অস্থায়ী বিবাহ প্রসঙ্গে

মুত্‘আহ্ (অস্থায়ী বিবাহ) মুসলমানদের দু’টি প্রধান ধারা শিয়া ও সুন্নীর মধ্যকার বিতর্কের অন্যতম প্রধান বিষয় - যা এ দুই ধারার মধ্যকার দূরত্বকে ব্যাপক বিস্তৃত করেছে। শিয়া মায্হাব অস্থায়ী বিবাহকে বৈধ গণ্য করে এবং সুন্নী মায্হাবগুলো এটিকে অবৈধ, বরং ব্যভিচারের সমতুল্য বলে গণ্য করে থাকে। এ বিতর্কের মূল কারণ, দ্বীনী বিধিবিধানের তথা ফরয ও হারাম সংক্রান্ত বিধানের প্রকৃত উৎসের দিকে দৃষ্টিপাত না করে সংশয়মূলক (ظنی) দলীল, মনীষীদের মতামত ও ব্যক্তিগত পসন্দ-অপসন্দকে অগ্রাধিকার প্রদান করা। প্রকৃত পক্ষে চারটি অকাট্য জ্ঞানসূত্রের বাইরের কোনো দলীলের দ্বারা ফরয বা হারাম প্রমাণিত হতে পারে না। এ চারটি দলীল হচ্ছে সর্বজনীন ও সুস্থ বিচারবুদ্ধি (عقل)-এর অকাট্য রায়, কোরআন মজীদ, মুতাওয়াতির হাদীছ ও হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর যুগে কোনো কাজ প্রচলিত বা নিষিদ্ধ থাকা সম্বন্ধে ছ্বাহাবীদের যুগ থেকে বিরাজমান মুসলমানদের মধ্যকার মতৈক্য বা ইজমা‘এ উম্মাহ্ (যে ক্ষেত্রে পরবর্তী কোনো যুগের ভিন্ন মত বা মতানৈক্যের কোনো গুরুত্ব নেই)। এ চার সূত্রের বাইরে খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছ বা কোনো মনীষীর মত দ্বারা ফরয বা হারাম প্রমাণিত হতে পারে না। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে নবী প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে আল্লাহ্ তা‘আলার সঠিক পরিচয় জানানো, আল্লাহ্ তা‘আলার আদেশ ও নিষেধ (ফরয ও হারাম) পৌঁছে দেয়া এবং সম্ভব ক্ষেত্রে ঐশী হুকুমত প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা। এমতাবস্থায় এটা সম্ভব নয় যে, কোনো কাজ ফরয বা হারাম হবে অথচ নবী তা তাঁর অনুসারীদের মধ্যকার স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তিকে জানাবেন। আর যেহেতু হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর ইন্তেকালের সময় তাঁর ছ্বাহাবীর সংখ্যা ছিলো সোয়া লক্ষের মতো সেহেতু এটা অকল্পনীয় যে, তিনি কোনো ফরয বা হারামের কথা মাত্র দু’চার জন ছ্বাহাবীকে জানিয়ে থাকবেন।প্রশ্ন করা হয় যে, মুত্‘আহ্ (অস্থায়ী বিবাহ) সম্পর্কে কোরআন মজীদে উল্লেখ আছে কিনা। যেহেতু ফরয ও হারামের উৎস উপরাল্লিখিত চার অকাট্য সূত্র সেহেতু এর মধ্য থেকে যে কোনো একটি সূত্রে কোনো ফরয বা হারামের উল্লেখ থাকাই যথেষ্ট, তেমনি কোনো কিছু জায়েয হওয়া সম্পর্কও এগুলোর মধ্য থেকে যে কোনো একটি সূত্রে উল্লেখ থাকাই যথেষ্ট; একটি সূত্রে পাওয়ার পরেও আরো দলীল দাবী করা মানে হচ্ছে সে সূত্রের ওপর সন্দেহ পোষণ করা। আর হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ)-এর যুগে যে মুত্‘আহ্ প্রচলিত ও বৈধ ছিলো এ ব্যাপারে উম্মাতের মধ্যে ইজমা‘ রয়েছে। তবে কতক খবরে ওয়াহেদ্ হাদীছে দাবী করা হয়েছে যে, নবী করীম (ছ্বাঃ) পরে এটি বন্ধ করে দেন। কয়েকটি কারণে এ দাবীর কোনোই মূল্য নেই। প্রথমতঃ উদ্ধৃতিযোগ্য তিন অকাট্য দলীলের (কোরআন, মুতাওয়াতির্ হাদীছ্ ও ইজমা‘এ উম্মাহ্) কোনোটি থেকেই নবী করীম (ছ্বাঃ) কর্তৃক মুত্‘আহ্ নিষিদ্ধ করার দাবী প্রমাণিত হয় না। দ্বিতীয়তঃ শুরু থেকেই বিধানটি সাময়িক হওয়ার বিষয়টিও উক্ত তিন দলীলের কোনোটি থেকেই প্রমাণিত হয় না। তৃতীয়তঃ নবী করীম (ছ্বাঃ) এটি নিষিদ্ধ করে গিয়ে থাকলে দ্বিতীয় খলীফাহ্ কর্তৃক এটি ‘নিষিদ্ধ করার’ প্রশ্ন উঠতো না, বরং তিনি কেবল নিষিদ্ধকরণ আইনের বাস্তবায়ন করতেন। কিন্তু সর্বসম্মত মত এই যে, তিনিই এটি ‘নিষিদ্ধ করেন’। শুধু তা-ই নয়, এ নিষেধাজ্ঞা জারীর সময় তিনি বলেন: “তোমরা রাসূলুল্লাহর (ছ্বাঃ) যুগে করতে এমন দু’টি কাজ আমি নিষিদ্ধ করছি, তা হচ্ছে হজ্বের মুত্‘আহ্ (তামাত্তু‘ হজ্ব) ও নারীর মুত্‘আহ্ (অস্থায়ী বিবাহ)।” এ থেকেও অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, নবী করীম (ছ্বাঃ) মুত্‘আহ্ নিষিদ্ধ করে দিয়ে যান নি। এমতাবস্থায় মুত্‘আহ্ নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত হাদীছগুলো যে জাল তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আর রাসূলুল্লাহ্ (ছ্বাঃ)-এর ওফাতের অন্ততঃ সোয়া দুইশ’ বছর পরে যে সব হাদীছ-সংকলন সংকলিত হয়েছে, যতো সতর্কতার সাথেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়ে থাকুক না কেন এবং সংকলকগণ বা অন্যরা ঐ সব সংকলনের নামের আগে যতোই না “ছ্বাহীহ্” ও “মুসনাদ্” বিশেষণ লাগিয়ে থাকুন না কেন, তাতে কতক জাল হাদীছ থেকে যাওয়া খুবই সম্ভব। বিশেষ করে ছ্বাহাবী থেকে সংকলক পর্যন্ত একেকটি হাদীছ আট-দশটি বা তারও বেশী সংখ্যক বর্ণনাকারী-স্তর পার হয়ে সংকলিত হওয়ায় এ সম্ভাবনা কোনো সুস্থ বিচারবুদ্ধিই অস্বীকার করতে পারে না। কারণ, এতোগুলো স্তরের মধ্যে যে কোনো স্তরেই মিথ্যা রচিত হয়ে থাকতে এবং পূর্বতন নির্ভরযোগ্য স্তরসমূহের নামে চালিয়ে দেয়া হয়ে থাকতে পারে। নীতিগতভাবেই চার অকাট্য দলীলের যে কোনো একটি দ্বারা কোনো বিষয় প্রমাণিত হবার পর আর সে সম্পর্কে কোনো মুসলমানের মনেই দ্বিধা থাকা উচিত নয়। সুতরাং ইজমা‘এ উম্মাহ্ দ্বারা প্রমাণিত বিষয় সম্পর্কে এ কথা বলা জায়েয হতে পারে না যে, এ বিষয়ে কোরআন মজীদের দলীল থাকলে গ্রহণ করবো, নয়তো নয়। কারণ, তাহলে বহু জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, তাওরাতে খাতনাহর বিধান আছে, কোরআন মজীদে তা নেই, কিন্তু হযরত রাসূলে আকরাম (ছ্বাঃ) আল্লাহ্ তা‘আলার নির্দেশে তা বহাল রাখেন। এমতাবস্থায় কোরআনে না থাকা ও ইয়াহূদীদের সাথে মিলে যাবার যুক্তিতে কোনো মুসলমান এ বিধান - যদিও খাতনাহ্-বিরোধীদের (খৃস্টান ও হিন্দুদের) দৃষ্টিতে তা নিষ্ঠুরতা - প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। যা-ই হোক, এ সত্ত্বেও আমরা কোরআন মজীদে মুত্‘আহর বৈধতা আছে কিনা তা অনুসন্ধান করে দেখতে পারি। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন:

وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ النِّسَاءِ إِلا مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ كِتَابَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَأُحِلَّ لَكُمْ مَا وَرَاءَ ذَلِكُمْ أَنْ تَبْتَغُوا بِأَمْوَالِكُمْ مُحْصِنِينَ غَيْرَ مُسَافِحِينَ فَمَا اسْتَمْتَعْتُمْ بِهِ مِنْهُنَّ فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً

আর (তোমাদের জন্য আরো হারাম করা হয়েছে) সুরক্ষিতা (অন্যের বিবাহাধীন) নারীদেরকে - তোমাদের দক্ষিণ হস্ত যাদের মালিকানা অর্জন করেছে (ক্রীতদাসী বা যুদ্ধবন্দী হিসেবে প্রাপ্ত মুশরিকা নারী) তাদের ব্যতীত; এ (হারামের বিধান) হচ্ছে তোমাদের জন্য আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আর এ সবের বাইরে অন্য সমস্ত নারীদেরকে তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে যে, তোমরা নিজেদের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উদ্দেশ্যে (مُحْصِنِينَ) - কামুকতা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে নয় - তোমাদের সম্পদের বিনিময়ে তাদেরকে যাচ্ঞা করবে; অতঃপর তোমরা যখন তাদের থেকে সুবিধা গ্রহণ করবে (তাদেরকে ভোগ করবে) (اسْتَمْتَعْتُمْ) সে ক্ষেত্রে তাদেরকে তাদের জন্য নির্ধারিত দেনমোহর প্রদান কর।” (সূরাহ্ আন্-নিসা’: ২৪) এখানে কয়েকটি প্রণিধানযোগ্য বিষয় আছে। তা হচ্ছে, আল্লাহর বিধানে নর-নারীর বৈধ যৌন সম্পর্ক অবস্থাভেদে বিভিন্ন ধরনের। স্থায়ী বিবাহ ছাড়াও ক্রীতদাসী বা যুদ্ধবন্দিনী হিসেবে প্রাপ্ত মুশরিকা নারীদেরকে শয্যাসঙ্গিনী করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। যদিও আল্লাহ্ তা‘আলা এর কারণ বর্ণনা করেন নি এবং কারণ জানা না থাকলেও আল্লাহর বিধানকে যথার্থ বলে জানতে হবে, তবে চিন্তা করলে আমরা এ বিধানের যথার্থতা বুঝতে পারি। একজন ক্রীতদাসী ও যুদ্ধবন্দিনী হবার ফলে দাসীতে পরিণত (কৃতদাসী) কোনো পুরুষের মালিকানায থাকবে - যে নারীর কোনোই স্বাধীনতা নেই - সে ঐ নারীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করবে না এটা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। অন্যদিকে যৌন প্রয়োজন কেবল পুরুষেরই নেই, নারীরও যৌন প্রয়োজন আছে। সুতরাং পুরুষ অগ্রসর না হলেও স্বয়ং নারীই নিজ প্রয়োজনে তাকে এতে প্ররোচিত করবে। তাই আল্লাহর বিধানে এ ধরনের দাসীদেরকে ভোগ করার জন্য তাদের মালিকদেরকে অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে যুদ্ধবন্দিনী সধবা হয়ে থাকলেও তাকে সংরক্ষিতা গণ্য করা হয় নি। কারণ, সে ক্ষেত্রে তাকে ভোগ করা নিষিদ্ধ করা হলে সে নিষেধাজ্ঞা হতো অর্থহীন। একই কারণে মালিকের দ্বারা তাকে ভোগের জন্য ইজাব-কবূলের শর্তও রাখা হয় নি এবং বন্দী হওয়ার আগে স্বামী থেকে থাকলে বা মালিকানা পরিবর্তন হয়ে থাকলে নতুন মালিক কর্তৃক তাকে ভোগের পূর্বে ঐ নারীর জন্য কোনো ‘ইদ্দত পালনের শর্তও রাখা হয় নি। তবে এ ক্ষেত্রে এদেরকে ভোগের বিষয়টিকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে; হাদীছ থেকে প্রমাণিত যে, একজন পুরুষ সর্বোচ্চ পাঁচজন দাসীকে স্বীয় শয্যাসঙ্গিনী করার জন্য একই সময় সংরক্ষণ করতে পারবে, যদিও তার মালিকানায় আরো অনেক দাসী থেকে থাকে। সুতরাং ইসলামে নর-নারীর বৈধ যৌন সম্পর্ক কেবল স্থায়ী বিবাহের মধ্যে সীমিত নয়। আর