সূরা রা’দ; (৫ম পর্ব)

সূরা রা’দ; আয়াত ১৪-১৬

সূরা রা'দের ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

لَهُ دَعْوَةُ الْحَقِّ وَالَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ لَا يَسْتَجِيبُونَ لَهُمْ بِشَيْءٍ إِلَّا كَبَاسِطِ كَفَّيْهِ إِلَى الْمَاءِ لِيَبْلُغَ فَاهُ وَمَا هُوَ بِبَالِغِهِ وَمَا دُعَاءُ الْكَافِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَالٍ

“তাকে ডাকাই বাস্তব এবং তাকে ছাড়া তারা যাদেরকে ডাকে, তারা তাদের কোন কাজে আসে না। তাদের দৃষ্টান্ত সেই ব্যক্তির মত যে তার মুখে পানি পৌঁছাবে এ আশায় তার হস্তদ্বয় এমন পানির দিকে প্রসারিত করে যা তার মুখে পৌছাবার নয়। সত্য প্রত্যাখ্যানকারী কাফেরদের আহ্বান নিষ্ফল।" (১৩:১৪)

বিশ্ব জগতে মহান আল্লাহর পরাক্রম এবং স্রষ্টার প্রতি সকল সৃষ্টির নিরলস আনুগত্যের বর্ণনা দেয়ার পর এই আয়াতে সত্য প্রত্যাখ্যানকারী কাফেরদের বিভ্রান্তি সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, তারা বিপদাপদ এবং প্রয়োজনের সময় এমনসব জড় বস্তুর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে যারা তাদের চেয়েও অক্ষম। যাদের কোন শক্তি বা সামর্থই নেই। তাদের অবস্থা সেই ব্যক্তির মত যে পানির কাছে পানি প্রার্থনা করে এবং পরিণতিতে পানি না পেয়ে তৃষ্ণার্ত থেকে কষ্ট পায়।

আসলে প্রত্যেক মানুষই স্বভাবগতভাবেই প্রকৃত স্রষ্টাকে অন্বেষণ করে তবে এ ক্ষেত্রে অনেকেই বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতির কারণে প্রকৃত স্রষ্টার পরিবর্তে কল্পিত স্রষ্টার নিগড়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। পানি মনে করে মরীচিকার পেছনে ছোটা যেমন তাদের অবস্থাও ঠিক তেমনই।

এই আয়াতে বুঝানো হয়েছে, প্রকৃত স্রষ্টা মহান আল্লাহর কাছে যদি কোন মানুষ সাহায্য কামনা করে, তার কোন প্রয়োজনের আর্জি নিয়ে আল্লাহর দরবারে নিবেদন করে তাহলে আল্লাহ তা'লা তার বান্দার আবেদন মঞ্জুর করেন, কিন্তু কেউ যদি বিভ্রান্ত হয়ে কল্পিত খোদার কাছে তার প্রয়োজনের কথা ব্যক্ত করে তাহলে এক্ষেত্রে কোন সুফল না পাওয়াটাই স্বাভাবিক।

এই সূরার ১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

وَلِلَّهِ يَسْجُدُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَظِلَالُهُمْ بِالْغُدُوِّ وَالْآَصَالِ

"ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আল্লাহর প্রতি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব কিছুই এবং তাদের ছায়াগুলোও সকাল সন্ধায় সিজদায় অবনত থাকে।" (১৩:১৫)

পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর উদ্দেশে মাথানত করে। সূরা নাহলের ৪৯ আয়াতেও বলা হয়েছে, “যা কিছু আকাশমণ্ডলীতে আছে আল্লাহকেই সিজদা করে। পৃথিবীতে যত জীবজন্তু আছে এবং সকল ফেরেশতাগণও। তারা অহঙ্কার করে না।"

তবে এই আয়াতে চমৎকার একটি উপমা ব্যবহার করা হয়েছে, বলা হয়েছে, সকল বস্তুর ছায়াও আল্লাহর সামনে সিজদায় অবনত হয়। আয়াতের উদ্দেশ্য হয়ত এটা যে, কাফেররা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করলেও প্রকৃতপক্ষে সমস্ত সৃষ্ট বস্তুই আল্লাহর অনুগত। সৃষ্টিজগতে বিদ্যমান সকল বস্তুই আল্লাহর বন্দেগীতে নিয়োজিত। মানুষ, জীবজন্তু এমনকি ফেরেশতারাও আল্লাহকে সিজদা করে, তার গুণগান করে।

সূরার ১৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,

قُلْ مَنْ رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ قُلِ اللَّهُ قُلْ أَفَاتَّخَذْتُمْ مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ لَا يَمْلِكُونَ لِأَنْفُسِهِمْ نَفْعًا وَلَا ضَرًّا قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الْأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَمْ هَلْ تَسْتَوِي الظُّلُمَاتُ وَالنُّورُ أَمْ جَعَلُوا لِلَّهِ شُرَكَاءَ خَلَقُوا كَخَلْقِهِ فَتَشَابَهَ الْخَلْقُ عَلَيْهِمْ قُلِ اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ

“(হে নবী! বলুন) কে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক? বলুন! তিনি আল্লাহ। বলুন! তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে অপরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করেছ যারা নিজেদের লাভ বা ক্ষতি সাধনে সক্ষম নয়? বলুন! অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান? অথবা অন্ধকার ও আলো কি এক? তবে কি তারা আল্লাহর এমন অংশী করেছে যারা আল্লাহর সৃষ্টির মত সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে, যে কারণে সৃষ্টি তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ঘটিয়েছে? বলুন,আল্লাহ সকল বস্তুর স্রষ্টা। তিনি এক ও পরাক্রমশালী।" (১৩:১৬)

পবিত্র কুরআনের অনেক জায়গায় অনেক বিষয় প্রশ্ন-উত্তর আকারে উপস্থাপিত হয়েছে। এটা কুরআনের একটি বৈশিষ্ট্য। যারা এক সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস স্থাপনের পর তার সাথে অন্য কিছুকে অংশী স্থাপন করতো তাদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, আল্লাহ যেমন এই বিশ্ব জগতের সব কিছু সৃষ্টি করেছেন তেমনি সব কিছুর নিয়ন্তা তিনিই। তার ইচ্ছায়ই সব পরিচালিত হয়। এমন নয় যে, তিনি জগতের কোন কোন বিষয় পরিচালনার দায়িত্ব কাঠ বা মাটির তৈরি মূর্তির উপর ন্যস্ত করেছেন। এখানে অংশীবাদীদেরকে ধিক্কার জানিয়ে বলা হয়েছে,তোমরা কেন এমন কারো উপাসনা করছো যারা আসলে তোমাদের চেয়ে অক্ষম এবং তারাও আল্লাহর বেঁধে দেয়া প্রকৃতির নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য!

এখানে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদেরকে অন্ধ ও চক্ষুষ্মান এবং আলো ও অন্ধকারের সাথে তুলনা করে বলা হয়েছে, যারা সত্যকে দেখার পরও গ্রহণ করতে পারে না অন্ধের সাথে তাদের পার্থক্য কোথায়?