আল কোরআনের অলৌকিকতাঃ পৃথিবী

জীবনের জন্য পয়োজনীয় প্রতিটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে পৃথিবীর। এগুলোরই একটি হলো বায়ুমন্ডল, যা জীব জগৎকে রক্ষা করার কাজে বর্ম হিসেবে কাজ করে। আজ এটি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, বায়ুমন্ডল একটির উপর অন্যটি অবস্তিত-এমনতর সাতটি স্তর-নিয়ে গঠিত। ঠিক কোরআনের বর্ণনার মতোই এটি ঠিক সাতটি স্তর-নিয়ে গঠিত। অবশ্যই এটি কোরআনের একটি অলৌকিকত্ব।

তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে। তিনি রাত্রি দিয়ে দিনকে আচ্ছাদিত করেন এবং দিন দিয়ে রাত্রিকে আচ্ছাদিত করেন। তিনি নিয়মাধীন করেছেন সূর্য ও চন্দ্রকে। প্রত্যেকেই নির্ধারিত সময় পর্যন্ত চলতে থাকবে। জেনে রাখ তিনি পরাক্রমশালী, পরম ক্ষমাশীল। (কোরআন, ৩৯ : ৫)

মহাবিশ্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে কোরআনে যে সমস্ত শব্দাবলী ব্যবহৃত রয়েছে-সেগুলো বেশ উল্লেখযোগ্য। “আচ্ছাদিত বা মোড়ানো” অর্থে উপরের আয়াতটিতে যে আরবী শব্দটির ব্যবহার করা হয়েছে সেটি হলো “Takwir”। ইংরেজীতে এর অর্থ “একটি জিনিষ দ্বারা অপর একটি জিনিষকে জড়িয়ে বা মুড়িয়ে দেয়া-যা কিনা একটি পোষাকের মতো ভাঁজ করা অবস্থায় গোছানো রয়েছে।” (উদারহণত, পাগড়ী যেমন করে পরিধান করা হয়, ঠিক তেমনিভাবে একটি জিনিষ দিয়ে অপরটিকে জড়ানোর কাজে আরবী অভিধানে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে)। দিন ও রাত্রি পরস্পরকে জড়িয়ে বা আচ্ছাদিত অবস্থায় রয়েছে-আয়াতটিতে প্রদত্ত এই তথ্য দ্বারা পৃথিবীর আকৃতির সঠিক তথ্যই প্রদান করা হয়েছে। এ অবস্থাটি কেবল সেই অবস্থায় সঠিক হতে পারে যখন পৃথিবীর আকৃতি হয় গোলাকার। এর অর্থ সপ্তম শতাব্দীতে নাযিলকৃত কোরআনে পৃথিবী গোলাকার হওয়ার বিষয়টির ইংগিত দেয়া হয়েছিল।

যাই হোক এটা স্মরণ রাখা উচিত যে মহাবিশ্ব সম্পর্কে সে সময়কার জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান ছিল ভিন্নরূপ। তখনকার সময় মনে করা হতো যে পৃথিবী একটি সমতল এলাকা আর এ বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই বিজ্ঞান বিষয়ক সমস্ত গণনা আর ব্যাখ্যাদি দাড় করানো হয়েছিল। অথচ আমরা গত শতাব্দীতে যে তথ্যটি জেনেছি তা কোরআনের আয়াতটিতে অন্তর্ভূক্ত ছিল। যেহেতু কোরআন আল্লাহ তায়ালার বাণী, সেহেতু যখন বিশ্বব্রহ্মান্ডের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তখন সবচাইতে শুদ্ধ আর সঠিক শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।

 

সুরক্ষিত ছাদ

কোরআনে মহান আল্লাহ তাআলা আকাশের একটি অত্যন্ত কৌতুহলকর বৈশিষ্ট্যের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন :

আর আমি আসমানকে সৃষ্টি করেছি একটি সুরক্ষিত ছাদরূপে, কিন্তু তারা তার নিদর্শনাবলী থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখে।-(কোরআন, ২১ : ৩২)

বিংশ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা আকাশের এ বৈশিষ্ট্যটি প্রমাণিত হয়েছে।

জীবনের অবিরাম গতিধারা বজায় রাখার জন্য পৃথিবীকে ঘিরে যে বায়ুমন্ডল রয়েছে তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে যাচ্ছে। যখন বড়, ছোট বহু উল্কা পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসে, তখন বায়ুমন্ডল এদেরকে ভূ-পৃষ্ঠে পতিত হতে দেয় না। এভাবেই পৃথিবীর জীবজগতকে উল্কা পতনের ক্ষতিকর দিক থেকে বাঁচিয়ে দেয় বায়ুমণ্ডল।

তা ছাড়া মহাশূণ্য থেকে জীবিত বস্তু সমূহের জন্য ক্ষতিকর যে রশ্মি নির্গত হয় তাকে ফিল্টার করে বা ছেকেঁ শোধন করে বায়ুমন্ডল। কৌতুহলের ব্যাপারটি হলো এই যে, যে রশ্মিসমূহ জীবের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং উপকারী, যেমন, দর্শনযোগ্য আলো, Near Ultraviolet Light আর বেতার তরঙ্গকেই বায়ুমন্ডল অতিক্রম করতে দেয়। এ সমস্ত রশ্মি জীবনের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। Near Ultraviolet Ray, যেটি কিনা কেবল আংশিকভাবে বায়ুমন্ডল কর্তৃক আসতে পারে, তা উদ্ভিদের সালোক সংশ্লেষণ আর সমস্ত জীবসমূহের টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সূর্য থেকে যে অতি গাঢ় আল্ট্রভায়োলেট রশ্মি নির্গত হয়, তা বায়ুমন্ডলের ওযোন স্তর দিয়ে ফিল্টার হয়; এভাবে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির অত্যন্ত সীমিত আর অতি প্রয়োজনীয় অংশ ভূ-পৃষ্ঠে এসে পৌছে।

