কারবালার কালজয়ী মহাবিপ্লব-(তিন)

ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়াকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানানোর পর হযরত ইমাম হুসাইন (আ) পবিত্র মদীনা থেকে মক্কার দিকে রওনা হন। নবী-পরিবারের সদস্য হিসেবে তিনি এ সম্পর্কেও ব্যাখ্যা দেন যে কেনো ইয়াজিদের মত চরম পাপিষ্ঠ ও অনাচারী ব্যক্তিকে খলিফা হিসেবে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। ইমাম যে ক্ষমতার লোভী ও নৈরাজ্যকামী নন তা তুলে ধরার জন্য একটি ওসিয়তনামাও লিখে যান। সেই ওসিয়ত-নামায় একত্ববাদ বা তাওহিদ, নবুওয়ত, পরকাল ও এই সফর সম্পর্কে নিজের চিন্তাধারা এবং বিশ্বাস তুলে ধরে ইমাম হুসাইন (আ) লিখেছিলেন: 'আমি আত্মকেন্দ্রীকতা কিংবা আরাম-আয়েশের জন্য অথবা দুর্নীতি ও জুলুম করার জন্য মদীনা থেকে বের হয়ে যাচ্ছি না, বরং আমার এই সফরের উদ্দেশ্য হল সৎ কাজের আদেশ দেয়া ও অসৎ কাজে নিষেধ করা; মুসলমানদের মধ্য থেকে দুর্নীতি বা অনাচার দূর করা এবং আমার নানার তথা মহানবীর সুন্নাত আর বিধি-বিধান ও আমার বাবা আলী ইবনে আবি তালিবের রসম-রেওয়াজকে পুনরুজ্জীবিত করা।'

সেই ঐতিহাসিক ওসিয়তনামায় কারবালা বিপ্লবের মহানায়ক ইমাম হুসাইন (আ) আরও লিখেছিলেন: 'যারা আমার কাছ থেকে এই বাস্তবতাকে মেনে নেবেন তারা আল্লাহর পথের অনুসারী হবেন। আর কেউ প্রত্যাখ্যান করলেও আমি ধৈর্য ও প্রতিরোধের মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যাব যাতে মহান আল্লাহ আমাদের মধ্যে কে উত্তম তা নির্দেশ করেন। আর আল্লাহ হচ্ছেন সর্বোচ্চ হাকিম বা বিচারক।' 

এ ছাড়াও ইমাম হুসাইন (আ) ওই ওসিয়তনামায় ইয়াজিদ সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি, অমানবিক ও ইসলাম-বিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাকে তার ওই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য বলে উল্লেখ করেছিলেন।

ইমাম হুসাইন (আ) একই প্রসঙ্গে আরও লিখেছিলেন:

'যদি তারা আমার কাছে ইয়াজিদের জন্য আনুগত্যের শপথ আদায় করতে নাও আসে তবুও আমি শান্ত ও নীরব হব না। কারণ, সরকারের সঙ্গে আমার বিরোধ কেবল ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে সীমিত নয় যে এ বিষয়ে তারা নীরব হলেই আমিও নীরব হয়ে যাব। বরং ইয়াজিদের ও তার বংশের তথা উমাইয়াদের অস্তিত্বই নানা ধরনের জুলুম আর দুর্নীতি এবং ইসলামের মধ্যে বিকৃতি ঘটানোর মাধ্যম। তাই এইসব অনাচার ও দুর্নীতি দূর করা, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাধা দেয়া, আমার নানা রাসুলে খোদার (সা) বিধি-বিধানসহ আমার বাবা আলী ইবনে আবি তালিবের রসম-রেওয়াজ পুনরুজ্জীবন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সব সংকট ও অসঙ্গতির মূল শেকড় বনি-উমাইয়াদের নির্মূল করার জন্য সক্রিয় হওয়া আমার দায়িত্ব।'

ইমাম হুসাইন (আ)'র বক্তব্যগুলো থেকে বোঝা যায় তিনি তার বিপ্লবী মিশনের সম্ভাব্য সফলতা বা ব্যর্থতার আলোকে বিপ্লবের দায়িত্ব পালন করার প্রক্রিয়াকে শিথিল বা তীব্র করতে চাননি। বরং ইসলামকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার মহান খোদায়ী দায়িত্ব পালনের জন্য নিজে অগ্রসর হওয়ার ও একই লক্ষ্যে জনগণকে জাগিয়ে তোলার পদক্ষেপ নেন।

