সূরা রা’দ; (৪র্থ পর্ব)

সূরা রা’দ; আয়াত ১১-১৩

সূরা রা’দের ১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-

لَهُ مُعَقِّبَاتٌ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ يَحْفَظُونَهُ مِنْ أَمْرِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ وَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ بِقَوْمٍ سُوءًا فَلَا مَرَدَّ لَهُ وَمَا لَهُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَالٍ

"মানুষের জন্য তার সম্মুখে ও পশ্চাতে একের পর এক প্রহরী থাকে, তারা আল্লাহর আদেশে তার রক্ষণাবেক্ষণ করে। আল্লাহ অবশ্যই কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে। কোন সম্প্রদায় সম্পর্কে আল্লাহ যদি অশুভ কিছু ইচ্ছা করেন তবে তা রদ করার কেউ নেই। এবং তিনি ব্যতীত তাদের কোন অভিভাবক নেই।" (১৩:১১)

এর আগে বলা হয়েছে, সৃষ্টি জগতের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য যা কিছু আছে সব কিছুই আল্লাহ জানেন। কোন কিছুই তাঁর অজানা নয়। এই আয়াতে বলা হচ্ছে ,আল্লাহ তা'লা প্রত্যেক মানুষের জন্য একজন ফেরেশতা নিয়োজিত করেছেন,এই ফেরেশতা মানুষকে নানা বিপদাপদ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করে। বিশ্ব প্রকৃতি আল্লাহরই সৃষ্টি এবং আল্লাহরই বেধে দেয়া নিয়মে প্রকৃতির সব কিছু পরিচালিত হচ্ছে। কাজেই প্রকৃতিতে যে সব ঘটনা বা দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়, তা আল্লাহর ইচ্ছায়ই হয়ে থাকে। ফলে প্রকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে ফেরেশতারাই মানুষকে রক্ষা করে।

এ আয়াতে আরেকটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, বলা হয়েছে প্রকৃতিতে কোন কিছু সংঘটিত করার শক্তি বা সামর্থ মানুষের নেই, কিন্তু মানুষকে তার ভাগ্য গড়ার সামর্থ দেয়া হয়েছে। সেটি ব্যক্তিগত হোক কিংবা সামাজিক হোক, মানুষ তার ভবিষ্যত বিনির্মাণের ক্ষেত্রে সামর্থবান। এটা প্রত্যাশা করা উচিত নয় যে, মানুষের ভাগ্য গড়ে দেয়ার জন্য আল্লাহপাক ফেরেশতা নিয়োগ করবেন। মানুষ যদি তার ব্যক্তিগত বা সামাজিক জীবনে সফলতা আনতে চায় তাহলে এজন্য তাকেই উদ্যোগী হতে হবে, নৈরাজ্য পরিহার করে সঠিক পথে চলার উদ্যোগ নিতে হবে এবং জুলুম-অত্যাচারের মূলোৎপাটন করে ন্যায়পরায়নতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অলৌকিকভাবে আদর্শ সমাজ বা আদর্শ রাষ্ট্র গড়ে উঠে না,এজন্য মানুষকেই সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হতে হবে।

এ ক্ষেত্রে ঐশী নিয়মের কথাও এই আয়াতে ব্যক্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোন জাতি যতক্ষণ না নিজেরা নিজেদের উন্নতির জন্য সচেষ্ট হয় ততক্ষণ আল্লাহও তাদের উন্নতি নিশ্চিত করেন না। আবার এটাও বলা হয়েছে,যারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য সচেষ্ট হয় না তারা সমুহ বিপদে নিমজ্জিত হয় এবং ঐশী শাস্তিও তাদেরকে গ্রাস করে। যদি কেউ বা কোন জাতি এ অবস্থায় উপনিত হয় তাহলে কারো সাহায্যই তাদের কাজে আসে না।

জনগণের প্রচেষ্টায়ই প্রত্যেক জাতি বা রাষ্ট্রের উন্নতি সাধিত হয়। জনগণ যখন আল্লাহর উপর নির্ভর করে নিজেদের ভাগ্য গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করে তখন মহান আল্লাহ তাদেরকে সেই সামর্থ দিয়ে সাহায্য করেন।