বায়ুমন্ডলের সুরক্ষার কাজ এখানেই শেষ হয়না। মহাশূণ্যের প্রায় ২৭০ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের মতো বরফ ঠান্ডা তাপমাত্রা থেকেও বায়ুমন্ডল পৃথিবীকে রক্ষা করে থাকে।

জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় রশ্মিগুলোকেই বায়ুমন্ডল পৃথিবীতে প্রবেশ করতে দেয়। উদাহরণস্বরূপ,আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি কেবল আংশিক ভাবে আসতে পারে। সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমে উদ্ভিদ সমূহের খাদ্য প্রস্তুতির জন্য আর পরিশেষে সমস্ত জীবকে টিকিয়ে রাখার মতো অত্যন্ত সঠিক পরিমাণই.(আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি) প্রবেশ করতে পারে।

গগনমন্ডল অবলোকন করতে গিয়ে বেশীরভাগ মানুষই বাযুমন্ডলের সুরক্ষার বা নিরাপদ রাখার বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখেনা। তারা প্রায় কখনই চিন্তা করেনা যে, যদি বায়ুমন্ডলের এধরণের গঠন না থাকতো, পৃথিবী কি ধরণের জায়গা হতো। উল্কার পতনের ফলে আমেরিকায়, আরিজুনাতে বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছিল। বায়ুমন্ডল না থাকলে মিলিয়ন মিলিয়ন উল্কাপিন্ড পৃথিবীতে এসে পড়তো, যার ফলে তা বসবাসের অযোগ্য জায়গা হয়ে যেতো। কিন্তু বায়ুমন্ডলের সুরক্ষার দিকটি পৃথিবীর জীবজগতকে নিরাপদে বসবাস করার সুযোগ দি‪চ্ছে। নিশ্চয়ই এটি মানুষকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহরই একটি সিস্টেম এবং একটি অলৌকিক জিনিষ যা কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে।

সূর্যে বিস্ফোরণের ফলে নির্গত শক্তি যে কি পরিমাণ ক্ষমতা রাখে তা মানবমন কদাচিতই ভাবতে পারে। এর একটিমাত্র বিস্ফোরণ হিরোশিমায় পতিত ১০০ বিলিয়ন এটম বোমার সমতুল্য। বায়ুমন্ডল আর ভ্যান এলেন বেল্টের জন্য এই শক্তির ক্ষতিকর দিক থেকে মহাবিশ্ব নিরাপদ রয়েছে।

মানব জীবনের জন্য পূর্ণাঙ্গ সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সৃষ্ট পৃথিবী থেকে বায়ুমণ্ডলের বাইরে মহাশূণ্যে যদি আমরা সরে যাই, তবে বরফ শীতল ঠান্ডার কবলে পড়বো। মহাশূণ্যের ২৭০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের মতো বরফ শীতল ঠান্ডা হতে পৃথিবী নিরাপদে রয়েছে এই বায়ুমন্ডলের জন্য।

পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড দ্বারা তৈরী ম্যাগনেটোস্ফিয়ার স্তর পৃথিবীকে মহাশূণ্যজাত বস্তু, ক্ষতিকর কসমিক রশ্মি এবং কণাসমূহ থেকে নিরাপদে রাখার জন্য বর্ম হিসেবে কাজ করে। ম্যাগনেটোস্ফিয়ার যার নাম ভ্যান এলেন বেল্ট।পৃথিবী থেকে সহস্র সহস্র কিলোমিটার উপরে অবস্থিত এই বেল্টটি মারাত্মক ক্ষতিকর শক্তি থেকে পৃথিবীর জীব জগৎকে রক্ষা করে যাচ্ছে, নচেৎ মহাশূণ্য থেকে ভয়ানক এই শক্তি পৃথিবীতে এসে পৌছুত। এ সমস্থা-বৈজ্ঞানিক তথ্যাদি প্রমাণ করে যে, বিশেষ এক পদ্ধতিতে পৃথিবী নিরাপদ রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো যে , ১৪০০ বছর পূর্বে এ আয়াতটি দ্বারা এই নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা জানানো হয়েছে : “আর আমি আসমানকে সৃষ্টি করেছি একটি সুরক্ষিত ছাদরূপে...”

বায়ুমন্ডল একাই কেবল পৃথিবীকে ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করেনা। বায়ুমন্ডলের সাথে পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড দ্বারা তৈরী ভ্যান এলেন বেল্ট নামক একটি স্তরও আমাদের গ্রহটিকে সেই সমস্ত ভীতিকর আর ক্ষতিকর রশ্মি বিচ্ছুরণ থেকে রক্ষার প্রয়োজনে বর্ম হিসেবে কাজ করে। সূর্য আর অন্যান্য নক্ষত্র থেকে অবিরত বিচ্ছুরিত এ সমস্ত রশ্মি জীব জগতের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর। ভ্যান এলেন বেল্টটি যদি না থাকতো তবে সূর্যের ভেতরে ঘন ঘন সংঘঠিত বিশাল বিস্ফোরনের শক্তি যা Solar Flare নামে পরিচিত তা পৃথিবীর সমগ্র প্রাণী জগতকে ধ্বংস করে দিতো।