এ ধরনেরই একটি সম্পর্ক হচ্ছে মুত্‘আহ্ - যাতে স্থায়ী বিবাহের তুলনায় অপেক্ষাকৃত সীমিত দায়-দায়িত্ব বর্তায়, কিন্তু তা থেকে দায়দায়িত্বহীন কামুকতা চরিতার্থ করাও সম্ভব নয়। কারণ, দায়দায়িত্বহীন কামুকতা চরিতার্থ করার ক্ষেত্রে একদিকে যেমন দেনমোহরের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই; দু’জন নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্মতিই যথেষ্ট, অন্যদিকে একজন নারী অর্থলোভে বা যৌনবৈচিত্রের লোভে একেক দিন একেক জন পুরুষের, এমনকি একদিনেও কয়েক জন পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হতে পারে। কিন্তু মুত্‘আহর ক্ষেত্রে মুত্‘আহর মেয়াদ-কালে ও মেয়াদ সমাপ্তি পরবর্তী ‘ইদ্দত্-কালে সে দ্বিতীয় কোনো পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হতে পারবে না। এর ফলে তার ওপর যে সীমাবদ্ধতা আরোপিত হয় সে কারণে স্বভাবতঃই সে তার মুত্‘আহর মেয়াদ-কালের ও ‘ইদ্দত্-কালের ভরণ-পোষণের নিশ্চয়তা চাইবে। আর এটা অবাধ যৌন সম্পর্কের তুলনায় পুরুষটির জন্য অধিকতর ব্যয়ের বোঝা নিয়ে আসতে বাধ্য। ফলে এটাও তার যৌনতা চরিতার্থকরণকে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।উপরোক্ত আয়াতের পূর্ববর্তী আয়াতে (২৩ নং আয়াত) সেই সব নারীদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যাদেরকে একজন পুরুষের জন্য হারাম করা হয়েছে, কেবল বিয়ে করতে নিষেধ করা হয় নি। অর্থাৎ এদেরকে কেবল স্থায়ীভাবে বিবাহ করাই নিষিদ্ধ নয়, অস্থায়ীভাবে বিবাহ করাও নিষিদ্ধ এবং কোনো না কোনোভাবে ক্রীতদাসী বা যুদ্ধবন্দিনী হয়ে হাতে এলেও তাদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে না। অনুরূপভাবে এ তালিকায় এসেছে حَلائِلُ أَبْنَائِكُمُ الَّذِينَ مِنْ أَصْلابِكُمْ - “তোমাদের ঔরষজাত পুত্রদের হালালকৃত (নারী)রা।” এখানে শুধু পুত্রবধুদেরকে বুঝানো হয় নি, বরং পুত্ররা যে নারীদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছে তাদেরকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যৌন সম্পর্ক স্থাপন কেবল স্থায়ী বিবাহের মধ্যে সীমিত নয়। সূরাহ্ নিসা’র উপরোক্ত ২৪ নং আয়াতে أَنْ تَبْتَغُوا بِأَمْوَالِكُمْ (যে, তোমাদের সম্পদের বিনিময়ে যাচ্ঞা করবে) বলা হয়েছে - যাতে নগদ প্রদান বুঝানো হয়েছে; স্থায়ী বিবাহের ক্ষেত্রে এটা খাপ খায় না। কারণ, সে ক্ষেত্রে নগদ দেনমোহর ছাড়াও স্ত্রীকে আজীবন নাফাক্বাহ্ দিতে হয়। অর্থাৎ ‘সম্পদের বিনিময়ে যাচ্ঞা’ বলে অস্থায়ী বিবাহের কথাই বুঝানো হয়েছে। এছাড়া এ ক্ষেত্রে কেবল ভোগ করার বেলায়ই দেনমোহর দেয়া অপরিহার্য করা হয়েছে। অর্থাৎ মুত্‘আহর জন্য ‘আক্বদ্ পরানো ও দেনমোহর নির্ধারণ করা হলেও যৌন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত না হওয়া, যেমন: এ উদ্দেশ্যে উভয়ের নির্জন কক্ষে প্রবেশ না করা পর্যন্ত দেনমোহর পরিশোধ করা অপরিহার্য নয়। কিন্তু স্থায়ী বিবাহের ক্ষেত্রে এরূপ শর্ত নেই। বরং সে ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হোক বা না হোক স্ত্রীকে অবশ্যই কিছু অর্থ বা সম্পদ দিতে হবে। কারণ, এরশাদ হয়েছে ঃ