এই সূরার ১২ ও ১৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

هُوَ الَّذِي يُرِيكُمُ الْبَرْقَ خَوْفًا وَطَمَعًا وَيُنْشِئُ السَّحَابَ الثِّقَالَ (12) وَيُسَبِّحُ الرَّعْدُ بِحَمْدِهِ وَالْمَلَائِكَةُ مِنْ خِيفَتِهِ وَيُرْسِلُ الصَّوَاعِقَ فَيُصِيبُ بِهَا مَنْ يَشَاءُ وَهُمْ يُجَادِلُونَ فِي اللَّهِ وَهُوَ شَدِيدُ الْمِحَالِ

"তিনিই তোমাদেরকে বিজলী দেখান-যা ভয় ও ভরসা সঞ্চার করে এবং তিনি সৃষ্টি করেন ঘন মেঘমালা।” (১৩:১২)

“বজ্র নির্ঘোষ ও ফেরেশতারা সভয়ে তাঁর সপ্রশংস মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করে এবং তিনি বজ্রপাত করেন এবং যাকে ইচ্ছা তা দিয়ে আঘাত করেন, তারপরও তারা আল্লাহ সম্বন্ধে বিতণ্ডা করে। যদিও তিনি মহাশক্তিশালী।" (১৩:১৩)

বজ্রপাত এবং আকাশে মেঘের গর্জন মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করলেও প্রকৃতপক্ষে তা আল্লাহর নেয়ামত বা অনুগ্রহের বার্তাই বহন করে। কারণ এর মাধ্যমেই বৃষ্টিপাতের সূচনা হয়। আর এই বৃষ্টির পানিই বৃক্ষ-তরুলতা এবং মানুষ ও জীবজন্তু বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান উপকরণ।

বজ্র নিনাদ বা মেঘের গর্জন প্রকৃতিরই নিয়ম। মহান আল্লাহই প্রকৃতির জন্য এই নিয়ম নির্ধারণ করেছেন। পবিত্র কুরআনের দৃষ্টিতে বজ্র নিনাদের মাধ্যমে প্রকৃতি মহান আল্লাহর একচ্ছত্র আধিপত্য,তাঁর পরিপূর্ণতা এবং মহিমা বর্ণনা করে থাকে। এছাড়া, মেঘমালা সৃষ্টি এবং বৃষ্টিপাত ঘটানোর দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতারা মেঘের গর্জনের ফলে সৃষ্ট আতঙ্কে আরো বেশি আল্লাহর মহিমা কীর্তন করে।

এ সবই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় সংঘটিত হয়,তাঁর ইচ্ছা ব্যতীত বজ্রপাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। প্রকৃতির এসব নিদর্শন প্রত্যক্ষ করার পরও অবিশ্বাসী কাফেররা কিভাবে সৃষ্টকর্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করে এবং এ নিয়ে অযথা বিতর্কে লিপ্ত হয়!

প্রকৃতির নিয়মেই আকাশে বিদ্যুত চমকায় এবং মেঘের গর্জন শোনা যায়,তবে অনেক ক্ষেত্রে ঐশী শাস্তি হিসেবে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। পবিত্র কুরআনে সামুদ গোত্র প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, তাদেরকে বজ্রপাতের মাধ্যমে শাস্তি দেয়া হয়েছে। হাদীস শরীফে এসেছে- যখনি আকাশে বিদ্যুত চমকাতো এবং মেঘের গর্জন শুরু হতো তখনি নবী করিম (সা.) দোয়া এবং এবাদতে মশগুল হতেন।

যাই হোক, প্রকৃতিও যে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রশংসা করে, পবিত্র কুরআনে তা বিভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে অধিকাংশ মানুষই তা উপলব্ধি করতে পারে না।

এই আয়াত থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, এই বিশ্ব প্রকৃতিই স্রষ্টার অস্তিত্বের বড় প্রমাণ। কাজেই যে যত বেশি প্রকৃতিকে জানবে তার ঈমান বা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ততই মজবুত হবে।