আমাদের জীবনের জন্য ভ্যান এলেন বেল্ট এর গুরুত্বের কথা বলতে গিয়ে ডঃ হিউগ রস কে বলতে হয়েছে :

প্রকৃতপক্ষে সৌর জগতের অন্য যে কোন গ্রহের চাইতে আমাদের পৃথিবীর ঘনত্ব অনেক বেশী। বিশাল নিকেললৌহ স্তর আমাদের বিশাল ম্যাগনেটিক ফিল্ড এর জন্য দায়ী। এই ম্যাগনেটিক ফিল্ডটিই ভ্যান এলেন রেডিয়েশন বর্মটি তৈরী করেছে যা রেডিয়েশনজনিত গোলাবর্ষণ থেকে ভূ-পৃষ্ঠকে রক্ষা করছে। এই বর্ম বা ঢালটি না থাকলে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব অসম্ভব হয়ে দাড়াতো। বুধ আরেকটি পর্বতময় গ্রহ যার ম্যাগনেটিক ফিল্ড রয়েছে-এই স্তরের ক্ষমতা পৃথিবীর ভ্যান এলেন বেল্টটির চেয়ে ১০০ গুণ কম। এমনকি শুক্র গ্রহ যেটি আমাদের পাশের গ্রহ যার কোন ভ্যান এলেন বেল্ট নেই। ভ্যান এলেন রেডিয়েশনের এই ঢালটি এক মাত্র পৃথিবীর জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে অনন্যরূপে।

এই বিস্ফোরণগুলোর একটির ফলে যে শক্তি সরবরাহ হয় তা হিরোশিমায় পতিত ১০০ বিলিয়ন এটম বোমার সমতুল্য বলে গণনা ও নির্ণয় করা হয়েছে। বিস্ফোরণের ৫৮ বছর পর পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে যে,কম্পাসের ম্যাগনেটিক সূচকটি অস্বাভাবিক নড়াচড়া প্রদর্শন করছে। আর পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের ২৫০ কিলোমিটার উপরে তাপমাত্রা সহসা বেড়ে গিয়ে ২৫০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে পৌচ্ছেছে।

সংক্ষেপে ভূ-পৃষ্ঠের উপরে উঁচু স্তরে একটি নিখুঁত সিস্টেম কর্মরত রয়েছে। এটি আমাদের বিশ্বের চারিদিক জুড়ে কর্মরত এবং বিশ্বকে বাইরের আসন্ন বিপদ বা আশংকা থেকে রক্ষা করছে। যদিও শত শত বছর পূর্বে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে আমাদের অবহিত করেছেন যে, পৃথিবীর বায়ুমন্ডল একটি সুরক্ষিত ঢাল হিসেবে কাজ করছে। অথচ বিজ্ঞানীগণ কেবল সেদিনই তা জানতে পেরেছেন।

 

আকাশের প্রত্যাবর্তন কার্যাবলী

পবিত্র কোরআনে সূরা তারিকের ১১নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা আকাশের প্রত্যাবর্তন কার্যাবলীর কথাটি উল্লেখ করেছেন :

কসম আসমানের, যা থেকে বৃষ্টিপাত হয়। (কোরআন, ৮৬ : ১১)

কোরআন অনুবাদের বেলায় এই আবর্তনশীল (Cyclical) শব্দটি আরো কটি অর্থ বুঝিয়ে থাকে; যেমন, “ফেরৎ পাঠানো”, কিংবা “ফিরে আসা” বা “প্রত্যাবর্তন”।

সবারই জানা আছে যে, পৃথিবীকে ঘিরে থাকা বায়ুমন্ডল বেশ কটি স্তর নিয়ে গঠিত। এর প্রতিটি স্তরই জীবনের কল্যানে বিবিধ প্রকার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখে যাচ্ছে। গবেষণায় উন্মোচিত হয়েছে যে, স্তর গুলোয় যে সমস্ত বস্তু কিংবা রশ্মি এসে পৌছে সেগুলোকে আকাশে কিংবা ভুপৃষ্ঠে ফেরৎ পাঠিয়ে দেয় এই বায়ুমণ্ডল। এখন চলুন পৃথিবীকে পরিবেষ্টনকারী এই স্তরগুলোর- “আবর্তন” বা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া কিছু দৃষ্টান্তের মাধ্যমে পর্যবেক্ষন করি।

(১) ভূ-পৃষ্ঠের ১৩-১৫ কিলোমিটার উপরে ট্রপোস্ফিয়ার নামক স্তরটি-ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উত্থিত পানি বাষ্পকে ঘনীভূত করে বৃষ্টিরূপে ফেরৎ পাঠায়।

(২) ২৫ কিলোমিটার উপরিস্থিত ওযোন স্তরটি-মহাশূণ্য থেকে আসা ক্ষতিকর রশ্মি আর আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি উভয়কেই প্রতিফলিত করে মহাশূণ্যেই ফেরৎ পাঠায়।

(৩) আয়নোস্ফিয়ার বেতার তরঙ্গ সম্প্রচারকে অপ্রতিরোধী যোগাযোগকারী উপগ্রহের (Passive Communication Sattelite) ন্যায় প্রতিফলিত করে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ফেরৎ পাঠায়। আর এভাবেই তা অতি দূর দূরান্তে ওয়ারলেস যোগাযোগ, রেডিও, টেলিভিশন সম্প্রচারকে সম্ভব করে তুলে।

