ‘রওজাতুশ শুহাদা’র বর্ণনা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। ইরানের সাফাভীদের আমলে শিয়া মাযহাবের প্রসারের কারণে শোকানুষ্ঠান সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ও প্রকাশ লাভ করে।

শিকল মারা ও বুক চাপড়ানো কোন্ জাতি এবং কোন্ সংস্কৃতি থেকে উৎপত্তি ঘটেছে?

উত্তর: শিকল মারার সংস্কৃতি ভারত ও পাকিস্তান থেকে ইরানে এসেছে। সেখানে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি এমনভাবে শিকল দিয়ে নিজেকে আঘাত করে শোক প্রকাশ করে যে, তাদের শরীরে ক্ষত সৃষ্টি ও রক্ত বের হয়। এ কারণে কিছুসংখ্যক আলেম এ বিষয়টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। যদি এ বিষয়টি এমনভাবে পালন করা হয় যেখানে শরীরে কোন ক্ষত সৃষ্টি হবে না ও বুদ্ধিবৃত্তির দৃষ্টিতে তা অপছন্দনীয় নয় অথবা তা আশুরার শিক্ষার অবমাননার কারণ না হয় তাহলে এ ধরনের শোক প্রকাশের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা নেই। যেহেতু ইরানের জনগণ বিশেষভাবে শিকল মারার ক্ষেত্রে শোক প্রকাশের কাক্সিক্ষত মর্যাদা রক্ষা করে চলে সেহেতু এ ধরনের শোক প্রকাশ প্রচলিত রয়েছে।

‘বুক চাপড়ানো’ শোক প্রকাশের একটি প্রথা হিসেবে পূর্ব থেকে আরবদের মাঝে প্রচলিত ছিল এবং পরে এই বিষয়টি সর্বজনীন রূপ লাভ করেছে। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা বলেন: যখন আল্লাহর রাসূল (সা.) ইন্তেকাল করলেন আমি কিছুসংখ্যক নারীকে সাথে নিয়ে সমবেতভাবে করুণ স্বরে ক্রন্দন করছিলাম এবং মাথা ও বুক চাপরাচ্ছিলাম।’ (মুসনাদে আহমাদ, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৩৯০, হাদিস ২৫৮১৬; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৪৫৬৮। তাই গুরুগম্ভীর শোক-গাথা পাঠের সাথে বিশেষ ছন্দে বুক চাপড়িয়ে শোকপ্রকাশ প্রথমে ব্যক্তিগতভাবে প্রচলিত ছিল, কিন্তু পরে যখন সাফাভীদের সময় প্রকাশ্যে শোক প্রকাশের প্রসার ঘটেছিল তখন শোকানুষ্ঠান ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সামষ্টিক ও সামাজিক রূপ লাভ করেছিল।

তাজিয়া (تعزيه) পারিভাষিক অর্থে আশুরার হৃদয়বিদারক ঘটনাকে অভিনয়ের মাধ্যমে চিত্রায়ন করাকে বোঝায়। প্রথম করিম খাঁন যান্দ এবং সাফাভীদের শাসনকালে বাহ্যত ইরানে এ ধরনের শোক প্রকাশের প্রচলন ঘটে এবং তা নাসির উদ্দিন শাহের সময় ব্যাপক প্রসার লাভ করে। ইউরোপ সফরে গিয়ে নাসির উদ্দিন শাহ থিয়েটার বা মঞ্চ নাটক দেখেছিলেন। তিনিই পরবর্তীকালে অন্যদেরকে আশুরার ঘটনাকে বাস্তব রূপ দানের উদ্দেশ্যে নাট্যরূপে উপস্থাপনে উৎসাহিত করেছিলেন। স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, তাজিয়া (অভিনয়ের মাধ্যমে কারবালার ঘটনাকে চিত্রায়িত করা) শুধু ইরানের সংস্কৃতি হিসেবে প্রচলিত ছিল না, অন্যান্য মুসলিম দেশ ও শিয়া অঞ্চলেও এ সংস্কৃতির প্রচলন ছিল। বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাস ও বিভিন্ন উপকরণ ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তা করা হতো। বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানে এ ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন ছিল।#আল-বাসাইর

