ভারতীয় নও মুসলিম জাহরা সুজা খানি

ইসলামের অন্যতম বড় আকর্ষণ হল এর বাণীর গ্রহণযোগ্যতা বা জনপ্রিয়তা এবং স্পষ্ট অর্থ। ইসলাম নিজেকে প্রকৃতির ধর্ম ও বিবেকের ধর্ম বলে মনে করে। আর এ জন্যই পবিত্র অন্তরের অধিকারী ব্যক্তি ও চিন্তাশীলদেরকে আকৃষ্ট করে এ মহান ধর্ম।
 
ইসলাম ধর্মের উদ্দেশ্য হল একত্ববাদী মানুষের মধ্যে ইসলামী ও মানবীয় গুণাবলী বিকশিত করা। এভাবে এ মহান ধর্ম মানুষের ব্যক্তিত্বের নানা দিককে পূর্ণতা দান করে এবং সৃষ্টির রহস্য তুলে ধরে মানুষের কাছে।
 
ইসলাম মানুষের সত্তার প্রত্যেক দিক ও তাদের ইচ্ছা বা ঝোঁকগুলোকে গুরুত্ব দেয়। মানুষের স্বাভাবিক বা বৈধ চাহিদাগুলোকে অন্য কোনো চাহিদার জন্য বিসর্জন দেয় না ইসলাম। পবিত্র কুরআন মানুষের মধ্যে এমন বিশ্বাস বা ঈমানকে বদ্ধমূল করে যা মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক- উভয় জীবনেই কল্যাণ বয়ে আনে। এভাবে ইসলাম সমাজ ও ধর্মকে সমন্বিত করে। আর এ কারণেই ইসলামের বাণী ও বক্তব্যগুলো যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্ম ও মতাদর্শের লোককে আকৃষ্ট করছে।  ভারতীয় নও-মুসলিম ‘জাহরা সুজা খানি' এমনই এক ব্যক্তিত্ব।
 
 
‘জাহরা সুজা খানি' ছোটবেলা থেকেই ছিলেন সত্য-সন্ধানী। আর এই প্রচেষ্টার পুরস্কার হিসেবে তিনি ইসলামের মহাসত্যকে বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, "আমার আগের নাম ছিল নিনা। বর্তমান নাম জাহরা সুজা খানি। আমি জন্ম নিয়েছি এমন এক দেশে যেখানে রয়েছে হাজার হাজার কল্পিত খোদা। আমার পরিবার ছিল জরাথ্রুস্ত ধর্মের অনুসারী। আমার পরিবারে চিন্তার স্বাধীনতার সুযোগ ছিল। এ পরিবারটি অত্যন্ত সম্পদশালী ও সচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও আমি সুখী ছিলাম না। আমি শৈশবেই মাকে প্রশ্ন করেছিলাম কেন যে কেউ আমাদের জরাথ্রুস্ত ধর্ম গ্রহণ করতে পারে না? কেন একজন জরথুস্তকে জন্মগতভাবেই জরথুস্ত হতে হয়? আমাদের খোদাকে বলা হয় আহুরা মাজদা এবং জরথুস্ত ছাড়া আমাদের উপাসনালয়ে অন্য কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ। অথচ আমাদের আশপাশে মসজিদ ও মন্দিরগুলোতে সবাইই অবাধে যাতায়াত করতে পারত। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ২/৩ মাসের জন্য খ্রিস্টান হব, এরপর ২ মাসের জন্য হিন্দু ও এভাবে একের পর এক অন্য ধর্মগুলোর অনুসারী হব। এরপর মুসলমান হওয়ার পালা। এক মুসলমান প্রতিবেশী আমাকে নামাজ শেখার বই উপহার দিলেন। সে সময় আমার বয়স ও জ্ঞান দুইই অনেক কম হওয়া সত্ত্বেও ইসলামকেই আমি শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে দেখতে পেয়েছিলাম।"
 