(৪) ম্যাগনেটোস্ফিয়ার সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্র থেকে নির্গত ক্ষতিকর রেডিও একটিভ কণা (Radio Active Particle) কে ভূ-পৃষ্ঠে পৌছুবার পূর্বেই মহাশূণ্যে ফেরৎ পাঠায়।

প্রকৃত ব্যাপারটি হলো যে, বায়ুমন্ডলের এই স্তরগুলোর- বৈশিষ্ট্যাবলী যা নিকট অতীতে উন্মোচিত হয়েছে-সেগুলোই পবিত্র কোরআনে শত শত বছর আগে ঘোষিত হয়েছিল-আর এটিই আবারো প্রমাণ করে যে, কোরআন আল্লাহ তাআলারই বাণী ।

পৃথিবীতে জীবসমূহের বেঁচে থাকার জন্য পানির প্রয়োজন অপরিহার্য। ট্রপোস্ফিয়ার স্তরটি পানি উৎপন্নের কাজে সাহায্য করে; ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উত্থিত বাষ্পকে ট্রপোস্ফিয়ার ঘনীভূত করে বৃষ্টি হিসেবে পৃথিবীতে ফেরৎ পাঠায়।

ওযোনোস্ফিয়ার এমন একটি স্তর যা ভূ-পৃষ্ঠের জীবসমূহের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এমন সব রশ্মির আগমনে বাধা দেয়। আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির ন্যায় ক্ষতিকর কসমিক রশ্মিগুলোকে মহাশূণ্যে ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়ে ওযোনোস্ফিয়ার পৃথিবীর জীবসমূহকে রশ্মিসমূহের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে থাকে।

বায়ুমন্ডলের প্রতিটি স্তরেরই রয়েছে মানব জাতির জন্য উপকারী বৈশিষ্ট্যাবলী। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আয়নোস্ফিয়ার স্তরটি কোন নির্দিষ্ট কেন্দ্র হতে সম্প্রচারিত বেতার তরঙ্গকে প্রতিফলিত করে নিম্নে পৃথিবীতে ফেরৎ পাঠায়। এভাবেই স্তরটি দূর-দূরান্তে সম্প্রচারকে সম্ভব করে তুলেছে।

 

বায়ুমন্ডলের স্তর

মহাবিশ্ব সম্পর্কে কোরআনের তথ্যগুলোর একটি হলো যে, আকাশ সাতটি স্তর নিয়ে গঠিত।

তিনি এমন যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের কল্যাণের জন্য পৃথিবীর সবকিছু। তারপর তিনি মনোযোগ দিলেন আকাশের প্রতি এবং বিন্যস্ত করলেন তা সাত আসমানরূপে। আর তিনি সর্ববিষয়ে সবিশেষ অবহিত। (কোরআন, ২ : ২৯)

অতঃপর তিনি আসমানের প্রতি মনোনিবেশ করলেন, তখন তা ছিল ধূম্রবৎ। তারপর তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন : তোমরা উভয়ে আস স্বে‪ছায় কিংবা অনি‪চ্ছায়। তারা উভয়ে বলল : আমরা স্বে‪ছায় ও সানন্দে আসলাম।

তারপর তিনি আকাশমন্ডলকে দু’দিনে সাত আসমানে পরিণত করলেন এবং প্রত্যেক আসমানে তার জন্য আদেশ প্রেরণ করলেন। আর আমি নিকটবর্তী আসমানকে সুশোভিত করেছি নক্ষত্ররাজি দিয়ে এবং তাকে হেফাজত করেছি। এটা পরাক্রমশালী, সর্বজ্ঞ আল্লাহর ব্যবস্থাপনা। (কোরআন, ৪১ : ১১-১২)

কোরআনের বহু আয়াতে যে “Heavens” শব্দটি এসেছে তা দ্বারা পৃথিবীর উপরের আকাশ তথা মহাবিশ্বকে বুঝানো হয়ে থাকে। এ শব্দটির এমন অর্থ হলে দেখা যায় যে পৃথিবীর আকাশ কিংবা বায়ুমন্ডল সাতটি স্তর নিয়ে গঠিত। বাস্তবিকই-এখন জানা গিয়েছে যে, পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের রয়েছে কয়েকটি স্তর যেগুলোর একটি আরেকটির উপর অবস্থিত । অধিকন্তু কোরআনে যেমন বর্ণিত রয়েছে তেমনি ঠিক সাতটি স্তর নিয়ে বায়ুমন্ডল গঠিত। বৈজ্ঞানিক সূত্রমতে বিষয়টি নিম্নরূপে বর্ণিত হয়ে থাকে :

বিজ্ঞানীগণ পর্যবেক্ষন করেছেন যে, বায়ুমন্ডল বিভিন্ন স্তর নিয়ে গঠিত। চাপ ও গ্যাসের প্রকারের মত ভৌত গুণাবলী দ্বারা স্তরসমূহ ভিন্নতা প্রদর্শন করে। ভূ-পৃষ্ঠের সবচেয়ে নিকটতম স্তর-হলো ট্রপোস্ফিয়ার। বায়ুমন্ডলের ৯০ শতাংশ নিয়ে এই স্তর গঠিত। ট্রপোস্ফিয়ারের উপরের স্তরটিকে বলা হয় স্ট্রাটোস্ফিয়ার। ওযোন স্তর স্ট্রাটোস্ফিয়ারেরই একটি অংশ যেখানে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি শোষিত হয়ে থাকে। স্ট্রাটোস্ফিয়ারের উপরের স্তরটিকে-বলা হয় মেসোস্ফিয়ার।