অনেকেই এ প্রশ্ন করতে পারেন যে ইমাম হুসাইন (আ) যে বিপ্লব করতে চেয়েছেন তা তাঁর বড় ভাই বা পিতা কেন করেননি? আসলে ইমাম হুসাইন (আ)'র সময় যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল তার সঙ্গে অতীতের ও পরের পরিস্থিতিগুলোর কোনো মিল নেই। একই পরিস্থিতিতে বিশ্বনবী (সা)'র অন্য সদস্যরা বা আহলে বাইতের অন্য ইমামরাও একই কাজ করতেন।

যা-ই হোক মদীনা ত্যাগের পর ইমাম হুসাইন (আ) মক্কায় আসেন এবং সেখানে চার মাস অবস্থান করেন। আরবের সর্বত্র এ খবর ছড়িয়ে পড়ে যে মহানবীর (আ) নাতি ইমাম হুসাইন (আ) মক্কায় এসেছেন। হজ মওসুমের প্রাক্কালে মক্কায় মুসলমানদের সমাগম ক্রমেই বাড়ছিল।

জনগণ মুয়াবিয়ার শোষণ ও শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল। মুয়াবিয়া তার ছেলে ইয়াজিদকে ক্ষমতায় বসানোর ব্যবস্থা করে যায়। ইয়াজিদের মত লম্পট ও প্রকাশ্য অনাচারী মুসলিম জাহানের খলিফার পদে বসায় জনগণ আরও বেশি অসন্তুষ্ট হয়। এ অবস্থায় অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ইমাম হুসাইন (আ)'র সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনায় করেন এবং তারা ইমামের প্রতি তাদের সমর্থন ও সহানুভূতির কথা ঘোষণা করেন।

ইরাক থেকে চিঠি-পত্রের ঢল নামে ইমাম হুসাইনের (আ) কাছে।

কুফার বহু নেতা ও গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং তাদের অনুসারী হাজার হাজার চিঠি পাঠান ইমাম হুসাইনের কাছে। ইমাম যেন তাদেরকে ইয়াজিদের জুলুম ও দুঃশাসন থেকে মুক্ত করে প্রকৃত ইসলামী শাসন কায়েম করেন সে জন্য আকুল আবেদন ছিল এইসব চিঠিতে। হজ মওসুমের প্রাক্কালে এ পরিস্থিতি ছিল ইয়াজিদের জন্য খুবই আতঙ্কজনক। ইমাম কুফার পরিস্থিতি যাচাইয়ের জন্য নিজের চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে পাঠালেন কুফায়। মুসলিম যাত্রা শুরু করেছিলেন পবিত্র রমজান মাসে। তিনি শাওয়ালের পঞ্চম দিনে পৌঁছে যান কুফায়। ঐতিহাসিক তাবারির বর্ণনা অনুযায়ী তিনি অবস্থান করেছিলেন মুখতার ইবনে আবু উবায়দার বাড়িতে। আহলে বাইতের অনুসারীরা তাঁকে দেখতে আসেন। তিনি জনগণের এক সমাবেশে ইমাম হুসাইন (আ)'র চিঠি পড়ে শোনান। উপস্থিত জনগণ ইমামের বক্তব্য শুনে কাঁদতে থাকেন। আবিস ইবনে শাবিব শাকিরি এবং হাবিব ইবনে মাজাহের তাদের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে ইমামের জন্য লড়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন।

কুফার ১৮ হাজার ব্যক্তি ইমাম হুসাইনের প্রতিনিধি মুসলিম ইবনে আকিলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। মুসলিম এই পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে ইমামের কাছে চিঠি লেখেন। কিন্তু এই চিঠি লেখার ২৭ দিন পর মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় নির্মমভাবে শহীদ হতে হয়েছিল ইয়াজিদের অনুচরদের হাতে। কুফার জনগণ তাঁকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। ইরাক ও বিশেষ করে কুফা শহরে ছিল বিশ্বনবীর (সা) আহলে বাইতের সমর্থকদের প্রাধান্য। কিন্তু এইসব সমর্থকের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোকই ইসলামের জন্য বড় ধরনের ত্যাগ বা কষ্ট স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল। হযরত আলী (আ) ও ইমাম হাসান (আ) অনেকটা এই একই কারণে বিপর্যয়ের শিকার হয়েছিলেন।(রেডিও তেহরান)