এভাবে নও-মুসলিম জাহরা সুজা খানি খুব দ্রুত ইসলামের গভীর অনুরাগী হয়ে পড়েন। তিনি সে সময়ই হিজাব বা পর্দা করতে থাকেন এবং ইসলাম সম্পর্কে আরো ব্যাপক পড়াশুনায় মশগুল হন। তিনি বলেছেন, " সে সময় টেলিভিশনে মডেল হওয়ার অনেক প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু অন্য অনেক তরুণীর মত খ্যাতি ও বিপুল অর্থের মোহ আমাকে আক্রান্ত করেনি দেখে আমার বাবা-মাও বিস্মিত হন।  মডেল হওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব এবং আমি আমার হিজাব অব্যাহত রাখব বলে বাবা-মাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলাম। আজ অনেক বছর পরও দেখছি যে আমার যেসব বান্ধবী মডেল হয়েছিলেন তারা অনেক অর্থ ও খ্যাতির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এখনও নিজের ভেতরে কি যেন খুঁজে বেড়ান। তারা সত্যের সন্ধান পাননি। কিন্তু আমি হিজাব বেছে নিয়ে সন্তুষ্ট ও আনন্দিত। আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি একবারও এ ব্যাপারে একবারও অনুতপ্ত হইনি।"
 
 
নও-মুসলিম জাহরা সুজা খানি মুসলমান হওয়ার ঘোষণা দিলে তার বাবা মা অসন্তুষ্ট হন। এ সময় পারিবারিক বাধার কারণে নিজের লক্ষ্যগুলোতে উপনীত হওয়া তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। সুজা খানি বলেছেন, "মূল সমস্যা আর যুদ্ধটা শুরু হল পরিবারের ভেতরেই।  প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বোঝানো হচ্ছিল আমাকে। কিন্তু উপদেশে যখন কোনো কাজ হল না তখন তারা ইসলাম সম্পর্কে নানা অপপ্রচার বা অপবাদ তুলে ধরছিলেন। দেখা গেল পরিবারে যে স্বাধীন  পরিবেশ ছিল তা আমার জন্য সীমিত ও শর্তযুক্ত হয়ে গেল।"
 
শেষ পর্যন্ত সুজা খানির দৃঢ় ঈমান ও বিশ্বাস সুফল বয়ে আনে এবং তার গোটা পরিবার ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি মেনে নেয়। ৭ বছর ধরে প্রবল প্রতিরোধ ও ইসলামের ওপর অবিচল থাকার কারণে  পরিবারের ওপর বিজয়িনী হন সুজা। মুক্তভাবে বা অবাধে নামাজ ও কুরআন পড়ার এবং পর্দা করার অনুমতি পান তিনি। তাকে তার ইচ্ছেমত পত্র-পত্রিকা পড়ারও সুযোগ দেয়া হয়।
বেগম সুজা খানি বলেছেন,
 
"আমার আত্মা ছিল সত্যের প্রতীক্ষায় শুকনো মরুভূমির মত তৃষ্ণার্ত। তাই প্রাণভরে তৃষ্ণা মিটিয়ে নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছিল।  আর এ জন্য দরকার ছিল সময় ও অনুরাগ। সৌভাগ্যক্রমে এ দুই-ই আমার মধ্যে ছিল ব্যাপক মাত্রায়।  ইসলাম সম্পর্কে যত বেশি সম্ভব জানার জন্য বেশি বেশি পড়াশুনা ও গবেষণা করছিলাম। আমার অন্তরাত্মা ও প্রকৃতি যেন এ জন্য প্রস্তুত ছিল। আর এটাও মহান আল্লাহর এক বড় অনুগ্রহ। ব্যাপক পড়াশুনার সুবাদে বুঝতে পারলাম যে ইসলামই সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যময় ও উন্নত ধর্ম।"
 
একত্ববাদ হল ইসলামের প্রাণ যা গভীরভাবে আকৃষ্ট করে সত্য-সন্ধানীদের। নও-মুসলিম সুজা খানিও এর ব্যতিক্রম নন। অন্য অনেক ধর্মে একত্ববাদের কথা এসেছে। কিন্তু বেগম সুজার মতে একত্ববাদকে সবচেয়ে ভালভাবে তুলে ধরছে ইসলাম এবং ইসলামী বিধি-বিধানগুলো হুবহু মানুষের প্রকৃতির অনুরূপ।  তিনি মনে করেন, ইসলাম মানুষের ব্যক্তিত্বকে উপলব্ধি করে বলে এ ধর্ম চর্চার মাধ্যমে মানুষ নিজের ব্যক্তিত্বকে ও নিজেকে বুঝতে পারে খুব ভালভাবে। এইসব উপলব্ধি ইসলামের প্রতি জাহরা সুজাখানির ভালবাসাকে করেছে অতলান্ত-গভীর।  শৈশব থেকেই যেসব প্রশ্নের জবাব তিনি খুঁজতেন সেসবেরই নির্ভুল জবাব তিনি পেয়েছেন ইসলামের মধ্যে।
 