মেসোস্ফিয়ারের উপরে থাকে থার্মোস্ফিয়ার। এই স্তরে আয়নে পরিণত গ্যাসগুলো একটি স্তর তৈরী করে যাকে বলা হয় আয়নোস্ফিয়ার। পৃথিবীর বাযুমন্ডলের সবচেয়ে বাইরের স্তরটি ৪৮০ কিলোমিটার থেকে ৯৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই স্তরটিকে-বলা হয় এক্সোস্ফিয়ার। ১৪০০ বছর পূর্বে যখন আকাশকে একটি অখণ্ড অংশ হিসেবে মনে করা হতো কোরআনে অলৌকিকভাবে তখনি বলা হলো যে এটি সাতটি ভিন্ন ভিন্ন স্তরে গঠিত। অন্য দিকে অতি সম্প্রতি আধুনিক বিজ্ঞান এ সত্যটি উদঘাটন করেছে যে পৃথিবীকে ঘিরে থাকা বায়ুমন্ডল সাতটি স্তর নিয়ে গঠিত।

আমরা এই সূত্রে স্তরগুলোর- সংখ্যা যদি হিসেব করে দেখি তবে দেখব যে, আয়াতে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে ঠিক তেমন করেই বায়ুমন্ডল সাতটি স্তর নিয়ে গঠিত :

১. ট্রপোস্ফিয়ার

২. স্ট্রাটোস্ফিয়ার

৩. ওযোনোস্ফিয়ার

৪. মেসোস্ফিয়ার

৫. থার্মোস্ফিয়ার

৬. আয়নোস্ফিয়ার

৭. এক্সোস্ফিয়ার

এ বিষয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অলৌকিক ব্যাপার এ উক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে :

অতঃপর তিনি আকাশ মণ্ডলকে দুদিনে সাত আসমানে পরিণত করলেন এবং প্রত্যেক আসমানে তার জন্য আদেশ প্রেরণ করলেন। ...........। (কোরআন, ৪১ : ২২)

অন্য কথায় বলা যায় যে আয়াতটিতে আল্লাহ তাআলা এটাই উল্লেখ করেছেন যে, তিনি প্রতিটি আসমানের জন্য তাদের করণীয় কাজ বন্টন করে দিয়েছেন। সত্যিই পূর্বের আয়াতগুলোতে আমরা দেখতে পেয়েছি যে, ভূ-পৃষ্ঠে বসবাসকারী অন্যান্য প্রাণীসহ মানবজাতির উপকারার্থে প্রতিটি স্তরই অতি প্রয়োজনীয় কাজ করে যাচ্ছে। বৃষ্টি উৎপন্ন করা থেকে শুরু করে ক্ষতিকর রশ্মিসমূহকে বাধা দান, বেতার তরঙ্গ প্রতিফলিত করা, উল্কা পিন্ডসমূহের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাধা দেয়া বা নিরোধ করা পর্যন্ত বিশেষ বিশেষ কাজগুলো ভিন্ন ভিন্ন স্তর ভিন্ন ভিন্নভাবে সম্পন্ন করে থাকে।

উদাহরণস্বরূপ, বৈজ্ঞানিক সূত্রে এগুলোর একটি কাজের কথা নিম্নে উল্লেখ করা হয়েছে : ভূ-পৃষ্ঠের বায়ুমন্ডলের রয়েছে সাতটি স্তর। সর্বনিম্ন স্তরটি-হলো ট্রপোস্ফিয়ার। বৃষ্টি, বরফ আর বাতাস কেবল এ স্তরটিতেই ঘটে থাকে।

এটি একটি বড় ধরণের অলৌকিক ব্যাপার যে, এই যে বিষয়গুলো বিংশ শতাব্দীর টেকনোলজী ব্যতীত উদঘাটন করা সম্ভব হওয়ার কথা ছিল না, সেগুলোই কোরআনে ১৪০০ বছর পূর্বে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল।

 

পর্বতমালার কাজ

পর্বতমালার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক কার্যাবলীর প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পবিত্র কোরআনের নিম্নের আয়াত :

আর আমি জমিনের উপর সুদৃঢ় পর্বতমালা সৃষ্টি করেছি যাতে তাদের নিয়ে জমিন ঝুঁকে না পড়ে; এবং আমি সেখানে প্রশস্ত প্রশস্ত রাস্তা সৃষ্টি করেছি যেন তারা গন্তব্যস্থলে পৌছতে পারে। (কোরআন, ২১ : ৩১)

ভূ-পৃষ্ঠের কম্পন প্রতিরোধে পর্বতমালার যে ভূমিকা রয়েছে সেটি আমরা আয়াতটিতে খেয়াল করেছি। কোরআন যে সময়ে নাযিল হয়, তখন কেউ এ ব্যাপারটি সম্পর্কে অবগত ছিল না। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক ভূ-বিজ্ঞানের প্রাপ্ত তথ্যসমূহের মাধ্যমে কেবলি সেদিন এ বিষয়টি প্রকাশ পেল।

এ সমস্ত তথ্যানুসারে, যে ভারী ভারী বড় প্লেটগুলো পৃথিবীর উপরের শক্ত স্তর সৃষ্টি করে, সেগুলোর নড়াচড়া আর সংঘর্ষের ফলেই উৎপত্তি ঘটে পর্বতমালাসমূহের। দুটি প্লেট যখন পরস্পর ধাক্কা খায় তখন শক্তিশালী প্লেটটি অন্য প্লেটের নীচে গড়িয়ে চলে যায়, তখন উপরের প্লেটটি বেঁকে গিয়ে পর্বত ও উঁচু উচুঁ জায়গার জন্ম দেয়। নিম্নের স্তরটি ভূমির নীচে অগ্রসর হয়ে ভেতরের দিকে এক গভীর প্রসারণের জন্ম দেয়। এর মানে পর্বতের রয়েছে দুটো অংশ, উপরে সবার জন্য দর্শনযোগ্য একটি অংশ যেমন থাকে, তেমনি নীচের দিকে গভীরে এর সমপরিমাণ বিস্তৃতি রয়েছে।