لَّا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِن طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ مَا لَمْ تَمَسُّوهُنَّ أَوْ تَفْرِضُوا لَهُنَّ فَرِيضَةً ۚ وَمَتِّعُوهُنَّ عَلَى الْمُوسِعِ قَدَرُهُ وَعَلَى الْمُقْتِرِ قَدَرُهُ مَتَاعًا بِالْمَعْرُوفِ ۖ حَقًّا عَلَى الْمُحْسِنِينَ

“তোমরা যদি তোমাদের স্ত্রীদেরকে স্পর্শ করার বা তাদের জন্য দেনমোহর নির্ধারণের পূর্বে তালাক্ব্ দাও তো তাতে কোনো দোষ নেই এবং এ ক্ষেত্রে তাদেরকে সম্পদ দান কর; সচ্ছল ব্যক্তির দায়িত্ব তার সামর্থ্য অনুযায়ী দেয়া এবং অসচ্ছল ব্যক্তির দায়িত্ব তার সামর্থ্য অনুযায়ী দেয়া; প্রচলিত রীতিপ্রথামাফিক (ন্যায়সঙ্গত পরিমাণে) এ সম্পদ প্রদান করা সৎকর্মশীলদের ওপর আরোপিত অধিকার।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্: ২৩৬) আগেই যেমন আভাস দেয়া হয়েছে, আল্লাহ্ তা‘আলা স্বয়ং যেখানে তাঁর বিধানের পিছনে নিহিত কারণ উল্লেখ করেন নি সেখানে কল্পনা করে কারণ নির্ণয় করা যেতে পারে না। তবে আমরা চিন্তা করলে বিভিন্ন বিধানের কতক কল্যাণকারিতা অনুভব করতে পারি। তেমনি চিন্তা করলে মুত্‘আহর বিধানেও বহু কল্যাণের সন্ধান পাওয়া যায়। আর আজকের সমাজে এর কল্যাণকারিতা সর্বাধিক অনুভূত হয়। ইসলাম মানুষের যৌন প্রয়োজন অবদমন সমর্থন করে না। এ কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা সদ্য বালেগ্ব হওয়া ছেলে-মেয়েদের সহ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পর্যন্ত সকল স্বামীবিহীন নারীকে ও সকল স্ত্রীবিহীন পুরুষকে বিয়ে দেয়ার জন্য মুসলমানদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন (সূরাহ্ আন্-নূর্: ৩২)। কিন্তু বিভিন্ন কারণে অনেক পুরুষ বা নারীর পক্ষে স্থায়ী বিবাহ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না, বিশেষ করে অনেক সময় কম বয়সী বিধবা নারীরা স্বীয় সন্তানদের প্রতি মায়া-মমতার কারণে স্থায়ীভাবে বিবাহ করতে প্রস্তুত হয় না, কিন্তু তাদের যৌন প্রয়োজন থেকেই যায়। ফলে তাদের জন্য যে কোনো মুহূর্তে পাপের পথে পা বাড়াবার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া গড়পরতা পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশ আগেই যৌবনপ্রাপ্ত হয়। ফলে মানবসমাজে সব সময়ই বিবাহক্ষম নারীদের সংখ্যা বিবাহক্ষম পুরুষদের তুলনায় বেশী। বহু বিবাহের মাধ্যমে এ ভারসাম্যহীনতার সমাধান হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে বহু বিবাহকে প্রায় সকলেই অপসন্দ করে। বিশেষ করে অনেক নারী স্বামীর অন্য নারীদের সাথে অবৈধ যৌন সম্পর্ক সহ্য করতে রাযী হলেও সতীন সহ্য করতে রাযী নয়। ফলে যে নারীদের স্বামী নেই বা যে নারীদেরকে কেউ বিবাহ করছে না তাদের অনেকে স্বীয় প্রয়োজনের তাগিদে অবৈধ যৌন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে সমাজে অনৈতিকতা বৃদ্ধি করে চলে। অস্থায়ী বিবাহ তাদের প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করে