তথ্যসূত্র:

১. তারীখে ইয়াকুবি, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪৬, সুয়ূতি, তারীখুল খোলাফা, পৃ, ২০৮, ইবনে আব্বাস সূত্রেও অনুরূপ বর্ণনা এসেছে : মুসনাদে আহমাদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮৩ ও আল-মুসতাদরাক, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩৯৭। স্বয়ং আল্লাহর রাসূল জিবরাইল (আ.) থেকে ইমাম হোসাইনের শাহাদাতের খবর (ভবিষ্যদ্বাণী) শুনে ক্রন্দন করেছেন। দ্রষ্টব্য : মুসনাদে আহমাদ, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮৪ ও ৬৪৮; মুসনাদে আবি ইয়ালা, ১ম খণ্ড, পৃ. ২০৬, হাদীস ৩৫৮; আল-মুসতাদরাক আলাস সাহিহাইন, ৩য় খণ্ড, পৃ, ১৭৬ ও ১৭৯; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, ৯ম খণ্ড, পৃ, ১৭৯; আসসাওয়ায়েকুল মুহরিকা, পৃ. ১১৫, অন্য সংস্করণে পৃ. ১৯৬; ইবনে সাব্বাগ মালেকী, আল-ফুসুলুল মুহিম্মাহ, পৃ. ১৫৪; কানযুল উম্মাল, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২২৩; নাসায়ী, খাসায়িসুল কুবরা, ২য় খণ্ড, পৃ. ১২৫; তারীখে ইবনে কাসির, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৩০ ও ৮ম খণ্ড, পৃ. ১৯৯, মাকতালে খাওয়ারেযমি, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৫৯ ও ১৬৩; ইবনে আছাম, আল-ফুতুহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৩২৫।

২. বিহারুল আনওয়ার, ৪৪তম খণ্ড, পৃ. ১৪৬।

৩. বিহারুল আনওয়ার, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৩১।

৪. বিহারুল আনওয়ার, ৪৫তম খণ্ড, পৃ. ১৩১।

৫. মিসবাহুল মুতাহাজ্জেদ, পৃ. ৭১৩।

৬. ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইন (আ.), পৃ. ১৪৩।

৭. হোসাইন, নাফ্‌সুন মুতমাইন্নাহ্, পৃ. ৫৬।

৮. বিহারুল আনওয়ার, ৪৪তম খণ্ড, পৃ. ২৮৪।

৯. বিহারুল আনওয়ার, ৪৫তম খণ্ড, পৃ. ২৫৮।

১০. বিহারুল আনওয়ার, ১০১তম খণ্ড, পৃ. ৩২০।

১১. কারণ, বনি উমাইয়া, বনি যুবাইর ও বনি আব্বাসের শাসকরা মহানবী (সা.)-এর বংশধরদের ওপর চরম নির্যাতন চালাত এবং তাদের সবধরনের তৎপরতা ও কর্মকাণ্ডকে তীক্ষè নজরে রাখত। ইমাম হোসাইন (আ.)-এর জন্য শোকানুষ্ঠানের আয়োজন একদিকে তাদের অন্যায়-অবিচারকে প্রকাশ, অন্যদিকে আহলে বাইতের অধিকারকে প্রমাণ করত যা তাদের শাসনের জন্য হুমকি বলে বিবেচিত হতো। তাই তারা এধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনে কঠোরভাবে বাধা দিত। কঠোরতার দিক থেকে মুতাওয়াক্কিল সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এমনকি সে ইমাম হোসাইনের মাযারকে মাটিতে মিশিয়ে দেয় ও সেখানে চাষের জন্য নির্দেশ দেয়। (ইবনে আসির, আল-কামিল ফিত তারীখ, ৭ম খণ্ড, পৃ. ৩৬-৩৭)। এক্ষেত্রে উমাইয়া খলিফা উমর ইবনে আবদুল আজীজ ও আব্বাসী খলিফা নাসির বিল্লাহ ও মুনতাসির ব্যতিক্রম ছিলেন।

১২. আল-মুনতাজাম ফি তারিখিল মুলুক ওয়াল উমাম, ৭ম খণ্ড, পৃ. ১৫।