বিজ্ঞানের বইগুলোতে পাহাড়ের গঠন বর্ণিত হয়েছে নিম্নরূপে :

মহাদেশগুলোর যে অঞ্চলসমূহ পুরু, যেথায় সারি সারি পর্বতমালা রয়েছে, সেথায় ভূ-পৃষ্ঠের শক্ত স্তর বা ক্রাস্ট ম্যান্টলের ভেতরে গভীরে ঢুকে যায়।

একটি আয়াতে পর্বতমালার এই ভূমিকাকে “পেরেকের” ভূমিকার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে :

আমি কি জমিনকে করিনি বিছানা সদৃশ ? এবং পাহাড়সমূহকে পেরেকস্বরূপ ? (কোরআন,৭৮ : ৬৭)

অন্য কথায় পর্বতমালাগুলো ভূ-পৃষ্ঠের উপরে ও নীচে গভীরে বর্ধিত হয়ে প্লেটগুলোকে তাদেরই সন্ধি বা মিলনস্থরেল স্থিরভাবে ধরে রাখে। এভাবে তারা পৃথিবীর উপরের স্তর বা ক্রাস্টকে দৃঢ়ভাবে এঁটে রাখে আর ম্যাগমা স্তরের উপরে কিংবা প্লেটগুলোর মাঝে ক্রাস্ট এর ভেসে যাওয়াকে প্রতিরোধ করে। সংক্ষেপে আমরা পর্বতমালাকে লৌহের পেরেকের সঙ্গে তুলনা করতে পারি যেগুলো কিনা কাঠের বিভিন্ন টুকরাকে একত্রে আটকে রাখে। পর্বতমালার এরূপ সেটে বা এটে ধরার কাজটি বিজ্ঞান সাহিত্যে Isostasy শব্দ দ্বারা বর্ণিত রয়েছে। Isostasy বলতে যা বুঝায় তা নিম্নরূপ :

Isostasy: মাধ্যাকষর্ন জনিত চাপের ফলে ভূ-পৃষ্ঠের নীচে সহজে বক্র হয় এমন পাথর জাতীয় জিনিষ দ্বারা পৃথিবীর ক্রাস্ট বা উপরিস্তরের-সাধারণ ভারসাম্য বজায় থাকে।

পর্বতমালার এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বহু শতাব্দী পূর্বে কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছিল যা কিনা আজ আধুনিক ভূবিজ্ঞানে ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা দ্বারা উন্মোচিত হয়েছে-এটি আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিতে সর্বোচ্চ বিজ্ঞতারই উদাহরণ।

আর আমি জমিনের উপর সুদৃশ পর্বতমালা সৃষ্টি করেছি যাতে তাদেরকে নিয়ে জমিন ঝুঁকে না পড়ে; এবং আমি সেখানে প্রশস্ত প্রশস্ত রাস্তা সৃষ্টি করেছি যেন তারা গন্তব্যস্তলে পৌছতে পারে।(কোরআন, ২১ : ৩১)

 

পর্বতমালার গতিশীলতা

পর্বতগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় যেন এরা স্থির, অবিচল। প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটি তা নয়। আসলে প্রতিনিয়তই পর্বতমালা রয়েছে সচল, গতিশীল। এই ব্যাপারটি কোরআনের একটি আয়াতে উল্লেখিত আছে :

আর তুমি পর্বতসমূহকে দেখে অটল-অচল মনে কর, অথচ এগুলো সেদিন মেঘরাশির ন্যায় চলমান হবে। এ হল আল্লাহর সৃষ্টি নৈপুণ্য, যিনি সবকিছুকে করেছেন সুষম-সুসংহত। তোমরা যা কিছু করছ, তিনি তা সম্যক অবগত আছেন। (কোরআন, ২৭ : ৮৮)

পৃথিবীর উপরিস্তর (Crust), যার উপরে পর্বতসমূহ অবস্থিত, সে স্তরের-( Crust) নড়াচড়াই পর্বতমালার গতিশীলতার কারণ । নীচে অধিকতর পুরু আরেকটি স্তর রয়েছে যাকে বলা হয় ম্যান্টল; ম্যান্টলের উপরে ভাসমান রয়েছে এই উপরিস্তরটি( Crust)। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ, যখন জার্মান বিজ্ঞানী Alfred Wegner ইতিহাসে সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন যে প্রথম যখন পৃথিবীর সৃষ্টি হয়, মহাদেশগুলো একত্রে সংযুক্ত অবস্থায় ছিল। কিন্তু এরপর এরা ভেসে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যায়। আর এভাবেই নড়াচড়ার কারণে একটি আরেকটি থেকে দূরে সরে যায়।

Wegner এর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর ১৯৮০ এর দশকে ভূ-তত্ত্ববিদগণ Wegner এর এই প্রস্তাবটি সঠিক ছিল বলে বুঝতে পারেন। ১৯১৫ সালে Wegner একটি আর্টিকলে নির্দেশ করেন যে, প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বছর আগে ভূ-পৃষ্ঠের স্থলভাগসমূহ একসঙ্গে সংযুক্ত অবস্থায় ছিল। আর এই বৃহৎ স্থল ভাগটি পৃথিবীর দক্ষিণ মেরুতে ছিল Pangaea নামে।