সমাজে যৌন শৃঙ্খলা নিয়ে আসতে পারে। এছাড়া বর্তমান যুগে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে পড়াশুনা ও অন্যান্য যুক্তিতে দেরীতে বিবাহ করা এবং প্রেম করে বিবাহ করা প্রায় সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তা এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, এটা রোধ করার ক্ষমতা কারোই আছে বলে মনে হয় না। আর এভাবে যুবক-যুবতীদের অবাধ মেলামেশার ফলে, পূর্বপরিকল্পনা না থাকলেও, অনেক সময়ই তাদের সম্পর্ক অবৈধ যৌন সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। বিশেষ করে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন মোক্ষম ব্যবস্থা থাকায় এ পথে তাদের জন্য কোনোই বাধাবিঘ্ন থাকে না। ফলে সমাজে নৈতিক চরিত্রের মান আশঙ্কাজনকভাবে নীচে নেমে গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এ ধরনের প্রেমের সম্পর্কের (এমনকি তা যৌন সম্পর্কে পর্যবসিত না হলেও) কোনো দ্বীনী বা আইনী ভিত্তি না থাকায় অনেক সময় দেখা যায় যে, একজন যুবক বা যুবতী একই সময় একাধিক যুবতী বা যুবকের সাথে সম্পর্ক রাখছে এবং একতরফাভাবে সম্পর্ক ভেঙ্গে দিচ্ছে - যা অনেক সময় কারো কারো ভাগ্যে চরম বিপর্যয় নিয়ে আসে। এদিক থেকে বরং পাশ্চাত্যের সামাজিক প্রথা বিবাহ-পূর্ব কোর্টশীপ - পরস্পরকে ঘনিষ্ঠভাবে জানার যুক্তিতে যা প্রচলিত হয়েছে - কম মন্দ। কারণ, কোর্টশীপ চলাকালে সংশ্লিষ্ট যুগলের কেউই তৃতীয় কোনো ব্যক্তির সাথে প্রেমের সম্পর্ক বা যৌন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার অধিকার রাখে না। বর্তমানে মুসলিম সমাজেও প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল সাধারণতঃ পরস্পরকে পসন্দ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই বিবাহ করে না, বরং পরস্পরকে আরো বেশী করে জানার যুক্তিতে দীর্ঘদিন ধরে প্রেমের সম্পর্ক বজায় রাখে। কিন্তু এ সম্পর্কের না আছে কোনো সীমাবদ্ধতা, না আছে কোনো দায়বদ্ধতা। এ ধরনের যুগলরা মুত্‘আহর আশ্রয় নিয়ে তাদের সম্পর্ককে শর‘ঈ ও আইনী সীমার মধ্যে নিয়ে আসতে পারে; পরে তারা যখন মনে করবে যে, তারা একত্রে জীবন যাপন করতে পারবে তখন তারা তাদের অস্থায়ী সম্পর্ককে স্থায়ী রূপ দিতে পারবে, নচেৎ পৃথক হয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, মুত্‘আহ্ হচ্ছে যারা প্রয়োজন মনে করে তাদের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে প্রদত্ত এক ধরনের সুযোগ ও অবকাশ; এমন নয় যে, লোকদেরকে অবশ্যই মুত্‘আহ্ করতে হবে। তেমনি মুত্‘আহ্ করার মানে এ-ও নয় যে, সংশ্লিষ্ট যুগলকে অবশ্যই পরস্পরের সাথে যৌন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তারা কেবল তাদের সম্পর্ককে অবৈধতার পরিবর্তে বৈধতার আওতায় নিয়ে আসার জন্য তথা পরস্পরকে স্পর্শ না করেও কেবল তাদের দেখাসাক্ষাৎ ও গল্পগুযব করার বিষয়টিকে জায়েয করার জন্যও মুত্‘আহ্ করতে পারে - যাতে ই্চ্ছায় হোক, বা ঘটনাক্রমে হোক, সে সম্পর্ক আরো বেশীদূর গড়ালেও তা অবৈধ পর্যায়ে উপনীত হয়ে না যায়।#আল হাসানাইন