এভাবে যতই দিন যাচ্ছে ততই বেগম সুজা খানির কাছে মনে হচ্ছে, যে ইসলামকে তিনি জানতেন তার চেয়েও অনেক বেশি বড় ও মহান এই ধর্ম।
 
সমাজ-বিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী নওমুসলিম বেগম সুজা খানি মনে করেন ইসলামের বিধি-বিধানগুলো অত্যন্ত উন্নত। তিনি বলেছেন, "ইসলাম চোখ, কান ও ইন্দ্রিয়গুলোকে খুবই সতর্ক রাখতে বলে। অনেক সময় এমন মনে হতে পারে যে, সামান্য সময়ের হারাম দৃষ্টি ও ছোটখাট হারাম কোনো কাজ তেমন গুরুতর ব্যাপার নয়। কিন্তু বাস্তবে এইসব পাপ মানুষের আত্মার মধ্যে একটি বীজের মতই বিকশিত হতে থাকে। এইসব শিক্ষা ও মনস্তত্ত্ব বহু বছর আগে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বর্ণনা করেছেন বিশ্বনবী (সা.)। অথচ পশ্চিমারা অতি অধুনা এসব বুঝতে শুরু করেছেন। ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা মানুষকে প্রফুল্ল করে ও সব ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনে। এ ধর্ম পার্থিব জীবনে মানুষের করণীয় কাজগুলো কিভাবে সঠিকভাবে সম্পন্ন হতে পারে তা জানিয়ে দেয়।  বিশ্বনবী (সা.)এর আহলে বাইতের অনুসরণ মুসলমানকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত করে। অজু করা, নামাজ পড়া, দাঁত মাজা, ইত্যাদির রয়েছে নানা আদব-কায়দা। এসবই বিশ্বজগতের সঙ্গে বন্ধনের সুন্দরতম মুহূর্ত। এসবের মধ্যে রয়েছে জানার অনেক কিছু বা জ্ঞানের নতুন কিছু দিক ।"
 
 মরহুম ইমাম খোমেনী (র.)এর আধ্যাত্মিক ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিল ইসলামের প্রতি জাহরা সুজার আগ্রহ সৃষ্টির আরেকটি বড় কারণ। তার মতে ইমামের আন্দোলন ছিল অনেক বড় ও তেজোদৃপ্ত আন্দোলন। এই মহান ব্যক্তিত্বের বরকতময় অস্তিত্ব বহু অমুসলমানকে ইসলামের প্রতি ও ইসলামী বিপ্লবের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। জাহরা সুজা মনে করেন তার জীবন তথা ইসলামী জীবনের জন্য তিনি ইমাম খোমেনী (র.)এর কাছে ঋণী। ইমাম না থাকলে তিনি আজ কোন্ অন্ধকার জগতে থাকতেন তা ভেবে শিহরিত হন এই নওমুসলিম নারী।
 
এক সময়কার অগ্নি উপাসক ও বর্তমান নওমুসলিম এই নারী মনে করেন মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) বর্তমান যুগে  সত্যিকারের আদর্শ মুসলমানের দৃষ্টান্ত। জাহরা  সুজা বলেছেন, “তবে আমরা এখনও মরহুম ইমাম খোমেনী (র.)-কে চিনতে পারিনি। তিনি যখন বলতেন, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই তথা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তখন তা সত্যিকার অর্থেই বলতেন। কিন্তু আমাদের অবস্থা এমন নয়। আমরা মাঝে মধ্যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুর ওপর ভরসা করি।  আমাদের মন বাঁধা রয়েছে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে। অথচ মরহুম ইমাম খোমেনী (র.) গোটা বিপ্লব ও সাদ্দামের সঙ্গে যুদ্ধকালীন সময়ে এক মুহূর্তের জন্যও বাস্তবতা থেকে বিচ্যুত হননি, বরং সত্যের পথে অবিচল থেকেছেন ও কেবল আল্লাহর ওপরই নির্ভর করেছেন।(রেডিও তেহরান)