প্রায় ১৮০ মিলিয়ন বছর পূর্বে Pangaea দুটি ভাগে ভাগ হয়ে বিভিন্ন দিকে ভেসে চলে যায়। এদের মাঝে Gondwana নামে বৃহৎ একটি মহাদেশ ছিল, যাতে বিদ্যমান ছিল আফ্রিকা, অষ্ট্রেলিয়া, এন্টার্টিকা-আর ইন্ডিয়া। দ্বিতীয় অংশটি ছিল Laurasia নামে, যেথায় অবস্থিত ছিল ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা আর ইন্ডিয়া বাদে এশিয়া। এই পৃথকীকরনের পর ১৫০ মিলিয়ন বছর ধরে Gondwana আর Laurasia ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে আলাদা হয়ে যায়।

Pangaea বিভক্তির পর আবির্ভূত এই মহাদেশগুলো ভূ-পৃষ্ঠের উপরে অবিরাম সরে যাচ্ছে, প্রতি বছরে কয়েক সেন্টিমিটার করে। ইতিমধ্যে পৃথিবীর স্থল ভাগ আর সমুদ্রের অনুপাতও বদলে গিয়েছে।

বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে চালানো গবেষণায় উদঘাটিত ভূ-পৃষ্ঠের কঠিন আবরণ ক্রাস্ট এর নড়া চড়া বিজ্ঞানীগণ নিম্নরূপে ব্যাখ্যা করেন :

Crust আর Mantle এর সর্বোপরিস্থিত স্তরটি-প্রায় ১০০ কিলোমিটার পুরুত্ব নিয়ে বিভিন্ন খন্ডে বিভক্ত হয় যাদের Plate বলা হয়ে থাকে। ছয়টি বড় বড় আর কয়েকটি ছোট খাট প্লেট বিদ্যমান রয়েছে এখানে। Plate Tectonices নামক থিওরী অনুসারে এই প্লেটগুলো তাদের সঙ্গে মহাদেশ আর সমুদ্রের তলভাগ নিয়ে ভূ-পৃষ্ঠে নড়ে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। পরিমাপ করে দেখা গেছে যে, মহাদেশগুলোর এই গতি বছরে প্রায় ১৫ সেন্টিমিটার। প্লেটগুলো যেহেতু অবিরত চলমান রয়েছে সেহেতু পৃথিবীর ভূগোলে ধীর গতির পরিবর্তন হবে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ প্রতি বছর আটলান্টিক মহাসাগর একটু একটু করে প্রশস্ত থেকে প্রশস্ততর হ‪চ্ছে।

এখানে এটি উল্লেখ করার মতো গুরুতপূর্ণ একটি পয়েন্ট : আয়াতটিতে আল্লাহ তাআলা পর্বতমালার নড়াচড়াকে চলমান বা প্রবাহিত হওয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আজ আধুনিক বিজ্ঞানীগণও এই গতির জন্য “মহাদেশের প্রবাহ” (continental drift) শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

প্রশ্নাতীতভাবেই এটি কোরআনের একটি অলৌকিকত্ব। বিংশ শতাব্দীতে সম্প্রতি সেদিন যা বিজ্ঞান দ্বারা আবিষ্কৃত হয়েছে তাই কোরআনে অনেক আগেই ঘোষিত হয়েছিল।

 

সাগরসমূহ কখনো মিশে যায়না

কেবলি সেদিন সমুদ্রের একটি বৈশিষ্ট্য উদঘাটিত হয়েছে-যা কিনা পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের সঙ্গে সম্পর্কিত, নিম্নে সেই আয়াতটি হলো :

“তিনিই মুক্তভাবে প্রবাহিত করেন দুই দরিয়া, যারা পরস্পর মিলিত হয়ে থাকে, কিন্তু উভয়ের মাঝখানে রয়েছে একটি পর্দা, যা তারা অতিক্রম করতে পারে না। (কোরআন, ৫৫ : ১৯-২০)

সমুদ্রগুলো পাশাপাশি বয়ে যায়, কাছাকছি আসে কিন্তু কখনোই মিশে যায়না-সাগরগুলোর এই বৈশিষ্ট্যটি সাম্প্রতিক কালে মহাসমুদ্রবিদগণ কর্তৃক উদঘাটিত হয়েছে। Surface Tension বা বহিপৃষ্ঠের টান নামক এক প্রাকৃতিক শক্তির কারণেই প্রতিবেশী সমুদ্রের পানি কখনই একত্রে মিশ্রিত হয় না। বহিপৃষ্ঠের টান নামক এই বলটির সূত্রপাত ঘটে সাগরের পানির ঘনত্বের তারতম্যের কারণে যা কিনা এক সমুদ্রের পানিকে অপর সমুদ্রের সঙ্গে মিশ্রিত হতে দেয় না। বরং দুটি সমুদ্রের পানির মাঝে একটি পাতলা আবরণ হিসেবে বিদ্যমান থাকে।

যে যুগের মানুষ পদার্থবিদ্যা, পৃষ্ঠটান কিংবা মহাসমুদ্রবিদ্যা-এগুলো সম্পর্কে কোন জ্ঞান বা ধারণাই রাখতো না, ঠিক সে সময়েই এই বিষয়টি কোরআনে প্রকাশিত হয় এটি একটি বিরাট আশ্চর্যের ব্যাপার।

 

সমুদ্রের গভীর অন্ধকার আর আভ্যন্তরীণ তরঙ্গমালা

সমুদ্রের গভীর অন্ধকার আর আভ্যন্তরীণ তরঙ্গমালা অথবা তাদের কার্যাবলী অত্যন্ত গভীর সমুদ্রের তলদেশের অন্ধকারের ন্যায়, যাকে আচ্ছন্ন করে তরঙ্গের পর তরঙ্গ, যার উপরে রয়েছে কালোমেঘ; অন্ধকারের উপর অন্ধকার। এমনকি যখন কেউ তার হাত বের করবে, তখন সে আদৌ তা দেখতে পাবে না। আর যাকে আল্লাহ হেদায়েতের নূর দান করেন না তার জন্য কোথাও কোন নূর নেই। (কোরআন, ২৪ : ৪০)

Oceans নামক বইটিতে গভীর সমুদ্রের সাধারণ পরিবেশের কথা বর্ণিত হয়েছে : গভীর সমুদ্র ও মহাসমুদ্রসমূহের গভীরে ২০০ মিটার ও তারও নীচে এক আঁধার পরিবেশ বিরাজ করে। এ পরিমাণ গভীরতায় প্রায় কোন আলো নেই। আর প্রায় ১০০০ মিটার গভীরতায় একদমই কোন আলো থাকে না।

অধুনা সমুদ্রের সাধারণ গঠনপ্রণালী, এর মাঝে বিদ্যমান জীবসমূহের বৈশিষ্ট্যাবলী, এর ঘনত্ব, এর ধারণকৃত পানির পরিমাণ, এর পৃষ্ঠতল আর গভীরতা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে তৈরী ডুবো জাহাজ ও বিশেষ যন্ত্রাদির মাধ্যমে বিজ্ঞানীগণ এই তথ্যসমূহ পেতে পারেন।

কোন ধরনের বিশেষ যন্ত্রাদির সাহায্য ছাড়া মানুষ সাগরের ৪০ মিটার গভীরে বা আরো নীচে ডুব দিতে বা যেতে পারে না। যেমন, ২০০মিটার গভীরে সমুদ্রের গভীর অন্ধকার অংশে কোন প্রকার সহায়তা ছাড়া বেঁচে থাকতে পারবে না মানুষ । এ সমস্ত কারণেই বিজ্ঞানীগণ সম্প্রতি সমুদ্র সম্পর্কে সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম তথ্যাদি উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন। অথচ ১৪০০ বছর আগেই সূরা নূরে “সমুদ্রের আঁধার” শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল। এটা অবশ্যই কোরআনের অলৌকিকত্ব প্রমাণের পক্ষে একটি যুক্তি কেননা এ তথ্যটি কোরআনে এমন সময় প্রদান করা হয়েছে, যখন মানুষ মহাসমুদ্রের গভীরে গিয়ে তথ্যাদি খুঁজে আনার মত কোন যন্ত্রাদির অস্তিত্বই ছিল না।

অধিকন্তু, “তরঙ্গের পর তরঙ্গ, যার উপরে রয়েছে কালোমেঘ; অন্ধকারের উপর অন্ধকার”-সূরা নূরের এ আয়াতটিও কোরআনে বর্ণিত আরেকটি অলৌকিক বিষয় হিসেবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে।

সাম্প্রতিক কালে বিজ্ঞানীগণ উদঘাটন করেছেন যে, সেখানে রয়েছে আভ্যন্তরীন তরঙ্গমালা যারা “পানির ভিন্ন ভিন্ন ঘনত্বের স্তরের মাঝে সৃষ্টি হয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্তরের ভিন্ন ভিন্ন রূপে অবস্থান করে”। আভ্যন্তরীন তরঙ্গমালা বা ঢেউসমূহ সাগর ও মহাসাগর সমূহের গভীর পানির স্তরগুলো ঢেকে থাকে, কেননা উপরকার পানির চেয়ে ভেতরের পানির রয়েছে বেশী মাত্রার ঘনত্ব।

আভ্যন্তরীন তরঙ্গমালা উপরি পৃষ্ঠের তরঙ্গমালার ন্যায় কাজ করে থাকে। উপরিপৃষ্ঠের তরঙ্গমালার মতো আভ্যন্তরীন তরঙ্গমালাও ভাঙ্গতে পারে। কোন মানব চক্ষু দিয়ে নয় বরং কোন একটি নির্দিষ্ট অবস্থানের তাপমাত্রা বা লবণের ঘনত্বের পরিবর্তনের পরীক্ষা-পর্যবেক্ষন করেই তবে আভ্যন্তরীন তরঙ্গমালাকে সণাক্ত করা হয়ে থাকে।

উপরের ব্যাখ্যাগুলোর সঙ্গে কোরআনের উক্তিসমূহ সুসামঞ্জস্যপূর্ণ। কোন প্রকার গবেষণা ব্যতীত একজন কেবল সমুদ্রপৃষ্ঠের ঢেউগুলোকেই চর্মচক্ষে অবলোকন করতে পারে। সমুদ্রের আভ্যন্তরীন তরঙ্গ সম্পর্কে অবহিত হওয়া একজনের পক্ষে অসাধ্য ব্যাপার। তারপরেও সূরা নূরে আল্লাহ তাআলা সমুদ্রের বিভিন্ন ঘনত্বে আরেক ধরণের তরঙ্গের প্রতি আমাদের মনোযোগ আকষর্ণ করেছেন। নিশ্চিতভাবেই অতি সাম্প্রতিককালে বিজ্ঞানীগন যা উদঘাটন করতে পেরেছেন, তা আরো একবার প্রমাণ করে যে, কোরআনের প্রতিটি কথাই আল্লাহ সোবহানাল্লাহু তাআলার কথা।